#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-দশ
.
শুভ্র ছাতা মাথায় ধরে বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে পূণ্য। অস্থির চোখদুটো খুঁজে চলেছে কিছু। কুঁচকানো ভ্রু যেন ভাসা ভাসা চোখদুটোর সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। হুট করে বৃষ্টি নামায় সে মোটেও খুশি নয়। হুটহাট নামা বৃষ্টি তার পছন্দ নয়। তার পছন্দ হাড়কাঁপানো শীত। তাইতো শীত পড়তেই সাজেক চলে যায় প্রায়শই। এই যে অফিস যাবে কিন্তু একটা যানবাহনের টিকি টাও পাচ্ছে না সে। এর জন্য সে মহাবিরক্ত। চোখ ছোট ছোট করে যাত্রীসহই একটা রিকশা দেখা গেলো। সে বোঝার চেষ্টা করলো মানুষটি কে? তাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে। কাছে আসতেই তার চোখমুখে উজ্জ্বলতা ফিরে পেলো। সে ছাতাসমেত দৌড়ে গিয়ে রিক্সা থামালো।
-“এই যে মিস্টার ছোঁয়াছুঁয়ি! রিকশাটা থামান।”
রিকশা থামতেই পূণ্যর ঠোঁটে ফুটলো হাসি এবং যাত্রীর মুখে বিরক্তির ছোঁয়া। স্পর্শকে যথাসম্ভব সাইড চাপিয়ে সে চড়ে বসলো রিকশাতে। স্পর্শ বিরক্ত হয়ে বলল,
-“আপনি আমার রিকশায় চড়ে বসলেন কেন? অন্য কোন রিকশা নিন।”
পূণ্য হেসে জবাব দিলো,
-“যেখানে গন্তব্য এক, সেখানে আলাদা যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি মিস্টার ছোঁয়াছুঁয়ি? একসাথে পথচললে মনের দূরত্ব ও কমে আবার ভাড়াও!”
স্পর্শ ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“প্রথমত আপনি আমাকে এই নামে কেন ডাকছেন? আপনাকে শতাধিক বার বারণ করেছি। আমার নাম স্পর্শ! স্পর্শ! ছোঁয়াছুঁয়ি কি? আর গন্তব্য এক হলেও আমাদের ঠিকানা এক নয়। আর কখনো হবেও না। আজ বৃষ্টি বেশি বিধেয় সহ্য করছি আর এমন কাজ দ্বিতীয় বার করবেন না।”
পূণ্য স্মিত হেসে বলল,
-“এই গন্তব্যই যদি স্থায়ী ঠিকানা হয় তবে কেমন হবে বলুন তো মিস্টার ছোঁয়াছুঁয়ি?”
স্পর্শ হার মেনে শ্বাস ছাড়লো। এই মেয়ে হাড়ে বজ্জাত। কোনো কথা সে মাটিতে পড়তে দিবে না। তার চেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়। বাকিটা পথ কেউই আর কোন কথা বলল না। তবে এই প্রথম পূণ্যর বৃষ্টি ভালো লাগলো। মন বললো এই বৃষ্টি আবার নামুক। প্রতিটা বৃষ্টিস্নাত দিন যেন এমনই কাটে!
.
এক ধ্যানেই শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে বেলা। তার আপাতত আশেপাশে খেয়াল নেই। কেন সে বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে তা নিজেও জানে না। শুদ্ধ এবার বেশ অপ্রস্তুত হলো। মেয়েটা এভাবে তাকিয়েই কেন আছে? সে তো ভেবেছিল লজ্জায় তার দিকে তাকাতেও পারবে না এখন তো দেখছে সব উল্টো। সে এবার জোরেসোরে গলা খাকাড়ি দিলো। বেলা এবার সত্যি লজ্জায় গুটিয়ে গেলো যেমন। ক্লাস শেষ করে শুদ্ধকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে সে। শুদ্ধ নিজেই তাকে নিয়ে এসেছে। তারও বেশ কৌতুহল জন্মায় বিধেয় শুদ্ধকে আর মানা করে নি। তবে সে এখনো দ্বিধায় আছে এটা কি স্পর্শ নাকি অন্যকেউ! বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব পাড় করে সে জিজ্ঞাসা করলো,
-“আপনি কি ঝুমা আপুকে চিনেন?”
শুদ্ধ এবার হেসে দিল। যেন তাকে কেউ হাসির গল্প বলেছে। বেলা চোখ ছোট করে তাকালো।
-“বেলা আপনি এতো কিউট কেন?”
হকচকিয়ে গেল বেলা। শুদ্ধ এবার বেশ গম্ভীর হয়ে বলল,
-“নাম শুনেও বুঝেন নি আমি স্পর্শ আহমেদ এর ভাই শুদ্ধ আহমেদ। আর ঝুমা আহমেদ আমার বড় বোন।”
বেলাকে বিভ্রান্ত দেখা গেল। আনমনেই বলল,
-“ঝুমা আপু তো আমাকে কখনো বলে নি তার আরেকটা ভাই আছে!”
আস্তে বললেও কথাটা কানে গেল শুদ্ধের। মুগ্ধ হয়ে বেলার দিকে তাকিয়েই বললো,
-“হয়তো সুযোগ পায় নি।”
বেলা হুট করে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো শুদ্ধের সাথে। নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করলো,
-“তা আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি মিস্টার শু-দ্ধ? শুদ্ধ!”
শুদ্ধ করুণ চোখে তাকালো ক্ষণিকের জন্য।
-“নামটা কি বেশি কঠিন?”
বেলার হাসি পেলো শুদ্ধের করুণ চাহনী দেখে। তবুও নিজেকে সামলে মাথা দুদিকে দুলিয়ে দ্রুত মুখে বললো,
-” না! না! একদম কঠিন নয়। শুধু একটু ভিন্ন আরকি!”
শুদ্ধ স্বাভাবিক হয়ে বললো,
-“না মানে আমার ভাই স্পর্শ বলছিল আপনি আমাদের আপার বাসায় থাকেন। এবং আপার সাথে বেশ ক্লোজও বটে। সামনে আপার জন্মদিন৷ তাই চাইছিলাম একটু সারপ্রাইজ দিবো।”
বেলা অবাক হয়ে বললো,
-“এর জন্য আপনি আমার সাহায্য কেন চাইছেন? আপনার ভাইই তো পারবে সাহায্য করতে!”
-“হ্যাঁ পারতো। কিন্তু সাহায্য টা আপনারই প্রয়োজন। আপা আমাদের থেকে সাত বছরের বড়। আমি এবং স্পর্শ দুজন জমজ। আমি স্পর্শর থেকে পয়ঁতাল্লিশ মিনিটের বড়। স্পর্শ যেমন চঞ্চল আমি ঠিক তার উল্টো। খুবই গম্ভীর মানুষ। সবসময় নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না। স্পর্শ আপার যতটা কাছের, আমার আর আপার দূরত্ব টা ঠিক ততটাই। এই দূরত্বটা ঠিক কেন তৈরি হয়েছে তা আমার অজানা। তবে আপা আমাকে আর স্পর্শকে কখনোই আলাদা চোখে দেখেন না। আর সারপ্রাইজ টা কোন ছেলের জন্য হলে অবশ্যই স্পর্শ সাহায্য করতে পারতো কিন্তু যেহেতু আপাকে দিবো তাই আপনার সাহায্যটাই এখন প্রয়োজন আরকি!”
বেলা সব শুনেও ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে। বিষয়টা তার গোলমেলে ঠেকছে। স্পর্শ যেহেতু ঝুমার কাছের তাহলে সেই তো বলতে পারবে ভালো। বেলা সন্দিহান চেয়ে বললো,
-“কি সাহায্য বলুন! আমি চেষ্টা করবো।”
শুদ্ধর ঠোঁটে হাসি ফুটলো। সে বেশ ভালো করেই জানে বেলা তাকে সন্দেহ করছে। এবং সন্দেহ সঠিকও। তবুও শাক দিয়ে সে মাছ ঢাকার চেষ্টায় আছে। স্পর্শকে খুব মনে পড়ছে তার। স্পর্শ তার জায়গায় থাকলে খুব সুন্দর করে সবটা সামলে নিতো। বেলাকে নিয়ে সে একটা শপিংমলে গেলো। হাঁটতে হাঁটতেই বেলা শুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলো,
-“আপনারা দুজন দেখতে অবিকল এক। আমি জানতাম না বিধেয় প্রথমে বেশ চমকে গেছি।”
শুদ্ধ কিছু না বলে হাসলো। বেলার ধুকপুক করা অস্থির হৃদয় যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন তো কখনো হয় নি বেলার। এমনকি স্বপ্নেও নয়। এখন এমন অবশ লাগছে কেন নিজেকে? মনের মাঝে হাজার ও প্রশ্নের ছড়াছড়ি। বেলা একটু একটু করে জানার চেষ্টায় আছে শুদ্ধকে।
-“আচ্ছা আপনাদের সবাই কিভাবে চেনে? কে স্পর্শ আর কে শুদ্ধ কিভাবে সনাক্ত করে?”
শুদ্ধ পূর্ণ চাহনী ফেললো বেলার চোখে।
-“ড্রেস আপ! আমি সমসময় ফরমাল সাদা শার্টেই থাকি আর স্পর্শ ঝলমলে কাপড় পছন্দ করে। বলতে গেলে আমি একটু ব্যাকডেটেড আর স্পর্শ আধুনিক। আমার গম্ভীরতা আর স্পর্শের চঞ্চলতা দেখে নিমিশেই চিনে ফেলে সবাই।”
বেলা থমকালো। আড়চোখে তাকালো শুদ্ধর দিকে। মনের মাঝে এতো শঙ্কা কেন? হাঁটার মাঝেই পা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো সে,
-“আপনার গার্লফ্রেন্ড বা বউ নেই?”
শুদ্ধ হাসলো বেলার কৌশল দেখে। খুবই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,
-“আছে তো।”
মুহুর্তেই বেলার মন যেন ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। শুদ্ধ বেলার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলো।
.
দীর্ঘ ছয়মাস খোঁজাখুঁজির পর ব্যর্থ রাফাত মনের জোর হারাতে বসলো। ঢাকার আনাচে কানাচে কোথাও বাকি রাখে নি। কিন্তু বেলা উধাও। রাফাত ভালো করেই বুঝলো বেলা ঢাকাতে নেই। কিন্তু কোথায় যেতে পারে? এই ভেবেই তার অস্থির মন। এদিকে এক ছাদের তলায় থেকে হুমায়রাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাও যেন দায়। মেয়েটাকে আজকাল বেশ মলিন মনে হয়। অসুস্থ নাকি? এইক্ষনে ভাবে একবার জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে বসে সেই কথা। নিজেকে কাজের মাঝেই বেশিরভাগ ডুবিয়ে রাখে সে। রাফাতের মা ঘরে এসে ছেলের পাশে বসলেন।
-“রাফাত তুই কি চাস একটু বলবি? আমাকে কি তুই একটু শান্তিও দিবি না?”
-“কি হয়েছে মা?”
-“কি হয়েছে আবার জিজ্ঞাসা করছিস? ওই এক মেয়ের জন্য আমার পুরো সংসার তুই ছারখার করে দিচ্ছিস! আমি মেনে নিতে পারছি না।”
রাফাত করুণ চোখে তাকালো মায়ের দিকে।
-“মা! আমি ওকে ভালোবাসি।”
-“কিন্তু বেলা তোকে ভালোবাসে না। তাকদির বলতেও কিছু আছে! এটা কেন ভুলে যাস? বেলা তোর তাকদিরে নেই। যে আছে সে স্বয়ং তোর স্ত্রী রূপে। তাকিয়ে দেখ মেয়েটার দিকে। অবহেলায় যেন মূর্ছা যাচ্ছে সে। আমি মেয়েটার দিকে তাকাতে পারছি না অপরাধবোধে। মেয়েটা আমাদের কাছে ঠাই খুঁজতে এসেছে। কম ছিল না মেয়েটার কাছে। বাবা মায়ের সাথে যুদ্ধ করে সে তোর সাথী হতে চেয়েছে। এটাই তার দোষ?”
-“মা তাকে আমি অনেকবার বলেছি চলে যেতে। কেন যাচ্ছে না আমার জীবন থেকে? কি চায় সে আমার কাছে?”
-“একটু ভালোবাসা। হুমায়রার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখ তো।”
পরক্ষণেই রাফাতের মা আফসোসের সুরে বললেন,
-“ওহ! কাকে বলছি কি? সে নিজেও তো একই পথের যাত্রী! তুই যতটা অবহেল হুমায়রাকে করছিস তার সবটাই তো প্রকৃতি তোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। তোর জন্য আফসোস হয়। ঘরে হীরে রেখে তুই কাঁচের পিছনে ছুটছিস। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝতে চেষ্টা করো রাফাত। হারালে কিন্তু সারাজীবন কাঁদলেও পাবে না।”
কথাগুলো বলে রাফাতের মা ঘর থেকে চলে গেলেন। রাফাত পরে গেল ভাবনায়। আসলেই তো বেলা তাকে বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না। সে তো মরিচিকার পিছনেই ছুটছে। যে সেচ্ছায় লুকায় তাকে খোঁজা আর মরুভূমিতে সুঁচ খোঁজা একই কথা। মোবাইল বেজে উঠতেই রাফাতের ভাবনায় ছেদ পড়ে।
-“হ্যালো!”
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই রাফাতের উত্তর,
-“আজকেই যেতে হবে? ওকে। টিকিট কাটো৷ যাবো আমি চট্টগ্রাম!”
(চলবে)..