#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৮

রিদম যখন অরণীর বাসার সামনে এসে পৌঁছায়, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় এগারোটা। এত রাতে বের হতে রিদমেরও বেগ পেতে হয়েছে, কিন্তু মা, বাবাকে বুঝিয়েছে যে কলেজের বড়ো ভাইয়ের চেম্বার শেষ হয় রাত দশটায়, ভাই তাকে তাই দশটার দিকে যেতে বলেছেন, রোগী থাকলে ডিটেইলস কথা বলতে পারবেন না।
চার ভাইবোনের মাঝে রিদম মেজো, বড় বোন মাসুমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট ভাই রাতুল তিতুমীরে পড়ছে, পড়ালেখায় অত মনোযোগ নেই, ছাত্র রাজনীতি নিয়েই সে ব্যস্ত। সবার ছোটো তিথি সামনে এইচএসসি দেবে। বলা যায় পুরো পরিবারের সমস্ত প্রত্যাশার ভার রিদমের কাঁধে। শুনতে স্বার্থপর শোনালেও মা, বাবা থেকে শুরু করে ভাই বোন সবাই অপেক্ষায় আছে কবে রিদম অনেক অনেক আয় করা শুরু করবে, আর তাদের হারানো দিন আবার ফিরে আসবে। তাই চেম্বারের কথা শুনে বাসার কেউ আর কোন প্রশ্ন তোলে না।

অরণীর বাবা জামিল সাহেব ঘড়ির কাঁটার সাথে চলার মানুষ, রাত এগারোটার ভেতর শুয়ে পড়বেন, আর ঠিক সকাল ছয়টায় উঠবেন। আধাঘন্টা হাঁটাহাটি করে অফিসের জন্য রেডি হবেন। জামিল সাহেবের সাথে থাকতে থাকতে মা হুমায়রারও তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার অভ্যাস হয়েছে। অরণীর দাদী সকালে ফজরের ওয়াক্তে উঠে নামাজ পড়েন, তাই তিনিও বিছানায় যেতে দেরি করেন না। এই বাসায় তাই অরণী আর অমিয় ছাড়া বাকিরা রাত এগারোটার ভেতর ঘুমানোর আয়োজন করে ফেলে। এখন রাত বারোটা মানে এই বাসায় গভীর রাত, কাল পরীক্ষা না থাকলে অরণীও শুয়ে পড়তো। এই মুহূর্তে অমিয় ওর রুমের দরজা বন্ধ করে গান শুনছে, এই ছেলে নিশাচর, এবং নির্লিপ্ত। এই যে বাসায় এত এত ঝড় বয়ে গেল, একবারও নিজের রুম থেকে বের হয়ে দেখেনি ঘটনা কী। তবে পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার পর মায়ের কাছে গিয়ে গুটগুট করে কী যেন গল্প করলো। অরণী খেয়াল করেছে পারিবারিক ঝগড়া, অশান্তি যাই হোক, মা অমিয়র উপর কখনো রাগ ঝাড়ে না, অমিয় গিয়ে দুটো ভালো কথা বললে কেমন নরম হয়ে যায়। একই কাজটা অরণী করতে গেলে মা তেমন পাত্তা দেয় না। আচ্ছা মাও কী এক পুরুষের প্রতাপ থেকে মুক্তি পেতে ভবিষ্যতের আরেক পুরুষের আশ্রয় খোঁজে। না মা ভাবে অরণী অন্যের ঘরেই যাবে, তার সাথে ভালোবাসা ভাগ করা যায়, দুঃখ নয়! কী জানি, এসব বেশি ভাবলে অরণীর এলোমেলো লাগে। তাছাড়া আজকের ব্যাপারটা আলাদা, আজ অরণীর একটা অপরাধবোধও আছে, আজকের এই অশান্তি টা তো সে নিজেই ডেকে আনলো।
অরণীর বদলে অমিয় একদম আলাদা, যেমন নির্লিপ্ত তেমন ঠান্ডা, কোন আপদ যেমন ডাকে না, তেমনি পারিবারিক কোন ঝামেলায় জড়ায়ও না, নিজের একটা জগত বানিয়ে থাকে।

অরণী ‘প্রস্থোডোন্টিকস’ বই খুলে বসে আছে, কাল সত্যি সত্যি আইটেম আছে, আর অরণী পড়ায় মন না বসালে সত্যিই পেন্ডিং খাবে। ফোনটা অবশেষে অন করে, রিক্তাকে ফোন দিয়ে জানতে হবে কী কী পড়েছে। আপাততঃ রিদমের সাথে যোগাযোগ করার কোন ইচ্ছে নেই। থাকুক, একটু শাস্তি পাওয়া দরকার আছে রিদমের, ও বুঝুক অরণী এমনই, এবার প্রেম পোষালে করবে, না করলে নাই। ফোন অন করতেই একের পর এক নোটিফিকেশন আর ম্যাসেজ আসতে থাকে। অরণী ঠিক করে এখন কোন ম্যাসেজ চেক করবে না, বরং রিক্তার সাথে কথা বলেই ফোন অফ করে দেবে।

“হ্যালো, রিক্তা?”

“অরু তোর ফোন বন্ধ ছিল কেন? রাত কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”

“স্যরি রে, এত রাতে কল করলাম, কিন্তু আমি জানতাম তুই ঠিক রাত জেগে পড়ছিস, তাই কল দিলাম। আমার কিছু পড়া হচ্ছে না রে। কী যে পরীক্ষা দেব।”

“তুই পড়ার চিন্তা করছিস, আর এদিকে রিদম ভাই তোর বাসার নিচে রাস্তায় বসে আছে। রাত বারোটার বেশি বাজে। তোর ফোন বন্ধ দেখে ভাইয়াকে বললাম চলে যেতে, ভাইয়া নাকি তোর সাথে কথা না বলে যাবে না।”

“কী বলিস এসব। রিদম কই? আমার বাসার নিচে? এতরাতে এখানে কী করে? সিকিউরিটি গার্ড একটু পরপর টহল দেয়, বিনা কারণে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করলে ধরে পুলিশে দেবে।”

“এসব আমাকে বলিস কেন? যাকে বলার দরকার তাকে বল। সেই নাকি সন্ধ্যা থেকে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে তোর বাসার নিচে বসে আছে, তোকে এক নজর দেখবে বলে।বাপরে তুই এত পাষাণ কেন?”

রিক্তার কথায় অরণীর কান্না পেয়ে যায়। সত্যি রিদম সন্ধ্যা থেকে না খেয়ে রাস্তায় বসে আছে! অরণী কয়েকবার তো বারান্দায় গেল, কই রাস্তায় তাকিয়ে রিদমকে দেখেনি তো। পরমুহূর্তে মনে হয় ও তো জানতো না রিদম এখানে, তাই হয়তো ওভাবে খেয়াল করা হয়নি। ফোন হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ম্যাসেজ চেক করে অরণী। অবশ্য রিক্তা ইচ্ছে করেই বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছে যেন অরণী তাড়াতাড়ি ম্যানেজ হয়ে যায়।

“অরু, তুমি একবার বারান্দায় আসো। একবার বলো ক্ষমা করছো। যতক্ষণ না বলবে আমি যাব না।”

“অরু, তুমি না আমার ইকোস্প্রিন, আমার বুকের ব্যথার ঔষধ। আমার বুকে রক্ত চলাচল করে তোমার নামে। আমার শিরা উপশিরায় অরণী মিশে আছে ড্রাগসের মতো। অরু আসবে না বারান্দায়?”

অরণী টেবিলের উপর ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছিল। রিদমের ম্যাসেজগুলো পড়ে তার রাগ গলে জল। আড় চোখে দাদীর নড়াচড়া খেয়াল করে অরণী। মনে হচ্ছে দাদী গভীর ঘুমেই আছে। আস্তে করে উঠে বারান্দায় চলে আসে। ফোন হাতে নিয়ে কল করে রিদমকে
“হ্যালো?”

“অবশেষে আমার উপর দয়া হলে। সত্যি আর একটু দেরি হলে মারাই যেতাম।”

“কখন থেকে আছ এখানে।”

রিদম চিন্তা করে মাত্র একঘন্টা বললে অতটা গভীর শোনাবে না। চার পাঁচ ঘন্টা বলবে নাকি! কিন্তু রিদম জবাব দেওয়ার আগেই অরণী বলে, “এটা কোন কথা রিদম। তুমি কী বাচ্চা? খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে সন্ধ্যা থেকে এখানে পড়ে আছ। বাসায় যাও প্লিজ, আঙ্কেল আন্টি চিন্তা করবে।”

“ইসস এত ভাবলে ফোন অফ রাখতে? আমি যাব, আগে বলো সব ভুলে গিয়েছ?” বলে মনে মনে রিক্তাকে একটা ধন্যবাদ দেয় রিদম। বোঝা যাচ্ছে রিক্তা অরণীকে ভালোই ম্যানেজ করেছে। আরে বন্ধু হলে এমনই হওয়া দরকার। অরণী গলে যাচ্ছে, আর মিনিট পাঁচেক। ফয়সাল গলির মুখে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে। এমনিও ঠিক করেছিল সাড়ে বারোটার ভেতর যোগাযোগ করতে না পারলে চলে যাবে। এর বেশি দেরি করা মুশকিল। ভালোই হলো, কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছে।

“আচ্ছা সব মাফ করেছি। তবে আর কখনো আমাকে এমন ডেটে যাওয়ার জন্য জোর করবে না। প্রমিস?”

“প্রমিস।”

“এখন বাসায় যাও। কিভাবে যাবে এত রাতে?”

“সমস্যা নেই ম্যানেজ করে নেব। প্রেমের মরা জলে ডোবে না, এইটা জানো না?”

“আচ্ছা তাড়াতাড়ি যাও। পৌঁছে কল দিও। চিন্তায় থাকবো।”

“লাভ ইউ বলো।”

“লাভ ইউ। এবার যাও।”

বারান্দা থেকে হাত নেড়ে রিদমকে বিদায় দেয় অরণী।
গলির মুখে এসে ফয়সালকে পায় রিদম। রিক্তা মেয়েটা অনেকদিন ধরে ফয়সালের পেছন ঘুরছিল। আজকের এই সাহায্যের বিনিময়ে ফয়সালের সাথে একটা লাইন করিয়ে দিতে হবে। মেয়েটাকে হাতে রাখলে লাভ। বিজয়ীর হাসি হেসে ফয়সালের বাইকে বসে রিদম। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে শুতে না শুতে ঘুম নামে চোখে, অরণীকে জানানোর কথা মনে থাকে না। আর এদিকে ফোন হাতে নিয়ে দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটে অরণীর। দুইবার কল দিয়েছিল, ফোন সাইলেন্ট থাকায় রিদম শুনতে পায়নি। ছটফট করতে করতে সকালের অপেক্ষা করে অরণী।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here