প্রায় এক ঘন্টা থেকে বউ সেজে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে ঝগড়া করছে আমার সদ্যবিবাহিত বরের আগের পক্ষের ছেলে মেয়েরা। তারা কিছুতেই বাড়ির ভিতর যেতে দিবে না আমাকে। বাইরে থেকে আমার বরও ঝগড়া করছে ওদের সাথে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে গেছে। কিছুতেই ওদের ঝগড়া থামছে না। এতো দিন মা বাবার ঘাড়ে বোঝা হয়ে ছিলাম কিন্তু এখন এ বাড়িতেও বোঝা হয়ে থাকতে হবে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। সুখ পাখি আমার মতো অভাগীর কপালে ধরা দিবে না। ওরা চিৎকার করে করে আমাকেও গালি দিচ্ছে,, আমি নাকি অর্থ-সম্পদের লোভে এই বুড়ো কে বিয়ে করেছি, আমি লোভী। গত দুইদিন ধরে কিছু খায় নি তারউপর এইসব চিল্লাপাল্লা মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

আমি আসমানি, বয়স ১৯। বাবা মায়ের আর্থিক অবস্থা জসিম উদ্দিনের সেই বিখ্যাত কবিতা “” আসমানী”” এর সাথে হুবহু মিল আছে। আসলে হয়তো আমাকে নিয়েই এই কবিতা টি লেখা। যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তার নাম আজিজুর রহমান আজিজ, বয়স চল্লিশ-উর্ধ্বে। উনি সম্পর্কে আমার প্রতিবেশী চাচা হোন। উনার ইটের ভাটা(ইট তৈরির কারখানা) বড় বড় দীঘি,, পান ক্ষেত সহ আরো অনেক ব্যাবসা এবং জমিজমা আছে।

আসমানী কবিতায়, আসমানীর বাবা রহিমদ্দির ভেন্না পাতার ছাওয়া ছোট বাড়ি ছিলো। কিন্তু আমার বাবার তাও ছিলো না। বুদ্ধি হওয়ার পরে থেকেই দেখে আসছি বাবা মায়ের এই রাস্তার ধারে, ওই ব্রিজের নিচে বা কারো পরিত্যক্ত ঘরে জীবন পার করতে। গত ১০ বছর থেকে পাশের গ্রামের আজিজ চাচার বড় দীঘির পাড়ে মেঠো রাস্তার ধারে ইটের তৈরি একটা ছোট দোকান ঘরে আমরা থাকি। এতো ছোট ঘরে ৫ জনের থাকা অসম্ভব তাই বাবা মা বাইরে বারান্দায় কলাপাতা দিয়ে ঘিরিয়ে একটা ঘরের মতো যায়গা করেছে। সেখানে রাতে মা বাবা ঘুমায় আর আমি ছোট দুই ভাই কে নিয়ে ঘরের মেঝেতে ঘুমাতাম।

বাবা সারাদিন মানুষের কামলা দিতেন,, মা আজিজ চাচার ইটের ভাটার কাজ করতেন এবং ওখানকার কর্মচারীদের রান্না করে দিতেন। তাদের রান্না করা অতিরিক্ত খাবার গুলো মা বাড়িতে নিয়ে আসতেন প্রতিদিন, আমার তিন ভাইবোন সেই খাবার খেয়ে দু বেলা পার করতাম। কোন দিন খাবার না বাঁচলে, না খেয়ে বা অর্ধপেটে থাকতে হতো। সারাদিন পরিশ্রম করার পরে রাতে বাবা আবারও সেই দীঘি পাহাড়া দিতো। মুলত আমাদের কে এই ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে এই দীঘির মাছ পাহাড়া দেওয়ার জন্য। আমি স্কুলে যায়,, ভালো লাগে স্কুলে যেতে। কিন্তু ভালো জামা কাপড় বা স্কুলের বিভিন্ন খরচ বহন করতে মা বাবা কে প্রচুর বেগ পেতে হতো।

একটু বড় হওয়ার আগে আমিও মাঝে মাঝে মায়ের সাথে ইটের ভাটায় কাজ করতাম এবং রান্নার কাজে সাহায্য করতাম। ছোট ভাই দুটোও স্কুলে যায় । সমাজের আনাচে কানাচে দুষ্টু মানুষের ছড়াছড়ি। যতই মায়ের সাথে কাজ করি না কেন,, কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেকের লালসার দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে আমাকে। কথা গুলো সাথে সাথে মাকে বলতাম কিন্তু গরিবের বিচার করার মতো কেউ নাই তাই মা আমাকেই উল্টো শাসন করে বলতেন, ভালো করে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে কাজ করতে পারোস না,, শরীরে কাপড় না থাকলে বেডা মানুষ তো তাকাবোই। তখন মনে মনে খুব রাগ হতো মায়ের উপর,, বুঝতাম না মা কেন আমাকেই শাসন করতেন।

একদিন আমার ছোট ভাইয়ের খুব জ্বর হয়েছিল বলে মা দুপুরের রান্না করার জন্য আমাকে একা পাঠিয়েছিলো। আমার খুব ভয় করছিলো যেতে,, কিন্তু না গেলে রাতের খাওয়া জুটবে না তাই মনে সাহস সঞ্চয় করে গেলাম। আমাকে একা যেতে দেখে দুই তিনজন লোক হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হলো। তরকারি কাটছিলাম তখন একজন লোক বিড়ি খাওয়ার জন্য আগুন নেওয়ার অজুহাতে আমার কাছে আসে।তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে বলে,, তোকে একশ টাকা দিবো যদি আমার কথা শুনিস। ঘিন্নায় গা ঘিনঘিন করছে,, আমি বটি হাতে নিয়ে সাথে সাথে বলি,আমি একটা কোপ দিবো যদি তুই এখান থেকে না যাস। সে হয়তো বুঝতে পারেনি আমি এমন আচরণ করবো তাই চুপচাপ চলে গেছে।

রান্না শেষ করে খাবার গুলো বাড়ার পরে সবাই কে খেতে বলে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি,, উনাদের খাওয়া হলে থালাবাসন পরিষ্কার করে অতিরিক্ত খাবার নিয়ে চলে যাবো। খেতে খেতে একজন আমাকে ডাক দিয়ে বলে,, কি রে আসমানী,, তুই এমন নাদুসনুদুস হলি কিভাবে, কার ছোঁয়া টোয়া নিস নাকি,,
অমনি বাকি সবাই হো হো করে হেসে উঠে। এতো গুলো মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ করার মতো কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না তাই চুপচাপ আরো দূরে গিয়ে দাড়ালাম।

বিকালে বাড়ি ফিরে খাবার গুলো রেখে ছোট ভাইয়ের কাছে গেলাম। এখনো খুব জ্বর,, গা পুড়ে যাচ্ছে,, ডাক্তার না দেখালে ভালো হবে না। আশেপাশে মা কে দেখতে পাচ্ছি না। রাতুল (ছোট ভাইয়ের নাম রাতুল আর মেঝোটার নাম মুকুল) কে জিজ্ঞেস করলাম মা কই গেছে। রাতুল বললো পাড়ার এক চাচি কাপড় কাঁচাড় জন্য ২০ টাকা দিতে চেয়েছে তাই মা ওদের কাপড় কাঁচতে গেছে। আমি রাতুলের গা ভেজা গামছা দিয়ে মুছে দিলাম তারপর একটু খাইয়ে দিলাম। আব্বা বিকালে বাজার থেকে ঔষধ নিয়ে আসে রাতুলের জন্য।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে ছিলো এমন সময় কে যেন আমাদের টিনের চালে ঢিল ছুড়ে। আব্বা সাথে সাথে কে ড়ে বলে টর্চ নিয়ে বাইরে যায় কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। গ্রামের কারো সাথে কখনো আমার বাবা খারাপ ব্যবহার করে না,, কেউ আমাদের শালা বলে গালি দিলেও তাকে বাবা বলে চলে আসেন।

যতই দিন যাচ্ছে ততই মানুষের কু-নজর পড়ছে আমার দিকে। মাঝে মধ্যে পাড়ার কিছু মহিলাদের সাথে পান ক্ষেতের কাজ করতে যেতাম। পানের বোঝা মাথায় তুলে দেওয়ার সময় ক্ষেতের মালিক আমার বুকে হাত দেয়। আচমকা এমন স্পর্শে আমার মাথা থেকে পানের বোঝা পড়ে যায়। তখন উনি উল্টো আমাকে মা** বলে গালি দিয়ে পানের দাম উসুল করে নেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে যান। অনেক গুলো পান নষ্ট হয়েছে,,কিন্তু কেন এমন হলো সেটা কাউকে বলতেও পারছি না। আমার সাথের মহিলারা আমাকে বলেন,, আমি যেন উনার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাই তাহলে হয়তো জরিমানা নিবে না। আমি কিছুতেই উনার কাছে যেতে রাজি হচ্ছি না দেখে ওই মেয়েরাও আমার উপর রেগে যায়।পরে বাধ্য হয়ে আমি উনার কাছে যায় কিন্তু আমার সাথে আরো দুজন মেয়ে ছিলো,, ইচ্ছে করে তাদের সাথে নিয়ে গেছি যেন একা পেয়ে আমার কোন ক্ষতি করতে না পারে। উনি শাস্তি স্বরূপ আমাকে আগামী ২ দিন বিনা পয়সার কাজ করতে বলেন।

পরের দুই দিন ছিলো নিজের সম্মান রক্ষা করার লড়াই। সবাই কে এক ধারের সারিতে পান ছিড়তে বললেও আমাকে অন্য ধারে পাঠাতো,, আমি একজনকে সব কিছু খুলে বলেছিলাম,, উনি আমার দিকে যথেষ্ট নজর রাখতো আর আমি নিজেও সব সময় সতর্ক ছিলাম বলে কোন সুযোগ পাই নি। জীবনের প্রতিটি পদে পদে নানা বিপদের সম্মুখীন হয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে জীবন টা তিতা হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে দুই একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে কিন্তু যৌতুকের দাবি পুরন করার সামর্থ্য নাই বলে সেগুলো দুর থেকেই চলে যায়। শুধুমাত্র কু-প্রস্তাব গুলোই নিকট পর্যন্ত আসে। আমাদের বাড়ির পাশের মাটির রাস্তাটা পাকা হবে তাই দূর দুরান্ত থেকে অনেক লোকজন এসেছে কাজ করতে। যতদিন কাজ শেষ না হয় ততদিন তাদেরকে রান্না করে দেওয়ার জন্য লোক খুঁজছে।যেহেতু গ্রামের সবাই জানে আমরা ইট ভাটায় রান্নার কাজ করি তাই রাস্তার লোকের রান্না করবো কি না তা জিজ্ঞেস করেন উনারা। উনাদের রান্না বাড়িতে করা যাবে,, রাতুল মুকুল দুজনেই রাজি হলো, তারাও সাহায্য করবে,, মা ইট ভাটায় রান্না করবে আর আমরা তিন ভাইবোন বাড়িতে। অতিরিক্ত কিছু টাকার আশায় আমিও রাজি হলাম।

যেহেতু রান্নাবান্না সব বাড়িতে তাই ওইসব লোকের আনাগোনা বেশি শুরু হলো। কারণে অকারণে, বিভিন্ন অজুহাতে বাড়িতে এসে বসে থাকে,, এটা সেটা বলে গল্প করে। তাদের মধ্যে একটা ছেলের নাম ছিলো সুজন। বুদ্ধি হওয়ার পরে থেকে ছেলে মানুষের বিভিন্ন রকম নজর দেখে বড় হয়েছি তাই খুব সহজে এখন বুঝতে পারি কে কোন নজরে আমাকে দেখে। সুজন ছেলে টা মাঝে মাঝে আমার সাথে দুই একটা করে কথা বলতো। আমি বুঝতাম হয়তো আমার সাথে কথা বলতে তার লজ্জা হয়। মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে,, আমার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় তারাহুরো করে উঠে চলে যেতো। বুঝিনা ছেলে মানুষের এতো লজ্জা কেন।

একদিন রাতে খাওয়ার সময় বাবাকে উনারা জিজ্ঞেস করলেন,, আমাকে বিয়ে দিবেন কি না। বাবা বললেন ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিবেন। তখন উনারা কথায় কথায় সুজনের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন,,,

চলবে,,

#সুখ_সন্ধানী
সুচনা পর্ব
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno

ভালো রেসপন্স পেলে বাকি পর্ব গুলো লেখার আগ্রহ বাড়বে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here