#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম

পর্ব-তিন

.
ঘর অন্ধকার করে রকিং চেয়ারে বসে রাফাত ভাবছে বেলা ঠিক কোথায় যেতে পারে। চোখ বন্ধ করলেই যেন বেলার চেহারাটাই ভেসে উঠে তার চোখে। বেলার হাসির রিনঝিন শব্দ তার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। বেসামাল হয়ে পড়ে তার ব্যাকুল মন। হঠাৎ করেই মনে হলো তার আগের দিন। কোন একটা ফুটবল ম্যাচ ছিল ভার্সিটিতে। খেলতে খেলতে হঠাৎই এক শ্যামাবতীর গায়ে লাগলো ভুলবশত। চোখ বড় করে এগিয়ে গিয়েছিল সে। ক্ষমা চাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেও বেলার অগ্নিচোখ দুটো গায়েল করেছিল তাকে। বেলা অসম্ভব রেগে গিয়েছিল সেদিন। চড় মারাই বোধহয় বাকি ছিল। তবে গালির বহর শুনেও যে কারো উপর ক্রাশ খাওয়া যায় রাফাত বুঝেছিল তা।

-“এই যে মিস্টার! মানুষজনকে কি চোখে পড়ে না? আজ আমার জায়গায় একটা বাচ্চা থাকলে কি হতো?”

-“শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? আচ্ছা অসভ্য তো। আমি এখানে গালাগালি করছি আর উনি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে! আরে বয়রা নাকি! ফালতু মানুষজন!”

রাফাতের ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা আরো রাগিয়ে দিয়েছিল রাগান্বিত বেলাকে। সে ফুটবল টা রাফাতের মাথা বরাবর ছুড়ে হনহন করে হেঁটে গিয়েছিল। ফুটবলের বারি খেয়েও তব্দা মেরে ছিল রাফাত। তার বন্ধুমহলের সবাই বুঝেছিল রাফাত এবার গোল দিয়ে নয় গোল খেয়ে বসে আছে। সে নিয়ে হাসাহাসি ও হয়েছিল প্রচুর।

হঠাৎ দরজার শব্দে ভাবনায় ছেদ ঘটলো রাফাতের। অন্ধকারেও বুঝলো কে এসেছে। হুমায়রাকে এখন তার আপাদমস্তক মুখস্ত হয়ে গেছে। হুমায়রা রাফাতের কাছে এগিয়ে এসে দেখলো তার চোখ বন্ধ। রাফাত মূলত হুমায়রাকে এড়িয়ে চলতেই ঘুমের ভান ধরেছে। রাফাত টের পেল হুমায়রা তার খুব কাছে চলে এসে কপালে চুমু খেল। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের পানি পড়লো রাফাতের গালে। হুমায়রা খুব ধীর কন্ঠে বলল,

-“খুব ভালোবাসি রাফাত। তোমার স্ত্রী হয়েও স্ত্রীর অধিকার পেলাম না। হয়তো কখনো পাবোও না। তবে তোমাকে ভালোবেসে পুরো জীবনটাই তোমায় দিলাম, আবারও ভালোবাসি প্রিয়।”

তৎক্ষনাৎ রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। এখানে কান্না করলে রাফাত জেগে যাবে। তাকে আবার গালমন্দ করবে। এদিকে হুমায়রা যেতেই রাফাত চোখ খুলে তাকালো। কপালে হাত ছুইয়েই রাগ উঠলো তার। এতো ন্যাকামোর কি প্রয়োজন! তার জীবন থেকে সব রঙ ছিনিয়ে নিয়ে এখন ভালোবাসি বলে মুখে ফ্যানা তোলার মানেই হয় না। তার জীবনের রঙ শুধুই বেলা। অন্যকেউ না। কেউ না। তার বুক জ্বলছে। খুব বাজে ভাবে পুড়ছে ভেতরটা৷ তার যে বেলাকে চাই। শুধুমাত্র বেলাকেই চাই। কোথায় পাবে তাকে? ফোন হাতে নিয়ে বেলার নাম্বারে ফোন দিল সে, তবে প্রতিবারের মতো একই উত্তর এলো,
“আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে, অনুগ্রহ করে কিছুক্ষন পর আবার চেষ্টা করুন।”

রাগে ফোন ছুড়ে মারলো রাফাত। মেঝেতে পড়তেই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল।

.
মাঝরাতেই মুশলধারে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির ফোঁটা মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙ্গলো বেলার। মাথার কাছের জানালাটা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছিল সে। উঠে জানালাটা লাগাতে যেতেই হঠাৎ থেমে গেল সে। বৃষ্টি তার ভালো লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে ভিজে নেক একটু! নিজের বাসা হলে এক্ষুনি ছুট লাগাতো ছাদে। এখানে তা সম্ভব নয়! বেলা একটু হেসে বারান্দায় দাড়ালো। বৃষ্টির ঝাপটা এখানেও আসছে তবে কম। বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে উপর থেকে নিচ অবধি বন্ধ। খোলা হলে বেশ হতো৷ বেলা রাস্তায় তাকালো। স্ট্রিট লাইট গুলো জ্বলছে, তাতে যেন বৃষ্টির অন্যরকম এক সৌন্দর্য ধরা দিল তার কাছে। দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কখন যে রাত পোহালো সে টেরই পেল না। ফজরের আজান কানে আসতেই সে ভেতরে এসে ওযু করে নিল। সৃষ্টিকর্তার কাছে এখন তার অনেক কথা বলার আছে, অনেক কিছু চাওয়ার আছে।

.
নামাজ শেষ করে বেলা রান্নাঘরে গেল। ঝুমা সোহানকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। আজ সকালটা বৃষ্টির মাধ্যমেই শুরু হলো তাই ঘুমটাও যেন সবারই বেশ ভালো করেই ঝেঁকে বসলো। বেলা যেহেতু জেগেই আছে সকালে নাস্তা বানানো যেতে পারে। রুটি, সবজি এবং ডিম ভাজি। সোহানের জন্য বানানো হলো পাস্তা। বাচ্চাটা পাস্তা খেতে খুব পছন্দ করে। কাজ শেষ করে উঠতে না উঠতেই বেল বাজলো কলিং এর। এতো সকালে তাও বৃষ্টির মাঝে কে আসবে! বেলা ইতস্তত করছে দরজা খুলতে। ওই যে কথায় বলে না চোরের মনে পুলিশ পুলিশ! স্বাভাবিক কাজেও সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাফাতকেই সন্দেহ করছে। এর মাঝেই ঝুমা উঠে এলো। বেল বাজতেই আছে। আরে আজব! এই ভোর সকালে সবাই ঘুমায়৷ অবুঝের মতো বেল বাজানো খুবই অন্যায় বলে মনে হলো বেলার। ঝুমা বেলাকে দেখে বলল,

-“কে এসেছে বেলা?”

-“আপু আমি জানি না। দরজা খুলি নি।”

-“ওহ আচ্ছা”

বলেই ঝুমা এগিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলতেই কেউ একজন জড়িয়ে ধরলো ঝুমাকে।

-“আপুউউ! তুই এতো নিষ্ঠুর! তোর এই ছোট্ট ভাইটাকে তুই এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলি?”

ঝুমা হতভম্ব। তার ভাইয়ের পিঠে ধুমধুম দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলল,

-“ছাড় শয়তান! ভিজিয়ে দিল একদম। এইভাবে ভিজে কাক হয়ে এসেছিস কেন? গাড়ি ছিল না? আর হঠাৎ এখানে?”

ছেলেটি প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল,

-“অফিস থেকে এসেছি সোজা। মাঝে নো দাঁড়ানো। এবার আমাকে ভেতরে যেতে দে দাদীআম্মা!”

ঝুমাও হেসে বলল,

-“গোসল করে নে নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।”

এতোক্ষণ নিরব দর্শক এর ন্যায় তাকিয়ে ছিল বেলা। ছেলেটিকে দেখে তার চোখের পলকই পড়ছে না। এও কি সম্ভব?

ঝুমাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতেই বেলাকে নজরে এলো ছেলেটির। ছেলেটিও বেশ অবাক।
ঝুমা বুঝতে পেরে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের।

-“বেলা! এইটা আমার ছোট ভাই স্পর্শ আহমেদ।”

-“আর স্পর্শ এটা প্রিয়তা শেখ বেলা। আমার বান্ধবীর কাজিন।”

পরিচয় শেষে স্পর্শ এগিয়ে এসে হঠাৎই বলল,

-“আপনি সেই ধাক্কা লেগে পড়ে যাওয়া মিস নন?”

বেলা অবাক হলো৷ সে বুঝতে পারছে না।

-“আরে রাস্তায় তাড়াহুড়োর জন্য আপনার সাথে ধাক্কা লাগলো, আপনি পড়ে গেলেন, মনে পড়েছে?”

বেলার চোখ কুঁচকে এলো। তাহলেই এই সেই আজব পুরুষ! স্পর্শ আবার অপরাধীর মতো করে ক্ষমা চাইলো বেলার কাছে।

-“আসলে আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেই নি। তাড়াহুড়োয় ছিলাম। তাই খেয়াল করি নি। আর আপনাকে ভালো করে কিছু জিজ্ঞাসাও করা হয় নি তখন। আপনি কি বেশি ব্যাথা পেয়েছিলেন মিস?”

বেলার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কি মিস মিস করছে! নিজেকে সামলে বেলা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। স্পর্শ যেন হাফ ছাড়লো বেলার উত্তরে।

-“ওকে পরে কথা হবে মিস।”

বলেই স্পর্শ রুমে চলে গেল। এদিকে বেলা এখনো অবাকের শীর্ষে। আনমনে মুখ ফুটে বলল,

-“স্বপ্ন পুরুষ!”

কিছু একটা মাথাতে আসতেই আনমনে বেলার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। এগিয়ে গেল তার জন্য বরাদ্দকৃত গেস্ট রুমে। সেই থেকে ভেবেই চলেছে,

প্রকৃতি কি তাকে চমকে দেওয়ার চেষ্টায় আছে। কিছু মনে হতেই আয়নার সামনে যেতেই বিরক্তিতে মুখ দিয়ে চ শব্দ বের হলো। তার চোখে কাজল নেই। আজই সে ভুলে গেল কাজল দিতে? তার স্বপ্ন পুরুষ যে তাকে কাজলে দেখতেই পছন্দ করে! বেলা আনমনা হয়ে বলল,

-“স্পর্শ-বেলা!”

(চলবে)..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here