#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-ছয়
.
মেঘালয়ের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত অমায়িক স্থানটির নাম প্রকৃতি কন্যা জাফলং। বেলা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে৷ উপরে স্বচ্ছ আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের বিচরণ। পাথরের উপর দিয়েই বয়ে চলেছে পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ ও স্থির ধারা। সবুজ পাহাড়ের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ খুঁজে পেলো বেলা। মুগ্ধতায় চোখ দুটো যেন চকচক করছে! মনটা নেচে উঠছে বারবার। যার মনে প্রেম আছে সে যে এই প্রকৃতিতে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য। পিছন ফিরে বেলা তাকালো তার বন্ধুদের দিকে। রাফাতের সাথে হঠাৎই চোখ মিলে গেল তার। হুট করেই অপ্রস্তুত হলো বেলা। রাফাত তারদিকেই তাকিয়ে ছিল। বেলা আবার ফিরে সামনে তাকালো। সবাই নিজের মতো প্রকৃতি বিলাসে ব্যস্ত। বেলা দেখলো হুমায়রা একটা বিশাল পাথরের উপর বসে আছে মনমরা হয়ে। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। এই সুন্দর পরিবেশে তার মন নেই কেন? কেমন স্থির তাকিয়ে আছে। তার নজর অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলো তার উদাসীন নজর রাফাতের দিকে। বেলার ঠোঁটে অজান্তের একটু হাসি ফুটলো। হুমায়রার শিওরে গিয়ে বসলো সে।
-“এই যে ভাবনার রানী! কি ভাবেন এতো? মন খারাপ নাকি?”
ভাবনায় ছেদ ঘটতেই পাশ ফিরে বেলাকে দেখে সে অপ্রস্তুত হাসলো।
-“তেমন কিছু নয় বেলা আপু!”
-“সত্যি তাই?”
-“হ্যাঁ একদম!”
-“তবে কি তোমার চোখদুটোই অবাধ্য?”
অবাক হয়ে তাকালো হুমায়রা। উত্তর দিল না। বেলা মৃদু হাসলো। তার হাসির বিশেষত্বের মাঝে একটি হলো সে হাসলে তার চোখ মুদে আসে। আর এখনোও ঠিক তাই ঘটলো। হুমায়রা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো বেলার দিকে। সে বুঝতে পারছে রাফাত কেন বেলাতে মত্ত!
-“রাফাতকে ভালোবাসো হুমায়রা?”
বুকের ভেতর কেমন ঝড় বয়ে গেলো হুমায়রার। সে তো কখনোই কাউকে বলে নি সে রাফাতকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। তার মনের গোপন কেউ এভাবে বুঝতে পারবে সে ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি। এবারও হুমায়রা নিরুত্তর রইলো। বেলা বুঝে গেলো তার না বলা উত্তর।
-“রাফাতকে বলে দিচ্ছো না কেন?”
শ্বাস আটকে এলো হুমায়রার। ফর্সা মুখখানা যেন মুহূর্তেই পাংশুটে হয়ে গেল। আচ্ছা বেলা কি বুঝতে পারছে না যে রাফাত তাকে ভালোবাসে? নাকি বুঝতে চাইছে না? যেকেউ রাফাতকে দেখলে বুঝে যাবে তার মনের অভিব্যক্তি। বেলা হুমায়রার অব্যক্ত মনের কথা বুঝে গেল অথচ রাফাতের আচরণেই তো বুঝা যায় সে বেলার প্রতি কতটা দুর্বল! হুমায়রার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করলো বেলাকে। তার আগেই এগিয়ে এলো রাফাত। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো হুমায়রার।
-“এই যে ম্যাডামেরা! দুপুর হতে চললো। এবার আমাদের খাওয়া দাওয়া সেরে নেওয়া উচিত। এরপর মায়াবী ঝর্ণার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।”
বেলার টনক নড়লো। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে স্লিপ করে পড়তে নিলে তার হাত ধরে ফেলে হুমায়রা।
-“আপু সাবধানে!”
বেলা হালকা হেসে সম্মতি জানালো হুমায়রাকে। স্মৃতি তার প্রেমিকের সাথে ঘুরছে আশপাশ। সে সাথে করে তার প্রেমিক কেও নিয়ে এসেছে। যদিও তার প্রেমিক কম হবু স্বামীর পরিচয়েই এসেছে। তাই কেউই আপত্তি জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি। সবাই মিলে ঠিক করলো কোন হাইফাই রেস্টুরেন্টে নয় বরং এলাকার হোটেল থেকেই এখানের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাবে। ঘুরতে এসে এটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় বলেই বেলা মনে করে। সিলেটের সবচেয়ে পরিচিত ও বিখ্যাত খাবার গুলোর মধ্যে “বিরইন ভাত” ও “সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস” অন্যতম। সবাই মিলে ঠিক করলো আজ নাহয় এই মুখরোচক খাবার দিয়েই প্রথম ভোজন শুরু করা যাক!
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই মিলে রওনা হলো মায়াবী ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। ভারত সীমান্তে অবস্থিত এই মায়াবী ঝর্ণাটির নাম সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা। স্থানীয় লোকেদের মুখে মায়াবী ঝর্ণা নামেই পরিচিত। জাফলং থেকে সেখানে যেতে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের পথ। বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে এসেছে তারা। যে উদ্দেশ্যে এসেছে তাও সফল। এই স্নিগ্ধ প্রকৃতির সাক্ষাতেই তো এসেছে। আকাশটা এই ফকফকা পরিষ্কার তো এই ধূসর কালো! তারা বিকেল পর্যন্ত পরিবেশটাকে উপভোগ করলো। ঝর্ণাতে নেমে গোসল করলো। তবে বিপদে পড়ল হুমায়রা! তার পরনের কাপড় খুব পাতলা হওয়ায় ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে। অবশেষে ঠিক করলো কোন এক নির্জন জায়গায় গিয়ে পালটে নিবে খুব দ্রুত। বেলা তার ব্যাগ থেকে শাড়ি নিলো। তার হুটহাট শাড়ি পড়ার অভ্যাসটাকে আজ খুবই উপকারী মনে হলো। চারটে গাছের সাথে শাড়ি প্যাচ দিয়ে জায়গাটাকে আবৃত করে দিলো মুহূর্তে! বিনা পেরেশানিতে কাপড় বদলে নিল হুমায়রা। সিলেট শহরে এসে উঠলো একটা হোটেলে। রুম নিলো তিনটা। একটাতে রাফাত, একটাতে বেলা এবং হুমায়রা এবং অন্যটাতে স্মৃতি ও তার হবু বর।
রাতে ক্যাম্পফায়ারের উদ্দেশ্যে তারা হোটেল এর পাশে বাগানে সব ব্যবস্থা করলো। ট্যুরে এসে ঘুমানোর মানে নেই। বরং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই রাত পার করা যাক। সবাই আড্ডাতে মশগুল হয়ে গেল মুহুর্তে। তাদের দেখে হোটেলের আরো কিছু গেস্ট তাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিলো।
সবার মাঝেই স্মৃতি সবাইকে প্রস্তাব দিল ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার জন্য! কেউ রাজি হলো, কেউ অমত পোষন করলো। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খেলবে বলায় সবাইকেই খেলতে হলো। প্রথমেই পড়লো স্মৃতির দিকে। সবাই হইহই করে উঠলো যেমন!
-“এই যে ম্যামোরি এবার বল! তুই কি নিবি? ট্রুথ ওর ডেয়ার?”
স্মৃতি বেশ ভাব ধরে বলল,
-“অবশ্যই ডেয়ার! আমি ভয় পাই নাকি?”
-“ওহ তাই নাকি? আচ্ছা এখন সবার সামনে দুলাভাইকে লাভ বাইট দিয়ে দেখা পারলে!”
রাফাতের এমন কথা হকচকিয়ে গেল সবাই। স্মৃতি তার হবু স্বামীর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিতেই ছেলেটা আতংকিত চোখে তাকাতেই স্মৃতি তার হাত ধরে কামড় বসিয়ে দিলো! কেউই এমন কাজের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওদিকে তার হবু বর সায়েম হাত ঝাকাচ্ছে ব্যাথায়! রাফাত ফুসে উঠে বললো,
-“এটা চিটিং! এটা তো লাভ বাইট না! মনে হলো পাগলা বাইট!”
-“পাগলা বাইট আবার কি?”
হুমায়রার প্রশ্নে রাফাত তার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এই যে কারণ ছাড়া হাতে পায়ে কামড়ানো!”
স্মৃতি হেসে বলল,
-“কিন্তু আমি তো লাভ বাইটই দিয়েছি! এখন হাতে হোক বা গালে! দিয়েছি তো। সেটাই অনেক!”
-“স্মৃতি! কি করলে এটা? ধুর আমি খেলবোই না। তোমাকেও আমি দেখে নেব সময় আসুক শুধু!”
সায়েম উঠে যেতেই স্মৃতিও হেসে উঠে গেলো সায়েম এর কাছে। সে খুব ভালো করেই জানে সায়েম কেন উঠে গেল! অল্প বিষয়ে রাগ করার মতো মানুষ সে নয়!
উপস্থিত সবাই কমবেশি বুঝে তাদের আর ঘাটালো না। থাকুক না শালিক জোড়া একসাথে!
আবার বোতল ঘুরাতেই পড়লো অন্য এক গেস্ট এর কাছে। এভাবে তারা খেলা চালিয়ে যেতে লাগলো। বেশ কিছু পালা শেষ হতেই বোতল এসে থামলো রাফাতের কাছে। সবার জোড়াজুড়িতে ডেয়ার নিল সে। বেলা হুট করেই বলল,
-“হুমায়রাকে প্রপোজ কর!”
এটার জন্য রাফাত মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কি বলছে বেলা এগুলো?
-“অসম্ভব বেলা! আমি এটা কিছুতেই পারবো না।”
সবাই রাফাতকে ফোর্স করতে লাগলো প্রপোজ করার জন্য! তাদের জুটিটা সেই হবে। বেলাকে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে রাফাতের রাগ হলো ভীষণ। হুট করে হুমায়রার হাত ধরে টেনে আনলো তার মুখোমুখি। চোখ দুটো বেলার দিকে রেখেই বলল,
-“আই লাভ ইউ হুমা!”
ব্যস! এই একটা বাক্যই কেমন ম্যাজিকের মতো মনে হলো হুমায়রার কাছে। রাফাত তাকে হুমা সম্বোধন করেছে। খুশিতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। সে জানে এটা খেলার অংশ, তবুও অবাধ্য মন, মস্তিষ্কের বিপরীতে গিয়ে এক অবাধ্য ও নিষিদ্ধ কাজ করে বসলো। হুট করেই হুমায়রা রাফাতের অধরে স্পর্শ করলো গভীর ভাবে। তৎক্ষনাৎ ছিটকে দূরে সরে হুমায়রাকে একটা চড় দিয়ে বসলো রাফাত! হুমায়রাও যেন হতবিহ্বল। সে কি করে ফেললো এটা?
(চলবে)..