#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-আট
.
সবশেষে বেলা সফল। ছোটখাটো একটা চাকরি জুটে গেছে কপালে। প্রাইমারি স্কুলের ইংলিশ শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত হয়েছে সে। বেতন খুব আহামরি নয় কিন্তু তার দিন চলে যাওয়ার মতোই। এবার একটু নিজেকে সামলে নিয়ে একটা বাসা খুঁজবে সে। খুশি মনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সে। আজ বাসায় মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবে। হোক ছোট চাকরি তবুও একটা খুশির সংবাদ তার জন্য। সামনে তাকাতেই দেখলো একটা লোক ধাক্কা দিয়ে এক মধ্য বয়স্ক মহিলাকে ফেলে দিল। মহিলাটি বুঝতে পারলো না। ভাবলো হয়তো এম্নেই ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু আসল বিষয়টা বেলার নজর এড়ালো না। সে “হেই” বলে বেশ খানিক পথ দৌড়ে গিয়ে লোকটিকে ধরে ফেললো। স্কুল-কলেজে থাকলে ক্রীড়া সপ্তাহে তার নাম থাকতো সবার মুখে। খুবই একটিভ ছিল সে। দৌড়ে সবসময় প্রাইজ পেতো সে। তবে কালের গহ্বরে সব যেন হারিয়ে ফেলছে সে। আগের চঞ্চল বেলাটিও যেন আর নেই। লোকটিকে ধরতে বেলার অনেক দৌড়াতে হয়েছে। লোকজন জড়ো হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। রোদে ঘেমে বেলার মুখটা চকচক করছে। হাতখোপা করা চুলগুলো খুলে ঝুলে আছে কোনমতে। মুখের উপর কিছু চুল এসে তাকে আরও ভয়ংকর লাগছে। চোখের কড়া চাহনী দেখে যেখানে সকলেই ভয়ে তটস্থ সেখানে এই চাহনীতে কারো বুকে এক আজব রক্তহীন রক্তক্ষরণ ঘটলো। ঠোঁটে না চাইতো ফুটলো এক চিলতে হাসি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধ হয়ে। বেলা লোকটির ঘাড় ধরে টেনে আনলো ভদ্রমহিলার সামনে। মহিলাটি বেলাকে দেখে অবাক হয়েছেন। অস্পষ্ট সুরে বললেন,
-“শুধু শুধু এনাকে ধরতে গেলে কেন মা? চলার পথে ধাক্কা তো লাগতেই পারে!”
বেলা বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
-“খালামনি দেখুন তো আপনার ব্যাগে পার্সটা আছে কিনা?”
কি আজব সম্বোধন! প্রথম দেখায় তো সবাই আন্টি ডাকে। এই মেয়েটা খালামনি ডাকলো? ডাকটা শুনতেই মহিলার মাতৃত্ব যেন জাগ্রত হলো অজানা কারণে। ভীষণ ভালো লেগেছে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে তার। আঁড় চোখে কোথাও তাকিয়ে হাসলেন তিনি। হাতরে ব্যাগে পার্স না পেয়ে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন বেলার পানে। তা দেখে বেলা এক প্রাণখোলা হাসি দিলো। স্বভাবতই তার চোখ মুদে এলো। মহিলাটি এবার যেন স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ভাগ্য এতো প্রসন্ন কেন তার?
-“এই লোকটাকে সাধে ধরিনি খালামনি! এ আপনার ব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছিল তো!”
ভদ্রমহিলা চোরটিকে একটা থাপ্পড় দিলেন। তবে পরক্ষণেই হেসে তার হাতে পাঁচশ টাকা ধরিয়ে দিলেন। বেলা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। কি হচ্ছে তার কিছুই সে বুঝতে পারছে না। মহিলাটি ব্যাগটা নিয়ে লোকটিকে ছেড়ে দিল। বেলা বলল,
-“চোরটাকে ছেড়ে দিলেন কেন? এ নিশ্চয়ই আবার কারো জিনিস চুরি করবে।”
-“চোর কি আর সাধে চুরি করে বেলা?”
বেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-“জি?”
মহিলাটি তাকে আমতা করে বললেন,
-“বলছি দিনের বেলা তো চোর দেখা যায় না। দিনের বেলায় চুরি করছে তার মানে নিশ্চয়ই তার উপায় নেই কোন তাই!”
বেলা আজব লজিকে গললো না। তার কেমন সবকিছু অদ্ভুত লাগছে। অগোছালো বেলাকে দেখে মহিলাটিই বললেন,
-“মা তোমার নাম কি?”
-“অদ্রিশা শেখ বেলা”
-“মাশা-আল্লাহ, যেমন নাম তেমন রূপ!”
বেলা বোকা বোকা চাহনী দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-“মানে?”
-“ভয়ংকর সুন্দর!”
বলেই হেসে ফেললেন মহিলা। পরে আবার নিজেই বললেন,
-“আমি শোভা আহমেদ। জানো তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।”
বেলা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“কেন?”
শোভা আহমেদ বললেন,
-“এই প্রথম কেউ আমাকে খালামনি সম্বোধন করলো। প্রথম দেখায় সবাই আন্টি অথবা আপু সম্বোধন করে। খালামনি সম্বোধন টা মনে গেঁথে গেছে।”
-“এটা আমার অভ্যাস”
বলেই বেলা লজ্জামিশ্রিত হাসি দিলো। শোভা নিজেও হাসলেন। কথা বাড়ালো না আর কেউ। বিদায় নিয়ে দুজন দুদিকে এগিয়ে গেল।
.
হুমায়রা এখন বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। কারণ ছাড়া রাফাতের সামনেও যায় না। আড়ালে কেঁদে বুক ভাসায়। তাদের চার দেয়ালের মাঝের সম্পর্কের তিক্ততা সম্পর্কে কাউকে বুঝতে দেয় না সে। কিন্তু অবহেলা যে মানুষের জীবনে ঠিক কতটা ক্ষতিকর তা যেন হারে হারে টের পাচ্ছে হুমায়রা। চেহারায় নেই আর আগের সেই উজ্জ্বলতা। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আজ তার ছোট ননদ রাইমা হঠাৎ এসে তার দিকে তাকাতেই যেন চমকে উঠেছে। এ কাকে দেখছে সে? এই মেয়েটাকেই বিয়ের প্রথমদিনের সাথে মিলালে মিলের চেয়ে অমিলের সংখ্যাটাই যেন হবে বেশি। রাইমা তাদের সম্পর্কের অবস্থা কিছু হলেও টের পেয়েছে। ভাইয়ের চোখ মুখ দেখে তার মনের অবস্থা বুঝে ফেলার এক আজব ক্ষমতা আছে তার। তাই টুকটাক বিষয় সে কবেই আন্দাজ করেছে। কিন্তু ভেবেছে হয়তো সময়ের সাথে সবটাই ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু না। সে শুনলো কি? ভাই তার রূপসী বউ রেখে আরেক মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তাও জোর করে। এবং মেয়েটি আর কেউ নয় ভাইয়েরই বেস্টফ্রেন্ড বেলা আপু। শুনে সে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিল। সে এটাও শুনেছে বেলা তার ভাইকে সহ্যই করতে পারে না। যার জন্য বিয়ের আগের রাতেই পালিয়েছে সে। তার কাছে সমস্তটাই ধোয়াশা। তাকে জানতে হবে সবটা। অন্তত এই নির্দোষ মেয়েটার জন্য হলেও। হোস্টেল থেকে আজই ফিরে সে সব শুনে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল। তাকে কেউ কিচ্ছুটি বললো না? রাইমাকে দেখে হুমায়রা যেন বেশ মনোবল পেয়েছে। মেয়েটা তার খেয়াল রাখে খুব। এই যে তার শরীরের এতো পরিবর্তন, বাসার কেউ খেয়াল করলো না অথচ মেয়েটা এক দেখাতেই বলে দিলো কত কি! মেয়েটাকে আর ধোয়াশায় রাখা ঠিক নয়। সে ঠিক করলো সবটাই জানাবে রাইমাকে। এম্নিতেও সবাই এটা বুঝতে পেরেছে রাফাত এবং হুমায়রার সংসার জীবন খুব একটা সুখকর নয়। তবে লুকিয়ে আর কি লাভ?
.
“এতটা কাছে… তবুও কেন আড়াল,
কোন সে ভুলে…আজ এই দ্বিধার দেয়াল!
থামিয়ে আঁধার সময় , চাইছে তোমায় হৃদয় !
ভালোবাসি , তাই কাছে আসি ,
ছুঁয়ে আছো এ মন , তুমি এখনো !”
রুমে কারো আগমনে হাতে থাকা গিটারটা থমকে গেলো। আগত ব্যক্তিকে দেখে মৃদু হাসলো। অপর মানুষটিও হাসলো। ভাইকে খুব বেশি একটা গান গাইতে দেখা যায় না। আগে প্রচুর গান গাইতো। কিন্তু এখন মন যখন অত্যধিক ভালো থাকে তখনই শোনা হয় এই কন্ঠ।
-“মন খারাপ কেন?”
-“কোথায় ভাই?”
-“আমাকে বুঝ দিচ্ছিস?”
হালকা হেসে দিলো অপর মানুষটি। পরবর্তীতে গম্ভীর এক আওয়াজে ডাক শোনা গেল,
-“স্পর্শ!”
-“জি ভাই!”
-“তন্নি মেয়েটা ভালো না। তোকে কখনোই সুখী রাখবে না। ভুলে যা ওকে!”
-“ভাই তুমি পারবে ভুলতে?”
-“কাকে?”
-“তোমার ভালোবাসা! তোমার স্বপ্নকন্যাকে!”
(চলবে)..