সর্বনাশ – ৩ শেষাংশ |
___________________

জাঁকজমকপূর্ণ পরিস্থিতিতে আগমন হয় শান্তর। মানুষজনের ভীড়ে তাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গ্রামের মানুষ বছর খানেক পর, প্রিয় ডাক্তারকে দেখার জন্য অধৈর্য্য প্রায়। নানান প্রশ্নের সম্মুখীন করছে শান্তকে। অথচ, শান্ত পরিবারের পাশে বুনিকে খুঁজে চলেছে। মেডিকেল রিসার্চ করা, দিনরাত পড়াশোনা, মাথা থেকে পা অবদি ডুবে থেকেও, ভিডিও কল করেছে বাংলাদেশের টাইম মেইনটেইন করে। শুধু এই বোকা বুনির, বোকাসোকা চেহেরাটা দেখতে। অথচ, প্রত্যেকবার শুনতে হয়েছে,
-‘ বাবা, মাত্র বাইরে গেলো, বুনি…আররে এইতো এহানেই ছিল, কই যে গেলো মাইয়াডা… ওইতো ওর খালাতো ভাইয়ের জন্মদিন, ওহানেই আছে….দোলা আছে না? ওইযে ফারুকীর মাইয়াডা, ওয় নিয়া গেল মাত্র। ‘
এইসব হাবিজাবি শুনে ত্যক্ত সে। মেয়েটা এয়ারপোর্টে ত যায়নি, সাথে গ্রামের বর্ডারেও আসেনি, রিসিভ করার জন্য। শান্তর ইচ্ছে করছে, কষিয়ে এক থাপ্পড় মারতে বুনিকে। ভালোবাসে বলে কী, মাথায় চড়ে থাকবে? মাথা থেকে নামিয়ে আছড়াবে। আজ শুধু সামনে আসুক।

বুনি ধানক্ষেতে হাঁটাহাঁটি করছে। হাতে চাল ভাজা। খাচ্ছে আর গুনগুন করছে। ক্ষেতের চাচা হঠাৎ বলল,
-‘ এরে, বুনি। ডাক্তার সাহেব ত আই পড়ছে রে। যাস না যে?
বুনি চুপ রইলো। ভেবে জবাব দিলো,
-‘ যামু?
-‘ যামু মানে? যারা কিছু লাগে না, তারা ভীড় করে রাখছে গ্রাম। আর তুই ত ডাক্তারের একমাত্র বউ। তুই থাকবি না?
-‘ কিন্তু, ডাক্তারের মা’য় ত যাইতে না কই দিলো।
চাচা বুনির সামনাসামনি আসলো। বুনির ভোলা মুখমণ্ডল ধরে, আদর করে দিল।
-‘ তার কথায় কী আহে যায়? পোলার মনের অনুভূতির, কোনো দাম দেয় না মহিলা’য়। খালি খালি ঝামেলা করে। তুই তার কথায় নিজেরে ছোডো মনে করবি না, কেমন?
-‘ ছোডো কেন মনে করমু? আমিতো বড় চাচা।
-‘ তুই শোন, বোকা। তুই হইছোস ডাক্তারের বউ। সারাজীবনের সঙ্গী। তুই যাবি, সর্বপ্রথম। বুঝছোস?
-‘ সারাজীবনের সঙ্গী?
-‘ হু। দুইজন মরার আগপর্যন্ত একসাথে থাকবি। ঝগড়া করবি না। জামাই যা কইব, শুনবি। নইলে মানষে তোর জামাই নিয়া যাইবো।
-‘ দিয়ে দেন চাচা।
বুনি আলগোছে চলে যাচ্ছে। হাতের চাল ভাজা আবারও খেতে শুরু করলো। চাচা মাথায় হাত চেপে, বিরবির করছে।

দুপুর দিকে বুনিদের বাড়ি আসে শান্ত। হাতে ছোট ল্যাগেজ। বিদেশ থেকে এসেছে। শ্বশুর বাড়ির জন্য, কিছু কেনাকাটা ত করতেই হয়। এবং সময় করে, করেছেও। বুনির চোদ্দগুষ্টি শান্তর সেবাযত্নে লেগে পড়লো। শান্ত অস্থির বুনিকে দেখার জন্য। ভাবছে, সর্বপ্রথম একটু আদর করবে, নাকি আগে থাপড়ে রাগ মেটাবে। রাগ আর বিচ্ছেদের অনুভূতি’তে ঝুলে আছে শান্ত। ঘন্টাখানেক চলে যাচ্ছে, বুনির দেখা নেই৷ মেয়েটা কী বাহিরে গেলো? বাড়িতে নেই? আর দুদিন। বাড়িতে নিয়ে সর্বপ্রথম ঠ্যাং ভাঙবে। বাহিরে ঘুরাঘুরি শুধু।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও, বুনিকে না দেখে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করলো অধৈর্য কন্ঠে,
-‘ বুনি কোথায়?
খালার জবাব,
-‘ আর বলিও না, বাবা। খেয়ে যে ঘুমিয়েছে, এতো ডাকার পড়ও এর উঠার নামগন্ধ নেই। তুমি যাও। পেছনের রুমে।
পারমিশন পেলে আর কী লাগে। শান্ত বড়সড় পা ফেলে, অধৈর্য আচরণে চলে এলো রুমে। রুমে ঢুকে, প্রথম দরজা লাগালো।
বিছানায় বুনি উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে। পরনের ফ্রোক রানের উপর উঠে আছে। মুখের উপর অগোছালো চুলের মেলা। শান্তর রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলো। শব্দ করে বসলো পাশে। ডান হাতে বুনির মুখের উপরে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিল৷ মুহুর্তে শীতল স্রোত বয়ে গেল, শান্তর মনে। হৃদয় কম্পন খেলায় মেতেছে। একটা বছর পড় দেখছে, এই মুখ। কতটা যন্ত্রণা হয়েছে তা শুধু শান্ত জানে। দু’হাতে ঘুমন্ত বুনিকে উঠালো। নিজের বুকে আশ্রয় দিলো। মিশিয়ে ধরলো বুনির মাথা নিজের বুকে। শান্তিতে চোখ বুঝে আসছে। মাথা নিচু করে, অজস্র কিছু চুমু খেয়ে নিল মুখে। তাকিয়ে রইলো বুনির দিক। একটু পড়পড় গালে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। চুল গুছিয়ে দিচ্ছে।

বুনির ঘুম ভেঙেছে বিকেলে। সদরদরজা থেকে শব্দ আসছে। উঠে সর্বপ্রথম সেখানে গেল। মা, বাবা, খালা’রা ল্যাগেজের জিনিসপত্র দেখছে। জামাই তাদের জন্য এনেছে। কতটা গর্বের ব্যাপার এটা আর নাই বলুক। গ্রামবাসীদের আফসোস আফসোস দৃষ্টি। বুনিকে দেখে খালা শান্তর আনা, রেডিমেড কামিজ’টা হাতে নিলো। বুনিকে দিয়ে বলল,
-‘ যা পরে আয়।
বুনি কামিজ হাতে রুমে এলো। সময় নিয়ে পরে বেরোলো। হাতে ওড়না নিয়ে কনফিউশানে। খালা সুন্দর ভাবে ওড়না পরিয়ে দিল। বুনির গালে চুমু খেয়ে প্রশংসা করলো,
-‘ মাশাল্লাহ। মাশাল্লাহ।
কামিজ পরিহিত বুনি পা বাড়ালো বাহিরে যাবার জন্য। মা ঝাড়ু হাতে দৌঁড়ে এলো। বুনি দ্রুত রুমে চলে গেল। প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। বুকে কয়েক ফুঁ দিলো। মা’র আওয়াজ আসছে,
-‘ ঘরের বাইরে পা রাখলে, তোর একদিন কী আমার। মনে রাখিস।
ভয়ে বুনি আর বেরোলো না। বরং শান্তর আনা জিনিসপত্র দেখতে লাগলো।

সন্ধ্যার দিক শান্ত এসেছে। বুনিকে নিয়ে একটু বাহিরে যাবে। ঘুরবে দুজন। গাধাটাকে কিছু তো শেখাতে হবে। নাহলে নির্ঘাত শান্ত রফাদফা হয়ে যাবে। বেশিদিন বাঁচবে না। শান্তকে দেখে বুনি ভয়ে আকুপাকু করছে। মা কামিজ পরিহিত বুনিকে ঠেলেঠুলে পাঠালো শান্তর সামনে। এদিকে, বুনিকে কামিজে দেখে, মনের বিষাক্ততা নিমিষেই উবে গেল শান্তর। উষ্ণতার ছোঁয়া বইতে লাগলো শরীরে।
বুনি আঁড়চোখে তাকাচ্ছে শান্তর দিক। অন্যরকম লাগছে। বিদেশ থেকে আরও সুন্দর হয়ে এসেছে। দোলা ত ঠিকই বলেছে। তাকাচ্ছে কীভাবে। বুনি ভয় পেলো, ধীরে গিয়ে পাশে বসলো। বারবার পড়তে নেওয়া, ওড়না খুলে হাতে নিলো। কেশে উঠলো বাবা। দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে। শান্ত অসহায় চোখে বসে। আলগোছে রুমের বাকিরাও চলে গেল। সকলে যেতেই, শান্ত নিজেই পরিয়ে দিল ওড়না। তারপর হাত ধরে নিয়ে চলল। বুনি টুকুরটুকুর চোখে দেখলো, আর যা বলা হলো করলো। বাইকে উঠতে গিয়ে বুনি ভয় পাচ্ছে। বাইকে একদম উঠতে পারে না। বুনির কিছু হয়ে যাবে ভেবে, শান্ত হাত ধরে হেঁটে চলল। ওপার থেকে রিকশা নিবে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো, বাইকটা বেঁচে দেবে। তারপর আরও কিছু টাকা মিলিয়ে, একটি গাড়ি কিনবে প্রথম। তার বুনি বাইক চড়তে পারে না। সমস্যা হবে।

পরপর দুদিন বিজি থাকে শান্ত। যেদিন বুনিকে তুলে নিবে, সেদিনও ভিষণ ব্যস্ত। একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে আসে। পৌঁছালে সকলে বলেছিল,
-‘ এখন যেহেতু ব্যস্ত। কয়েকদিন পর তুলিও। কাজের চাপ
কমুক।
উঁহু। শান্তর একই জবাব। আজই তুলবে। শান্তর সাথে শান্তর মা’ও পেরে উঠলো না। এদিকে বুনির কী কান্না। সে যাবে না। যাবে না, মানে যাবে না। বিরবির করছে থেমে থেমে,
-‘ সর্বনাশ। সর্বনাশ। আমি সর্বনাশের সাথে যাবো না।
শান্ত অস্থির গলায় বাচ্চাদের মতো বুঝাচ্ছে,
-‘ বুনি। লক্ষি আমার। প্রতিদিন নিয়ে আসবো বাড়িতে? হু? তোর কী লাগবে? সব দিবো আমি। যা লাগবে। তুই যা চাইবি তাই দিব। হু?
না, বুনি থামছে না। একই কথা যাবে না।
-‘ আচ্ছা, আর কখনো মারবো না। বকব না।
চোখের জল মাঝপথে থেমে গেলো বুনির।
-‘ সত্যি?
-‘ হু। একদম সত্যি। মারবো না।
কিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুছলো। মায়ের দিক তাকিয়ে বলল,
-‘ যাই।
সকলকে পেছনে রেখে, এগিয়ে চলল বুনি। কয়েকবার পায়ে শাড়ি পেঁচিয়ে পড়তে নিচ্ছিলো। দু’হাতে শাড়ি উঁচু করে ধরলো। পেছনে শান্ত মাত্র স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পরপর বুনির অবস্থা দেখে, হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। দ্রুত পায়ে গিয়ে কোলে তুলে ফেলল বুনিকে। সকলের সামনে, চুমু খেলো বুনির কপালে। আদুরে কন্ঠে বলল,
-‘ বোকা।
অথচ, বুনির ধীরে বলা, ‘ সর্বনাশ হতে চলেছে আমার ‘ কেউ শুনতে পেলো না।

সমাপ্ত
নাবিলা_ইষ্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here