#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২০
#Saji_Afroz
নিহির ড্রাইভারকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছে, বুশরা বের হয়েছে কী না। সে জানায়, বের হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। নিহির তাকে ঠিকঠাকমতো পৌঁছে দিতে বলে ফোন রাখলো।
এদিকে ড্রাইভারের কথা শুনে বুশরা বুঝতে পারলো, নিহির ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে। এতে করে সে খুশি হলো। নিহিরের জন্যে তার জীবনে এতকিছু ঘটে গেলেও তার প্রতি রাগ হয় না বুশরার। কারণ মানুষটার মন ভালো। যা করেছে ভাই এর খুশির জন্য করেছে। নিজের ভাইকে ভালোবেসে এতটুকুও কেউ করে?
.
.
সাজানো গাড়িতে উঠে বসেছে নওয়াজ। উপর থেকে এই দৃশ্য দেখে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে তায়শা। বোঝার চেষ্টা করছে নিচে কী হচ্ছে। তায়শা দেখলো, একে একে গাড়িতে নওয়াজের মা ও বোনও উঠেছে। সাথে আরও কয়েকজন আছে। গাড়ি আছে দু’টো। নওয়াজ পাঞ্জাবি পরে, তার মা বোন এভাবে সেজেগুজে তৈরী হয়ে যাচ্ছে কোথায়?
তায়শা দ্রুত নিচে নেমে আসে। কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি গুলো চলে যায়। আলিয়া খাতুন তায়শা কে এভাবে ছুটে আসতে দেখে তার পিছু নিয়েছিলেন। গেইটের বাইরে এসে বললেন, এইভাবে ছুটে আসলি কেনো?
-নওয়াজ ভাই আর তার পরিবার এইভাবে সেজেগুজে কই যাচ্ছে দেখতে এলাম।
-কীভাবে?
-আরে গাড়ি সাজিয়েছে, সে পাঞ্জাবি পরেছে। আর বোনও বেশ সেজেছে।
.
আলিয়া খাতুন একটু ভেবে বললেন, শুনেছিলাম ওর বিয়ে হয়ে যাবে।
.
তায়শা চমকে উঠে বলল, মানে?
-মানে ওর খালাতো বোনের সাথে বিয়ের কথা চলছিল। সাজানো গাড়ি করে যখন গেছে নিশ্চয় বিয়ে করতে গেছে। কিন্তু তোর নওয়াজের বিষয়ে এত আগ্রহ কেনো? যখন আমি ওর কথা বলেছিলাম তখন তো বেশ লাফিয়েছিস।
.
তায়শা তার মা এর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দৌঁড়ে নিজের রুমে আসে। নওয়াজ এত সহজে অন্য কাউকে কীভাবে বিয়ে করতে পারে!
তায়শা নিজের মাথায় হাত দেয়৷ এর পেছনে যে সেও দায়ী। নওয়াজকে বুশরার ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলার পরেও আর সত্যটা বলেনি সে। তার উচিত ছিল নওয়াজ কে সবটা খুলে বলে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। তবে এখনো খুব বেশি দেরী হয়নি। ফোন করে নাহয় সবটা বলবে।
সেদিন নওয়াজের ফোন নাম্বার সেইভ করেনি তায়শা। অনেক ঘেটেঘুটে সময় মিলিয়ে নাম্বারটা বের করে সে। কিন্তু ফোন দিলে কেউ রিসিভ করে না। আসলে নওয়াজ ভুলে নিজের ফোনটায় বাসায় রেখে গেছে।
এদিকে তায়শা তাকে ফোনের উপর ফোন দিয়ে চলেছে আর মনে মনে নিজের করা অন্যায় এর জন্য ব্যথিত হচ্ছে।
.
.
এলাকায় প্রবেশ করতেই বুশরার বুক ধুকপুক করতে শুরু করে। একইসাথে তার মনে ভালো লাগা ও খারাপ লাগাও কাজ করছে। যদি নওয়াজ দেশে না আসতো, সে কোনোদিনও এখানে দ্বিতীয়বার আসার কথা ভাবতে পারতো না। শুধুমাত্র নওয়াজের জন্যে তার ফিরে আসা। নওয়াজকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে আছে সে।
ড্রাইভার বলল, আপা গাড়ি কোথায় থামাব?
.
বুশরা তাকে দেখিয়ে দেয়। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই মুখ ঢেকে নেমে পড়ে বুশরা। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতে বলে।
পেছনে ফিরে প্রথমে নিজের বাড়ির দিকেই চোখ গিয়ে আটকায় বুশরার। কতশত স্মৃতি রয়েছে এই বাড়িতে।
যদিও ভালো স্মৃতির চেয়েও খারাপ স্মৃতি-ই বেশি এইখানে। সেসব এখন মনে করে মনটা খারাপ করতে চায় না বুশরা। সে ওড়না দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে নেয়। এরপর নওয়াজের বাড়ির দিকে যায়। কিন্তু এ কি! দরজায় বড়ো একটা তালা লাগানো। যেটা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে বুশরা। এখন কী করবে ভেবে পায় না সে। নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে তায়শা বা নাফিশা কে দেখার চেষ্টা করলো বুশরা। কিন্তু কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে না। অন্তত তায়শা কে পেলে তার সাহায্য নেওয়া যেত। সে কী করবে এখন?
একটু ভেবে বুশরা সিদ্ধান্ত নিলো, সে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। নওয়াজের অপেক্ষা করবে সে। আজ যত দেরীই হোক, নওয়াজের সাথে দেখা না করে যাবে না।
.
.
-বিয়েতে সম্মতি থাকিলে বলুন কবুল?
.
কাজি সাহেবের কথা শুনে বুকটা ধুক করে উঠলো নওয়াজের। বারবার চোখের সামনে বুশরার মুখটা ভেসে আসছে। সে কী ভুল করে ফেলছে? একটাবার মেয়েটার সাথে দেখা করার উচিত ছিল না?
মুহুর্তেই তায়শার বলা কথাগুলো মনে পড়ে তার। তায়শা কখনোই বুশরার নামে বানোয়াট কথা বলবে না। বরং সে বুশরার দোষ ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে। তাদের সম্পর্ক টা এমনি।
কাজি আবারও কথাটি বলতে নওয়াজ মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দেয়। সে বলল, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
.
নওয়াজের পর কাজি সাহেব তানিশার কাছে যায়। বিয়ে পড়ানো শেষে তিনি উচ্চশ্বরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। নওয়াজ সাহেব আজ থেকে আপনার স্বামী।
এই বলে পেপারে সাইন নিয়ে তিনি চলে যায়। তানিশার চাচাতো বোন দুষ্টুমি করে বলল, কী রে তানিশা? তুই এক সেকেন্ডও টাইম নিসনি কবুল বলতে। এদিকে ছেলে হয়েও কবুল বলতে ঘাম ছুটে গেছে নওয়াজ ভাই এর। এই অবস্থা কেনো?
.
তানিশা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তাই নাকি! আসলে সব হুটহাট তো।
-হুটহাট তোর জন্যেও। কিন্তু তোর মাঝে যতটা আনন্দ আমি দেখতে পাচ্ছি, ভাইয়ার মাঝে নেই। বরং একরাশ বিরক্তি নিয়ে তিনি বিয়েটা সম্পন্ন করেছেন মনে হচ্ছে।
.
তানিশা চিন্তিত হয়ে পড়ে। নওয়াজ কী এই বিয়েতে রাজি ছিল না? কিন্তু কেনো!
.
.
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। নওয়াজের দেখা নেই। আর এখানে এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বুশরার জন্যে ঠিক নয়। আলিয়া খাতুন দেখলে নওয়াজের বাড়ির সামনে দাঁড়ানোও তার বন্ধ হয়ে যাবে।
তাই সে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে তাকে কেউ দেখতে পাবে না। কিন্তু সে সবই দেখবে।
সেই দুপুর থেকে একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ব্যথা করছে। ঘেমেভিজেও একাকার হয়ে গেছে। একটু পর পর রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিলেও সারা শরীর ভিজে যাওয়ার কারণে ভীষণ অস্থির লাগছে তার।
নওয়াজ কী আদৌ আজ বাড়ি ফিরবে?
ভাবতে ভাবতেই একটা গাড়ি চোখে পড়ে তার। যেটি এসে থামে নওয়াজের বাড়ির সামনে। আর সেই গাড়ি থেকে নেমে আসে পাঞ্জাবি পরিহিত নওয়াজ। বুশরা তাকে দেখে খুশিতে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে।
নওয়াজ ভেতরে প্রবেশ করতেই বুশরাও সেদিকে ছুটে যায়। এসে দেখলো দরজা বন্ধ। দরজায় কড়া নাড়তে বুশরার হাত কাঁপছে। সে কাঁপা হাতে কড়াটা নেড়েই ফেললো। নওয়াজ দরজা খুলে বুশরা কে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে যায়। এক এক মুহুর্তের জন্য সে ভুলেই গেছে, বুশরা এখন তার কেউ নয়! সে অবাক হয়ে বলল, তুমি!
-হ্যাঁ আমি! বুশরা। তোমার বুশরা।
.
একথাটি শুনে তানিশার কথা মনে পড়ে তার। যাকে একটু আগেই নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করেছে।
তানিশা তার। বুশরা কেউ নয়। বুশরা শুধুমাত্র একজন ছলনাময়ী।
নওয়াজ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি হঠাৎ?
-তুমি এসেছ শুনে ছুটে এসেছি।
-ও তাই! তা তোমার সেই প্রেমিক কোথায়?
-কোন প্রেমিক?
-যার কাছে এতদিন ছিলে।
.
বুশরা বুঝতে পারলো তার কান ভারী করা হয়েছে। যেটা সে আগেই ভেবেছিল। সে নওয়াজ কে ছোঁয়ার চেষ্টা করে বলল, আমার কথা শোনো।
.
নওয়াজ তার হাতটি সরিয়ে বলল, শোনার সময় নেই। আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
.
একথা শুনে যেন পা এর নিচের মাটি সরে গেল বুশরার। সে ভাঙাস্বরে বলল, মানে?
-মানে আমি আজ তানিশাকে বিয়ে করেছি। আজ রাতে ওখানেই থাকব। ফোনটা ফেলে গিয়েছি বলে নিতে এলাম।
.
বুশরা যেন নিজের কানে শুনেও একথা বিশ্বাস করতে পারছে না। তার চোখে পানি এলেও মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল, মিথ্যে বলছ তাইনা? তানিশাকে কেন বিয়ে করবে? সে তোমার কাজিন। আর তুমি তো আমায় ভালোবাসো।
-তুমি আমাকে ধোকা দিয়ে অন্য কারো সাথে বিয়ে ছাড়াই চলে যেতে পারো। আর আমি পবিত্র সম্পর্কে জড়াতে পারব না? বিয়ে করেছি৷ তোমার মতো নষ্টামি নয়।
সরো আমার বেরুতে হবে।
.
বুশরার পাশ ঘেষে বেরুই নওয়াজ। এরপর দরজাটা বন্ধ করে সে বেরিয়ে পড়ে। একটাবারও বুশরার দিকে ফিরে তাকায়নি। বুঝতে চেষ্টা করেনি, বুশরার উপরে কি বয়ে যাচ্ছে।
বুশরা চাইলে এখন তাকে থামিয়ে সবটা খুলে বলতে পারে। কিন্তু এটা সে করবে না। কত সহনে নওয়াজ তাকে নষ্ট মেয়ে বলে গেল। সত্যিই কী নওয়াজ ভালোবাসার মানে বোঝে?
কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসে বুশরা। নিজের বাড়ির দিকে তাকাতেই বারান্দায় দাঁড়ানো তায়শাকে দেখতে পায় সে। তায়শা তাকে দেখলেও কোনো কথা বলল না। কারণ তার মা এর সাথে করা ওয়াদা সে ভোলেনি।
এদিকে তায়শার এমন নীরবতা বুশরার ভাঙা হৃদয়টা আরও চুরমার করে দিচ্ছে। এতদিন পর তাকে দেখেও এইভাবে নীরব দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে তায়শা?
.
চলবে