গল্প# হীরের নাকফুল ও লাল বেনারসি
৩য় পর্ব
স্বর্ণা অবিশ্বাস্য চোখে আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল।
নিজেকেই চিনতে পারে না।
মুখে সাদা পাউডারের চড়া প্রলেপ,
ঠোঁটে কালচে বেগুনি রংয়ের লিপস্টিক, চোখে বেগুনি আইশ্যাডো, থ্যাবড়ানো কাজলে স্বর্ণাকে কিম্ভুতকিমাকার লাগছে।
সামনের চুল পাফ করে উঁচু করে করা খোঁপাটা ভয়ানক উঁচু হয়ে আছে।
হতভম্ব হয়ে ও আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“হায় খোদা! তোমার এই কী অবস্থা ভাবী?”
রেহনুমার ডাকে ও আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
রেহনুমার দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে ওঠে।
মুখ চুনের মত সাদা,চুলের খোঁপাটা পাহাড়ের মত উচুঁ হয়ে আছে।
“ তোমারও এই অবস্থা করেছে?”
রেহনুমা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
“ শুধু আমার না।সবার সাজের একই অবস্থা। শুধু মেঝো আপার সাজ কিছুটা ঠিক হয়েছে।সবচে খারাপ অবস্থা হয়েছে বড় আপার।দেখো,বড় আপার ডাগর ডাগর চোখ কোন ম্যাজিক দিয়ে এরা চাইনিজ মেয়েদের মত ছোট করে দিয়েছে।”
স্বর্ণা সবাইকে দেখে।
কেন যেন ওর হাসি পেয়ে যায়।
ও ফিক করে হেসে ফেলে।
বড় ননাস রেবেকা বিউটিশিয়ান পলিনের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে,
“ আপনি নাকি চোখ বন্ধ করেও বউ সাজাতে পারেন।এই তার নমুনা?
এখন আপনি বউয়ের সাজ ঠিক করে দিবেন।চুলও ঠিক করে দিবেন।”
পলিন মুখ শক্ত করে বলে,
“এখন সম্ভব না।এখন ঠিক করতে গেলে সব নষ্ট হবে।চুলের খোঁপা খুলে ঠিক করতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে।অলরেডি সাড়ে পাঁচটা বাজে।
বউয়ের শাড়ি পরানো এখনো বাকি।”
“এত কথা জানি না।আপনি যেভাবে পারেন আগে বউয়ের মেকআপ ঠিক করবেন।আমাদের মেকআপ ও ঠিক করে দিতে হবে।”
গলা আরও চড়িয়ে রেবেকা বলল।
স্বর্ণা হাসতে হাসতে বলল,
“ তাও ভালো বেগুনি লিপস্টিক দিয়েছে।লাল লিপস্টিক দেয়নি। তাহলে আমাকে ড্রাকুলার মত লাগত।মনে হত রক্ত খেয়ে বুঝি এলাম।”
স্বর্ণার কথায় পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ননদরা হিহি করে হাসতে লাগল।
বড় ননাস রেবেকাও হেসে ফেলল।গলার স্বর বদলে হাসতে হাসতে বলল,
“ এই মেয়ে দেখি সারাক্ষণ হাসে।”
প্রচন্ড অনীহা নিয়ে বিউটিশিয়ান পলিন আবার স্বর্ণার মেকআপ ঠিক করতে শুরু করে।
অন্য বিউটিশিয়ানরাও স্বর্ণার ননাস,ননদদের নষ্ট মেকআপ ঠিক করার কাজে লেগে পড়ে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মেঝো ননাস রেহানা আতঙ্কিত গলায় বলে ওঠে,
“ এই রে! সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে।মা কিন্ত বলে দিয়েছিল সাড়ে ছয়টার মধ্যে বাসায় ফিরে যেতে।”
“তুই তো এখন একথাই বলবি। তোর সাজ তো আমাদের মত ভয়ংকর হয়নি।”
বড় ননাস রেবেকা কৃত্রিম ধমকের সুরে বলে।
স্বর্ণা আবারও হাসে।
সাথে যোগ দেয় অন্য ননদরা।
ঘষামাজার পর স্বর্ণার মুখের উৎকট সাদা পাউডার কিছুটা কমে আসে।ঠোঁটের কালচে বেগুনি লিপস্টিক হালকা করে দেওয়া হয়।ঠিক করে দেওয়া হয় চোখের মেকআপ।
চুল ঠিক করা সম্ভব হয় না।তবে ওড়না দিয়ে খোঁপাটা ঢেকে দেওয়ার পর দেখতে খুব একটা খারাপ লাগে না।
বাসায় ফিরে যাওয়ার পর স্বর্ণার শাশুড়ি ওদের সবাইকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে বিরক্তির সুরে বললেন,
“ আমি বুঝলাম না এরা কি পার্লারে গেল, নাকি চুন গোলানো পানিতে ডুব দিয়ে এল? টাকা খরচ করে এমন জায়গায় যাওয়ার দরকারটা কী?”
মেয়েরা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের মেকআপ এবং চুল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
স্বর্ণার শাশুড়ি চীৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলেন।
“ সাতটা বেজে গেছে।এদের সাজই শেষ হয় না।এরা যাবে কখন? আ্যাই রেবেকা, রেহানা সবাইকে নিয়ে গাড়িতে ওঠ।নতুন বউয়ের গয়না পরা হয়েছে নাকি দ্যাখ।”
স্বর্ণা খাটে বসে গয়না পরছিল।ওর পাশেই ঢাকনা খোলা কয়েকটা গয়নার বাক্স থেকে ঝিকমিক করছে জমকালো গয়না।
শাহেদ ওয়াশ রুম থেকে বের হলে স্বর্ণার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়।
স্বর্ণা কানে ঝুমকা পরতে পরতে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল,
“ আজকে আমাকে কেমন লাগছে তুমি একবারও বলনি।আমি জানি আজকে আমাকে ভয়ংকর রকম পচা লাগছে।”
বলেই খিলখিল করে হাসতে থাকে।
শাহেদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“ তোমার মত ভয়ংকর সুন্দরীকে কী পচা লাগা সম্ভব? তুমি হাসলেই তো কেয়ামত হয়ে যায়।”
“ এহ্ গ্যাস দিচ্ছো।”
বলে স্বর্ণা আবারও হাসতে থাকে।
ওর দুই ননাস তখন ঘরে এসে ঢোকে।
মেঝো ননাস জিজ্ঞেস করে,
“ স্বর্ণা, তুমি রেডি?”
“ আমি রেডি আপা।রেহনুমা কই?”
“ ওর চুলের খোঁপা খুলে ফেলেছে।এখন নিজের চুল নিয়ে নিজেই যুদ্ধ করছে।ও পরে যাবে।”
“ আমি গিয়ে ওর চুলটা বেঁধে দিয়ে আসি।”
বড় ননাস বলে ওঠে,
“পাগল মেয়ে কী বলে? আমাদের এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।আব্বা,চাচারা অনেক আগেই চলে গেছে।আর একটুও দেরি করা যাবে না।”
স্বর্ণার শাশুড়ি তখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
স্বর্ণার কথা শুনে গম্ভীর মুখে বলেন,
“তোমার ননদের রং ঢংয়ের কোনো শেষ নাই।ও যেতে যেতে বৌভাতের সব আয়োজন শেষ হয়ে যাবে।সকালও হয়ে যেতে পারে।”
স্বর্ণা কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে স্বর্ণাদের বাড়ির লোকজন চলে আসে।
স্বর্ণার বাড়ির সবাই বিস্ফারিত চোখে ওর শাড়ি এবং সাজ দেখে ।
তবে ওর মুখে খুশীর ঝিলিক , চোখে আনন্দের দ্যুতি দেখে তাদের ভালো লাগে।
স্টেজে স্বর্ণার পাশে বসে ছোটো খালা নিচু গলায় বলে,
“ এই সেই বিখ্যাত শাড়ি!”
“ হুম, এই সেই বিখ্যাত শাড়ি।”
স্বর্ণাও নিচু গলায় উত্তর দেয়।
“ তোমার শ্বশুর বাড়ির অনেক মেয়েদের দেখলাম মাথার ওপর মাউন্ট এভারেস্ট পর্বত নিয়ে ঘুরছে।”
ছোট বোন শবনমের কথায় হাসতে হাসতে ওর চোখে পানি চলে আসে।
ও হাত দিয়ে ঘষে চোখের পানি মোছে।
সোহানা বলে,
“ হয়েছে আর হাসতে হবে না।বিয়ের দিন কেঁদে মেকআপ নষ্ট করেছিস।আজকে দেখা যাচ্ছে হেসে মেকআপ নষ্ট করবি।”
তখনই ওর ননদ রেহনুমা কাছে এসে দাঁড়ায়।ওর মাথার ওপরের পাহাড়ের মত খোঁপাটা আর নেই।
হালকা খোঁপায় ওকে দেখতে ভালো লাগছে।
স্বর্ণা ওর হাত ধরে বলে,
“ তোমাকে ফেলে আসতে খুব খারাপ লাগছিল।”
হাসি মুখে শ্বশুর বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মেঝো ননাস বলে ওঠে,
“ বাপের বাড়ি গিয়ে আবার আমাদের ভুলে যেওনা।”
রেহনুমা ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ মাত্র তিনদিনেই তোমার জন্য কেমন মায়া পড়ে গেছে।তোমাকে খুব মিস্ করব ভাবী।”
ঘর ভর্তি মেহমান, রান্না-বান্নার তুমুল ব্যস্ততার মাঝেও স্বর্ণার মা ফেরদৌসী আহমেদ চোখ সরু করে মেয়েকে জরিপ করেন।
মেয়ের চোখ-মুখ দিয়ে উপচে পড়া নিখাদ, নির্ভেজাল হাসিটা চোখ ভরে দেখেন।মন ভালো হয়ে যায়।
“ মা, আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই অনেক ভালো।আমি শুধু শুধুই এত ভয় পাচ্ছিলাম।”
রান্নাঘরে মা’র পাশে দাঁড়িয়ে স্বর্ণা বলে।
স্বর্ণার কথায় ফেরদৌসী আহমেদ প্রশান্তির হাসি হাসেন।
“ ভালো মনে করলে পৃথিবীর সবকিছুই ভালো রে মা।”
পায়েসের মিষ্টি পরখ করতে করতে জিজ্ঞেস করেন,
“ তোর শাশুড়ি কেমন ?”
“ ওনাকে ঠিক বুঝতে পারি না।একটু গম্ভীর,একটু মনে হয় রাগী ।”
বলে ও থামে।
তারপর ঠোঁট উল্টে বলে ,
“জানি না ওনার মন জয় করতে পারব কিনা।”
ফেরদৌসী আহমেদ কাচের ছোট বাটিতে পায়েস ঢেলে মেয়ের হাতে দেন।
ঠোঁটে রহস্যের হাসি খেলিয়ে বলেন,
“একটা জিনিষ আছে সেটা অকৃপণ ভাবে ঢাললে শুধু মানুষের মন কেন, পুরো পৃথিবী জয় করা যায়।সেটা একটু বেশী বেশী ঢেলেই দ্যাখ না।”
চোখ গোল গোল করে স্বর্ণা তাকায়।
সরল গলায় বলে,
“ সেটা কী মা?”
ফেরদৌসী আহমেদ রহস্যপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বলেন,
“ সেটা হচ্ছে ভালোবাসা।”
মা-মেয়ে দু’জনেই সশব্দে হেসে ওঠে।
স্বর্ণা এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে বলে,
“ ওকে ম্যাডাম, ঐ বস্তু বেশী করে ঢেলে দেখব।জানি না উলুবনে মুক্তা ছড়ানো হবে কিনা।”
(চলবে)