#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-চার
.
নাস্তা খাওয়ার সময় দেখা হলো স্পর্শ-বেলার। বেলা যেন খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে স্পর্শকে। স্বপ্নে তো লোকটাকে আরো বেশি স্নিদ্ধ লাগে! বেলার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি লেগে আছে। ঝুমা খেয়াল করলো বেলার মনটা আজকে খুবই ফুরফুরে। বিষয় টা তারও ভালো লাগলো। মেয়েটার লাইফে তো এমনি কত ঝড়। স্পর্শকে ঝুমা জিজ্ঞাসা করলো,
-“আম্মুকে বলেছিস তো তুই এখানে আছিস? নয়তো খুবই চিন্তা করবে।”
-“আরে আপু চিন্তা করিস না। এমনি বুঝে গেছে। দুইদিন খুব ঝামেলা করেছি বাসায়। তন্নিকে আম্মু কিছুতেই…”
ঝুমা ইশারায় চুপ করিয়ে দিল ভাইকে। বেলার সামনে পারিবারিক কথাটা বলা শোভনীয় নয় বলেই হয়তো। বেলা হয়তো তাদের না বলা কথা বুঝতে পেরেছে। খাওয়া তৎক্ষনাৎ শেষ করে হাসিমুখে বলল,
-“ঝুমা আপু আমার খাওয়া শেষ। এখন একটু বের হবো। ”
ঝুমাও হেসে সায় দিল। বেলা যেতেই একটু মন কেমন করে উঠল। আচ্ছা বেলা কি কিছু বুঝতে পারলো? স্পর্শ তাকে সুধরে দিয়ে বলল,
-“মেয়েটা কি আমাদের কথায় কিছু মনে করলো? তার তো বোঝা উচিত!”
ঝুমা স্পর্শর কথার পিঠে কিছু বলল না। স্পর্শ উঠে গেল টেবিল থেকে।
বেলা রেডি হতে হতে ভাবলো এখানে এসে কি সে ভুল করে ফেলল? আবার ভাবলো, একটা চাকরি জোগার হলেই সে ঝুমাকে বলে বিদায় নিবে। আর যাই হোক তার আত্মসম্মান প্রবল। ততদিন নাহয় সে দূরে দূরেই থাকলো তাদের থেকে। কিন্তু স্পর্শ? তার থেকে কি সে দূরে থাকতে পারবে?
বাসা থেকে বের হতেই রিক্সা পেয়ে গেল সে। হাতে একটা ঠিকানা নিয়েই রওনা হলো সেখানে।
.
হুমায়রা তার শ্বশুরবাড়ির সবার মন জয় করলেও আজ অবধি রাফাতকে সে নিজের করে পেলো না। তার অবশ্য কারণও আছে। সে রাফাতের জীবনে একপ্রকার জোর করেই প্রবেশ করেছে। হুমায়রা ছিল রাফাতের চেয়ে দুই ব্যাচ জুনিয়র। বেলা ছিল তার এক ব্যাচ জুনিয়র। হুমায়রা প্রথম সাক্ষাতেই রাফাতের প্রেমে পড়েছিল। সেদিন ছিল হুমায়রার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন। সে বেশ ভয়েই ছিল ভার্সিটি জীবন নিয়ে। এবং বিধিধাম! ভার্সিটি গেট পার হতেই সে রাফাতের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিচেই পড়ে গেল। প্রথমে ভেবেছিল রাফাত হয়তো তাকে চড় দিয়ে বসবে বেয়াদব বলে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে রাফাত তাকে হাত ধরে তুলে বলেছিল,
-“নতুন নাকি? সাবধানে হাঁটবে তো!”
ব্যস এইটুকুই যথেষ্ট ছিল রাফাতের প্রেমে পড়ার জন্য তার কাছে। প্রচন্ড শ্রদ্ধাবোধ চলে এলো মনে। তারপর থেকেই রোজ রাফাতকে ফলো করতো সে। এর মাঝেই বন্ধুত্ব হয়ে গেলো বেলার গ্রুপের সাথে। বেলা, রাফাত, বাঁধন, স্মৃতি, আবির আর হুমায়রা। ছয়জনের বন্ধুত্ব ছিল প্রবল, সবাই ছিল ভিন্ন ভিন্ন ব্যাচের তবুও তাদের মেলবন্ধন অনেকেরই অবাক হওয়ার কারণ হতো। বেলা আর আবির ছিল একই ব্যাচের। বিধেয় তাদের বন্ধুত্ব অন্যদের তুলনায় বেশিই ছিল। সময় বদলায় সাথে মানুষের মনও। আজ যে তোমার বেস্টফ্রেন্ড কাল সে অচেনা কেউ। যাকে দেখলেই মন থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তবে যেকোন সম্পর্কই টিকিয়ে রাখতে দুপক্ষের সমান অবদান প্রয়োজন। কথায় আছে এক হাতে তালি বাজে না। আসলেই তাই! কোন সম্পর্ক ভাঙার পেছনে অবশ্যই দুইজনই সমান অংশীদার থাকে। তবে হয়তো সেটা কারো মনেই আসে না। হুট করে একদিন বেলাকে প্রপোজ করে বসলো আবির। বেলা হতবাক চেয়ে ছিল। সে মানতে পারছে না। যাকে সব সময় ভাইয়ের আসনে বসিয়ে এসেছে হুট করে সে তাকে প্রেমিকা হিসেবে চাইছে, বিষয়টা তার জন্য হয়ে উঠলো জটিল। সে বুঝাতে চাইলো আবিরকে কিন্তু আবির বুঝতে নারাজ। তার বেলাকে চাইই চাই। বেলা শেষে বিরক্ত হয়ে বলেছিল সে অন্যকাউকে ভালোবাসে। কিন্তু আবির তাও মানতে চাইলো না। তার ধারণা বেলার প্রেমিক থাকলে সে অন্তত জানতো।
-“বেলা আমি তোকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। আর শুধু শুধু মিথ্যে কেন বলছিস? তোর রিলেশন থাকলে আমি অবশ্যই জানতাম!”
-“আবির! বিষয় টা আমিই লুকিয়েছি। প্লিজ এবার অফ কর। আমার ভালো লাগছে না।”
-“নো! আই কান্ট স্টপ! আই হ্যাভ টু নো এবাউট দিস! তুই কাকে ভালোবাসিস? এক্ষুনি আমাকে বলতে হবে নয়তো তোকে আমি কিছুই ছাড়বো না।!”
বেলা নিরুপায় হয়ে বসে রইলো। তার অসহায় লাগছে খুব। বন্ধুত্ব বাঁচাতেই সে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিল তবে এবার কিভাবে প্রমাণ করবে সে। সেই মুহূর্তে রাফাত এসে আবিরকে বলেছিল,
-“বেলা আমার গার্লফ্রেন্ড! ও আমাকে ভালোবাসে।”
এমন একটা কথার জন্য আবির বেলা কেউই প্রস্তুত ছিল না। তবে রাফাতের দিকে বেলা তাকাতেই আড়ালে তাকে চোখ টিপি দিয়েছিল সে। তাতেই বেলা বুঝলো তাকে রাফাত সাহায্য করতে চাইছে। সেও তার কথায় কথা মিলাতে লাগলো। আবির বাধ্য হয়ে সব মেনে নিয়ে সেই যে বন্ধুত্ব ভাঙ্গলো আজও সে আসে নি তাদের সামনে। হয়তো লজ্জায় বা অভিমানে!
সেদিন হুমায়রা খুব কান্না করেছিল। রাফাত এর মনে যে খুব আগে থেকেই বেলার বসবাস বুঝতে বাকি রইলো না তার। তবে অবাধ্য মন কি তা মানে? তারপরও সে লুকিয়ে লুকিয়ে রাফাতকে দেখতো৷ আবিরের কান্ডের পর থেকেই তাদের বন্ধুত্বটা বেশ নড়বড়ে দেখা গেল। বাঁধন যুক্ত হলো অন্য গ্রুপে। সেখানেই বেশি সময় তাকে দেখা যেতো। বাকি ছিল বেলা, স্মৃতি, রাফাত আর হুমায়রা। এরপর যা ঘটেছিল তা মাথায় আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো হুমায়রা৷ তার সারা শরীর ঘামে ভিজে। তার মাথা ঘুরছে। ঘনঘন নেওয়া শ্বাস প্রশ্বাস প্রকাশ করছে তার ভয়ের পরিমান।
.
সারাদিন বাইরে পাগলের মতো ঘুরেছে বেলা একটা চাকরির জন্য৷ বেশ কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ ও দিয়েছে। তবে চাকরি হওয়ার চান্স খুব কম। কল্পনার দুনিয়াটা বেশ রঙিন হলেও বাস্তব জীবনটা বেশ জটিল। বাবার ছায়াতল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলেই যেন পৃথিবীসম অসহায়ত্ব নেমে আসে ধরনীতে৷ সে সাথে রাস্তাঘাটে মেয়েদের দুর্গতি তা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। রাস্তায় এক ভদ্রমহিলাকে সাহায্য করতে গিয়ে দু জায়গায় ইন্টারভিউ মিস করেছে সে। সন্ধ্যায় ঝুমার বাসায় আসে বেলা। কলিং দিতেই দরজা খুলে দেয় স্পর্শ। সে যেমন বেলাকে দেখেই নি। খুলে দিয়ে সাথে সাথেই চলে গেল নিজের রুমে। বেলা বেশ অপমানিত বোধ করলো৷ এটা কেমন ভদ্রতা! পরে ভাবলো হয়তো জরুরি কোন কাজও থাকতে পারে। পরক্ষণেই ভাবলো সে কি বেলার প্রতি বিরক্ত? বেলার মন খারাপ হয়ে গেল। ক্লান্তি ঠেলে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। ঝুমা খেতে ডাকলেও সে খেয়ে এসেছে বলে আর গেল না। ভেবে রেখেছে সকালেও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাইরে খাবে সে। এম্নিতেই তো এখানে এসে তার ঝামেলা করে দিলো এখন যদি নিত্য নিত্য তাদের অন্নেও ভাগ বসায় তবে ঋনের পরিমানটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে যাবে। বোকা মেয়ে বুঝলো না রিজিকদাতা আল্লাহ। তিনি কারোর রিজিক থেকে নয় বরং সবাই নিজ নিজ রিজিক থেকেই পায়। অভিমান নিয়ে বসলো ছোট্টমনে। আনমনেই সে ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি নিয়ে পড়ে ফেলল। ছোটবেলার অভ্যেস বলে কথা। মন খারাপ হলেই হুট করে শাড়ি পড়ে ফেলে সে। সাজবিহীন শাড়ি পরিহিতা বেলাকে কাজল চোখ ও খোলা চুলে লাগে অপ্সরার মতো৷ তবে সেই সময় তার নিজেকে দেখতেও ইচ্ছে হয় না। চুপ করে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। যেমন আজও বারান্দায় এসে আকাশ দেখতে লাগলো সে।
.
মোবাইলের স্ক্রিনে “প্রিয়-সে” লেখাটি ভেসে উঠতেই স্পর্শের ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা দেখা গেল। কল রিসিভ করেই প্রথমে বলল,
-“ভালোবাসি প্রিয় তুমি!”
-“উফফ স্পর্শ ঢং কম করো! ভালো লাগে না আমার।”
-“এমন করে কেন বলছো তন্নি? আমি তো চেষ্টা করছিই।”
-” কি কচু যে করছো জানা আছে। তোমার মা! সেকি ইহজনমে আমাকে মানবেন? বুড়ো হয়ে এক পা কবরে চলে গেল তাও তার ছেলের জীবনে এতো হস্তক্ষেপ এর মানে কি?”
-“এইসব কি বলছো তন্নি? হ্যাভ ইউ লস্ট ইট? আমার মায়ের সম্পর্কে এমন কথা বলার সাহস কি করে হয় তোমার? ভালোবাসি বলে এই না আমার মায়ের নামে তুমি যা তা বলবে!”
ওপাশ থেকে তন্নির খুব করুণ সুর শোনা গেল,
-“আসলে বাবু! আমি খুবই রেগে গিয়েছিলাম। সরি। আমি তোমার মা কে এমন বলতে চাইনি। আসলে বাসা থেকে খুব প্রেশার দিচ্ছে তো! তাই আরকি! আমি আর এমন কখনোই বলব না। সরি!”
-“প্লিজ ফোনটা রাখো, আমার মেজাজ ভালো নেই।”
ব্যস স্পর্শ নিজেই কল কেটে দিল। আস্তে করে বাসার নিচে চলে গিয়ে হাঁটতে লাগলো নির্জন রাস্তায়। সোডিয়ামের লাইটগুলোতে রাস্তা যেন এক মায়ার শহরে পরিনত হয়েছে। আশপাশে পাহাড় থেকে ঝিঁঝিঁর শব্দ ভেসে আসছে কানে। হাঁটতে হাঁটতেই উফফ বলে বিরক্তি প্রকাশ করেই উপরে তাকালো সে। বারান্দায় এক সফেদ শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে কেশবতী এক কন্যা। আকাশের পানে তার মায়াবী মুখশ্রী। কোন কারণে সে ভার করে রেখেছে সেটি। চোখে যেন জ্বলজ্বল করছে দু’ফোটা জল। কাজল কালো চোখ দুটি দেখে এক অদ্ভুত শিহরণ হলো তার মনে। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তার,
-“পরিপূর্ণ মায়াবী কন্যা!”
(চলবে)..