# হায়েনা
ধারাবাহিক গল্প ১
নাহিদ ফারজানা সোমা

“এটা আপনি করতে পারেন না। এতো বড় অন্যায় আপনি করতে পারেন না।”
“আমি করিনি,তোমার বাবা করেছেন।আমাকে দোষ দিওনা।”
“আব্বা কেন করলেন?”
“উনি কেন করলেন,আমি কি করে বলবো?”
“কলকাঠিতো আপনিই নাড়ছেন”।
” বেয়াদবের মতো কথা বলবে না। এতো সাহস কি করে হলো তোমার?”

অশ্রু বাবার কাছে গেল। কোন আক্কেলে যে তার নাম অশ্রু রাখা হয়েছিল! জীবনটা অদৃশ্য নয়নজলেই কেটে গেল।

“আব্বা, এমন কাজ কি করে করলেন আপনি?”
“ভুল কিছু তো করিনি।”
“ঠিক করেছেন?আপনি নিশ্চিত? ”
“কেন নয়? বাড়ি জোহরার নামে করে দিয়েছি,এটাইতো স্বাভাবিক। ”

অশ্রুর মুখে সহসা কথা যোগালো না।

“উনি কি আমাকে এক কণা অংশও দিবেন?দিবেন না।তিনি তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে দিবেন। আব্বা,আপনি আপনার সম্পত্তি হতে আমাকে বঞ্চিত করলেন?আপনার প্রথম সন্তানকে?আমার কথা,আমার মরা মায়ের কথা একবার আপনার মনে এলো না?”

“তোমাকেতো বাবা খিলগাঁ এ জমি কিনে দিয়েছি।তুমি ওখানেও নেবে,এখানেও নেবে,তা কি করে হয়?”

“আব্বা,খিলগাঁর নিচু জায়গায় তিন কাঠা জমি আর নিউ ইস্কাটনে ঝকঝকে চার তলা বাড়ি এক হলো?”

“তুমিতো সহায়-সম্পত্তি খুব ভাল চিনেছ দেখি।”

“আপনি আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন। সম্পত্তির উপর আমার এতোটুকু লোভ নেই। কিন্তু আমার প্রতি চরম অন্যায় করা হচ্ছে, আব্বা। আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন আর আপনাদের চারজন সন্তান থাকতো,পারতেন আব্বা এমন অসম বন্টন করতে?এখন আপনার স্ত্রী তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে তিনটা ফ্লোর দিয়ে দিবেন,আমাকে দিবেন না,এটাতো চোখ বন্ধ করে বলা যায়। খিলগাঁয়ে উনার পরামর্শে আগেভাগে আমাকে জমি লিখে দেওয়া একটা কৌশল, আমাকে এই বাড়ি থেকে বঞ্চিত করার। আপনার তিন সন্তানকে ইস্কাটনের বাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন আব্বা,নিজের মা মরা বড় ছেলেকে বাদ দিয়ে? ”

“তোমাকে আমি ভালো স্কুল -কলেজ-বুয়েটে পড়াইনি?”

“কেন পড়াবেন না আব্বা?এটা আমার অধিকার। আপনিতো অসচ্ছল নন আব্বা, আপনার বাকি ছেলেমেয়েদেরও তো সবচেয়ে ভাল জায়গায় পড়িয়েছেন, টিউশন দিয়েছেন। শুধু আমার জন্যই যে আপনার কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থব্যয় হয়েছে, তাতো নয়।”

সামাদ সাহেব যুক্তি খুঁজে পান না।জোহরা বেগমের নিরলস ও অবিরাম অনুরোধ, অনুযোগ, অভিমানের ফলাফল হল সম্পত্তি বন্টনের এই ব্যবস্থাপত্র। প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত একমাত্র সন্তানকে যে খুবই অন্যায় ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে এটা তিনি ভালোই জানেন। কিন্তু কিছু করার নেই। জোহরা তাঁকে বশ করে ফেলেছে_ রাগ দিয়ে,জেদ দিয়ে, সর্বোপরি শরীর দিয়ে। এই আকর্ষণ থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়।

জোহরা পাকা খেলোয়াড়। বিয়ের পরপর অশ্রুর জন্য সৎ মায়ের আদরের ঘনঘটা দেখে আত্মীয়-স্বজন, পড়শী,স্বয়ং সামাদ সাহেবও অভিভূত,সেই সাথে ছোট্ট অশ্রু ও। সামাদ সাহেব যখন রিটায়ার করলেন তখন থেকে জোহরা বেগমের নখ-দাঁত খুব সন্তর্পণে একটু একটু করে বের হতে লাগলো।এক সময় বাড়িটা নিজের নামে লিখিয়ে নিলেন।

” আমার সম্পত্তি নিয়ে মাথা ঘামিওনা।ইন্জিনিয়ার বানিয়েছি, এই যথেষ্ট। খাইয়েছি,পরিয়েছি,খিলগাঁতে তোমার নামে জমি কিনেছি।আর কি চাও?এবারে নিজের ব্যবস্থা নিজে কর। জোহরার সাথে তোমার বউএর বনিবনা হচ্ছে না। তোমার সংসারও বড় হচ্ছে। তুমি আলাদা বাসা নাও।”

অশ্রু তার বৌ আর ছেলে নিয়ে আলাদা হয়ে গেল।
রাতে জোহরাকে তার বোন ফোন করে বলল,”ঐ ছেলে যদি মামলা করে?”

বোনটি জোহরার একান্ত উপদেষ্টা। জোহরা বাঁকা হেসে বললেন,”ঐ অপদার্থ এসবের মধ্যে যাবে না। স্বামী আমার নামে বাড়ি লিখেছে,আমি আমার খুশিমতো যাকে খুশি, তাকে দিব।”

“একটাইতো তুই আর দুলাভাই থাকবি, একটা দুই মেয়ের নামে লিখে দিবি,দুইটা পাবে সুমন।তাইতো?”

” তিন ছেলেমেয়েকে সমান সমান দিব। আনীলার বরটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না। ওর জন্য মালীবাগে একটা জমি কিনেছি, তোকে বলা হয়নি। তোর দুলাভাইকে আপাতত কয়েকটা টিনশেডের বাড়ি তুলে দিতে বলেছি । ভাড়াটা আনীলার অ্যাকাউন্টে যাবে।আমি বেঁচে থাকতে আমার কোন ছেলেমেয়ের এতোটুকু কষ্ট হতে দিবো না।”

“আনীলাকে বাড়তি জমি কিনে দিলি,বাকি দুটো রাগ করবে না?”

“ওদেরকেও পরে সময়মতো কিনে দিবো।জমি কিনে ফেলে রাখাওতো জ্বালা। ”

“দুলাভাই কামিয়েছে কত রে,আপা!”

দুই বোন হা হা করে হাসতে থাকেন,একজন আত্মতৃপ্তির,অপরজন ঈর্ষার।

জোহরা বেগম রামপুরার দিকে পাঁচ কাঠা জমি বায়না দিয়ে রেখেছেন নিজের নামে, অশ্রুর মায়ের অনেক গয়না তাঁর কাছে রাখা ছিল ভবিষ্যতে অশ্রুর বৌকে দেওয়ার জন্য, সেগুলো বিক্রি করে। ভাগ্য, গয়নাগুলোর কথা যারা জানতো,তারা কেউ আজ বেঁচে নেই জোহরার বশংবদ স্বামী ছাড়া।

দিন চলে যায়।অশ্রুর বুকের ক্ষত কিছুতেই শুকায় না। বিমাতার সাথে শৈশবের অনেক মিষ্টি স্মৃতি আছে। তারপরে যত দিন গেছে,জোহরা বেগম ততোই আত্মপ্রকাশ করেছেন। জোহরার কোলে প্রথম এলো আনিলা।ছোট্ট বোনটাকে দারুণ ভালোবাসতো অশ্রু। আদর করতে গেলেই মা সরিয়ে দিতেন,”বাবু এখন ঘুমাবে,বাবু খাবে,বাবুকে জ্বালাতন কোরো না” ইত্যাদি। দাদী বেঁচে ছিলেন তখন।দাদীর সামনে মায়ের উল্টো সুর, “বাবুসোনা,বোন ঘুমাচ্ছে, আমার কোলে এসে বস,” আরও অনেক মিষ্টি কথা –

“বোন বড় হয়ে অশ্রুবাবুকে দাদাভাই বলে ডাকবে,”
“আমি মরে গেলে আমার অশ্রু বাবা তার ভাই -বোনদের
দেখে শুনে রাখবে”-রও কত কি! দাদী-ফুপুরা নিশ্চিন্ত। নিশ্চিন্ত না হলেও কিছু করার ছিল না, সামাদ সাহেব সংসারের কর্তা,তার উপরে বদরাগী।

অশ্রুর নানা-নানী বিয়েতে মেয়েকে অনেক গয়না দিয়েছিলেন। নানার বাড়ি ও দাদার বাড়ির মধ্যে দারুণ সম্পর্ক ছিল। কেমন করে যেন সেই সম্পর্ক ভাঙতে থাকলো।এই পরিণত বয়সে অশ্রু বুঝতে পারে,সম্পর্ক ভাঙার পেছনে সামাদ সাহেব আর জোহরা বেগমের কূটকৌশল ছিলো। অশ্রুর নানা মেয়ের মৃত্যুর ছয়মাসের মাথায় চলে গেলেন। নানী অশ্রুকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন, বাবা দেন নি। ধরা গলায় বলেছিলেন, ” সাঈদার স্মৃতি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চান,মা?আমি কি নিয়ে বাঁচবো? ” নানী অভিভূত হতেন। নানী মারা যাওয়ার পরে বাঁধন একদম আলগা হয়ে পড়লো। সামাদ সাহেব অশ্রুকে শুনিয়ে বলতেন,”ভাগ্নের ভার নিতে হবে,তাই সব সটকে পড়েছে। মানুষ পারেও বটে! আরে,আমি আমার ছেলেকে দিব পরের কাছে মানুষ করতে?আমি মরে গেছি? এমন কংস মামা-খালাদের দরকার নেই। ”
জোহরা বেগম তাল দিতেন,” উনাদের দেখেতো এমন মনে হয়নি! এতো ভালোমানুষ ওরা, আর আজ আমার অশ্রুকে নিয়ে এমন কথা বললেন?আমার অশ্রুকে যেন উনাদের ঘাড়ে না চাপাই?কেন,অশ্রুর বাপ-মা নেই? অমন মামাদের বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। কার মনে কি আছে,কে জানে?”

অশ্রুরও খুব রাগ হয়েছিল তিন মামা আর এক খালার উপরে। সে উনাদের কাছে জলজ্যান্ত উপদ্রব? মামা-খালারা নাকি ভীষণ ঝগড়া করেছে নিজেদের মধ্যে। কেউ অশ্রুকে রাখতে চায় না। মেজ মামা নাকি এটাও বলেছে,”বুবু মরার সময় ছেলেটাকে নিয়ে মরলেই পারতো।” এটা শুনে দাদী-ফুপুরাও খুব ক্ষেপে গেছে। কসম খেয়ে বলেছে, অশ্রুর মামা-খালাকে এই বাড়িতে কখনো ঢুকতে দেওয়া হবেনা,আর অশ্রুকে পাঠানোর তো প্রশ্ন ই ওঠেনা।সত্যি বলতে কি,এমন কথাই তো উঠে নি কখনো। বাপ থাকতে,দাদী থাকতে,এমন লক্ষীমন্ত সৎ মা থাকতে ছেলে যাবেই বা কেন মামার বাড়ি বাস করতে?

নানার পরিবারের সাথে আর কোন সম্পর্ক ছিল না। অশ্রু যখন অনেক বুঝদার, বাবা আর সৎ মায়ের কুটিলতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও ওয়াকিবহাল, তখন ফুপুর কাছ থেকে গোপনে মামাদের ঠিকানা যোগাড় করে সবার সাথে দেখা করেছে। কেউ এখন আর গ্রামবাসী নয়,ঢাকারই চার জায়গায় চারজনের বসবাস। একসাথে না থাকলেও তাদের সম্পর্ক অটুট।

বড় মামা অশ্রুকে বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন।এখন অবশ্য কান্না বা মিষ্টি কথায় অশ্রু বিগলিত হয়ে যায়না।সময় তাকে অনেক বাস্তববাদী,সন্দেহ প্রবণ বানিয়েছে। মামা-মামী, খালাদের অভিন্ন বক্তব্য, তাঁরা অশ্রুকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন, সামাদ বা জোহরার উপরে ঠিক ভরসা রাখতে পারছিলেন না, কিন্তু অশ্রুর বাবা এমন চাল চাললেন যে সম্পর্কটাই আর থাকলো না। এরপরেও উনারা বারবার গেছেন অশ্রুকে দেখতে, দেখতে দেওয়া হয়নি। সদর দরজা দিয়েই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অশ্রুর দাদী দেননি,সামাদ সাহেব বা জোহরা বেগম দেননি। দাদীকে বুঝানো হয়েছিল ওরা অশ্রুর ক্ষতি করতে পারে,তাই বৃদ্ধাও শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন।

খালা কথায় কথায় জানিয়ে দিলেন,অশ্রুর মায়ের প্রচুর গয়না আছে, বাপ-মায়ের দেওয়া।অশ্রু যেন তা বুঝে নেয় সময়মতো। মামারা বললেন, অশ্রুর নামে দশ বিঘা জমি তার নানা লিখে দিয়েছিলেন মেয়ে মরার পরে,অশ্রু যেন জমি বুঝে নেয়।

অশ্রু কিছুই পায়নি। তিক্ততা যখন চরমে,তখন গয়না আর জমির কথা তুলেছিল অশ্রু। আকাশ থেকে পড়েছিলেন সামাদ-জোহরা।

“তোমার নানা কোন জমিদারের পো ছিল যে কাঁড়ি কাঁড়ি গয়না-জমি তোমার নামে রেখে গেছে? কে বলেছে এমন অদ্ভুত কথা?”

অশ্রু ফুপুর কাছে জিজ্ঞেস করেছিল গোপনে। ফুপু সব সত্যি খুলে বলেছিল, একদম গোড়া থেকে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “তোর জন্য কিছু করতে পারি নাই বাপ। তোর বাপের ভয়ে তটস্থ থেকেছি সারাজীবন। এখনও। লেখা পড়া শিখিনি তেমন, তোর ফুপা সারাজীবন কাজকর্ম কিছু করলোনা, এতোগুলো ছেলেমেয়ে, তোর বাপ যদি আমাকে এখান থেকে উঠিয়ে দেয়, ভিক্ষা করা ছাড়া আমার আর উপায় থাকবে নারে। আমি যে তোকে সব বলেছি,খবরদার বাপ, ভুলেও কাউকে এই কথা বলিস না। আর এই অকর্মা,মেরুদণ্ডহীন ফুপুকে পারলে ক্ষমা করে দিস।”

মামাদের কাছে তাকে থাকতে না দেওয়ার উত্তর পেয়ে যায় অশ্রু,নানা বাড়িতে সে মানুষ হলে মায়ের গয়না আর তার জমি হাতানো এমন পানির মতো সহজ
হতো না।

শিশুরা নাকি খুব সহজেই খাঁটি ভালোবাসা আর ভেজাল ভালোবাসা বুঝে। অশ্রুর বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল।

ছোট বেলায় ওরা যখন মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় থাকতে এলো,তখন থেকে ছোট্ট অশ্রুর মনের বয়স আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। সকালের নাস্তা একসাথে করতে বসতো চারজন। প্রথম কয়েক বছর সামাদ সাহেব ছেলের প্লেটের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। ছেলের সম্পদ নিজের করে নিলেও ভালোবাসাতো ঠিকই ছিল। ভাবতেন, জমিজমা নিয়ে তো কবরে যাবেন না, সব তো সন্তানদের মধ্যেই ভাগ করে দিবেন। জোহরাকেও তিনি চিনে ফেলেছিলেন খাঁটি জহুরির মতো।

বাধ্য হয়ে অফিসগামী স্বামীর ভয়ে অশ্রুর পাতে ডিম,সব্জি সবই দিতেন জোহরা, এক গ্লাস দুধ ও। বুকটা হিংসায় ফেটে যেতো কিন্তু মুখে ঝকঝকে হাসি নিয়ে ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলতেন,”বেশি করে খাও,আব্বু। লম্বা হতে হবে না?গায়ে একটু গোশত লাগাতে হবে না?অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে না? অশ্রু বাবা ছাড়া আমার অসুখ সারাবে কে?”

সামাদ সাহেব অফিস চলে যাওয়ার পরপরই অন্য রূপ।

“আনিলার কাছে যাবে না।”

” সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করবে না।”

“মাছ আমি বেছে দিতে পারবো না। বাছতে পারলে খাও, নইলে খামোখা নিয়ে নষ্ট কোরোনা।”

“দুধ তুমি একাই খেয়ে ফেললে অন্যেরা খাবে কি?সকালে দুধ খাবে, সন্ধ্যায় মুড়ি।”

আব্বা বাসায় আসার পর হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি। দুধ খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে আব্বাকে জোহরা বেগম নানা কথা বুঝাতেন,”ছেলে দুধ খেতে চায়না। দুধে সমস্যা হয় মনে হয়।পেট ব্যথা করে।পাতলা পায়খানা হয়। তোমার ভয়ে সকালে খায়,তারপরে বাথরুমে দৌড়ায়। আমি কোনদিন সুজি,কোনদিন হালুয়া বানিয়ে দিই,তাই খায় সন্ধ্যায়।”

খাওয়া নিয়ে কথা? লজ্জায় অশ্রু খাওয়া নিয়ে একটা কথাও বলতো না। আব্বাকে বলতে পারতো না,”আম্মা মিথ্যা বলছেন। ”

সবচেয়ে কষ্ট হতো জোহরা যখন আনিলাকে সারাদিন ধরে “আমার পুতুল সোনা,আমার জান,আমার কলিজা ” বলে আদর করতেন আর অশ্রু গেলে ভুরু কুঁচকে তাকাতেন। তারপরে আরিশা হলো,সুমন হলো, অশ্রুর দুর্গতিও বাড়তে লাগলো। আব্বার আদর আর মনোযোগও আগের মতো রইলো না। আব্বা অফিস থেকে এসে সুমন আর আরিশাকে দুই কোলে নিতেন,চুমু দিতেন,তারপরে আনিলাকে কোলে নিতেন,সবার শেষে অশ্রুকে জিজ্ঞেস করতেন,”লেখা পড়া কেমন হচ্ছে? ”

আদরের অভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠতে লাগলো।
আব্বার নিস্পৃহতা, আম্মার থমথমে মুখ, দাদীর মৃত্যু, ফুপুর বিয়ে, নানাবাড়ি থেকে বিচ্ছিন্নতা। অশ্রু বড় অসহায় হয়ে পড়ল।

যন্ত্রণা শতগুণে বেড়ে যেত জোহরা বেগমের বাপের বাড়ির লোকজন এলে। আনিলাদের তিন ভাই -বোনকে নিযে আদিখ্যেতা আর অশ্রুর সাথে সারাটাক্ষণ কঠিন ব্যবহার ওর ছোট্ট বুকটাকে ঝাঁঝরা করে ফেলতো।

আনিলার বর আসিফ ভালোই ছিল। ইদানিং বেশ গন্ডগোল করছে।বেশি ঝামেলা করছে আসিফের বাপ-মা-ভাই-বোন।

আনিলার ননদ দোলার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। চট করে আসিফের মা বলে বসলেন,”দোলার চিন্তা কি?বড়লোক ভাবী আছে না?ননদকেতো ঝুড়ি ভরে উপহার দেওয়ার কথা।”

আনিলা অবাক হয়ে তাকালো। বাপ-মা-দাদাভাই বিস্তর সুযোগ -সুবিধা দিলেও মেয়েটা পড়ালেখা, ছবি আঁকা কোনোটাতেই তেমন সুবিধা করতে পারেনি। যাকে বলে অ্যাভারেজ। চেহারাও সাধারণ। তবে মনটা বড় সুন্দর।
আসিফের খালাতো ভাই আরিফ দাদাভাই এর বন্ধু। দাদাভাই আর আরিফ ভাই এর উদ্যোগে বিয়েটা হয়।

আনিলা চাকরি,ব্যবসা কিছুই করেনা। ও দোলাকে রাশি রাশি উপহার দেবে কি করে? হ্যাঁ, নিজের গয়না কিছু দিবে,তা সে আগেই ঠিক করে রেখেছিল। আর আসিফ বড় ভাই, প্রাইভেট কোম্পানির ইন্জিনিয়ার,সে তো বোনকে দিবেই। শাশুড়ি মা কি বলতে চাচ্ছেন?

” দোলারে,তোর ভাবী বিয়েতে তোকে মার্সিডিজ কিনে দিবে।”
ঘরের সবাই হেসে উঠলো।
আনিলা আর সহ্য করতে পারলো না।
“মা,ঠাট্টা করছেন কেন?আমাকে কিছু বলতে চান?সরাসরি বলেন।সরাসরি না বললে আমি কিছু বুঝিনা।”

“তাই মা?তুমি এত সরল?তোমার মায়ের থেকেও সরল?”

বাবা -মা-ভাই-বোনকে নিয়ে কটু কথা বললে বুকে যে কতো লাগে,তা যদি মানুষ বুঝতো!

শাশুড়ির মুখ ভারী খারাপ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, উনি আরিফ ভাই এর আপন খালা। আরিফ ভাই এর মা খুব মার্জিত।

“মা,আমাকে যা বলার বলেন,আমার পরিবারকে নিয়ে কিছু বলবেন না,প্লিজ। ”

“তোমার দাদাভাইকে নিয়ে খারাপ কথা বললে তোমার খুব ফুর্তি হবে,আমি শিওর।”

“না,হবে না।দাদাভাই আমার প্রাণ। ”

“দাদাভাই তোমার প্রাণ? ” ঘরে হাসির বন্যা বয়ে গেল।

“আবার বোলো না,দাদাভাই তোমার মায়েরও প্রাণ? ”

আনিলা মাথা নিচু করে রইলো।সে কথার পিঠে কথা বলতে পারেনা ছোট বেলা থেকেই।

“মা বটে আমাদের বৌমার। মহিলা জাতির কলংক। এতো খারাপ মানুষ হয়?আর আসিফের শ্বশুরটাতো একটা ভেড়া। মাগী যা বলে,মাগ তাই শোনে। বুড়ো বয়সেও রস যায়না। মাগী শরীর মেলে ধরে একটা করে অর্ডার দেয়, বুড়ো হুড়মুড়িয়ে বৌএর হুকুম পালন করে।লজ্জা, লজ্জা।”

আনিলা মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলো। কথাগুলো নোংরা কিন্তু সত্যি। তবে কথা হলো, ওর বাপ-মা যাই করুক, ইনারা বলার কে?

“আমাদের বাসায় যাই হোক,আমরা বুঝবো,আপনাদের এতো মাথাব্যথা কেন?”

“চোরের মেয়ের ডাংর গলার কথা। আমাদের মাথাব্যথা কেন?ওই মায়ের মেয়ে কি জিনিস হবে,সেইটা ভেবেই মাথাব্যথা। কি করে পারে মানুষ সৎ ছেলেকে এভাবে ঠকাতে?আর ওই বুড়া ভাম? একটা ঠ্যাং কবরে, তারপরেও রসের নাগর।নিজের ছেলেকে ঠকালো।মাগীর না হয় সতালো ছেলে। আল্লাহ কোনোদিন এদের মাফ করবে না।”

আনিলা চেঁচিয়ে উঠে, “চুপ করুন।আর একটা কথাও না।”

“চুপ না করলে কি করবে?খুন করবে?তা যেই গুণধরী মায়ের মেয়ে,খুন করতেও পারো।”

শ্বশুর গম্ভীর স্বরে বললেন,”যে এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করলো,সে যেন আগুন ভক্ষণ করলো।আমার কথা না,কোরান শরীফের কথা। তোমার বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখার এতোটুকু ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরাও যাবো না,উনারাও আসবেন না।”

দাদাভাই তার দুঃখের সাতকাহন কাউকে বলেনি,এটা আনিলা ভালোভাবেই জানে। সামাদ সাহেবের চাচাতো ভাই ইন্জিনিয়ার, উনি জানিয়েছেন আরিফ ভাইকে,আরিফ ভাই তাঁর বাড়ির লোককে।

নিজের ঘরে যেয়ে আনিলা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলো। বাবা-মায়ের কাজকর্মকে সে প্রচন্ড ঘৃণা করে,কিন্তু বাবা-মা’কে নয়। আর দাদাভাই তার জান।এ কথা কেউ বিশ্বাস করবেনা।

দাদাভাই তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো,ট্রাইসাইকেলের পিছনের সিটে তাকে বসিয়ে দাদা সাইকেল চালাতো,নিজের জমানো পয়সা দিয়ে ওকে চকলেট কিনে দিতো,আনিলার জ্বর হলে অশ্রু সারাক্ষণ বোনের মাথার কাছে বসে থাকতো,ছোট ছোট হাতে কপালে জলপট্টি দিয়ে দিতো,আরও কত স্মৃতি। খুব চঞ্চল ছিল দাদাভাই, ধীরে ধীরে শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেলো। মা দাদাভাইকে খাওয়ার কষ্ট দিতো, আরিশার সাথে খেলা করতে বলতো দাদার পড়ালেখার সময়ে, সুমনের ন্যাপি কাচতে দিতো দিনের মধ্যে চৌদ্দবার, দাদী বা ফুপু এলে একদম ভালো মানুষ।

আনিলার নানীতো দাদাভাইকে চড়-থাপ্পড়ও লাগাতো, গাল মুচড়ে দিতো, সামাদ সাহেব বাড়ি এলে নানা কূটকাচালি করতো….”অশ্রু কিন্তু একটু দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাবা,প্রায় বোন দুইটাকে চুলের মুঠি ধরে মারে,পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের সাথে মেশে,ওর মায়ের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে, একটা কথাও শোনেনা,আজ জোহরার ব্যাগ থেকে টাকা সরিয়েছিল, তুমি আবার এসব কথা জোহরাকে বোলোনা বাবা, মা তো ছেলে অন্ত প্রাণ, অশ্রুর অনেক দুষ্টুমির কথা তোমার থেকে লুকিয়ে রাখে।কিন্তু বাবা,তুমি বলো,এগুলো লুকিয়ে রাখার জিনিস? ছেলের ভালোর জন্যই দরকারে কঠিন হতে হবে না?”

সামাদ সাহেব ছেলেকে বকতেন,মারতেন,বোকা দাদাভাই টু শব্দটা করতো না। আনিলা কয়েকদিন জোর প্রতিবাদ করতে যেয়ে মায়ের হাতে মার খেয়েছে।

বাবার কাছে লুকিয়ে নানীর মিথ্যা কথার বিরুদ্ধে নালিশ করতে যেয়ে নিজেই ফেঁসে গেছে। মা মিষ্টি করে বলেছে,”ছিঃ মা! তুমি আর দাদাভাই জোট বেঁধে আরিশাকে মার দাও, আমরা কাছে না থাকলে সুমনকে চিমটি কাটো,কাঁদাও, ওইদিন দাদাভাই তোমাকে বাবার মানিব্যাগ লুকিয়ে নিয়ে আসতে বললো,তুমিও নিয়ে আসছিলে,আমি দেখে ফেললাম, এসব কথা বাবাকে না বললে হবে?তুমি চাও,তোমার দাদাভাই পচা লোক হোক?”

“সব মিথ্যা কথা। ”

“মেয়ে,তুমি বেশি পচে গেছ।মিথ্যা বলে ফের মুখে মুখে তর্ক?”

আনিলার আর কি করার ছিল? সে তার সবটুকু ভালোবাসা ভাই কে উজাড় করে দিতে চাইতো।ভাই মার খেলে পাশে বসে কাঁদতো, নিজের ভালো খাবারের ভাগ ভাইকে দিতে চাইতো,অশ্রু কিছুতেই নিতো না, কি করার ছিল ছোট্ট আনিলার? তারতো ইচ্ছে করে দাদাভাই কে উজাড় করে সবকিছু দিয়ে দিতে।

ভাবীটাও ভারী মিষ্টি মেয়ে। দাদা যখন বাড়িতে ভাবীর কথা জানালো তখন মা একবারে আঁতকে উঠেছিলেন।

“আমার কতো সাধ,বড় ছেলের বৌ আমি নিজে পছন্দ করবো, তুই এমন করতে পারলি?”

“মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ, আম্মা। আপনারা দেখেন একবার। ”

দলবেঁধে সবাই গেলো মেয়ে দেখতে।ছয় মাস হলো ভালো চাকরি হয়েছে অশ্রুর।চাকরি করা ছেলেকেতো বলা যায়না,”তুই সারাজীবন বিয়ে করতে পারবি না।” অশ্রু ভালো কামাই করে।সামাদ সাহেবের অনেক উপরি ইনকাম,সহায়-সম্পদ থাকলেও অশ্রু জোহরা বেগমের হাতে সংসার খরচের টাকা তুলে দেয়। দুধ দেওয়া গরুকেতো হাতে রাখতেই হয়।

রেণুকে দেখে আনিলা মহাখুশি। কি মিষ্টি! কি মিষ্টি! চোখ দেখলেই বোঝা যায়, এই মেয়ে পৃথিবীর কোন ঘোরপ্যাঁচ জানেনা।

বাসায় এসে সামাদ সাহেব ফেটে পড়লেন।

“একটা হা-ঘরের মেয়েকে পছন্দ হলো তোমার? কি দেখে পছন্দ হলো?বাপ ছোট চাকরি করে, মা নাই, একপাল ভাই -বোন, কালোকুলো মেয়ে, কি দেখলে এর মধ্যে? নিজেদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই ও নাই।”

“আব্বা,ও আমার সাথে পাশ করেছে। ”
“আমার মাথা কিনেছে। ইন্জিনিয়ার মেয়ে আর চোখে পড়ে নি?”
“ওর মতো ভালো মেয়ে আমার চোখে পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা…”
“কি সবচেয়ে বড় কথা?”

“ও দেখতে আমার মায়ের মতো।”

কয়েক মুহূর্ত সব চুপচাপ। তারপর জোহরা বেগমের কান্না,” এতো ভালোবেসেও আমি ওর মা হতে পারলাম না।”

পরে এই কথাকে রীতিমতো অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছিলেন জোহরা বেগম।

“কলিজা দিয়ে দিলেও সৎ ছেলে আপন হয় না গো।আমি পেটের ছেলের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছি,কিন্তু ও আমাকে কখনো মা বলে মানতে পারেনি।”

জোহরা বেগমের অত্যাচার ছিল খুবই গোপনে ও কৌশলে, বাড়ির বাইরে কাকপক্ষীটি কিছু টের পায় নি, এখন এই কথাগুলো নানা জায়গায় বিলাপ করে বলে তিনি অনেকের সহানুভূতি আদায় করতে থাকলেন। কৌশল, ধুরন্ধরী বুদ্ধি। আনিলা সবই বুঝে।

ভাবীর উপরে আম্মা কম অত্যাচার করেছে?কত কটু কথা।ফকিরের মেয়ে, পাতিলের তলা, ছেলে ভাগানী কতো কিছু। ভাবী চুপ করে থেকেছে, কোন কোন দিন আনিলা ভাবীর ভেজা চোখের পাতা দেখেছে, কিন্তু ভাবী কাউকে কোন নালিশ করেনি। আনিলা নিশ্চিত, দাদাভাইকেও না। ভাবীটা এমনই।

ভাবী মোটা টাকা বেতন পেতো,অফিসে যাওয়ার আগে সকালের নাশতা বানাতো,রাতে ফিরে অন্তত দুইটা তরকারি রেঁধে দিতো আলিমা বুয়া থাকা স্বত্বেও, মাঝেমধ্যেই বাইরের মজার মজার খাবার নিয়ে আসতো, ছুটির দিনে কেক বানাতো,পোলাও -কোর্মা রাঁধতো, মেহমানদারি করতো,ভাবীকে পৃথিবীর মেয়ে মনে হতো না আনিলার। লেট রাইজার আনিলা ভোরে উঠে ভাবীকে নাস্তা বানানোয় সাহায্য করতে লাগলো মায়ের তীব্র রাগ উপেক্ষা করে।

“এখনও বিয়ে শাদী হয়নি,চুলার পাড়ে সারাদিন পড়ে থাকলে গায়ের রং ঐ উনার মতোই হবে।”

ভাবী তার বাবা-ভাইবোনদের জন্যও অনেক করতো,প্রকাশ্যেই। ভাবীর মাঝে অস্বচছতা বলে কিছু ছিল না।

জোহরা বেগম উঠতে বসতে বলতেন,”বাপের বাড়ি সব পাচার করে। আর বাপ-ভাইও তেমন,দেওয়া তো দূরের কথা,মেয়ের কাছ থেকে শুধু নেয় আর নেয়।হাভাতে ঘর। ফকির ও মেয়ের বিয়েতে এর চেয়ে বেশি আয়োজন করে।”

ভাবীকে এক রাতে ছাদে নিঃশব্দে কাঁদতে দেখে আনিলাও কেঁদে ফেললো। নিজেকে বড় অভিশপ্ত মনে হচ্ছিল। এমন ফাটা কপাল যে এক নোংরা মহিলা তার মা,মেরুদণ্ডহীন লোভী মানুষ তার বাবা, নানী সাক্ষাৎ ডাইনি বুড়ি। ভাবীকে জড়িয়ে ধরে সে মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেল।ভাবী তাকে থামিয়ে দিল।

“না,সোনা, কারো নামে মন্দ বলতে নেই। সময় সব ঠিক করে দিবে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here