#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৪
অভিমানে অরণীর কেমন কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সবাই বলে অরণী অনেক লক্ষী মেয়ে, বড় খালাতো সবসময়ই ওনার মেয়েদের বলেন, “অরণী আপুর মতো হও, যেমন লক্ষী তেমন মেধাবী।”
যেই দাদী সারাক্ষণ সবার ভুল ধরে, সেই দাদীও বলেন, “আমার নাতনির মতো আর কেউ নাই, ফুফুগো মতো সুন্দর আর গুণী হইছে।” দাদীর কাছে সেরার মাপকাঠি হলেন দুই ফুপু।
অথচ রিদম তাকে কতগুলো শক্ত শক্ত কথা বলে ফেললো। এই যে ওর এই নরম স্বভাব, চঞ্চল হলেও বেপরোয়া নয়, বাবা মায়ের আদুরে শুধু নয়, আজ্ঞাকারী মেয়ে এটাই তো সবার ভালো লাগে। বন্ধুর মায়েরা বলে অরণীর মতো হও, আত্মীয় স্বজনেরা বলল অরণীর মতো হও। মাঝেমাঝে অতিরিক্ত সতর্ক চোখের পাহারা অরণীর খারাপ লাগলেও, সবার এইসব প্রশংসা বাক্যে যে সে তার খুশি খুঁজে নিয়েছে।
রিদমও কত বলে, “অরণী, তোমার মতো মেয়ে এখন বিলুপ্ত প্রজাতি জানো। এত মিষ্টি মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে পোষাবে না, আমার বৌ বানাতে হবে তাড়াতাড়ি।”
আর আজ সেই অরণীকে রিদম কেমন করে বকে দিল। অরণী মাথানিচু করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ইচ্ছে করছে এখুনি বাসায় চলে যেতে, বাসায় গিয়ে মাকে কিছু একটা বুঝ দিয়ে দেবে যে আজ আর ক্লাস হবে না। মা সহজ সরল মানুষ, এত কিছু খোঁজ নিতে যাবে না। ভয় হলো বাবাকে নিয়ে, ক্লাস হয়নি শুনলে অনেক প্রশ্ন করবেন। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলতে পারে না অরণী।
নাকি কলেজে চলে যাবে, যে কয়টা ক্লাস পায় করবে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তাছাড়া আগে কখনো একা এতদূর আসা হয়নি, একা একা পার্ক থেকে বের হতেও অস্বস্তি লাগবে। অরণীর চোখে এবার সত্যিই পানি চলে আসে, আসলেই তো ও এত ভীতু কেন হলো! ওর বান্ধবীরা সমস্ত ঢাকা চষে বেড়ায়, আর অরণীর দৌঁড় কলেজ থেকে বাসা, বড়জোর কলেজের কাছে ফাস্টফুডের দোকানগুলো।
হঠাৎ রিদম এসে একদম পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে যায়, “মাফ করে দাও অরু, কী বলতে কী বলে ফেলেছি। প্রথম ডেটিং এ এসেছি তো, অনেক নার্ভাস। জানোই তো নার্ভাস থাকলে প্যানিক এটাক হয়। প্লিজ কেঁদো না। আই অ্যাম স্যরি অরু।”
ভালোবাসার তীব্র আবেগের সময় রিদম ওকে অরু করে বলে, তখন রিদমকে মায়ের মতোই কাছের কেউ আর আপন কেউ মনে হয় অরণীর। একটু আগেও ভাবছিল চলে যাবে। কিন্তু এখন রিদম এমন চেহারা করে তাকিয়ে আছে, ক্ষমা চাইছে যে অরণীর শক্ত ভাবটা শিথিল হয়ে যায়। রিদম অরণীর হাত ধরে বসিয়ে দেয়। জোর করে কান্না আটকানোর চেষ্টা করায় অরণীর নাকটা ফুলে ফুলে উঠছে কান্নার দমকে, লম্বা সময় দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে রাখায় নিচের ঠোঁটটা লাল রঙ হয়ে গিয়েছে। আজ সকালে তাড়াহুড়োয় অরণী কোনরকমে চুল আঁচড়ে বের হয়েছিল। অথচ এখন এই প্রসাধন বিহীন, সিধে সাধা মুখটাই লাবণ্যময় লাগছে রিদমের। অরণী মাথা নিচু করে বসে আছে। রিদম হঠাৎ মুখটা তুলে ধরে গালে একটা চুমু বসিয়ে দিলো। ঠোঁটে ঠোঁট বসানোর সাহস হয় না। কিন্তু এতেই অরণী ছিটকে সরে যায়, ও বিশ্বাসই করতে পারে না এইমাত্র কী হলো।
“স্যরি অরু, তোমাকে এত মায়া লাগছিল যে নিজেকে সামলাতে পারিনি। বিশ্বাস করো এরমাঝে কোন নোংরা উদ্দেশ্য নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই কাছে টেনেছি। আর এতটুকু তো প্রেমে চলেই। বাকিটুকু বিয়ের পর।”
অরণীর কানে কোন কথা ঢুকে না, তাই উত্তরও দেয় না। কান ঝা ঝা করছে। অনেকক্ষণ ধরেই চলে যাবে ভাবছিল। এখন আর বসে থাকার মানে হয় না। উঠে যাবে এমন সময় দুইজন টোকাই ধরনের লোক সামনে চলে আসে, “কী ভাই জায়গা লাগবনি, সামনে ঝোপের পিছনে ব্যবস্থা আছে। পলিথিন লাগলে বইলেন।”
অরণীতো বটেই রিদমও হচকচিয়ে যায়, “আমাদের কিছু লাগবে না, আমরা এখনি উঠছি” রিদম কণ্ঠে জোর নিয়ে বলে। অরণীর হাত ধরে উঠেও যায়। কিন্তু লোক দুটো বাজে ভাবে হাসতে থাকে। এর মাঝে আরও দু’জন লোক এগিয়ে আসে। তার মানে জায়গাটা নিরিবিলি মনে হলেও ঝোপের আড়ালে এমন মাদকাসক্ত বখাটেরা ঠিকই লুকিয়ে থাকে। চারজন লোককে দেখে অরণী আর রিদম দু’জনই ভয় পেয়ে যায়। পেপার পত্রিকায় পড়া দুনিয়ার সব কাহিনি অরণীর মাথায় চলে আসে। কী করবে এই লোকগুলো! এখন তো দিনের আলো, গায়ে হাত টাত দেবে না তো! এমন কিছু হলে অরণী মারাই যাবে। অরণীর ফ্যাঁকাসে রক্তশূণ্য মুখ দেখে রিদমের ভীষণ খারাপ লাগছে, অরণীর কোন ক্ষতি হলে যে সে নিজেকে মাফ করতে পারবে না, ওকে যে সেই এখানে নিয়ে এসেছে।
“দেখেন ভাই, আপনারা কী চান? এখানে আসেপাশে লোকজন আছে, পুলিশ আছে, আমরা চিত্কার করে লোক জড়ো করবো। আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি, রাজনীতি করি, ফোন দিলে আমার ছেলেপেলেরা চলে আসবে এখনি।” কণ্ঠ যতটা স্বাভাবিক রেখে ফোন বের করে কল করার ভঙ্গি করে রিদম। মেডিকেল পড়ে, এই পরিচয় দিলে এরা দু’পয়সার ভয় পাবে না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলে, কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুনলে সবাই কিছুটা হলেও সমীহ করে। অরণী বুঝতে পারে কেন রিদম এমনটা বলছে। রিদমের শার্ট খামছে ধরে সেও স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, এদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে ভয় পেয়েছে।
লোকগুলোর মুখের ভাবভঙ্গি একটু পরিবর্তন হলেও রিদমকে খুব একটা পাত্তা দেয় না তারা, দলনেতা গোছের লোকটা বলে “আরে দেখলাম চুম্মাচাটি করতাছেন। তাই একটু সাহাইয্য করতে আইলাম। উল্টা দেখি পুলিশের ডর দেখান, পোলাপান আনার ডর দেখান। পোলাপান আমগো কম আছেনি। আপনে আনার আগে আমগো লোক আইবো। আর পুলিশ আইবো সবার শ্যাষে। তাই কই ঝামেলাত আপনেও না যান, আমরাও না যাই। মজা করতে আসছেন করেন, এই তো বয়স আমনেগো। আমগোও কিছু চা পানি খাওয়ার টাকা দ্যান আমরাও যাই গা।”
অরণী ইশরায় রিদমকে টাকা দিতে বলে,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও এখান থেকে বের হতে চায়। রিদম একশো টাকার একটা নোট বের করে দেয়। কিন্তু লোকগুলো হাতে নেয় না। “কী দিলেন, ভিক্ষা? তাই তো কই মাইয়া নি হোটেল না যাইয়া জঙ্গলে আইলেন ক্যান। ফকির পাইছেননি? পাঁচশো দ্যান, আমরা পাঁচজন আছি।”
“পাঁচজন কই, চারজন আপনারা। আর একশো টাকা কম হলো নাকি?”
“না দিলে আমরাও লোক ডাকুম, বলুম পার্কে নোংরা কাম করতাছিলেন, আমরা হাতেনাতে ধরছি। ছবি তুইল্লা নেটেও ছাড়ি দিমু।”
অপমানে আর লজ্জায় অরণীর মনে হচ্ছে মাটির সাথে মিশে যাবে। রিদমও ঘামছে। এত টাকা তার কাছে নেই। পকেটে সম্ভবত আর পঞ্চাশ টাকা আছে। অরণীর কাছে পাঁচশো টাকার নোট আছে, সকালেই বাবা দিয়েছিল, আর কিছু খুচরো টাকা হবে। বাসায় যেতে ভাড়া লাগবে কত কে জানে, কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বের হতে চায়। তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে পাঁচশো টাকা বের করে দেয়। টাকা নিয়ে লোকগুলো সালাম দিয়ে চলে যায়। অরণী গেটের দিকে দৌঁড়াতে থাকে, জীবনে এত খারাপ দিন তার কখনো আসেনি, কী ভেবে এসেছিল আর কী হলো!
রিদমও পেছন পেছন দৌঁড়ায়, “অরু, দাঁড়াও, আমি বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। অরু।”
“একটা কথা বলবা না আমার সাথে। তোমার জন্য আজ আমাকে এতকিছু শুনতে হলো। ছিঃ”
কাঁদতে কাঁদতে রিকশায় উঠে অরণী, রিদম উঠতে চাইলেও দেয় না। রিদমেরও অনেক রাগ ওঠে, অরণী ওভার রিয়াকশন দেখাচ্ছে মনে হয়। “শালা এমন সেনসেটিভ মেয়ের সাথে প্রেম করাই ভুল” মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে সেও উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে।