#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব২
রান্নাঘরে গিয়ে হুমায়রা বুঝতে পারলেন তাড়াহুড়োয় আজ অরণী চা বানাতে ভুলে গিয়েছে। জামিল সাহেব আটটায় বের হবেন, পাঁচ মিনিটের ভেতর চা না পেলে চা না খেয়েই যাবেন, তবে এমনি এমনি না, কিছু তীব্র বাক্যবাণে বিদ্ধ করে তবেই বের হবেন। আর এরপর সারাদিনই এই কথা তুলবেন শাশুড়ি। বিয়ের তেইশ বছরেও এই সংসার আর সংসারের মানুষগুলোর আচরণে পরিবর্তন আসেনি। জামিল সাহেব উচ্চপদস্থ মানুষ, বড় প্রতিষ্ঠানে এডমিনের দায়িত্বে আছেন, কেতাদুরস্ত চলাফেরা। ধনী না হলেও সচ্ছলতা আছে পরিবারে। বাইরে টিপটপ চলাফেরা দেখে বোঝার উপায় নেই ঘরে ওনার ব্যবহার কেমন। অফিসের সবাই ওনাকে ভদ্র, অমায়িক মানুষ হিসেবেই জানেন। এমনকি কাজেও নাকি বেশ সপ্রতিভ। কিন্তু এই মানুষই আবার বাসায় অন্য রকম, বদরাগী, কথায় কথায় শ্বশুরপক্ষকে ছোট করে কথা বলে স্ত্রীকে আঘাত করা, আর সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি বলে সবসময়ই একটা দাম্ভিক ভাব নিয়ে চলা।
“চ্যারিটি বিগানস এট হোম” কথাটা বহুল প্রচলিত হলেও, এর প্রয়োগ বাস্তব জীবনে খুব কম। বাস্তব জীবনে বেশিরভাগ মানুষ সবচেয়ে অমানবিক ব্যবহার ঘরের মানুষদের সাথেই করে। সামর্থ্য থাকার পরও তাদের ডাক্তার দেখাতে অবহেলা করে, কথায় কথায় তীব্র ভাষায় অপমান করে, সঙ্গীকে কষ্ট দিতে তার বাবার বাড়ির লোকদের ছোট করে কথা বলে। আর এই বিষয়টা শুধু যে পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, মুখের বিষে নারীরাও কম যায় না। কণ্ঠে গরল উগড়ে দিতে দিতে সম্পর্কের মিষ্টতা চলে যায় বহুদূর।
“অরণীর আম্মু, চা কী ফুডপান্ডায় অর্ডার দিয়েছিলে? এককাপ চা আনতে এতক্ষণ?”
“মেয়েটা তাড়াহুড়োয় চা বানাতে ভুলে গিয়েছিল। আমি এখন দ্রুত বানিয়ে আনলাম।”
“চা তো মেয়ের বানানোর কথাই না। মেয়েটাকে পড়ালেখা করিয়ে ডাক্তার বানানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু এখন তোমার ঘরের কাজ করতে করতে ভবিষ্যতে কী গতি হবে কে জানে। এত কাজ যখন শিখতেছে আর বিয়েই দিয়ে দেই, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে কাজ করুক।”
“বাসার কাজে একটু সাহায্য করলে মেয়েদেরই ভালো। হঠাৎ করে নিজের সংসারে গিয়ে বিপদে পড়তে হবে না। সব মেয়েই টুকটাক কাজ জানা দরকার, আমিও করছি ওর বয়সে। আর ওকে আমি সবসময় কাজ করতে বলি না। কাল শরীরটা খারাপ ছিল, তাই আজ সকালে অরু নাস্তাটা রেডি করছে।”
অরণীর দাদী রুটি দুধে ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন, বেশিরভাগ দাঁত ফেলে দেওয়ায় ভালো চাবাতে পারেন না। নকল দাঁত বানিয়েছেন, কিন্তু অভ্যস্ত হতে পারেন না। খাবার তাই নরম করেই খান। ছেলে আর ছেলের বৌয়ের কথার মাঝে ঢোকা ওনার পুরনো অভ্যাস। সেই অভ্যাস বশতই বললেন, “হুমায়রা, স্বামীর সাথে মুখে মুখে তর্ক করার সময় দেখি নিঃশ্বাস বন্ধ হয় না। অথচ একদিন আগে দুই পদ রান্না করতেই নাকি শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিলে। শুনো, আমার নাতনি হইলো সুস্থ সবল মেয়ে, তারে যে সংসারে বিয়ে দিব সে সংসার উজ্জ্বল করবে, ডাক্তার মেয়ে আমার নাতনি। তোমার বাপের মতো অসুস্থ মেয়ে কারও গলায় আমরা দেব না, আর ও কোন ফকিরের মেয়ে না যে কাজ শিখে যেতে হবে। নিজে কী কচুর কাজ শিখছো? মাসে বিশ দিন অসুখের নাম করে শুয়ে থাকো, বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে কাজ করাও, বুয়ার পেছনে হাজার টাকা ঢালো। আমার ছেলের কষ্টের কামাই, তোমার গায়ে লাগে না।”
হুমায়রা শাশুড়ির সাথে আর কথা বাড়ায় না। বুয়াকে কয়টাকা বাড়তি দেয় এই হিসেব করলেও, এই সংসারে আর একটা প্রাণীও কাজ করতে চায় না। এই যে অরণীর দাদী বয়স্ক মানুষ, ওনার কাজে সাহায্য করার শক্তি নাই। অবশ্য যখন শক্তি ছিল তখনো করতেন না, সেটা আলাদা কথা। তারপর আছে স্বামী জামিল সাহেব, যিনি বাসায় একটা চামচ নেড়ে খেতে রাজি না। বাপ আর দাদীকে দেখে ছেলেও হয়েছে এমন। ছেলে অমিয় নিজের ঘরের বিছানাটা পর্যন্ত করে না। সে ধরেই নিয়েছে এসব মা বোনদের কাজ, অর্থাৎ মেয়েদের কাজ। ছেলেকে শাসনও করা যায় না, নাতিকে কিছু বলা শাশুড়ি একদম পছন্দ করেন না। আবার বুয়াকে বাড়তি কাজ করিয়ে বকশিস দেওয়াও তাদের ভালো লাগে না, অপচয় মনে হয়। গরমে ঘেমে হাঁপানির টান ওঠে বলে ইদানীং রান্নার কাজের জন্য বুয়া রাখতে হয়েছে, রোজ খাওয়ার টেবিলে বসেই এই নিয়ে একপ্রস্ত কথা শুনতে হয়। সবার মাঝে অরণীটা মায়ের কষ্ট বোঝে, বাসায় থাকলে বাবা আর ভাইয়ের জন্য ভালো কিছু আইটেম বানায়। খালার রান্না কোনমতে চললেও সেটা কারও খেতে ভালো লাগে না। তাই সুযোগ পেলে অরণী ভালোমন্দ রান্না করে। তবে মাকে মেয়ের এই সাহায্যটুকু করাও আবার বাকিদের ভালো লাগে না। কী অদ্ভুত মানব মন।
***
“অরু, চলো আজ রিকশায় যাই। বাসে যা ভীর।”
“রিকশায় গেলে ক্লাস ধরতে পারবো না। বাসে আমিও উঠতে চাই না, ভীর অনেক। চলো সিএনজি নেই। বাবা টাকা দিয়েছে সকালে, ভাড়ার সমস্যা নাই।”
“হুম, আঙ্কেল তো পয়সাওয়ালা মানুষ। কিন্তু আমার বাবার এত বাড়তি টাকা নাই যে সিএনজিতে যাব। বাসার বড় ছেলে আমি, ইন্টার্নশিপটা শেষ হলেই আমাকে ইনকামের পথ খুঁজতে হবে।”
“আর তো কিছুদিন, তারপর আমিও ডাক্তার হয়ে যাব। দু’জন আয় করলে তোমার একার উপর চাপ হবে না।”
“যাহ্, বৌয়ের টাকা কেন নেব? আমার অনেক বড় বড় স্বপ্ন আছে। দেখবা একসময় সফল মানুষদের একজন হবো, তখন বাস না রিকশা ভাবতে হবে না, তোমার জন্য গাড়ি নিয়ে আসবো।”
“আমার এত কিছু লাগবে না। আমি বাস, রিকশা সবকিছুতে চড়তে পারি, তুমি সাথে থাকলেই হবে। তোমার ইন্টার্নশিপ শেষ হলে যখন তুমি একটা কাজ শুরু করবে, আমরা বিয়ে করে ফেলবো, ঠিক আছে? তোমার আমার টোনাটুনির সংসার হবে।”
“আচ্ছা আমার টুনটুনি বৌ। চলো না কোথাও ঘুরতে যাই, আজ ক্লাস না করলে। চন্দ্রিমা উদ্যানে যাবে?”
“আরে না, বাবা জানলে খবর আছে। পচাত্তর পার্সেন্ট পার্সেন্টেজ লাগবো ক্লাসে, পরীক্ষার সময় সমস্যা হবে না হলে।”
“ধ্যুত, কচু হবে। কত ক্লাস বাংক করলাম।”
“তুমি মোটেও ক্লাস ফাঁকি দেওয়া মানুষ ছিলে না। সবাই জানে রিদম হাসান ক্লাসের টপ স্টুডেন্ট ছিল। যত ফাঁকিবাজি গার্লফ্রেন্ডের বেলায়।”
” আরে কী শুরু করেছ, চলো না যাই, একদিনই তো। তোমাকে একটু আরাম করে দেখাও হয় না। কেমন মেঘ করেছে, এখুনি বৃষ্টি নামবে। তোমাকে ময়ূরের রূপে দেখি একটু।”
“ময়ূরের রূপ!”
“হ্যাঁ, বৃষ্টি নামার সময় ময়ূর পেখম মেলে যখন নাচে, তখন তার সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুণ। তুমি তেমনি সুন্দর হয়ে যাও। তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম এমনই বৃষ্টি ভেজা দিনে। কলেজের বাইরে টং দোকানে চা খাচ্ছিলাম, আর তখনই নজরে আসে একটা মেয়ে হাতে একগাদা কদম ফুল নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসছে। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল হাতে সেই মেয়েকে আমার একটা ময়ূূরই মনে হচ্ছিল।”
এই প্রথম দেখার গল্প অরণী বহুবার শুনেছে, তারপরও নানা বাহানায় শুনতে ইচ্ছে করে। এই গল্প যখনই করে, রিদমের চোখগুলো স্বপ্নালু হয়ে যায়। আর অরণী বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ পায়। মনে পড়ে কলেজের হার্টথ্রব সিনিয়র ভাই ওর সামনে এসে বলছে, “তোমার কাছ থেকে একটা কদম নিতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু জানো তো মিথ আছে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল কখনো নিতে নেই, তাহলে বিচ্ছেদ হয়। আর কোন কিছুর বিনিয়মে যে আমি বিচ্ছেদ চাই না।”
খেয়ালের দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফেরে অরণী, “আচ্ছা যাব, কিন্তু কদম দিতে হবে, অনেকগুলো। এখন তো আর বিচ্ছেদের ভয় নেই।”
অরণী হাসে, অরণীর হাসিতে ঢেউ খেলে রিদমের বুকে।
(চলবে)