#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-পাঁচ
.
আজ সকালের আবহাওয়া বেশ গুমোট। চারিদিকে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি যে সবুজের মাত্রাটা একটু বেশিই বাড়িয়ে তুললো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ যেন এক মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিপাশে। বেলা সেই শাড়ি পরিহিতা অবস্থাতেই ভোরে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। উদ্দেশ্য খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটবে। স্পর্শের সাধিন্য এখন কোনভাবেই সম্ভব নয় তাই ঠিক করলো কিছু ইচ্ছে একা পূরণ করতে কোন বাধা নেই। তাতে হয়তো মনের খুশি বাড়ে বৈ কমে না। সারারাত সে ভেবেছে। নিজেকে সময় দিয়েছে। তার জীবনের গতিবিধি বুঝার চেষ্টায় ছিল বারংবার। অদ্ভুত হয়েও সত্যি স্পর্শ তার স্বপ্নে আসে। শুভ্রবেশে। পুতপুরুষ হয়ে। তবে বাস্তবে কেন সে এতো অচেনা? কাজল লেপ্টানো চোখ দুটো যেন মুহূর্তেই ছলছল করে উঠলো বেলার। স্বপ্নপুরুষ কি তবে স্বপ্নেই ধরা দেবে শুধু? বাস্তবে কি পারবে বেলা তার হাতটা ধরে এই ভেজারাস্তায় হাটতে? পারবে কি তার অভিমানি চোখ দুটোর ভাষা বোঝাতে? ইশ! যদি পারতো! বেলা চোখ দুটো বন্ধ করে আকাশের পানে চাইলো! হঠাৎই মধুর এক ফোটা পড়লো তার চোখের পাতায়, সাথে সাথেই চোখের কোল ঘেঁষে কপোলে গড়িয়ে গেল সেই জল। সাথে বেলার নেত্রের লোনাজল গড়িয়ে পড়াটাও বোধহয় লুকিয়ে গেল সযত্নে।
চোখ খুলেই সামনে নিজের স্বপ্নকে দেখে ভয় পেল বেলা। আনমনেই বলে ফেলল,
-“আপনি?”
মনের মাঝের হাজার উচাটন প্রকাশ করতে চাইলো না সে। সে খুব করে চাইসে এটা স্বপ্ন হলেও যেন সে তার স্বপ্নপুরুষ এর হাতটা এই মুহূর্তটার জন্য হলেও নিজ অধিকারে ধরতে পারে!
.
সকাল সকাল রাফাত তৈরি হচ্ছে বাইরে যাবে। বেশ অনেকদিন ধরেই সে ঘরে খাওয়া ত্যাগ করেছে। হুমায়রার ছোঁয়া সবকিছুতেই যেন সে বিতৃষ্ণা খুঁজে পায়। মাঝে মাঝে নিজেও অবাক হয়ে যায় তার নিজের কর্মে। হুমায়রাকে সে কেন সহ্য করতে পারে না? মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসে। কিন্তু পরক্ষণেই তার বেলার কথা মনে হয়৷ সাথে মনে হয় কিছু বিশ্রী অতীত। যা সে না চাইতেও তার মনকে বিষিয়ে তোলে। সাথে হুমায়রার চেহারা দেখলে যেন সেই পরিমাণটাও বেড়ে যায় অধিকাংশ। কি ক্ষতি হতো যদি হুমায়রা তার আর বেলার মাঝে না আসতো তো? খুব কি ক্ষতি হতো যদি শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এগিয়ে নিতো তো? সে তার ভুল বুঝতে পারছে। পারলে সে অতীতের সেই জঘন্য দিনটা তার জীবন থেকে মুছে দিতো। তার জীবনটা তাহলে এতোদিনে বেলাময় হতো। ইশ! বড্ড ভুল হয়ে গেল।
-“এই সকালে কোথায় যাচ্ছো রাফাত?”
-“যেখানেই যাই তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই। একদম অধিকার দেখাবে না! এটা শুধুই বেলার অধিকার।”
খুব ঘৃণায় ও অভিমানে হুমায়রা যেন ফুসে উঠলো। কি পেয়েছে সে! এই একটা মেয়ে তার জীবনের সব রঙ কেড়ে নিয়েছে! ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে তাকে উধাও করে দিতে। পরক্ষণে মনে হয় সে কি আসলেই তাদের মাঝে এসেছিল? নাকি হুমায়রা নিজেই রাফাতের ভালোবাসায় ভাগ বসাতে চাইছিল? এই বেলার জন্যই তো সে রাফাতকে পেল। নয়তো কখনোই রাফাত তার হতো না। নিজের নিচু ভাবনার জন্য নিজের চোখেই নেমে গেল সে।
রাফাত বিপরীতে কোন উত্তর না পেয়ে চলে যেতে নেয় হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে। হুমায়রা তাকে আটকে বলে,
-“আমাকে কি একটু সুযোগও দেওয়া যায় না রাফাত? ভালোবাসি তো তোমাকে!”
-“হুম! আমিও! ভালোবাসি বেলাকে।”
হুমায়রা কেঁদে উঠলো ডুকরে। এই জীবনে এতো বিষাদ কেন? প্রেমে এতো কষ্ট কেন? এতো যন্ত্রণা যে সে সহ্য করতে পারছে না। স্বামীর মুখে অকপটে অন্য নারীকে ভালোবাসার কথা যেন তার মন মস্তিষ্কে তীরের মতো বিধছে।
রাফাত বেশ সাবলীল ভাষায় বলল,
-“চলে যাও আমার জীবন থেকে। তোমার জন্য সুন্দর একটা জীবন পড়ে আছে। এই নরক থেকে নিজেকে মুক্ত করে চলে যাও!”
-“তুমিবিহীন সুন্দর জীবন চাই না আমার। তুমি থেকে যাও! আমি নরকটাকেই স্বর্গের ন্যায় মনে করবো। শুধু তুমি আমার হও। আমি মুক্ত নয় বন্ধী হতে চাই তোমার প্রেমে। তোমার বক্ষস্থলে মাথা রেখে শান্তিতে নিশ্বাস নিতে চাই! প্লিজ রাফাত! আই লাভ ইউ!”
ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে রাফাতের উচ্চ আওয়াজ শোনা গেল,
-“অসম্ভব! বেলাবিহীন আমি নিঃস্ব!!”
রাফাতে আর থাকে নি হুমায়রার সামনে। তার অশ্রুসিক্ত চোখগুলোও এড়িয়ে গেল সে।
.
মনে পড়ে যায় আজ থেকে দেড় বছর আগের সেই আঁধারঘন দিনটির কথা। বন্ধুদের আড্ডায় হুট করে বেলা প্রস্তাব দিয়ে বসে তারা ট্যুরে যাবে। এবং সিলেটের সবুজ আরণ্যে হারাবে তারা। হুট করেই করা প্ল্যানে সবাইই রাজি হয়েছিল। বেলা, হুমায়রা, স্মৃতি আর রাফাত। সাথে ভার্সিটির আরো কিছু ক্লাসমেটও গিয়েছিল অবশ্য। সব গোছগাছ করে উঠে পড়েছিল উপবন এক্সপ্রেসে। আড্ডায় মাতোয়ারা সকল তরুন-তরুনীর মনেই ছিল উচ্ছ্বাস। গানে গানে পরিবেশটাকে বেশ মাতিয়ে রাখছিল তারা। হুট করে গান ধরেছিল বেলা,
“চেনা শোনার কোন বাইরে,
যেখানে পথ নাই, নাই রে,
সেখানে অকারণে যাই ছুটে!”
প্রথমবারের মতো বেলার গানের কন্ঠ শুনেছিল রাফাত। তার কাছে যেন বেলাএ রিনরিনে কন্ঠস্বর এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে তাকে মাতাল করে তুলল মুহূর্তে। ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো চারিপাশ। সাথে রাফাত নিজেও গান ধরলো,
“চোখ দুটো আকাশের নীলে সাজানো,
ঠোঁটের হাসি তার চাঁদ রাঙানো,
হাজার লোকের ভিড়ে অনন্যা,
যে নিজেই নিজের তুলনা,
সেই মেয়েটি এমন!”
গানের মাঝেই হুমায়রার কন্ঠও শোনা গেল সমান তালে,
“তোমায় যত গল্প বলার ছিলো,
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়ে ছিল,
দাও নি তুমি আমায় সেসন কুঁড়িয়ে নেওয়ার কোন কারণ!”
আনন্দের মাঝেই এমন গানে বেশ মজা নিয়েছিল সবাই। তবে কে জানতো গানের মাঝেই তারা তাদের মনের কথা ব্যক্ত করছিল!
.
সফেদ শার্ট পরিহিত স্পর্শকে এইসময় এইভাবে আশা করে নি বেলা। যেন স্বপ্নটা আজ রঙিন হয়ে ধরা দিল তার কাছে। এও কি সম্ভব? তার প্রশ্নবিদ্ধ নয়ন যেন স্পর্শে রাগ আরও বাড়িয়ে দিল!
-“আপনি এখানে কেন? সেটা আগে বলুন! তাও এতো সকালে?”
স্পর্শর দেখানো রাগে ভ্যাবাচেকা খেল বেলা। এভাবে কথা বলছে কেন লোকটা?
-“এমনি ভেজা রাস্তায় হাটতে আমি পছন্দ করি তাই!”
-“আচ্ছা তাই বুঝি? তা ভেজা শরীরের ভাজটাও বুঝি দেখাতে পছন্দ করেন সবাইকে?”
বেলা যেন শিউড়ে উঠলো এমন ধাচের কথায়। তার তো মাথায়ই ছিল না সে সাদা শাড়ি পড়ে যাছে। বৃষ্টি গুড়ি গুড়ি ফোঁটাও তাকে ভিজিয়ে তুলেছে। শাড়িটা লেপ্টে আছে তার অঙ্গে। আশপাশ তাকিয়ে দূরদূরান্তে কাউকে পেলো না বেলা। তবুও নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে চলে যেতে নিল সে। পিছন থেকে এক বজ্রকন্ঠ কানে এলো তার,
-“ভুলেও যেন আর কখনো এভাবে রাস্তায় বের হতে না দেখি!”
বেলা বিষ্ময় নিয়ে পিছনে ফিরতেই দেখে স্পর্শ যত দ্রুত না তার কাছে এসেছিল তার চেয়ে বহুগুণ দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো সে। বেলার বুঝে আসলো না স্পর্শের এমন অধিকারবোধ দেখানোর কারণ!
(চলবে)..