#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩৪
#Saji_Afroz

তায়শা ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়। পাশেই সে রাস্তায় পড়ে থাকা নওয়াজকে দেখতে পায়। নওয়াজ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রয়েছে। তায়শা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। নওয়াজ ধীরেধীরে চোখ খুলে। মাথাটা চেপে ধরে উঠে বসে সে।
তায়শা রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল-
আপনার এই অবস্থা কেনো?
.
নওয়াজ তায়শাকে দেখে বলল-
বুশরা কোথায়?
-আপনি কোথায় ছিলেন আগে বলুন।
-আমি তো এখানেই ছিলাম। কে যেন পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে আমার। আর কিছু মনে নেই।
-নিহির করেছে এটা৷ সাথে বুশরাকেও নিয়ে গেছে।
-মানে?
-আপনার জায়গায় নিহির বুশরাকে কিডন্যাপ করেছে।
.
নওয়াজ অবাক হয়ে বলল-
সে কীভাবে আমাদের এসবের কথা জানলো?
-সেটা আমিও ভাবছি।
-এখন কী উপায়? ওই ব্যাটার বাসায় যাই? হাঙ্গামা করে বুশরাকে নিয়ে আসি।
-সে বুশরাকে বাসায় নিয়ে যাবে আপনি জানেন? তাছাড়া ওর সাথে হাঙ্গামা করার ক্ষমতা আপনার নেই। উলটো পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে দেবে। এছাড়াও বুশরাও আপনাকে সাপোর্ট করবে না।
-তবে এখন?
-আমার নিজের মাথাও যে কাজ করছে না!
.
.
জ্ঞান ফিরলে বুশরা নিজেকে আবিষ্কার করলো নিহিরের রুমে। সে চমকে এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো সে! চারপাশে ভালো মতন তাকালো বুশরা। নাহ, ঠিকই তো দেখছে সে।
বুশরা দাঁড়িয়ে পড়ে। রুম ছেড়ে বেরুতে যাবে তখনি নিখিল আসে। তাকে দেখে বুশরা বলল-
আমি এখানে কীভাবে বলতে পারো?
-এখানে থাকার কথা ছিল না?
-নাহ! আমি শপিংমল এর পেছন সাইডে ছিলাম।
-তুমি কিডন্যাপ হয়েছ।
-মানে?
-মানে তোমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।
-কে করেছে?
-ভাইয়া।
.
এই বলে হো হো শব্দে হেসে উঠলো নিখিল। বুশরা রেগে বলল-
বিচ্ছিরী ভাবে না হেসে আমায় বলো ঘটনা কী? উনি আবারও কেনো আমায় কিডন্যাপ করেছে?
-তোমাকে বিয়ে করার জন্যে।
.
এইবার বুশরা অনেকটা রেগে বলল-
কীসব আবোলতাবোল বলছ?
.
নিহির এসে নিখিলকে থামিয়ে বলল-
এখন আপনার কেমন লাগছে বুশরা?
-পাগল পাগল লাগছে। প্লিজ কী হচ্ছে আমাকে একটু বলবেন?
.
বুশরাকে বসিয়ে সবটা খুলে বলল নিহির। তাকে তানিশার সাথে কথাও বলিয়ে দেয় সে। সবটা শুনে বুশরা যেন আকাশ থেকে পড়ে৷ নওয়াজ নাহয় বাইরের কেউ কিন্তু তায়শা! সে এটা কীভাবে করতে পারলো? এইজন্যই বুঝি ভালো সাজার অভিনয় করেছে সে?
এইবার আর বুশরার চোখে পানি দেখলো না নিহির। তীব্র ঘৃণা দেখতে পেল সে। রাগে তার চোখ দু’টো লাল হয়ে গেছে।
নিহির ও নিখিল তাকে শান্তনা দেয়। বুশরা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
সবই বুঝলাম। এসব তো আপনি আমাকে জানাতে পারতেন কোনোভাবেই। কিডন্যাপ করতে হলো কেনো?
-আপনার কাছে ফোন ছিল না।
-প্রমাণ ছিল আপনার কাছে। বাসায়ই চলে আসতেন।
.
নিখিল হেসে বলল-
ভাই তো তোমাকে আর যেতে না দেওয়ার জন্যে নিয়ে এসেছে।
-মানে?
-মানে ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করতে চায়।
.
বুশরা হেসে ফেলে বলল-
আবারও দুষ্টুমি।
.
এইবার মুখ খুললো নিহির। সে বলল-
ও ঠিকই বলেছে।
.
বুশরা চমকে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নিহিরের দিকে। পরিবেশ শান্ত দেখে নিখিল দাঁড়িয়ে পড়ে। সে বলল-
তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।
.
নিখিল চলে গেলে নিহির বলল-
অজান্তেই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। আপনি ছাড়া এই বাড়িটা ফাঁকা মনেহয়। প্লিজ এখানে থেকে গিয়ে বাড়ির সাথে সাথে আমাকেও সম্পূর্ণ করে দিন।
.
বুশরা বলল-
আপনার আর নওয়াজের মধ্যে তবে তফাৎ টা কই রইলো? ভালোবাসা প্রকাশ না করে কিডন্যাপ করতে হবে কেনো?
-আমি কোনো জোর করছি না! কিডন্যাপ আমি ওদের হাত থেকে বাঁচাতে করেছি। আমি আপনাকে আমার মনের কথা জানালাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছে।
.
বুশরা দাঁড়িয়ে পড়ে। নিহিরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল-
আমি আসছি। আর আপনি হয়তো মোহ তে আছেন। আমাকে ভালো লাগার মতো কিছুই নেই। ভালো কাউকে পাবেন আপনি। আমি আসি।
.
এই বলে বুশরা চলে যেতে থাকে। তার পথের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিহির।
.
.
দরজা খুলে বুশরাকে দেখে চমকে উঠলেন নওয়াজের মা। তিনি অবাক হয়ে বললেন, তুমি এখানে?
-নওয়াজ আছে বাসায়?
.
তিনি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তখনি তানিশা এসে বলল-
আছে।
.
সাথে সাথেই নওয়াজকে ডাক দেয় তানিশা। নওয়াজ এসে বুশরাকে দেখে তার কাছে ছুটে এসে বলল-
তুমি এসেছ! আমি জানতাম তুমি আমার কাছেই ফিরে আসবে।
.
বুশরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সামনে এসব বলতে তোমার লজ্জা করছে না?
-আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি।
-এখনো হয়েছে ডিভোর্স? আর তুমি ভাবলে কীভাবে? ডিভোর্স হলেও আমি তোমাকে মেনে নেব? যেই মুখ দিয়ে ভালোবাসো বলছ সেই মুখ দিয়েই নষ্টা বলেছিলে আমায়। ভালোবাসা তো সেদিনই ফুরিয়ে গেছে আমার। তোমাকে আমি এসব জানানোর পরেও আমাকে কিডন্যাপ করার মতো প্লান কীভাবে করলে?
-একবার বিয়ে হয়ে গেলে তোমার রাগ কমবে ভেবেছিলাম।
-বিয়ে হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যায়? কই? তোমার আর তানিশার মাঝে হয়েছে সব ঠিক?
.
এইবার নিশ্চুপ হয়ে যায় নওয়াজ। বুশরা তানিশার পাশে এসে বলল-
এমন একটা মেয়ে ভাগ্য করে পেয়েছ তুমি। হয়তো সেও তোমায় ছেড়ে গেলে ওর মূল্যটা তুমি বুঝবে।
.
নওয়াজের দিকে তাকিয়ে বুশরা বলল-
আমি তোমাকে ভালোবাসি না। শুনেছ? আর কখনো এমন নোংরা প্লান করবে না। আমি মরে যাব, তবুও তোমার হব না।
.
এই বলে বুশরা হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
নওয়াজের মা তার গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তাকে কিছু না বলে তানিশাকে বলল-
আজ আমি তোকে বলছি, ও তোর যোগ্য নয়। তুই চলে যা মা। চলে যা!
.
তানিশা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো-
এখুনি চলে যাচ্ছি আমি।
.
সে রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে আসে। সবাইকে বিদায় জানালেও নওয়াজের দিকে ফিরেও তাকায় না। চোখের পানি মুছে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় তানিশা।
.
.
-আর বলবেন না আঙ্কেল! এর আগেও একবার পালিয়েছিল। আজ আবারও পালালো।
.
কাউকে না জানিয়ে হুট করেই দেশে ফিরে এসেছেন বুশরার বাবা বশর। তিনি সোজা এই বাড়িতেই এসেছেন মেয়েকে দেখার জন্যে। এতদিন যে বউ এর জন্য বুশরার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন সেইজন্য তিনি অনুতপ্ত । ভেবেছিল দেশে এসে মেয়েটার একটা গতি করে দিয়ে যাবেন। কিন্তু এখানে এসে মেয়ের সম্পর্কে এসব শুনবেন ভাবেননি।
আলিয়া খাতুন বললেন-
তুমি তো ভাইজান উল্টা আমাকে বকেছিলে। বিশ্বাসই করোনি। এইবার হলো তো বিশ্বাস?
.
-এইবারও আপনারা মিথ্যে বলছেন।
.
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বুশরাকে দেখে চমকে উঠে সকলে। তায়শা ভাবতেও পারেনি সে ফিরে আসবে! তাই নিজের অপকর্মে পর্দা টানার জন্যে আবারও মিথ্যে বলছে সে।
তায়শার সামনে এসে তার ডান গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় বুশরা। আলিয়া চেঁচিয়ে বললেন-
এই আমার মেয়েকে মারলি কেনো তুই?
-বড়ো বোন হিসেবে এটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল আমার। সে কী করেছে জানো? নওয়াজের সাথে প্লান করেছে আমাকে কিডন্যাপ করার জন্য। আর নিহির স্যার তো আমাকে বাঁচিয়েছেন। তার সাথে পালিয়ে যায়নি আমি। এর আগেও তায়শা ভেবে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবুও রটেছিল, ওহ না ভুল বলছি। তোমরা রটিয়েছিলে আমি পালিয়েছি। সবসময় আমার সম্পর্কেই এত নোংরামো কেনো বলো তো? পাড়াপ্রতিবেশি কে ভুলভাল বুঝিয়ে শান্তি হয় না? এখন আবার কাকে কী বোঝাচ্ছ?
.
আলিয়া খাতুন বললেন-
দেখেছ ভাইজান? ও সবসময় আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করে।
.
নাফিশা বলল-
মোটেও না। বরং আজ প্রথম আপি এভাবে কথা বলছে।
.
‘ভাইজান’ ডাকটি শুনে বশরের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় বুশরা।
নাফিশা বলল-
ইনি তোমার বাবা আপি।
.
বুশরা তা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। মুহুর্তেই বাবার ডাকে ঘোর কাটে তার। ছুটে আসে তার কাছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তিনি বললেন-
তোর থেকে দূরে আর থাকতে পারলাম না। তাই চলে এলাম।
-তুমি আসবে এটা শুনেছিলাম। কিন্তু কবে তা জানতাম না। সেদিন থেকেই আমি ছটফট করছিলাম দেখার জন্য তোমাকে।
.
তিনি বুশরাকে ছেড়ে বললেন-
আমার আসার তো কথা ছিল না। মানে কাউকে জানাইনি।
.
বুশরা আলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মিথ্যে বলেছ তুমি?
-ইয়ে মানে হ্যাঁ। মিথ্যে বলে বিয়েই তো দিতে চেয়েছি।
.
বুশরা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল-
তুমি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো বাবা। আর তো পারছি না আমি!
.
তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-
আমি এসেছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
.
.
বুশরার পিছু পিছু তার রুমে আসে তায়শা। তাকে দেখে বুশরা বলল-
আমি কেনো ফিরে এসেছি জানতে চাস তো? কারণ আমাদের চক্করে পড়ে নিহির স্যারের মতো একটা মানুষ শান্তিতে থাকতে পারছে না। তিনি আমাকে বিয়ে করতে চায়, এটা সত্য। কিন্তু তুই সেটা চাস না। আমাদের বিয়েটা হলে তুই আবারও কোনো অঘটন ঘটাবি। এসব ভেবেই আমি চলে এসেছি।
.
তায়শা হুট করে বুশরার হাত ধরে কাঁদতে শুরু করলো। সে বলল-
আমি ভুল করেছি। জেদের বশে এসব করে ফেলেছি। আমি সত্যি অনুতপ্ত আপি। মাফ করে দাও আমাকে।
.
বুশরা তার হাত ছেড়ে বলল-
আমাকে ভালোবেসে তুই কিছু বললে আমি শুনতাম না? তোর জন্য এক নিহির কেনো? হাজার নিহির কে ভুলে যেতে রাজি আমি।
-তবে কী তুমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছ?
.
প্রশ্নটি শুনে বুশরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। আসলেই কী সে নিহির কে ভালোবেসে ফেলেছে নিজের অজান্তেই!
তায়শা আবারও একই প্রশ্ন করলে বুশরা বলল-
তুই এত কথা বলছিস কেনো? চলে এসেছি এটাতেই খুশি থাক না।
.
তায়শার আর বুঝতে বাকি রইলো না সেও ভালোবাসে নিহিরকে। তবুও সে ফিরে এসেছে। বুশরার জায়গায় সে থাকলে এমনটা কী করতো কখনো!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here