#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_১৭
রাবেয়ার কথা শুনে পরম আদরে বুকে টেনে নিলেন স্বপ্না চৌধুরি।রাবেয়ার চোখের পানি সযত্নে মুছে দিলেন তিনি।আর বললেন,”ভুলে যা ছয় বছর আগের সেই দিনের কথা।আমরা তো রোজ কত দুঃস্বপ্ন দেখি তাই না।মনে কর ঐটাও তোর দেখা কোন দুঃস্বপ্ন।আজ তুই স্বাধীন। নিজ পায়ে দাড়িয়েছিস শুধুমাত্র ঐ দিনের সেই সাহসিকতার জন্য।তুই নিজের সাথে কোন অন্যায় হতে দিসনি।আমার গর্ববোধ হয় তোকে নিয়ে।”
রাবেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”অনেক রাত হয়েছে।এইবার ঘুমিয়ে পড়।তোর সাথে কাল আমার জরুরি কথা আছে।”
“আচ্ছা।”
স্বপ্না চৌধুরি চলে যাওয়ার পর রাবেয়া মনে মনে বলল,”আমি আপনার কথা রেখেছি ডাক্তারসাহেব।নিজের সাথে কোন অন্যায় হতে দেয়নি আমি।কিন্তু কেন আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিনা আমি।আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার।”
আজ ছয়বছর ধরে রাবেয়া খুঁজে আসছে আসাদকে।বিয়ের রাতে পুলিশের সাহায্য নিজের বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল রাবেয়া।নিজের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো বলে নয় বরং বোনদের মুখে বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়ার কথা শুনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল সে।বিয়ের বাজারে বেচাকেনার পাত্র সে হতে চায় না।কিন্তু বর্তমান সমাজে প্রতিননিয়ত বিয়ের নাম করে এইভাবে সম্পর্কের বেচাকেনা হচ্ছে।সম্পর্কের দাম যদি এত চওড়া হয় তবে সে সম্পর্কে না জড়ানোই শ্রেয়।বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ফলে হাসান সাহেবের মান সম্মান মাটিতে মিশে গিয়েছিলে।সমাজে কি মুখ দেখাবেন তিনি।তাই সেদিন রাতেই রাবেয়াকে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ছিলেন তিনি।নিলুফা বেগমের শত অার্তদানকে নাকচ করে দিয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন হাসান সাহেব।যেখানে আত্নসম্মান নেয় সেখানে নিশ্বাস নেওয়াটা বড়ই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়ে।তাই রাবেয়া সেখান থেকে চলে আসার সিদ্ধাত্ন নেয়।এখন সে আত্নসম্মান নিয়ে বাঁচবে।নিজের জন্য নিজে একাই লড়াই করবে।
দেশে ফিরেছে সবে মাত্র এক মাস হয়েছিলো তখন মিনহাজ চৌধুরির।ভগ্নিপতির সাথে সম্পর্ক এতো ভাল ছিলো না তার।তবুও বোনের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন তিনি।ভাগ্নির বিয়ের কথা শুনে প্রথমে অবাক হলেও পড়ে বোনকে আর কিছু বললেনি তিনি।বিয়ের দাওয়াতে আসতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল তাদের।কিন্তু যতক্ষনে মিনহাজ ও স্বপ্না চৌধুরি সেখানে পৌছেছিলেন ততক্ষনে বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল।রাবেয়ার কাজল লেপ্টে থাকা শুষ্ক মলিন চেহারা দেখে বুক ধক করে উঠলো মিনহাজ চৌধুরির।সেদিন তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন।রাবেয়াকে সেখান থেকে নিয়ে আসার সময় হাসান সাহেবকে কিছু কথাও বলেছিলেন তিনি।
“আজকের এইদিনটার কথা মনে রাখবেন।যে মেয়েকে ফেলনা মনে করে ছুড়ে ফেলে দিলেন একদিন সেই মেয়েকে বড্ড প্রয়োজন হবে আপনার।কিন্তু সেদিন আপসোস করা ছাড়া আর কিছুই করা থাকবেনা আপনার।মেয়ের চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলার এই সাহসটুকু তখন আপনার আর থাকবেনা।আর আজ থেকে আমার মেয়ের সাথে আপনাদের কোন সম্পর্ক নেই।আজ থেকে সে শুধু আমার মেয়ে।”
অন্যের মেয়ে হওয়ার শর্তেও রাবেয়াকে নিজের মেয়ের মতো আপন করে নিয়েছিলেন স্বপ্না চৌধুরি।এইভাবে শুরু হলো রাবেয়ার আত্নমর্যাদা সম্পূর্ন নতুন জীবনের।পুনরায় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষারর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল রাবেয়া।এর মাঝে কয়েকবার সলিমুল্লাহ মেডিকেলল কলেজেও গিয়েছিল সে আসাদের খোঁজে।কিন্তু তাকে পাইনি সেখানে।পরে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছিল সে।রাবেয়া মনে করেছিলো কলেজে ভর্তি হওয়ার সুবাদে এখন খুব সহজে সে আসাদের সম্পর্কে জানতে পারবে।কিন্তু তেমন কিছুই জানতে পারেনি সে।পরে একজন হসপিটাল স্টাফকে আসাদের সম্পর্কে জিজেস করাই সে বলেছিল সে খোঁজখবর নিয়ে তাকে জানাবে।বহু অপেক্ষারর পর জানতে পারলো যে বছর দুইয়েক আগে পড়াশুনার জন্য বিদেশে চলে গিয়েছিলো সে।সেই স্টাফ তাকে আসাদের কলেজের নামও বলেছিলো।আসাদের বিদেশ চলে যাওয়ার কথা শুনে মনটা অবসাদে ভরে গেল রাবেয়ার।তাই সে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেল রাবেয়ার ইন্টার্নশীপ শেষ হয়ে সে একজন ডাক্তারও হয়ে গেল কিন্তু আসাদের জন্য তার অপেক্ষা শেষ হলোনা।হঠাৎ আজ তার খেয়ালে আসলো আসাদের কলেজে গিয়ে যদি তার বাসার ঠিকানাটা পাওয়া যায়।কিন্তু তেমন কিছুই পেলোনা সে।কে জানে কখন দেশে আসবে সে।আসলেও কি দেখা হবে তার সাথে?কখনো কি হসপিটালে আসবে আসাদ!
___________________________
আজকের সকালটা অন্যরকম লাগচ্ছে সেলিনা মীরের কাছে।অনেকবছর পর পুরো পরিবার একসাথে নাস্তা করছে।আসাদ আর সাফা মেতে আছে তাদের খুনসুটিতে।তাদের সঙ্গ দিচ্ছেন শামীম সাহেব।আসলেই ছেলে মেয়ের হাসিমাখা মুখের দিকে তাকালেই শরীরের সকল ক্লান্তি নিমিষে শেষ হয়ে যায়।নাস্তা শেষ করে সাফা বলল,”ভাইয়া আজকে আমাকে কলেজে তুই নামিয়ে দিয়ে আসবি।”
বোনের আবদার শুনে আসাদও উঠে দাড়ালো আর বলল,”ওকে মাই প্রিন্সেস। ” দুইজনে বের হয়ে গেল সাফার কলেজের উদ্দেশ্যে।
“তুলি আর কতক্ষন লাগবে তোর।দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
“এই তো আপু হয়ে গেছে। আসছি আমি।” উপর থেকে চেঁচিয়ে বলল তুলি।নিচে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে রাবেয়া আর স্বপ্না চৌধুরি।
তুই কেন ওর জন্য অপেক্ষা করিস বলতো?মেকআপ করতেই লেগে যায় ওর একঘন্টা।মেয়েটাকে নিয়ে পারলাম না আর।”
“মামী টেনশেন নিয়ো না তো।আমি ওকে বুঝাবো।একটু সময় দেন ওকে।ও নিজ থেকে নিজেকে পরিবর্তের কাজ ধরবে।ইসলামে জবরদস্তি বলতে কিছু নেই।আমাদেরকে ধৈর্য্য নিয়ে ওকে বুঝাতে হবে।আর আমিতো আছি।”
“তুই আছিস বলেই তো মেয়েটাকে নিয়ে টেনশেন কম করি।তা না হলে আজকালকার ছেলে মেয়েদের যে কি এক অবস্থা।মা বাবার কথাই শুনো না।কিন্তু তোর বিয়ের পর আমি মেয়েটাকে কিভাবে যে সামলাবো!”
বিয়ের কথা শুনে কিছুটা দমে গেল রাবেয়া।মুখে যতই বলুক তার শুধুমাত্র আসাদকে কিছু বলার আছে।কিন্তু সে মনে মনে এইটা জানে যে আসাদের জন্য সে গভীর কিছু অনুভব করে।আর সেই অনুভব থেকে তার এই অপেক্ষা।সবসময় নামাজে মোনাজাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট সে তার অপেক্ষা অবসানের ফরিয়াদ জানায়।আসলে ভালোবাসা মুহূর্তের সৃষ্টি। কাউকে নিয়ে রোজ ভাবতে ভাবতে কখন যে সে মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলে সেটা বুঝা আসলেই কষ্টসাধ্য।রাবেয়ারও তাই হয়েছে।মনের অজান্তে সে তার হৃদকুটিরে আসাদকে জায়গা করে দিয়েছে।মামীর কথায় ধ্যন ভাঙ্গল রাবেয়ার।
“তোকে একটা কথা বলার ছিলো।”
“হ্যা….ও…হ্যা বলোনা মামী!”
“কি ভাবছিলি?”
“না তেমন কিছু না বলো কি বলবে।”
“আগামী সাপ্তাহে হসপিটাল থেকে একদিন ছুটি নিস তো।বাসায় কিছু গেস্ট আসবে।”
“মামী তুমি তো জানো আমি বাইরের কারো সামনে আসিনা তাহলে…”
“ওরা তোকে দেখতে আসবে।”মামীর কথায় কিছুটা অবাক হলো রাবেয়া।কিন্তু মামীকে না বলার বা তাদের কথা উপেক্ষা করার কোন ইচ্ছা রাবেয়ার নেই।কারন এই মানুষগুলোই তো আপন তার।আর আপনদের কোন কষ্ট হোক তা সে চাইনা।কারন রাবেয়া জানে না আদৌ তার অপেক্ষা কখনো শেষ হবে কিনা।
“আচ্ছা ঠিক আছে।”কথাটা বলে তুলিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল রাবেয়া।
চলবে……
®নওশিন সালসাবিল।