#সাহেব_বাবুর_বউ – [০২]

ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। এর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বিজলির চমক। গুড়ুম গুড়ুম গর্জনে মুখরিত চারদিক। যখন-তখন আকাশের বুক চিরে সহস্র ধারায় নেমে আসে বৃষ্টি। বেশ ক’দিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। কারণ ঋতুচক্রে এখন বর্ষাকাল। কদিন আগেও তীব্র তাপপ্রবাহ আর প্রখর রোদে মানুষ হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ। শুধু মানুষই নয়, পশু-পাখি এমনকি সবুজ বৃক্ষও নেতিয়ে পড়েছিল তীব্র তাপপ্রবাহে। তাই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার বান্দাদের কষ্ট লাঘবের জন্য রোদের মুখে ছাই ছিটিয়ে বর্ষার সুশীতল শান্তির বারতা তথা বৃষ্টি দিয়ে প্রকৃতির বুক যেন জুড়িয়ে দিলেন। বর্ষা ঋতুচক্রের দ্বিতীয় ঋতু। আর সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দুই মাস মিলে বর্ষাকাল। তবে এর ব্যাপ্তি আরও বিস্তৃত। বর্ষার আকাশ মানেই যেন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। এই মেঘ, এই বৃষ্টি। মাঝে মাঝে সাদা-কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে তেজহীন শান্ত সূর্য। রাতের বেলায় মাঝে মাঝে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো আছড়ে পড়ে গাছের চূড়ায়। এ আবহাওয়াকে বলা হয় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। কলেজ থেকে ফিরছে নূরি। সাথে আছে ওর দুই বান্ধুবি মুনমুন আর হাসি। আকাশ মেঘাছন্ন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হবে। হাটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। এর-ই মধ্যে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে। মুনমুন আর হাসি গাড়ির দিকে তাকালেও নূরি একেবারের জন্যেও তাকায় না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয় তখন হাসি ওর হাত ধরে বলে, ” কোথায় যাচ্ছিস তুই? দেখছিস না আহনাফ ভাইয়া এখানে গাড়িয়ে থামিয়েছে। দাঁড়া একটু কথা বলে নেই।” নূরি কিছু বলে না চুপচাপ এখানে দাঁড়ায়। তখন গাড়ি থেকে নেমে আসে আহনাফ আর মুনমুন ও হাসিকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” মনে হচ্ছে এখুনি বৃষ্টি শুরু হবে। তোমরা দুজন আমার সাথে এসো আমি তোমাদের পৌঁছে দিবো।”

“আর নূরি! নূরি যাবে না আমাদের সাথে।” প্রশ্ন করে হাসি। আহনাফ নূরির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে তারপর বলে, ” না যাবে না। কোন দাম্ভিককে আমার গাড়িতে তুলি না আমি। এই তোমরা যাবে আমার সাথে? নাহলে থাক চলে যাচ্ছি আমি।” আহনাফ গাড়ি খুলতে নেয় তখনি মুনমুন বলে উঠে, “হ্যাঁ যাব তো।” এই নূরি আমরা আসি রে। মুনমুন ও হাসি দুজনেই গাড়িতে গিয়ে বসে। আহনাফ ও গাড়িতে বসবে তখনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। থেমে যায় আহনাফ, ঘুরে নূরি দিকে তাকায়। মেয়েটা পুরো ভিজে গেছে। কপালের ছোটছোট চুল বেয়ে পানি পরে ভিজিয়ে দিচ্ছে নূরির নাক গাল ঠোট। সেই সাথে খেয়াল করলো নূরির হাত। হাতটা শক্তমুঠি করে রেখেছে সে। আহনাফ নূরিকে ভালোকরে স্ক্যান করে নিলো আরো একবার তারপর সে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। আহনাফের চলে যাওয়ার পর ধপ বসে পরো নূরি। চোখ দিয়ে অধোর ধারায় জল পরতে শুরু করে যেটা বৃষ্টির পানিতে মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে, ” কেন চলে গেলে সাহেব। আমি যে আর পারছিনা তোমাকে ছাড়া থাকতে। প্লিজ সাহেব ফিরে এসো।” চোখের সামনে ভেসে উঠে ছয় বছর আগের ঘটনা।

” নূর বাড়ি ফিরে চল বলছি। এখনি বৃষ্টি শুরু হবে আর তুই তো জানিস বৃষ্টিতে ভিজলেই তোর জ্বর আসে। প্লিজ নূর এখন বাড়ি ফিরে চল।”

” আমি বৃষ্টিতে ভিজবো তুমি বাড়িয়ে চলে যাও সাহেব।”

” এবার কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি নূর।”

” সে আমি পরে ঠিক মানিয়ে নিবো। এখন তুমি বাড়ি যাও।”

” তুই আমার সাথে যাবি না তাইতো, ওকে দাঁড়া।” এই বলে সাহেব নূরিকে টেনে বাড়ি নিয়ে যায়। বাড়িতে নিয়ে সেদিন নূরিকে ঘরবন্ধ করে রাখে সাহেব। আর নিতুকে বলে দেয় আন্টি, ” আজ কেউ নূরের ঘরের দরজা খুলবে না বলে দিলাম।” সেদিন কেউ নূরির ঘরের দরজা খুলে দেয়নি। রাতের বেলা সাহেব এসে নূরির ঘর খুলে দেয়। কিন্তু অভিমানী নূরি সেদিন সাহেবের সাথে কোন কথা বলে নি। সাহেব নূরির রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি। দুদিন কেটে যায় তবুও নূরির অভিমান কমে না। কমবে কি করে সাহেব যে আর আসেই নি। রাতে যখন নূরি ঘুমিয়ে যেত তখন চুপিচুপি এসে নূরির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। যাওয়ার আগে কপালে গালে নাকে চুম্বন করে তারপর যেত। সারাদিনে আর দেখা মেলতো না তাদের। সাহেব জানতো নূরি ঠিক আসবে। দুদিন পর নূরি যায় সাহেবের বাড়িরতে। সাহেব তখন নিজের ঘরে ছিলো। নূরি সাহেবের ঘরে গিয়ে দেখে সাহেব জামাকাপড় প্যাক করছে।

“তুমি আজ-ই চলে যাবে সাহেব?” বিছানায় বসে প্রশ্ন করে নূরি। সাহেব কোন জবাব দেয় না। চুপচুাপ নিজের কাজ করতে থাকে। নূরি সাহেবের এক হাত জড়িয়ে ধরে বলে, ” সাহেব।” নূরির গলা কাঁপছে। সাহেব নূরিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। অতঃপর বলে, ” মান ভেঙেছে তোর? কি করে পারিস আমাকে কষ্ট দিতে। ” নূরি জবাব দেয়, ” শুধু আমি-ই কষ্ট দেই তুমি দাওনা। কই এই দুদিনে তো একবারও আসলে না আমার বাড়ি।” সাহেব হাসে নূরির কথা। নূরিকে ছাড়িয়ে ওর দুই গালে হাত রেখে মৃদু হেসে বলে, “তাই, আচ্ছা ঘুমের ঘোরে আমার চুমু খাওয়ার পর যখন আমাকে জড়িয়ে ধরতিস আর বলতিস আমাকে ছেড়ে যেও- না সাহেব তখন কি সেটা স্বপ্ন মনে হতো।” সাহেবের কথা শুনে চোখ বড়বড় হয়ে যায় নূরির। “মানে তুমি সত্যি-ই আসতে।” হুম “।এবার ছাড় আমাকে, প্যাকিং করতে হবে। আহনাফ আবার প্যাকিং করতে মন দেয়। নূরি কিছুক্ষণ চুপচুাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নূরির হঠাৎ করা প্রশ্নে আহনাফ থেমে যায়। ” তুমি আমাকে ভুলে যাবে না -তো সাহেব? ” সাহেব নূরির হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দেয় আর বলে, ” এমন কথা কেন বলছিস নূর? তুই জানিস না তুই আমার কে ” তোকে ভুলে যাব আমি! তোকে ভূলে যেতে হলে যে আগে আমার নিজেকে ভুলতে হবে।”

” কবে ফিরবে? আর আমার সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখবে তো? দেখো আগেরবার কিন্তু তিনদিন তুমি আমার সাথে কথা বলোনি। এবার এমনটা করলে আমি সত্যি-ই মরে যাবো।” সাহেব হাত রাখে নূরির মুখে। গম্ভীর মুখে বলে, ” এমনটা বলেনা সোনা। তোমার এমন কথা শুনলে যে আমার পাঁজর ভেঙে আসে। তুমি যে এই সাহেবের শক্তি। আর আমি তো যেতে চাইনি তুমিইতো বলেছিলে, আমি অক্সফোর্ড এর ডিগ্রী না পেলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে না। তাইতো যাচ্ছি। তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্যে আমি যমের থেকেও ডিগ্রী আনতে পারি। আমার ইংল্যান্ডে ভালো লাগে না। ওখানে ড্যাডদের উচ্চ বিলাসবহুল জিবন যাপন আমার ভালো লাগে না।” সাহেবের কথাগুলো নূরি মনে মনে বলে, ” আমি জানি সাহেব আমি জোড় না করলে তুমি কখনো যেতে না। কি করবো বল। বড় সাহেবের বড় ইচ্ছে তুমি অক্সফোর্ড এর পড়বে। ” আচ্ছা সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছো তো? প্রশ্ন করে নূরি। সাহেব উত্তর দেয়না। তাকিয়ে থাকে নূরির মুখপানে। নূরির কপালে অধোর ছুঁইয়ে বলে, ” সবচেয়ে দামি এন্ড গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাই রেখে যাচ্চি আমি নূর।” কি করে থাকবো আমি তোকে ছাড়া।” নূরিকে ছেড়ে কাবার্ড থেকে একটা এ্যালবাম বের করে সাহেব। যেখানে বন্ধি আছে নূরি আর সাহেবের ছোট বেলার হাজারো স্মৃতি জড়ানো মুহূর্ত। একটা ম্যেমোরি কার্ড নিজের মোবাইলে ডুকিয়ে দেয়। এটাতে আছে নূরির গাওয়া গান। সাহেবের মন খারাপ হলে সে নূরির বাসায় চলে যেত আর নূরির কোলে মাথা গুজে গুয়ে পড়তো আর বলল, ” একটা গান শুনাতো নূর।” নূরি সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে গান গাইতো আর সাহেব ঘুমিয়ে যাইতো।

” কোথায় উঠবে গিয়ে?” প্রশ্ন করে নূরি।

” বাবা দাদার দেশে যাচ্ছি থাকার কথা উঠছে কেন?” হেসে বলে সাহেব।

” তুমিও বলছো বাবা দাদা। ঠিক হচ্ছে না তোমার জন্যে। তুমি তো বলবে ফাদার গ্রান্ডফাদারস্ ক্রান্ট্রি বুঝলে ইংরেজ সাহেব।”

” হাসালে নূর। এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করি আমি অথচ নিজের বাপ-দাদার ভাষাটা পর্যন্ত জানিনা। একদম খাঁটি বাঙালি হয়ে গেছি আমি। শুধুমাত্র গায়ের রং আর চোখ দুটো ছাড়া আমার ইংরেজ পিতার কোন নিদর্শন নেই আমার মধ্যে। আমিতো এই নগরপাড়ার কুমার সাহেব। বুঝলে নূর। ”

” এবার আমি আসি গো।” নূরি চলেই যাচ্ছিলো তখন সাহেব পর পথ আটকে হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়। আর বলে, ” আজ রাতে এটা লেখেছিলাম। পরে একদিন পড়ে শুনাবো এখন তোর কাছেই রেখে দে।”

” কি আছে এটাতে?”

” আলোকবর্তিকা। সাহেবের আলোকবর্তিকা।” নূরি কাগজ সমেত চলে যায়। সেদিন গভীর রাতে মুখের উপর গরম কিছু পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় নূরির। চোখ মেলে তাকাতেই সামনে গভীর মায়াবী নীল বর্ণের চোখ দেখতে পায়। অস্ফুটভাবে বলে, সাহেব। সাথে সাথে সাহেব ঝাপটে ধরে নূরিকে। সাহেব কাঁদছে। সাথে কাঁদছে নূরিও। প্রায় অনেক্ষন পর সাহেব কান্না থামিয়ে বলল, একদম মামা- মামির অবাধ্য হবি না। না-হলে আমি ফিরে এসে তখন তোকে কঠিন শাস্তি দিবো। আর শোন নিজের যত্ন নিবি”। সাহেব নূরির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে,” একবার শুধু অক্সফোর্ডের ডিগ্রী পাই ফিরে এসে তোকে নিজের করে নিবো নূর।” সাহেব নূরির হাতে একটা হিরের আংটি পড়িয়ে দিয়ে বলে, “এটা সবসময় নিজের কাছে রেখে দিবি। আজ থেকে তুই আমার বাগদত্তা। তোর সাহেব বাবুর হবু বউ।” নূরি কোন কথা বলে না। নিরবে চোখের জল ফেলছে। সাহেব নূরিকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। একে অপরকে গভীর ভাবে চুম্বনে লিপ্ত হয়। হঠাৎ করে সাহেব নূরিকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ডুকে যায়। লম্বা সময় ধরে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল বেড়িয়ে আসে সাহেব। বিছানায় চোখ পড়তেই দেখতে পায় নূরি এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ বন্ধকরে নেয় সাহেব। “এটা আমি কি করতে যাচ্ছিলাম। নিজের সীমা ভুলে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে তুই মাফ করিস না নূর।” ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় সাহেব। বিছানায় শুয়ে নূরি ভাবতে থাকে, “আজ তুমি শুধু নিজের প্রলোভনকেই জয় করোনি সাহেব। নিজের পুরুষত্ব এবং সর্বোপরি নিজের ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করলে জিবনের সর্বোচ্চ শিখরে মাত্র ষোল বছর বয়সে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here