#সুরমা_কালো
#পর্ব-১

কনে সাজে রজনীগন্ধা ফুলের তৈরী বাসরে বসে আছি। ফুলের গন্ধে বমি লাগছে। মাথার রগ দিপ দিপ করে লাফাচ্ছে। দুনিয়ার সব কিছুই অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে একটা ব্লেড দিয়ে হাতে একটা পোচ মারি, ব্যাস সব শেষ। খুব ভালো শিক্ষা হবে জোর করে বিয়ে দেবার। বিশেষ করে ছোট চাচীর। বিদায়ের সময় ছোট চাচীর কানে বলে এসেছি — “আমি এতিম বলেই এমনটা করতে পারলে”।

আসলেই তো, আমি এতিম বলে আমার কোনো মূল্যই রইলো না।
আমার মা ছোটবেলায় মারা গেছে। আব্বা আর এরপর বিয়ে করেন নি। আমার কথা ভেবে যে করেন নি তা না, ব্যবসা থেকে সময় বের করতে পারেন নি। তবে আব্বাও আমার ষোলো বছর বয়সে হঠাৎ করেই মারা যান।
জেলা শহরে আমাদের বেশ বড় দোকান আছে। ব্যবসায়ী হিসাবে আমাদের পরিবারের বেশ নামডাক। আমার তিন চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা সবাই ব্যবসাতেই জড়িত।
আমাদের পরিবারের মেয়েরা বড় হয় বিয়ে, বাচ্চা পালন, সংসার এসব মাথায় নিয়ে। এ পরিবারে যারা বিয়ে হয়ে আসে তারাও সংসার মাথায় নিয়েই আসে। পড়াশোনা চাকুরী তো প্রশ্নই আসে না। তাই বলে কেউ অসুখী না। আমার চাচা কিংবা ভাইয়েরা বউদের যথেষ্ট ভালোবাসে ও সম্মান করে। মোটকথা মোটামুটি রক্ষণশীল যৌথ পরিবার আমাদের। সবাই সুখি, সবাই মিলেমিশে আছে।
এ পরিবারে আমিই একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম। বাপ মা নাই বলে কোনদিন অবহেলা হয়নি কিন্তু কেন জানি আমি বিয়ে আর সংসারই জীবনের সবকিছু তা মেনে নিতে পারি নি। মেয়েদের কলেজের শুরুতেই এ পরিবারে বিয়ের পাত্র দেখা শুরু হয় এবং এক বছরের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়।
কিন্তু আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়তে পেরেছি অনেক ঝুক্কি ঝামেলা সামলে। অবশ্য আমাকে পুরো সাপোর্ট দিয়ে সব সময় আগলে রেখেছিল আমার ছোট চাচী। অথচ এই ছোট চাচীই অনেকটা জোর করে সবাইকে রাজি করায় এখানে বিয়ের ব্যাপারে।
কেন এমন করলো ছোট চাচী?

ছোট চাচী আমার চেয়ে বয়সে সাত আট বছরের বড় কিন্তু উনার পরম যত্নে আর সহযোগীতায় আমি উনাকে বন্ধু ভাবতাম, মায়ের জায়গা দিয়েছিলাম। অথচ উনি কি করলো!
মেজো চাচীর মেয়ে লিনা আমার চেয়ে ছোট কিন্তু বিয়ের উপযুক্ত। ওকে বিয়ে দিলে সে কখনোই না করতো না। কিন্তু আমাকেই কেন দিলো!
আমি এতিম বলে! হ্যাঁ সেটাই!
কারো কথা বাদ দিয়ে আমাকে এখানে বিয়ে দেয়ার একমাত্র কারণ পাত্র দেখতে কালো। হয়তো শ্যামলা কিন্তু আমাদের পরিবারে শ্যামলা মানেই কালো। আমরা সবাই ফর্সা বলা চলে চাচা-চাচী, ভাই- বোন, ভাবী দুলাভাই সবাই।আমাদের পরিবারে কোনো কালোর ছিটেফোঁটা নেই। সেখানে আমাকে কেন তারা কালোর সাথে বিয়ে দিলো? ছেলে শুধু বড় ব্যবসায়ী বলে?
উফ! কিছু ভালো লাগছে না। আমি ঠিক করলাম এ বাড়িতেই আমি ধুকেধুকে মরবো কিন্তু আর কোনদিন বাপের বাড়ি যাবো না, কখনো না। আর যাবোই বা কেন, কে আছে আমার ওখানে?

হঠাৎ দরজা ঠেলে আমার স্বামী রুমে ঢুকলো। ওকে দেখেই আমার মুখ শক্ত হয়ে গেল। উফ! এই কালো লোকটা কি আমাকে এখন জড়িয়ে ধরবে! তাহলে আমি নিশ্চিত ওর মাথা ফাটিয়ে দেবো। গোল্লায় যাক আমার পরিবারের মান সম্মান। দরকার হলে আমি আত্মহত্যা করবো।
লোকটা আমাকে এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো।

রাশেদ রুমে ঢুকে নাজিলাকে এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো। এক পলকেই নাজিলার শক্ত মুখ দেখলো রাশেদ।
বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে রাশেদ বললো, তুমি চাইলে শাড়ি গহনা চেঞ্জ করে আসতে পারো। অনেক সময় ধরে পরে আছো, নিশ্চয়ই হাস ফাঁস লাগছে!
নাজিলা ঝট করে নেমে ব্যাগ থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
রাশেদও নিজের পাঞ্জাবি পাজামা বদলে ট্রাউজার টিশার্ট পড়ে নিলো।

******
আমি হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে দেখি আমার স্বামী মানে রাশেদ জামা কাপড় বদলে বিছানার কোনায় জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। যেন সে একটা অপরিচিত পরিবেশে বেড়াতে এসেছে। ওর অস্বস্তি দেখে আমার মনে কেন জানি স্বস্তি আসে। আমি কখনোই লাজুক বা ভীতু প্রকৃতির মেয়ে নই। চঞ্চল, উচ্ছল আর যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতী। যে কোনো পরিস্থিতে নিজেকে সামলে নিতে জানি। রাশেদের জুবুথুবু ভাব দেখে আমি সজাগ ভঙ্গিতে বিছানায় গিয়ে পা তুলে বসি।
রাশেদ আমার দিকে না তাকিয়েই বলে, তুমি এ বিয়েতে রাজি ছিলে না আমি জানি।
আমি কিছু না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকাই।
রাশেদ বলতে থাকে, আমার বিয়ের প্রস্তাবে তোমার চাচারা আমাকে নিয়ে দ্বিধায় ছিল। আমার পরিবার, আমার ব্যবসা সব কিছুই উনাদের পছন্দ ছিল কিন্তু আমার গায়ের রং নিয়ে হয়তো তারা ভাবছিল। তোমরা তো সবাই অনেক বেশি সুন্দর।
জানো, তখন আমার খুব আফসোস হয়েছিল। আমি কালো এ জন্য নয় আমার আফসোস ছিল তুমি কেন এতো সুন্দরী, কেন এতো ফর্সা। আমি তোমাকে যেদিন দেখেছিলাম ঐ দিনই পছন্দ করেছিলাম।

আমি মনে মনে মুখ বাঁকালাম। দেখা মাত্রই পছন্দ করেছেন রূপ দেখে আবার আফসোস করছেন কেন এতো সুন্দরী হলাম। কত যে ঢং জানে ছেলেরা!

রাশেদ বলল, তুমি হয়তো ভাবছো তোমার সৌন্দর্যে যে কেউ তোমাকে পছন্দ করবে। আমি কিন্তু তোমাকে অন্য কারণে পছন্দ করেছিলাম।

আমি একটু চমকে তাকাই। অন্য কি কারণ হতে পারে!

রাশেদ বলতে থাকে, তোমার পরিবারের দ্বিধার কথা জেনে আমি আর রিস্ক নেই নি। তোমার ছোট চাচীর সাথে আলাপ করি। সে-ই বাকি সব ঠিক করে। জানিনা তোমার চাচী আমার সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলেছে কিনা কিন্তু আমাকে তোমার সম্পর্কে সবই বলেছে। তুমি এখন বিয়ে করতে ইচ্ছুক না, তুমি পড়ালেখা চালাতে চাও, তোমার নিজের কিছু করার ইচ্ছা সব কিছুই আমাকে জানিয়েছে।
আমি কিন্তু তোমার অমতে এ বিয়ে করার পক্ষে ছিলাম না।

— তাহলে করলেন কেন?
–তুমি হয়তো জানো না তোমার ছোট চাচী শিউলি কিন্তু আমার ছোটবেলার বন্ধু। তুমি এখন বিয়ে করতে রাজি নও শুনে আমি তোমার অমতে বিয়ে করতে না চাওয়ায় শিউলি বলল আমি না করলেও তোমার বিয়ে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। তোমার বিয়ে অনেকটা জোর করেই দেয়া হবে অন্য কারো সাথে।

আমি দাঁত কিটমিট করে বললাম, তাই ছোট চাচী তার বন্ধুকেই বেছে নিলো।

রাশেদ হেসে বলল, আসলে ব্যাপারটা তা না। তোমার তো পছন্দের কেউ ছিলো না। তুমি শুধু পড়ালেখা করতে চেয়েছিলে। আর তোমার পরিবার মেয়েদের এতো পড়ালেখা শেখানোর মানসিকতা রাখে না।
অন্যদিকে আমার কাছে বিয়ের পর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কোনো সমস্যা না। আমি কিংবা আমার পরিবার এতে বাধা তো দিবোই না উল্টো তোমাকে সাহায্য করবো। তোমার চাচী আমার পরিবারকে ভালো করে চিনে। সে আমাকে বলেছিল আমার সাথে তোমার বিয়ে হলে তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে। নইলে তোমার অন্য কোথাও বিয়ে হলে সেখানে তুমি হয়তো সুখী হবে কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাবে।

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
রাশেদের কথাগুলো অনেকটাই ঠিক। আমার পড়ালেখার শখ, স্বপ্ন সবকিছু ছোট চাচী জানে আর আমার যেকোন সময় বিয়ে হয়ে যাবে এবং সেখানেই আমার স্বপ্নের পতন হবে তা আমিও জানতাম। তাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম ছোট চাচীর সাপোর্টে। তাহলে ছোট চাচী কি আমার ভালোর জন্যই এখানে বিয়ে দিয়েছে?
ছোট চাচী আমাকে এ বিয়ে নিয়ে কি যেন বলতে চেয়েছিলো বার বার কিন্তু আমি তখন কিছুই শোনার অবস্থায় ছিলাম না। সবকিছু এতো জলদি হচ্ছিল আর সবকিছুর মূলে ছোট চাচী ছিল শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল।

আমি বললাম, আপনি আমাকে কোথায় দেখেছেন?? আপনি বললেন আমাকে আপনি অন্য কারনে বিয়ে করেছেন। সে কারন টা কি?
—সব কি আজই বলতে হবে? অনেক রাত হয়েছে। আমরা না হয় আজ শুয়ে পড়ি।

আমি দুহাতে ভর দিয়ে তড়িঘড়ি পিছিয়ে তোতলার মতো বলি আ.. আ.৷ আমার কিছু কথা ছিল।
আমার এমন আচরণে রাশেদ অনেকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়।

আমি নিজেই লজ্জা পেয়ে যাই। রাশেদের চাহনীতে পুরোই বোঝা যায় আমি যা ভেবেছি রাশেদ তা মোটেও বোঝায় নি। এখন আমি কি বলবো? নিজের কাজে নিজেই লজ্জা পাচ্ছি।

রাশেদ মাথা নিচু করেই বলে তুমি কিছু বলতে চাইছিলে।

আমি আমতা আমতা করে বললাম, আসলে আপনি তো জানেনই আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। মানে মানসিক ভাবে আমি এখনও প্রস্তুত নই। আমাকে যদি…. আমি ঠোঁট কামড়ে আস্তে করে বললাম বৈবাহিক জীবণে আমাকে যদি একটু সময় দিতেন…

রাশেদ যেন আমার চেয়েও বেশি লজ্জা পেল।
হেসে বলল, তুমি নিশ্চিত থাকো। তুমি না চাওয়া পর্যন্ত আমি তোমার কাছে আসবো না। কিছুক্ষণ থেমে বলল, তুমি কি আমাকে বিছানা ছেড়ে অন্য কোথাও ঘুমাতে বলছো?
—না না! আপনি শুয়ে পড়ুন বলে আমি তাকে সামনে জায়গা দিয়ে পিছনে শুয়ে পড়লাম।

অন্ধকার রুমে শুয়ে শুয়ে কত কি ভাবতে লাগলাম।
রক্ষণশীল পরিবার বলে কখনো কোন ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব বা মেশা হয় নি। কলেজে ছেলেরা সব দূর থেকে দেখতো, মিশতে চাইতো। আমি সবসময় এড়িয়ে যেতাম। তাদের চাহনীতে সব সময় প্রেম, ভালোবাসা, আমার সৌন্দর্যের মুগ্ধতা ছিল। কিন্তু পাশে শোয়া মানুষটা জানি কেমন। আমার দিকে ঠিকমতো তাকালোও না।
রাশেদের স্বাভাবিক কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল আরও শুনি। অপরিচিত ছেলেদের সাথে কথা বলতে কেমন অনুভূতি হয় আমি তা জানি না। কিন্তু হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় যে চরম অশান্তি নিয়ে এতোক্ষণ বসে ছিলাম রাশেদের সাথে কথা বলে কেমন যেন হালকা লাগছে। অস্বস্তি ভাবটা যেন চলে গেছে।

পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার কথা ভাবতে থাকি আমি। একদিনে কি আর ভালোবাসা হয়!
রাশেদের কথায় আমি যা অনুভব করছি সেটা ভালোবাসা না, ভালোলাগাও না! সেটা অন্য কিছু।
সে শুয়ে যেতে বলল আর আমিও শুয়ে গেলাম।
সে আমার স্বামী আমার উপর সব অধিকার তার। কিন্তু সে বলল, আমি যেন তাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি। আমি কেন জানি তার উপর ভরসা করতে পারছি। এটা কেন হবে? তার মানে কি প্রথম দিনেই রাশেদ তার প্রতি আমার আস্থা অর্জন করতে পেরেছে?

চলবে।।

ঝিনুক চৌধুরী।।

চার পর্বের গল্প এটি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here