#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২১
#Saji_Afroz

হতাশায় ভরা মন নিয়ে নিহিরের বাড়ির সামনে আসে বুশরা৷ ভেতরে প্রবেশ করতে লজ্জাবোধ হচ্ছে তার৷ কত গর্ব করে নিহিরকে বলেছিল, সে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটা যে তার সাথে এমন করবে, এটা কে জানতো!
মানুষের কথাগুলো এত সহজে বিশ্বাস করে ফেললো নওয়াজ? একটাবারও তার সাথে কথা বলে সত্যতা যাচাই করা উচিত বলে মনে করেনি!
তায়শা? তায়শার কাছেই সব জানতে পারতো। কিন্তু সেটাও সে করেনি। করলে নিশ্চয় অন্য কাউকে বিয়ে করে নিত না।
তায়শার কথা মনে হতেই তাকে দেখে নীরব দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি মনে পড়ে বুশরার। অবশ্য এটার কারণ সে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। নিশ্চয় আলিয়া খাতুন কথা বলতে নিষেধ করেছেন।
বুশরা চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে বাড়ির ভেতরে পা বাড়ায়৷ তার ভাগ্যটা এতই খারাপ যে, ঢুকতেই সেনোয়ারা বেগমের মুখোমুখি হয় সে৷ তাকে দেখেই সেনোয়ারা বেগম বললেন, এত রাতে বাইরে থেকে আসাটা আমি মোটেও পছন্দ করছি না।
-আমি নিহির স্যারকে বলে গিয়েছিলাম।
-ওহ! তাহলে তো আর কিছুই বলার নেই।
.
আরও কিছু তিনি বলতেন। কিন্তু বুশরা তাকে পাশ কাটিয়ে ফাহমিদা বেগমের রুমে চলে আসে। যেখানে মা এর পাশে বসে আছে নিহির।
নিহির তাকে দেখে অনেকটা অবাক হয়েই বলল, আপনি?
.
বুশরা ভেতরে আসতেই ফাহমিদা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরলেন। নিহির বলল, বারবার আপনার কথাই বলছিলেন মা।
-জ্বর কমেছে উনার।
-হ্যাঁ। এখন সুস্থ আছে। কিন্তু আপনি চলে এলেন যে?
.
বুশরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যার জন্যে গিয়েছিলাম সে অন্য কারো হয়ে গেছে।
-মানে?
-তার বিয়ে হয়ে গেছে।
-বিয়ে করে নিয়েছে! কিন্তু কেনো?
-ভুল বুঝেছে আমাকে। ভেবেছে অন্য কারও সাথে পালিয়েছিলাম।
.
নিজেকে অপরাধী মনে হলো নিহিরের কাছে। সে যদি বুশরা কে না নিয়ে আসতো সেইদিন, এতকিছু তার জীবনে ঘটতো না।
নিহির কী বলবে ভেবে পায় না। বুশরা বলল, আমি একটু ঘুমোতে চাই।
-খেয়েছেন কিছু?
-খিদে নেই।
.
এই বলে সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
.
.
তানিশার রুমটা আজ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। সে বউ সেজে খাটের মাঝখানে বসে অপেক্ষা করছে নওয়াজের জন্যে।
বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে তানিশার। আচ্ছা, আজ কী করবে সে? নওয়াজের সাথে গল্প করার ইচ্ছে তার। কিন্তু নওয়াজ কী তা করবে? শুনেছে ছেলে মানুষরা মেয়েদের থেকেও বেশি উৎসুক থাকে বাসর রাতের জন্য। তারা গল্প কম কাজ বেশি করতে চায়। এই কথা মনে হতেই লজ্জায় তানিশার মুখটা লাল হয়ে যায়। এসব কী ভাবছে সে!
দরজার শব্দে তানিশা ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। দেখলো, নওয়াজ এসেছে৷ সে এসেই ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে এসে তানিশাকে বলল, তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও। অনেকক্ষণ ধরে এভাবে আছ।
.
তানিশা নওয়াজের কথামতো ওয়াশরুমে যায়। কিন্তু এসে দেখলো, নওয়াজ বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে আছে।
তানিশা কত তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হলো। এতটুকু সময় এর মাঝে নওয়াজ ঘুমিয়ে পড়লো? নিশ্চয় অনেক ক্লান্ত ছিল।
তানিশা লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। এরপর নিজেও নওয়াজের পাশে শুয়ে পড়ে৷ আধো আলোতে সে নওয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে করছে আলতো করে তার মুখে নিজের হাতটা ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু নিজের এই ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে চোখ জোড়া বন্ধ করে তানিশা৷ আজ তার ভালো ঘুম হবে। শান্তির ঘুম!
.
.
সারারাত দুচোখ এক করতে পারেনি বুশরা। ভোরের দিকে চোখ জোড়া লেগে এসেছিল। কিন্তু একটা দুঃস্বপ্নে তার ঘুমটা ভেঙে যায়।
নওয়াজ ও তানিশাকে দেখেছিল সে। যদিও তারা খুব খুশিতে ছিল কিন্তু বুশরার জন্য এটা সহ্য করা কষ্টকর।
কালকের সমস্তকিছু মনে পড়তেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে মতন অবস্থা বুশরার। কালকের রাতটা তাকে কাঁদিয়েছিল কম, ভাবিয়েছে বেশি। সেই ছেলেটা আসলেই নওয়াজ ছিল তো?? যাকে সে এতটা ভালোবাসতো!
এই ভেবে নিজের অজান্তেই ঠোঁটে হাসি চলে আসে বুশরার। তাচ্ছিল্যের হাসি৷ ছেলেটি আসলেই নওয়াজ ছিল। কিন্তু অন্য এক নওয়াজ৷ তবুও বেহায়া মনটা শেষ বারের মতো ছটফট করছিল নওয়াজকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু পারেনি। অন্যের স্বামীর উপরে তার যে কোনো অধিকার নেই।
.
.
এদিকে নিহিরের কাছে সবটা শুনেছে নিখিল। মেয়েটার জন্য মায়া অনুভব করলো সে৷ তাদের দুই ভাই এর জন্য তার জীবনটা অগোছালো হয়ে গেল। তার কোনো অন্যায় ছিল না। তবুও কেনো সে এত শাস্তি পাচ্ছে? তবে কী সামনে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য? শুনেছে কষ্টের পরেই সুখের সন্ধান পাওয়া যায়। মেয়েটি কখন তা পাবে কে জানে!
.
.
ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সকলের সাথে নাস্তা সেরে নেয় নওয়াজ। নাস্তার টেবিলে যতটুকু সময় সে বসেছিল, খুবই বিরক্ত হয়েছিল। কেননা তানিশার চাচাতো বোনেরা তার সাথে মজা করতে ব্যস্ত ছিল। যেসব নওয়াজ পছন্দ করছিল না। বিষয়টা তারা বুঝতে পেরে সেখান থেকে সরে যায়। পরবর্তীতে তা নিয়ে তানিশাকে কথা শোনায়। তানিশা এসবে পাত্তা না দিয়ে বলল, উনি আগে থেকেই এমন। নিজেও কারও সাথে মজা করেন না। তোরা উনার সাথে এমন করিস না তো।
.
নওয়াজ তার পরিবার নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দেয়। অবাক করার বিষয় হলো, সে তানিশাকে বিদায় জানায়নি। একটাবার তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। শুধু নিজের খালার সাথে কথা বলে বেরিয়ে যায়। এটা নিয়েও তানিশার সাথে তার বোনেরা মজা নেয়। এইবার তানিশার মনটা আসলেই খারাপ হয়৷ তানিশাকে বিদায় জানিয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হত?
.
বাসায় পৌঁছে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ে নওয়াজ। তার চারপাশের মানুষজন কতটা খুশি ছিল। কিন্তু খুশি নেই তার মনে। বরং গতকাল বুশরাকে দেখার পর থেকে অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে। এতকিছুর পরেও সে কেনো এল এইখানে? এতদিন কেনো আসেনি?
নানারকম প্রশ্নে গিজগিজ করছে তার মাথাটা।
মাথা ঝেড়ে ফোন হাতে নেয় সে। সে কী! তায়শার এতবার ফোন? কাল খেয়ালই করেনি।
নওয়াজ তায়শাকে কল ব্যাক করে।
তায়শা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সে কিছুতেই মানতে পারছে না, নওয়াজ বিয়ে করে ফেলেছে। তার জন্য বুশরা কত কষ্ট পেল।
নিজের করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে নওয়াজকে সে ফোন দিয়েছিল। কিন্তু সে রিসিভই করলো না।
এখন নওয়াজের ফোন পেয়ে রিসিভ করে তায়শা কর্কশ কণ্ঠে বলল, কাল সারাদিন কই ছিলেন? এতবার ফোন করলাম রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করেননি? বিয়ে করতে এতই এক্সাইটেড? দেখে তো মনেই হয়নি অন্য কাউকে ভালোবাসতেন আপনি।
.
তায়শার এমন আচরণে নওয়াজের রাগ হয়। সেও ভারী কণ্ঠে বলল, আচ্ছা তাই! ধোকাবাজের জন্যে আমি কেনো দেবদাস হয়ে থাকব?
-কাকে ধোকাবাজ বলছেন? সে ধোকাবাজ নয়। তার কপালটা খারাপ।
.
শোয়া থেকে উঠে বসে নওয়াজ। সে বলল, মানে?
-মানে আমি ওইদিন যা বলেছিলাম সবটা ছিল মিথ্যে। আসলে ওইদিন এমন একজনের সামনে আপনি আমাকে ওইসব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার সত্যি বলার উপায় ছিল না। নাহলে আমার এই বিয়েটাও ভেঙে যেত।
-আমি কিছুই বুঝছি না তায়শা।
.
তায়শা নওয়াজকে সব খুলে বলতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার। নওয়াজ প্রায় চেঁচিয়ে বলল-
আমি কারও কথা নয়, তোমার কথা বিশ্বাস করে এতবড়ো একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তুমি বোন হয়ে এটা কীভাবে করতে পারলে?
.
নওয়াজের চিৎকার শুনে তার মা ও বোন এগিয়ে এল। তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নওয়াজের দিকে।
তায়শা বলল, শুধু আমি ভুল? আপনি ক’টা দিন অপেক্ষা করে সত্যমিথ্যা যাচাই করবেন না? ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়েটা করে নিলেন।
.
নিজের রাগ সামলে নিয়ে নওয়াজ বলল, বুশরা কোথায়?
-জানিনা কোথায় এখন। কাল তো পারতেন তাকে আঁটকাতে।
.
এইবার আর রাগ সামলাতে পারলো না নওয়াজ। সে বলল, সবকিছুর মূলে আছ তুমি। জীবনে কখনো সুখী তুমি হতে পারবে না। কোনোদিনও না।
.
তায়শা ফোনটা কেটে দেয়। রাগের বশে সব সত্যিটা নওয়াজকে জানিয়ে ভুল করলো না তো?
.
এদিকে মা বোনকে দেখে চেঁচিয়ে নওয়াজ বলল, হা করে কী দেখছ? যাও এখান থেকে। আমাকে একা থাকতে দাও।
.
তারা কিছু না বলে চলে যায়।
বুঝতে পারছে নওয়াজের মাথা ঠিক নেই।
নওয়াজ উঠে পাগলের মতো সারারুমে পায়চারি করতে থাকে৷ বুশরাকে ভুল বুঝে কতগুলো কথা শোনালো সে। মেয়েটা এসব কীভাবে সহ্য করলো!
কেনো সে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলো না। কেনো!!
.
.
ক’দিন কেটে যায়। বুশরা সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ সময় সে ফাহমিদা বেগমের সাথেই কাটাই। কারণ তার মনেহয়, পৃথিবীতে এই একজন মানুষই তার আপনজন। যে তাকে সবসময় নিজের কাছে রাখতে চায়। সে না থাকলে দুঃখ পায়। বুশরাও তার অনেক যত্ন নেয়। ইদানীং তার সাথেই রাতে ঘুমোয়। তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোলে মনেহয়, নিজের মা কে জড়িয়ে ধরেছে।
বাইরের জগতের প্রতি কোনো আগ্রহ বুশরার আর নেই৷ তাকে যদি ফাহমিদা বেগমের সাথে সারাজীবন থাকতে বলা হয়, তবে সে থাকবে। একটা অসুস্থ মানুষের মাঝে যদি নিজের ভালোলাগা খুঁজে পাওয়া যায়, সমস্যা কী এতে!
.
.
সেনোয়ারা বেগমের সামনে বসে আছে নিহির। সে কিছু একটা বলবে বলে তাকে বসিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারছে না।
সেনোয়ারা বেগম বললেন, কী বলবে বলো? রান্নাটা সারতে হবে তো। অনেকদিন সরষে ইলিশ করি না। ভাবলাম আজ করব।
-আসলে…
-কী?
-আমি বিয়ে করতে চাই।
.
খুব দ্রুত কথাটি বলে মাথা নিচু করে নেয় নিহির। সেনোয়ারা বেগম খুব বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে বললেন, ওহ এই ব্যাপার! তা তুমি করতেই পারো। কবে করতে চাচ্ছ?
– আমি চাইলেই তো হয়ে যাচ্ছে না। তোমাদের সম্মতির প্রয়োজন।
-আসলেই প্রয়োজন?
-কী যে বলোনা। মেয়ে পছন্দ করতে হবে না তোমায়? বলো কবে দেখতে যাবে? আগে দেখে আসো। পরে বাকিসব।
.
বুশরার কথা বলেছে ভেবে তিনি আগ্রহ দেখাননি। বুশরা না শুনে, তার যেন খুশির সীমা নেই। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, মেয়ের নাম কী?
-তাহরিমা।
-সুন্দরী?
-অনেক।
-বাহ বাহ! প্রেম কতদিনের?
-করিনি। বলেছি আমার চাচী আম্মা যাবে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে।
-আমার যদি মেয়ে ভালো না লাগে?
-তবে ক্যান্সেল।
সে জানে তিনি দুষ্টুমি করে কথাটি বলেছে।
.
এই বলে নিহির হাসলো। তিনি বললেন, কবে দেখতে যাব?
-কাল চলো?
-চলো কী? তুমি যাবে না। পরে যাবে। যখন সব ঠিকঠাক হবে। আগে আমি গিয়ে দেখব।
-তবে বুশরা আর নিখিলকে নিয়ে যেও। তারা দেখুক? একা গেলে তোমারও ভালো লাগবে না।
-তা ঠিক। কিন্তু বুশরা নয়, নিখিল যাবে। বাইরের কাউকে নিতে আমি রাজি নই।
.
এই বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে নিহির বলল, আচ্ছা।
.
এদিকে নিখিল সবটা শুনে অনেক খুশি হয়। ভাই এর বউ দেখার জন্যে সেও অনেক বেশি আগ্রহী। কিন্তু তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে এটা নিয়ে যে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই।
এই সাজানো সংসারে অশান্তির বন্যা নামতে চলেছে এবং তা খুব দ্রুত!
.

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here