#সাহেব_বাবুর_বউ – [০৩]

পরেরদিন সাহেব চলে যায় সুদূর ইংল্যান্ডে। আর নূরি থেকে যায় বাংলার মাটিতে। সেখানে গিয়ে সাহেব নিজের পড়াশুনা নিয়ে শত ব্যস্তাতার মাঝেও রাতে নূরিকে কল করতে ভুলতো না। নূরির গলা শুনেই যে সাহেবের সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। মাঝে মাঝে নূরি যখন কাঁদতো তখন ওপাশ থেকে সাহেব বলতো, ” আমি সদূর ইংল্যান্ড থেকে তোর কান্নার শব্দ পাই নূর। তুই এমন করলে আমি এখানে কি করে থাকবো বলতো সোনা।” তখন মনে হতো নূরির ভিতরটাকে কেউ ক্ষত বিক্ষত করছে। এভাবেই চলতে থাকে দিন। বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়। সাহেবের এম বি এ এক্সাম ও শেষ হয়। সে বছর অক্সফোর্ডের রেজাল্ট শিডিউলে ম্যাথম্যাটিকস্ এ সর্বোচ্চ পাঁচ জনের মাঝে তৃতীয় স্থান লাভ করে সাহেব। রাতে নূরির সাথে প্রায় দুই ঘন্টা কথা হয় সাহেবের। পরেরদিন সাহেব বাংলায় ফিরে আসবে। এই প্রত্যাশা নিয়ে দুই প্রান্তে থাকা দুটি মানুষ স্বপ্ন বুনতে বুনতে ঘুমিয়ে যায়। তারপর কেটে যায় চারদিন। এর মধ্যে সাহেব নূরিকে একবারও কল করেনি। আর না সাহেব ফিরে এসেছে। চারদিনে নূরি পুরো উন্মাদ হয়ে যায়। পাগলের মতো পলাপ করতে করতে চলে আসে মহলে। সেখানে এসে জানতে পারে সাহেবের এক্সিডেন্ট হয়েচে। রানীমা আর বড় সাহেব গেছেন ইংল্যান্ডে। সেদিন নূরি খুব অসহায় হয়ে পরছিলো। তারথেকেও বেশী অসহায় হয়েছিলো সেদিন যেদিন সাহেব ফিরে। কারন সেদিন রানীমার সাথে সাহেব ফিরেনি ফিরেছিলো আহনাফ চৌধুরী। এক্সিডেন্টে সাহেবের স্মৃতি হাড়িয়ে স্মৃতিহীন সাহেব হয়ে যায় আহনাফ। নূরি শুধু অপেক্ষা করতো কবে সাহেবের স্মৃতি ফিরবে আর ওকে কাছে টেনে নিবে। কিন্তু সেদিন আজ-ও আসে নি। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় নূরি। এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার কারনে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি ঠিক-ই বলেছিলে সাহেব। আমাকে ভুলে যাওয়ার আগে তুমি নিজেকেই ভুলে যাবে। আজ দেখো সেটাই হয়েছে তুমি ভুলে গেছো নিজেকে। আমার সাহেব তোমার মতো এমন বেপরোয়া ছিলো না। আমার সাহেব ছিলো অসাধারণ এক প্রকৃতি প্রদত্ত শক্তি। তার কথা, কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, মুখচ্ছবি এবং শারীরিক গঠনে এমন এক মহাজাগতিক সৌন্দর্য সন্নিবেশিত থাকতো যে, মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার পানে চেয়ে থাকতো । সাহেব ছিলো পরোপকারী এবং সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সে সবাইকে ভালোবাসতো। তুমি যেমন আমাকে তোমার শত্রু মনে করে কষ্ট দাও আমার সাহেব কিন্তু তার শত্রুকে কষ্ট দিতো না। সে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করতো। তুমি কোন দিনও আমার সাহেব হতে পারবে না আহনাফ চৌধুরী।”

তারপর দুইদিন কলেজে আসে না নূরি। আহনাফ তার গ্যাং নিয়ে রোজকার মতো কলেজের পাশে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয় আর নতুন নতুন ফন্দি আটে নূরিকে জ্বালাতন করার জন্যে। কিন্তু পরপর দুদিন নূরি কলেজে না আসায় আহনাফের মুখে চিন্তার রেশ দেখা যায়। আহনাফের আচরণ কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। মেয়েটার হলো কি? কেন সে কলেজে আসছে না। নানা চিন্তা করতে করতে সে বাড়ির পথে রওনা দেয়। রানীমা, একমাত্র রানীমা-ই আছেন সে নূরির সব খবর রাখেন। রানীমার খুঁজে মহলের ভিতরে প্রবেশ করে আহনাফ। রানীমা বসে বসে পান চিবুচ্ছে এমন সময় আহনাফের আগমন। রানীমা কিছু বলতেই যাবে তার আগেই আহনাফ বলে উঠে,

“নূরি এসেছিলো মহলে? দুদিন নূরির দেখা নাই।”

” জ্বর এসেছে মেয়েটার।”

“আচ্ছা ও ঔষুদ খেয়েছো তো। এখন কেমন আছে।”

রানীমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আহনাফের দিকে। আহনাফ কাচুমাচু মুখ করে বলে, “এভাবে কি দেখছো?”

” তুমি হঠাৎ নূরির জন্যে চিন্তা করছো!” নূরিকে তো তুমি দু -চোখে সহ্য করতে পারো না।”

” ঠিক বলেছো আমি নূরিকে সহ্য করতে পারিনা। একদম-ই পারি না। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় আহনাফ তারপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, “ওকে বলে দিও ঠিকমতো ঔষুদ খেতে। রোয়াব যেন না দেখায়।” চলে যায় আহনাফ। রানীমা মৃদু হাসে। মনে মনে আওড়ায়, ” কখন যে তুমি আহনাফ থেকে সাহেব বাবু হয়ে যাও নানুভাই বুঝতে পারিনা।”

পরেরদিন কলেজে আসে নূরি। কলেজে এসে কারো সাথে তেমন কথা বলে না। আগের মতোই চুপচাপ থাকে। খামখেয়ালি গ্যাংয়ের এক সদস্য রাহুল আহনাফের কানে খবর পৌঁছায় নূরি এসেছে। খবরটা শুনা মাত্র-ই আহনাফ কলেজে আসে। নূরি তখন পুকুরপাড়ে একা বসে রানীমার কথা কথা ভাবছিলো। জ্বরের ঘোরে নূরি যখন সাহেব সাহেব বলে ডাকছিলো তখন রানীমা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো, “তুই সাহেবকে ভুলে যা নূরি। সাহেব আর নেই এখন যে আছে সে আহনাফ চৌধুরী যে তোকে সহ্য করতে পারে না।” রানীমা কি করে এমন একটা কথা বলতে পারলো। সে কি জানেনা সাহেব নূরির জিবনে কি? সাহেবকে কি করে ভুলে যাবে নূরি। সাহেব বাবু যে নূরির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ছে।

নূরিকে ক্লাসে দেখতে না পেয়ে লাইব্রেরির দিকে চলে যায় আহনাফ। পথিমধ্যে মেঘনা এসে আহনাফের পথ আটকায়। মেঘনা নূরির ক্লাসমেট এবং খামখেয়ালি গ্যাংয়ের একজন সদস্য আর বর্তমানে আহনাফের গার্লফ্রেন্ড। আহনাফ মেঘনাকে উপেক্ষা করে চলেই যাচ্ছিলো তখনি মেঘনা আহনাফের এক হাত জড়িয়ে ধরে বলে, “আমাকে উপেক্ষা কেন করছো বেবী? দু-দিন ধরে তোমার দেখা নাই। আমি কল করছি অথচ তুমি আমার কলটা রিসিভ ও করছো না।” আহনাফ মুখে বিরক্তিকর শব্দকরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “তোমাকে কতবার বলেছি যখন তখন আমার কাছে ঘেসবে না।” চলে যাচ্ছিলো আহনাফ কিন্তু নূরিকে দেখে সে থেমে যায়। নূরি আর মুনমুন আসছে লাইব্রেরির দিকটায়। মেঘনাও নূরিকে দেখে হাসে। কারন মেঘনার কাছে নূরিকে বড্ড ব্যাকডেটেড মনে হয়। এই বিংশ শতাব্দীতে এসে কেউ কলেজে শাড়ী পরে আসে এটা বরই হাস্যকর। সত্যিই মেয়েটা বড্ড ব্যাকডেটেড না-হলে কেউ আন্টি সেজে কলেজে আসে। আহনাফ তাকিয়ে আছে মুনমুনের দিকে। ওর মুখের অবয়ব দেখে বুঝা যাচ্ছে সে কিছু প্ল্যান করছে। নূরি আর মুনমুন ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে তখন শুনতে পায় মেঘনার কথা,” তুমি আমাকে এভাবে এভয়েট করতে পারো ন। আহনাফ। তুমি জানো তোমাকে কতটা মিছ করেছি।” মেঘনার কথা শুনে নূরি হাসলো তবে এটা ওর মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই। মুনমুন হাত ধরে টেনে লাইব্রেরির ভিতরে ডুকতে ডুকতে বলল, “এবার বুঝো প্লে বয়ের সাথে প্রেম করার মজা।” নূরির কথা শুনে লাইব্রেরিয়ান হেসে দেয়।

হুমায়ুন আহমেদের লেখা বই অপেক্ষা পড়ছে নূরি। কেন জানিনা মনে হচ্ছে সুরাইয়ার চরিত্রটা নূরিকে নিয়ে লেখা। পড়ায় বেশ মনোযোগ তার। সামনে যে একটা লোক বসে আছে সেদিকে নজর নাই তার। বই পড়ার মাঝে তার মাথায় শুধু ইমনের কথা ঘুরছে। আচ্ছা শেষে কি হয়েছিলো ইমন কি পেয়েছিলো তার বাবাকে। নূরির ইচ্ছে করছে সবার আগে লাষ্ট পেজটা পড়ে নিতে। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে সে। আরো বিরক্ত হয় যখন তার সামনে বইয়ের উপর একটা দেখতে পায়। ধবধবে সাদা ঘন লোম বিশিষ্ট একটা হাত যেটা নূরির বইটা নিজের আওতায় নিয়ে নেয়। হাতটা দেখেই নূরির বুক কেপে উঠে। সামনে তাকাতেই তার চোখ আটকে যায় ঘন কালো নেত্র পল্লবের ভিতরে থাকা নীল চোখের মণিতে। ততক্ষণৎ চোখ নামিয়ে নেয় নূরি। এবার মুখ খুলে আহনাফ। ” আমাকে উপেক্ষা করে কি বুঝাতে চাইছো তুমি। যেখানে সব মেয়েরা আমার জন্যে পাগল সেখানে তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাও না। সব সময় আমার বিরুদ্ধতা করো। আমার মনোযোগ পাওয়ার সস্তা ধান্ধা খুঁজছো। ভোলাভালা সাজার চেষ্টা করছো। কি মনে করছো আমি কিছুই বুঝি না? ভালো ফিল্মি চাল জানো।” আহনাফের কথায় হাসে নূরি। তারপর বলে, ” তোমার মতো এত বড় মন নেই আমার যে চারিদিকে প্রেম বিতরণ করবো। আমার একাটাই মন। এই মনটা অনেক আগেই একজন নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে তাই সেখানে নতুন করে তোমার জায়গা হবে না গো।”

” তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে! তাকে তো কখনো দেখেনি।”

” ছিলো তবে এখন নেই।”

” তোমার আন্টি ভাব দেখে সে নিশ্চয় পালিয়ে গেছে তাইনা।”

” পালিয়ে নয় সে হাড়িয়ে গেছে।” নূরির গলা কাঁপছে। আহনাফের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর দৃষ্টিটাও কেমন লাগছে। আসলে ওর মনের ভিতরে কি চলছে সেটা বুঝার উপায় নেই। নূরি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না চলে যায় লাইব্রেরি থেকে। আহনাফ ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

নিজের রুমে বসে গিটারে টুংটাং আওয়াজ করছে আহনাফ। বুকের ভিতরে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে সেটা কিছুটা হলেও লাগভ করার চেষ্টা করছে। বিকালে যখন ওর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো তখন মানিক বলে, ” ম্যাথ সাবজেক্টা কি যে বিরক্তিকর।”
কি করে যে ম্যাথ এ বি এস সি করার সখ জাগলো কে জানে। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।” মানিকের কথায় আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর কি মনে হতেই বলল, ” তোর প্রবলেম গুলো আমায় একটু দেখতে দিবি।”
” তোর দেখে কি কাজ। পড়াশুনাতো করিস না। বিদেশ থেকে এসে এখানে বাহাদুরি দেখাচ্ছিস।”
“উহ্ এত কথা না বলে সেটা বলছি সেটা কর-না।”
” এখন কি-ভাবে হবে। আমার বাড়িতে যেতে হবে তো।”
“তাহলে চল।”

তারপর ওরা সবাই মিলে মানিকের বাসায় যায়। মানিক ওর প্রবলেম গুলো দেখিয়ে দিতেই আহনাফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চট করেই খাতা কলম নিয়ে ম্যাথের প্রবলেম সলভ্ করে দেয়। রাহুল বলে উঠে, ” তুই কি করে এই ম্যাথের প্রবলেম সলভ্ করলি।” আহনাফ হেসে জবাব দেয়, জানিনা রে, তবে মনে হলো আমি পারবো তাই করলাম।” হাতে একটা ইনভেলাপ নিয়ে দিপা ঘরে ডুকলো। দিপাকে দেখে আহনাফ গিটার রেখে বলে, “আরে দিপা, কখন এলি।” দিপা হেসে জবাব দেয়, অনেক্ষন হলো, নূরি আপুর সাথেই এসেছিলাম। আর এই নাও তোমার ইনভেলাপ।”
“নূরি এসেছিল? ইনভেলাপ হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে আহনাফ।”
” হুম। আচ্ছা কি আছে এই ইনভেলাপে?”
“তোদের ভাবিজীর ফটো।”
” কই দেখি তো।”
“এখন নয় এক্কেবারে ছয় মাস পর বিয়ে করে এনে দেখাবো।”
” আমিও দেখবো ভাবিজী-কে।” দিবা ঘরে ডুকে। আহনাফ দিবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়। দিবা এসে আহনাফের গলা জড়িয়ে ওর কোলে বসে পরে। আহনাফ প্রশ্ন করে,
” তা নূরির সাথে কি কি গল্প করলি?” প্রশ্ন শুনে দিবা মন খারাপ করে বলে,
“আমাদের সুযোগ কোথায়? যা বলার সেটা তো নানু বলল। বাবববা তাদের কথা যেন শেষই হয় না। তবে নূরি আপু আমাদের গান শুনিয়েছে।” দিবার কথায় কিছুটা চমকে উঠে আহনাফ আর প্রশ্ন করে,
“নূরি গান জানে?”
” তুৃমি জানো নূরি কত ভালো গান গায়। যেমন ভালো গানের গলা তেমনি মন দিয়ে গান গায়। এই বয়সে ওর গলায় এত ইমোশন, গান শুনলেই হাড়িয়ে যাই। দিপার কথায় থো মেরে বসে থাকে আহনাফ আর মনে মনে আওড়ায়,

চলবে,,,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here