#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ১১
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno

অবশেষে উনারা এসে পৌছালেন দুপুরের আগে। রাশেদ ভাইজানের সাথে কালো লম্বা, চোখ দুটো কেমন যেন ছোট ছোট দেখতে একজন এসেছেন। আমি তো চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি। বুকের মধ্যে ধুকুপুকু নিয়ে উনাদের সামনে নিজের করা বেশ কিছু রান্না পরিবেশন করলাম। মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকছি, যেন আমার রান্না গুলো উনার পছন্দ হয়। উনি সব গুলো খাবার থেকে সামান্য কিছু খাচ্ছেন কিন্তু মুখে তেমন কিছুই বলছেন না।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না আমাকে। অবশেষে রাশেদ ভাইজান আমাকে ডেকে বলেন,, যদি কিছু গোছগাছ করার থাকে তাহলে যেন গোছগাছ শুরু করে দিই। কারণ আমরা কাল সকালেই চট্রগ্রাম যাবো। তারমানে উনি আমার রান্না পছন্দ করেছেন। খুব খুশি লাগছে এখন। ইশ মা যদি থাকতো তাহলে কত খুশি হতেন। রান্না গুলো তো মায়ের কাছে থেকেই শেখা। ভাবতেই চোখ ভিজে গেলো নোনা পানিতে।

খালাকে জড়িয়ে কান্না করলাম, ফাতেমার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম, নিজের অজান্তে কখনো কষ্ট দিয়েছি ভেবে। আল্লাহর নাম মুখে নিয়ে আবারও রওনা দিলাম। চট্রগ্রামে পৌছাতে পৌঁছাতে বিকাল হয়ে গেছে। রাশেদ ভাইজান আমাকে নিয়ে প্রথমে উনার বাসায় গেলেন। দুইদিন পরে এক তারিখ। ওইদিন থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হবে। বাসায় ভাবি এবং তুর্জের জন্য রান্না করে দিই এই দুইদিন। আজ ভাইজান ভাবি তুর্জ আমাকে নিয়ে ওই রেস্টুরেন্টে আসেন। এখানেই আমার থাকার ব্যাবস্থা আছে। মাঝে মাঝে ভাইজান ভাবি এখানে আসবেন বলে আমাকে শান্তনা দেন। যেখানে নিজের জন্মদাত্রী মা এবং নাড়ী ছেড়া ধনকে ছেড়ে একা একা জীবন পার করতে পারছি সেখানে উনারা তো ক্ষনিকের সঙ্গী মাত্র।

এখন আমাকে সারাক্ষণ রান্না করতে হয়। মালিক আমার উপর ভিষণ খুশি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে উনি আমাদের সাথে আরো যারা আছেন তাদের ভালো মন্দ খবর নেন। এখানে থাকতে থাকতে প্রায় অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়েছে। একদিন বিকালে রান্না ঘর ছেড়ে সামান্য কিছু সময়ের জন্য বাইরে আসি। পাশের টেবিলে কেমন পরিচিত পরিচিত কাউকে দেখলাম। কিন্তু মনে করতে পারছিনা কে উনি। উনাকে আমি চিনি, কোথায় যেন দেখেছি,, খুব চেষ্টা করছি কে উনি মনে করার।

হঠাৎ করে মনে হলো ইনিই তো সেই মানুষ যে ঢাকায় আসার সময় আমাদের সাহায্যের নামে সর্বনাশ করেছেন। উনার কাছে হয়তো আমার মা ভাই ছেলের কোন খবর পাওয়া যাবে। উনি খাওয়া শেষে উঠে চলে যাচ্ছেন। আমি পিছনে যেতেই দেখি আমাদের মালিকের সাথে কথা বলছেন। একটু দূরে দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে উনার কথা গুলো শোনার চেষ্টা করছি। উনি কোন একটা অনুষ্ঠানের জন্য খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন। দুইদিন পরে উনার খাবার লাগবে।

আমি উনার কাছে যাওয়ার আগেই উনি চলে গেছেন। এতো কাছে পেয়েও উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। কে উনি, কি করেন এইসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন সময় পেছনে থেকে আসমানী বলে মালিকের ডাক শুনতে পেলাম। উনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,, একটু আগে যার সাথে কথা বললেন উনি কে ছিলেন।

মালিক আমাকে একটা ঠিকানা দেখিয়ে বললেন, এই ঠিকানায় দুশো প্যাকেট খাবারের অর্ডার দিলেন। আমিও চিনি না কে উনি। তারপর উনি ঠিকানাটা আমাদের ম্যানেজার কে দিয়ে কি কি খাবার যাবে তার বর্ননা দিলেন।

ম্যানেজারের সাথে ও মাঝে মাঝে কথা বলতাম কিন্তু তেমন ভাবে কখনো কথা বলি নি। আমার ওই লোকটার সাথে কথা বলতেই হবে তাই ম্যানেজার ভাইকে এটা সেটা বলে কথার ছলে ওই ঠিকানা নিলাম। যেহেতু আমি চট্রগ্রামে আসার পরে কখনো এই রেস্টুরেন্টের বাইরে যায় নি তাই ম্যানেজার ভাইকে বললাম আমাকে নিয়ে যদি এই ঠিকানায় যেতেন তাহলে যায়গা টা কেমন দেখা হতো আর আমার একটু বাইরে থেকে বেড়িয়ে আসা হতো। উনি আজ সন্ধ্যার পরে আমার দ্বায়িত্ব গুলো আরেকজন কে দিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন।

অপেক্ষার প্রহর খুবই ধীরগতির হয়। সন্ধ্যার পরে আমি আর ম্যানেজার ভাই গেলাম ওখানে। কেমন আধাপুরনো একটা বাড়ি, চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। ম্যানেজার ভাই সামনের রাস্তা দিয়ে হাটছেন আর আমি পিছনে থেকে চুপিচুপি ওই বাড়ির ভিতর ঢুকে যায়। এদিকে সেদিকে কোথাও কারো দেখা নাই। কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসবো এমন সময় সেই পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পায়। সাথে সাথে একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ি।

দুজন লোকের সাথে উনি হেটে আসছেন এবং বলছেন,, এইবার কিন্তু অনেক বড় অপারেশন হবে। ট্রলার টা যায়গা মতো রাখবি,, পুরো দুশো জনের ট্রিপ। কোন রকম ভুল হলে সর্বনাশ হবে। যেহেতু উনারা হেটে হেটে যাচ্ছেন আর এই কথা গুলো বলছেন তাই আমি আর কিছু শুনতে পেলাম না। তবে আন্দাজ করতে পেরেছি তারা কি নিয়ে কথা বলেছেন।

আপাতত এখানে থাকাটা বিপদজনক, যা করতে হবে সব ভেবে করতে হবে। আমি খুব সাবধানে বাড়ির বাইরে চলে আসি,, আশেপাশে কোথায় ম্যানেজার ভাই কে দেখলাম না,, এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে দূরে ভাইকে দেখলাম।আমি পিছনে থেকে জোরে করে ডাক দিতেই উনি হন্তদন্ত হয়ে কাছে এসে বললেন, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কত ভয় পেয়েছি জানো?

রেস্টুরেন্টে ফিরে আসার পরে মনে মনে প্ল্যান করি আজ রাতে সবাই ঘুমানোর পরে আমি আবারও যাবো। আমাকে জানতেই হবে আমার আপনজনের সাথে কি ঘটেছে। রেস্টুরেন্টের কাজ শেষ করা বললেই করা সম্ভব না। ঘড়িতে ১২ টা পার হয়ে গেছে। আমি রান্নার কাটাকাটিতে ব্যবহৃত ছোট ছোট কয়েকটি অস্ত্র নিলাম প্রয়োজনে ব্যবহার করবো ভেবে। একটা কালো চাদড়ে নিজেকে ঘিরে নিলাম। তারপর চুপিসারে বাইরে চলে আসি। নির্জন রাস্তায় অনেক্ক্ষণ পর পরে দুই এক জন মানুষের দেখা মিলছে।

সন্ধ্যাবেলা রিকশাতে গেছিলাম, যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের বেশ কিছু যায়গা চিহ্নিত করে রেখেছিলাম যেন পরের বার আসার সময় চিনতে অসুবিধা না হয়। রাতের গভীরতার সাথে ঝিঝিপোকার ডাকের গভীরতা বেড়েই চলেছে। আমি বাড়িটার গেইটের এক পাশের ভাঙা ছিদ্র দিয়ে কোন রকম ভিতরে যায়। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দূরের কোন এক ঘরে সামান্য আলো দেখা যাচ্ছে তাই সেখানে পৌঁছাতে অগ্রসর হলাম। পা দুটো অসার হয়ে যাচ্ছে, সামনে এগোতে খুব ভয় করছে। কিন্তু এমন ছন্নছাড়া একাকী জীবনের কারণ খুঁজতে দৃঢ় সংকল্প করেছি।

ঘরের বাইরে থেকে আবছা গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই শব্দ টা একজনের না, বহুজনের।কিন্তু জানালা গুলো অনেক উঁচুতে হওয়ার জন্য কোন ভাবে সেখানে কি চলছে তা দেখতে পাচ্ছি না। বাড়ির বাম পাশের একটা ছোট্ট ঘর থেকে হাসির শব্দের মতো কিছু শোনা যাচ্ছে। আমি আবারও পা বাড়ালাম সেদিকে। কিন্তু আবারও নিরাশ কারণ বাড়ির পিছনের দিকে অনেক নিচু করে বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে। ইচ্ছে করলেও জানালায় উঁকি দেওয়া সম্ভব না।

ফিরে আসবো এমন সময় কিছু একটার সাথে হচোট খেয়ে পরে গেলাম। হাতের তালুতে ব্যাথা করছে দেখে অন্য হাত দিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি। হাতে কিছু একটা লেগে কেটে গেছে হয়তো,, কেমন যেন আঠা আঠা লাগছে। এই ছোট্ট খাটো বিষয় নিয়ে পরে থাকলে চলবে না। উঠে আসার সময় খেয়াল করি একটা কাঠের গুড়িতে হচোট খেয়েছিলাম।

গুড়িটা গড়িয়ে গড়িয়ে জানালার পাশে নিয়ে অতি সাবধানে তার উপর উঠে চেষ্টা করছি ভিতরে কি হচ্ছে তা বুঝতে। আর একটু উঁচু হলে সব কিছু পরিষ্কার দেখা যেতো। তবে এই ঘরে ৪/৫ জন মানুষ আছে তা বুঝতে পারছি। এখন আমি গুড়িটি আবারও আগের ঘরের পেছনে এনে ভিতরে তাকিয়ে দেখি, বেশ কিছু ছোট ছোট বাচ্চা, কেউ কেউ স্কুল ড্রেস পড়া,আবার অনেকে পথশিশু। এদের মধ্যে আমার দুই ভাই এবং ছেলে আছে নাকি তা দেখতে মরিয়া হয়ে উঠি।কিন্তু কোন ভাবেই এই ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে পুরো ঘরের ভিতর দেখা যাচ্ছে না।

দুই হাতে দুটো ছোট্ট ধারালো ছুরি নিয়ে এগুলো থাকি বাড়ির সামনে। কাঠের তৈরি শক্ত দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করা। হয়তো উনাদের সাঙ্গপাঙ্গরা সবাই ওই ঘরে এক সাথে আছে। টানা চারটি রুমের মাঝের দুটোতে বাচ্চাদের রেখেছে মনে হচ্ছে। এখন খুব রাগ হচ্ছে নিজের উপর, আজ একটা ফোন থাকলে পুলিশকে জানানো যেতো। আর আমি তো এখানকার থানা পুলিশ কিচ্ছু চিনি না। অন্ধকার দেখে দেখে পা ফেলে এগুচ্ছি সামনে। এমন সময় হঠাৎ করে ওই ঘরের দরজা খুলে কেউ একজন বাইরে চলে আসে, সাথে পাশের পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ি, উনি উনার হাতের টর্চটা এইদিকে একবার ধরলেন। আমি মনে প্রাণে আল্লাহ কে ডেকে যাচ্ছি।

বেশ কিছুক্ষন হয়ে গেছে আর কারো কোন সারা-শব্দ পায় নি। নিজেকে শান্ত করে আবারও মনে সাহস সঞ্চার করে এগুতে থাকি। বাইরের আলো বন্ধ হওয়াতে আমার সুবিধা হয়েছে। আমি ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখতেই ভিতরে একটা মেয়ে আর চারজন পুরুষ মানুষকে দেখলাম। উনারা সবাই নেশা করছেন আর টাকা পয়সার হিসাব করছেন। এক সাথে এতো জনের সঙ্গে লড়াই করে পেড়ে উঠা সম্ভব না। তাই সুযোগের অপেক্ষাই থাকলাম। উনাদের ঘরের ভিতর কোন ওয়াশরুম দেখতে পাচ্ছি না।

আমি বাইরের চারিদিকে খুজতে থাকি কোথাও ওয়াশরুম আছে নাকি। মানুষ দুনিয়ার সব কাজ সঙ্গবদ্ধ ভাবে করলেও একমাত্র ওয়াশরুমে একাকী আসে। এই সুযোগ টা-ই কাজে লাগাতে হবে। টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট ওয়াশরুম। আল্লাহ হয়তো আজ আমার সহায় হয়েছেন তাই ওয়াশরুম টা বাইরে। আমি ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করতে থাকি কারো আসার জন্য।

এতো গুলো মাসুম বাচ্চাদের জীবন বাচাতে যে কোন কিছু করতে রাজি আমি। বেশ কিছুক্ষণ পরে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। নিজের অস্ত্রপাতি গুলো আবারও রেডি করে নিলাম। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগে অতর্কিত ভাবে আঘাত করে আহত করে দিতে হবে। দরজার কোণে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক তখনই

চলবে,,,,,

যারা আমাকে কমেন্ট করে গল্প লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন তাদেরকে পেইজের ফলোয়ার এক হাজার উপলক্ষে এত্তগুলা ভালোবাসা। খুব তারাতাড়ি বেশ কিছু আপির নাম উল্লেখ্য করে পোস্ট করবো 🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here