#সাহেব_বাবুর_বউ- [০৫]

বেশ কয়েকদিন ধরের নূরির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সময় অসময়ে জ্বর চলে আসে সাথে মাথা ব্যাথা তো আছেই। এখন আর ঠিক মতো কলেজেও যেতে পারে না। রানীমা মাঝে মাঝে আসেন নূরিদের বাড়ি। লম্বা সময় ধরে চলে তাদের আলাপন। তাদের সব কথা হয় শুধু সাহেবকে নিয়ে। এই যেন নূরি এখন অসুস্থ, ঠিকমতো শরীরের যত্নটাও নেয় না। সময়মত খাবার খায়না। সাহেব থাকলে এমনটা হতো না। সাহেব নিজ হাতে যত্ন নিত নূরির। আসলে নূরি এখন নিজেকে সবার থেকে দূরে কোথাও আড়াল করতে চাইছে কিন্তু পেরে উঠছে না। আবারও শরীর কাপিয়ে জ্বর উঠেছে নূরির। রানীমা শিয়রের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন, “কেন এমন করছিস? কেন নিজের ক্ষতি করছিস? তোর কিছু হলে যে আমার নাতীটাকে আর বাঁচানো যাবে না।”
” আমি মরে গেলে তো ভালোই হবে। ওর পছন্দ মত মেয়েকে বিয়ে করে নিবে।”
” আমাদের কথাটাও একবারও ভাববি না।” জানিস সেদিন যখন আমি ওর ঘরে গেলাম তখন দেখি ওর হাতে একটা বই। সাদিয়া খান সুবাসিনীর লেখা শিরোনামহীন বইটা। এটা আমার খুব পছন্দের বই। তবে জানিস যখন দেখলো ছেলেটা মেয়েটাকে রেখে বিদেশে চলে যায় তখনি বইটা রেখে দিলো আর বলল অসহ্য। তোকে ছাড়া যে ও আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।”
“তুমি কি জানো তোমার নাতীর কুড়িটা গার্লফ্রেন্ড। যখন দেখি আমার সামনে মেঘনাকে জড়িয়ে ধরে তখন আমার পাঁজর ভেঙে আসে। নিজেকে বড্ড অস্তিত্বহীন মনে হয়।” রানীমা নূরিকে নিজের বুকে টেনে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।

নূরির জ্বরের কথা শুনে আহনাফ আসে নূরির বাড়ি। সাথে আসেন রানীমা। আহনাফ নূরির ঘরে গেলে নূরী চুপচাপ বসে থাকে কোন কথা বলে না। আহনাফ-ই শুরু করে, ” ভালো ডক্টর দেখিয়েছ? আমাদের গ্রামের থেকে শহরের ডক্টররা বেশী অবিজ্ঞ সম্পন্ন। তুমি শহরের কোন ডক্টরকে দেখাও।” আহনাফের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না নূরি। পাশ ফিরে থাকে। আহনাফের দৃষ্টি নূরির মুখের দিকে। বুকের ভিতরে আবার প্রচন্ড জ্বালা করছে। চিনচিন করে ব্যাথা করছে। কেমন জানি অস্থির অসহায় লাগছে। কেমন মুখ ফিরিয়ে আছে মেয়েটা! এত অবঞ্জা সহ্য হয় না আহনাফের। কথারও কোন জবাব দিলো না। দিশা হারা লাগছে আহনাফের। আহনাফের এমন অসহায়ত্ব ছোবল মারে সেই নূরিকেই। মুখ খুলে নূরি,
“সামান্য জ্বরে এত দাপাদাপি করার কিছুই নাই। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”
“এতদিনেও কেন হলো না তাহলে?” নূরি চুপ মেরে বসে রইলো। চোখদুটি ক্রমশ ঝাপসা হতে লাগলো। এ যেন চোখের সামনে সাহেব বসে আছে। সাহেবের মতো করে তাকে শাসাচ্ছে। নিজেকে কোন মতে সামলে নূরি বলে, “তুমি কেন এত ভাবছো?”
“কারন আমি ছোটতে তোমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম।” কথাটা শুনে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে নূরি। প্রশ্ন করে,
“তোমার সব মনে পরেছে? ”
” না, নানুর কাছেই শুনেছি তুমি আমার বন্ধু ছিলে। আমার রুমে তোমার সাথে আমার একটা ফটো আছে।” সব আনন্দ উল্লাস নিমিষেই মিলিয়ে যায় নূরির। মনে মনে বলে, ” তুমি শুধু আমার বন্ধু নও সাহেব। তুমি যে আমার প্রান। তোমাকে ভালোবেসেছি ভালোবাসার শব্দটার মানে বুঝার আগেই।” আহনাফকে প্রশ্ন করে নূরি,
” এই জন্যেই দেখতে এসেছো বুঝি! বন্ধুত্বের মান রাখতে।” জবাব দেয়না আহনাফ। রাগে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। এত প্রশ্ন কেন মেয়েটার। মনে মনে বলে উঠে,
“বন্ধুত্বের মান রাখতে আসিনি। একদিন তোমার দর্শন না পেলে আমি অন্ধকারে ডুবে যাই। কতশত অপেক্ষা করি শুধু তোমার দেখার আশায়। তুমি কি করে বুঝবে অপেক্ষার যান্তনা! তুমি তো আর প্রেমে পড়ো নি। আচ্ছা, এত কেন অবঞ্জা,কেন এত ঘৃনা করো আমায় নূরি। আমি কি এতটাই অযোগ্য। একবার, শুধু একবার ফিরে তাকাও আমার পানে নূরি, আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। যদি তুমি আমায় ভালোবাসো, আমিও তোমায় সারা আকাশ ভেঙ্গে ভালোবাসা দেবো । আমি তোমায় ভালোবাসবো চোখে চোখ রেখে। ভালোবাসবো তোমায় আঙুলের স্পর্শে। সব দুর্নিবার দূরত্বের কষ্ট আমি উড়িয়ে দিবো বুকে চেপে ধরে। তোমার অস্থিরতা আমি শান্ত করবো। তোমার সব অতৃপ্ততা আমি ভালোবাসার আগুনে পুড়িয়ে দিবো। তোমার অভিমানে জল আমি ঠোঁটে ছুয়ে মুছে দিবো । তোমায় ভালোবাসবো আমি সঙ্গীতের মূর্ছনায়। আমি ভালোবাসবো তোমার সুগন্ধি। তোমার প্রতিটি মুহূর্ত কাটবে প্রথম মুহূর্তের পুনরাবির্ভাবের পুলকে। আমি বুঝে নিবো তোমার সব সুক্ষতা। আমি চিনে নিবো তোমার সব চাতুর্য। আমি বাস্তব করবো তোমার সব কল্পনা। মিটাবো তোমার সব উত্তেজনা। তোমার সব শীতলতা আমি উষ্ণ করে দিবো। তোমার আসক্তিতে আমি সবসময় স্পর্শ দিবো।তুমি খুশীতে হাসবে আমার কৌশলে।তোমায় কষ্ট কখনো খুজে পাবেনা। তুমি যদি অত্যাচারের তীব্রতা আর ঘৃনায় সুখ খুঁজতে চাও, তবে বৃস্টির জল দেখতে দেখতে তোমার নিয়ে আমি খেলবো। খেলতে খেলতে তোমায় অসহায় করবে না পাওয়ার যন্ত্রণা। তোমায় একা বইতে দিবো বিরহ। দ্রোহের যন্ত্রণায় কেমন লাল হয়ে যাও তুমি, আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো। ক্রোধে বের হয়ে আসা তোমার কান্না আমি হাসিমুখে উপভোগ করবো। যদি হেরে যাও নিজের কাছে, আত্মসমর্পণ করে ফেলো, তবে ভালোবাসা জড়িয়ে দেবো তোমার পরতে পরতে। তোমার সব চিন্তা-ভাবনা- ইচ্ছা-কাজের আমি স্বীকৃতি দিবো। তোমার গোপন প্রকাশ্য সব রুচিতে আমি পাশে থাকবো। তোমায় ঘেরা প্রকৃতির সব অসমতায়, দুঃসংবাদে, সুসংবাদে ,শোকে, মৃত্যুতে,রোগে ব্যর্থতায়, বিচ্ছিন্নতায় আমি ছায়ার মতো থাকবো, তোমায় সঙ্গ দিবো সর্বদা।”

বাড়ি ফিরে এসে ঠান্ডা পানিতে গোসল করে আহনাফ। ঠান্ডা পানিতে গোসল করে এখন প্রানটাও শীতল লাগছে তার। ফেরার সময় রানীমার থেকে জেনে নিয়েছে, নূরির বয়ফ্রেন্ড এখন নেই সে হাড়িয়ে গেছে। আহনাফের মন এখন সদ্য ফুটা কলির ন্যায় ফুরফুরে সিগ্ধ। যাক বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারখা মিটলো তাহলে! তবে ওর শরীরের অবস্থার কথা মনে করে আবারও শান্ত মনটা অশান্ত হয়ে যায়। রানীমাকে জানিয়ে দিয়েছে, নূরিকে শহরের কোন ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে যত টাকা লাগে সব বহন করবে জমিদার হাউস। আহনাফের কথা শুনে চমকে উঠেন রানীমা। কৌতুহল নিয়ে আহনাফের দিকে তাকায় আর বলে,
” নূরির চিকিৎসার খরচ আমরা কেন বহন করবো?”
” ওর বাবা তো আমাদের কোম্পানিতেই কাজ করে। ওদের ভালোমন্দের দেখভাল তো আমাদেরই করতে হবে।” রানীমা আর কোন কথা বলেন না। শান্ত কোমল সিগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে থাকে আহনাফের দিকে। ওয়াশরুমে আয়নার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে আহনাফ। দুধসাদা গায়ের রংয়ের উপর কালো লোমবিশিষ্ট সুঠাম দেহের উপর বিন্দু বিন্দু পানির দানা গড়িয়ে পরছে। বড্ড মোহনীয় লাগছে আহনাফ। যে কোন কিশোরীর মনে শিহরণ জাগিয়ে দেওয়ার মতো। আয়নায়তে প্রতিবিম্ব নীল চোখের দিকে তাকিয়ে গালে হাত রেখে বলল, “আমাকেই খোঁজ নিতে হবে কোন মহাপুরুষ তোমার মনে জায়গা করে নিয়েছে। যাকে মন দিলে সে তোমার মনের দেখভাল করে করে না। যতই খারাপ ভাবোআমায় ব্যাপারটা আমাকেই দেখতে হবে তোমার প্রেমিক দেখবে না। সে শুধু তোমার মধু খাবে কাটায় রক্তাক্ত হবে না। রক্তাক্ত হওয়ার জন্যে তো আহনাফ আছেই, আহনাফের মন্দ কপাল যে।

আগামি কাল বড় সাহেব আর রানীমার পঁয়ষট্টিতম বিবাহ বার্ষিকী। জমিদার মহলে বেশ ঘটা করেই এই উৎসবটা পালন করেন প্রতিবছর। শত ব্যাস্ততার মাঝেও বড় সাহেব এই দিনটা রেখে দেন শুধুমাত্র রানীমার জন্যে। এই দিনে রানীমার খুশি যেন আর ধরে না। রানীমার কাছেই শুনেছে কাল নূরিও আসবে এখানে।তখন থেকে আহনাফের খুশি দেখে কে? গত বছর তো এই দিনটাতেই প্রথম দেখেছিল সে নূরিকে। পুরো মহলটাকে সাজানো হয়েছে হরেক রকমের ফুল দিয়ে। আহনাফ ও তার গ্যাংয়ের সদস্যরা ডেকোরেশনের দায়িত্ব নিয়েছে। গেটে থেকে মহলের ভিতরে প্রবেশের জন্যে প্রায় পঞ্চাশ ফুঁট রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে গাধা ফুলের মালা। এই কাজটা বেশ যত্ননিয়ে করছে আহনাফ। অধোরে তার হাসির মেলা। যত্নকরে মালা লাগিয়ে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় আহনাফ। নিচে পরে থাকা ফুলগুলোর উপর আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ভাবছে, “তোমার রুপ যে এই বাহারী ফুল কেও হাড় মানাবে নূরি। এই ফুলের সুভাষে আমার মন ভালো হয়ে যায় আর তোমার শরীরের ঘ্নানে আমি পাগল উম্মাদ মাতাল হয়ে যাই।” দিপার কথায় সামনে তাকায় আহনাফ। “সত্যি বলছি ভাইয়া আজ তোমাকে কুমার সাহেবের মতো লাগছে। এখন একটা রাজকন্যা হলেই হবে।” দিপার কথায় মৃদু হাসে আহনাফ আর বলে, ” শুধু রাজকন্যা হলেই হবে না তাকে হতে হবে সর্বগুনসম্পন্ম গুণান্বিত। নগরপাড়ার কুমারের বউ কি এমনি এমনি হবে নাকি।” আহনাফের কথার মাঝে রানীমা এসে বলে,
” ঠিকই তো, যে সে কি আর আমার সাহেবের বউ হতে পারে।” সাহেব কথাটা আহনাফের বুকে গিয়ে লাগে। বুকের বা পাশটায় পচন্ড জ্বালা অনুভব করে সে। দু হাতে মাথা চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। রানীমার বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর কষ্টটা তাইতো তিনি চোখের ইশারায় দিপাকে চলে যেতে বলে নিজের নাতীর মাথায় হাত রাখেন। তাকে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টার করছে। আহনাফ এখন কিছুটা শান্ত তবে চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে লাগছে। রানীমা এখনো আহনাফের মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে তখনি পিছন থেকে ভেসে এলো কোকিলের ন্যায় কন্ঠশ্বর।
” কি হয়েছে ওর রানীমা?” কন্ঠটা চিনতে বুঝতে সময় লাগলো না আহনাফের। অস্ফুটভাবে বলল, নূরি। পিছন ফিরে নূরিকে দেখে যেন থমকে যায় আহনাফের পুরো দুনিয়া।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here