সর্বনাশ পর্ব ১
________

চমৎকার শক্তিশালী হাতের থাপ্পড় খেয়ে ভরকে গেল বুনি। কিছুক্ষণের জন্য শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। চোখ বড়সড় হয়ে এলো। কানের পর্দা ফেটে গেল মনে হচ্ছে। একেই বুঝি বলে, ‘ মারব এখানে, লাশ পড়বে স্বশানে। ‘ স্বশানে না গেলেও হাসপাতাল বুনি নির্ঘাত যাবে। গালে হাত দিয়ে দৌঁড় লাগালো। পেছনে শান্তর রাগী কন্ঠে থামলো না। বরং হাসপাতালের পেছনে লোকাল। গালটা চিনচিন করছে। হাটু ভাঁজ করে নিচে বসল। ব্যথাটা কমলে বাড়ি যাবে। আজ বাড়িতে ঢুকলে আর বেরোবে না। যদি আবারো মারে, তখন? রিস্ক নেওয়া যাবে না। শান্ত শুধু শুধু মারলো বুনিকে। দোষী তো দোলা। ও-ই না প্রেমপত্র প্রদান করতে বলল। বুনি কতশত করে বলল,
– না না, পারবো না। আমাকে বকবে।
অথচ দোলা তাদের গাছের পেয়ারা দিয়ে, বুনিকে রাজি করিয়ে ফেলল। এখন? দোষ কী বুনির? নিশ্চয়ই দোষ দোলার। ও না বললে কী বুনি করতো? উঁহু, কখনোই না। এইযে, হাসপাতাল থেকে যাবার পথে শান্ত, তাদের বাড়িতে বিচার দিয়ে যাবে। তারপর মা বুনিকে ভিষণ বকবে। বকতে বকতে বুনিকে শেষ করে ফেলবে। এর মাঝে বুনি আরেক কান্ড বাধিয়েছে। মা পিঠে প্যাক করে দিয়েছিল..শান্তকে পৌঁছে দিতে৷ অথচ, মাঝপথে সুজনেরা সব খেয়ে ফেলল।

রাত হতে শুরু করেছে। বিছানা থেকে বুনি টিনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে। ওইতো শান্ত আসছে। হাতে স্যুটকেস। ডাক্তার সাহেব তাহলে বিচার দিবেই? ভয়ে বুনি দৌঁড়ে বাথরুম ঢুকলো। বাথরুম থেকে স্পষ্ট শান্তর আওয়াজ পাচ্ছে,
– চাচা? বাড়ি আছেন?
বুনি চোখ পিটপিট করছে। শরীর রীতিমতো কাঁপছে। কান চেপে দাঁড়িয়ে। পরপর মায়ের চেঁচামেচি শুরু।
– বুনি? ওই বুনি? কই তুই?
বাথরুম থেকে বেরোলো না। বরং সেখান থেকে পালালো। আজ তাকে মারবে। পিঠে ঠাস ঠাস দিবে। এভাবেই কানের ব্যথায় মনে হচ্ছে জ্বর চলে আসবে। এখন যদি, মারে? তাহলে ত বুনি বাঁচতে বাঁচতে মরে যাবে৷ এর থেকে ভালো লুকিয়ে থাকবে। সকালে সব ভুলে যাবে মা। বুনি খালার বাসায় চলে এলো। আজ খালার বাসায় থাকবে। বুনিকে দেখে খালা, মাথায় হাত চাপলেন। ভেতরে নিতে নিতে বুনিকে কিছুক্ষণ আদুরে গলায় বকলেন,
– বড় কবে হবি? হু? তোর বয়সী মেয়েরা বিয়ে করে বাচ্চা সামলাচ্ছে। আর তুই এখনো গাধা রয়ে গেলি। বুনি হাসতে হাসতে কুটিকুটি,
– আই ক্যান সলভ ম্যাথ খালাম্মা।
কান টেনে খালা বললেন,
– শুধু ম্যাথ সলভ করলে হবে বুঝি? সমাজে আরও নিয়মকানুন রয়েছে। সেগুলোও শিখতে হবে। তা আজ কী হয়েছে? কে বোকা বানালো তোকে?
বুনি খুলে বলল। খালা নিশ্বাস ছাড়লেন। মনেমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে নালিশ করলেন। স্বভাবে এতটা বোকা বুনিকে তিনি না বানালেও পারতেন। মেয়েটাকে নিয়ে খালা বেশ চিন্তায় থাকেন। ঘুমানোর সময় খালার সাথে ঘুমালো বুনি। খালার হাতের ছোঁয়ায় আরামসে ঘুমিয়ে পড়লো।
মাঝরাতে হারিকেন হাতে মা-বাবা এসেছে। চিন্তিত তারা বুনিকে না পেয়ে। একপ্রকার খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। খালার পেছনে লোকাল বুনি। স্পষ্ট দেখল বাবার পেছনে শান্ত দাঁড়িয়ে। আরও ভয় পেলো ৷ বারবার বলতে লাগলো ‘ যাবো না। ‘ এদিকে মা রেগে গেল। শক্ত গলায় বলল,
– এক্ষুনি চল৷
অগ্যত বুনিকে রওনা হতে হলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার চলার পথে, হারিকেন হাতে বাবা বুনিকে নিজের সাথে নিচ্ছেন। আঁড়চোখে তার বোকা মেয়ের মুখখানা দেখে, বকলেন না। বরং শান্তকে ইঙ্গিত করে বললেন,
– বাবা, বাড়ি যাও। সকালে হাসপাতাল যেতে হবে তো?
– জি।
– ঘুমাও গিয়ে।
বুনি আঁড়চোখে দেখল, শান্ত শক্ত চোখে তার দিক তাকিয়ে। ভয়ে সামনে চলে গেল। দোলার দোষ। ওরে ধরবে। বুনিকে শক্ত চোখ কেনো দেখাচ্ছে? থাপ্পড় তো একটা মারলো। আরও মারবে নাকি?

বাড়িতে ফিরে মা চেঁচাতে শুরু করলেন।
– হাসপাতাল কেনো পাঠাইসি তোরে? হ্যাঁ?
বুনি ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,
– পিঠা দিতে।
– তুই দিছিলি?
– সুজনেরা খাই ফেলছে।
– সাহস পায় কীভাবে ওরা? তুই না দিলে কীভাবে পায় সাহস? ছেলেটা কত্ত করে আমাদের লাইজ্ঞা। তোর কী মায়াদয়া নাই একটুও? ওই, ওই সুজনেরা তোর কী লাগে? কেনো দিছস ওদের?
জবাব দেস না কে।
– সুজনেরা কিছু লাগে না।
– তাইলে কেন দিছস? আরেকদিন যদি শুনি, ওদের লগে কথা কইছস পা কাইট্টা দিমু।
– আচ্ছা।
বুনি চুপচাপ ঘুমালো। পরদিন আর ওদিকে গেল না। দোলা বাড়ি আসলো। বারবার প্রশ্ন করলো,
– কি’রে? জবাব দিছে শান্ত ভাই?
বুনির সোজাসাপ্টা জবাব,
– থাপ্পড় মারসে। মা’রে নালিশ দিছে।
– আহারে। লাগছে গালে? দেখি…

বুধবার ছিল সেদিন। মা বিরিয়ানি পাকিয়েছে। টিফিন তৈরি করে, বুনিকে দিল হাসপাতালে পৌঁছাতে। বারবার বলে দিলো,
– ভদ্রভাবে যাবি। দিয়ে আবার ভদ্রভাবে ফিরবি, কেমন?
– আচ্ছা।
যেতে যেতে বুনি ভাবলো..এই শান্তকে না চিনলে কতটা ভালো হতো। এত কষ্ট করতে হতো না.. বোকা খেতে হতো না.. মাইর খেতে হতো না। কেনো যে আব্বুর বন্ধু এই শান্তর বাবা হতে গেল। আর কেনই বা তারা পাশাপাশি থাকতে গেল। সব সর্বনাশ এখন বুনির উপর। শান্ত একটা সর্বনাশ। বুনির জন্য সর্বনাশ। এই শান্ত কবে যাবে দেশ ছেড়ে? কবে থেকে শুনছে চলে যাবে। এখনো যায় না কেনো?

শান্তর চেম্বারে বসে বুনি। আধাঘন্টা যাবত সে বসে। শান্ত ব্যস্ত। কোনো বাচ্চাকে দেখছে হয়তো। বসতে বসতে ঝিমাতে শুরু করেছে বুনি। দরজা খোলার শব্দে হকচকিয়ে উঠলো। শান্ত এসেছে। সাদা ইউনিফর্ম পরনে। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো। হাত ঘড়ি খুলে ডেস্কে রেখে.. বুনির দিক নজর দিল। মুখের দিক বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সেদিকে খেয়াল নেই বুনির। দিব্বি দেখিয়ে দিল ডেস্কে রাখা টিফিনবক্স।
– মা পাঠিয়েছে। আমি যাই।
দরজা টানলো। খুলছে না। শান্ত চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
– বোস। খেয়ে নেই.. তারপর যাবি।
বুনি মাথা দুলিয়ে বসলো। আবারো ঝিমাচ্ছে। মাথা এদিকসেদিক ঝুলছে। এই কাহিনি দেখতে অস্বস্তি লাগছে শান্তর। উঠে বুনির সামনে যেতেই… বুনি উঠে গেল। এতটা শার্প কেনো মেয়েটার কান?
বুনি তাড়াহুড়ায় প্রশ্ন করলো,
– হয়ে গিয়েছে? যাই তাহলে।
শান্ত দু আঙুলে আঁকড়ে ধরলো বুনির ঠোঁট।
– কথা না বললে…বেশি ভালো লাগে।

কার্তিক মাসের শেষের দিক। বুনি খেয়াল করছে, তাকে বেরোতে দেওয়া হয়না। মা বাড়ির কাজ শেখাচ্ছে টুকটাক। বাবা বাজার করছে। এই হাবিজাবি কিনছে ঘরে। যেমন কেউ আসবে। সেদিন দুপুরে ভাবী তাকে সাজাতে বসলো। শাড়ি পরালো। খালা এসে নিজের চেইন পরিয়ে দিল। দু’হাতে চুরির ঝুনঝুন শব্দ। ভাবী নিয়ে গেল তাকে বৈঠক খানায়। শান্ত.. তার মা-বাবা.. আত্নীয় স্বজন সকলে উপস্থিত। খটকা লাগলো বুনির। বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করলো। কেউ জবাব দিচ্ছে না। ওখান থেকে চলে আসার সময়.. শান্তও আসলো। বুনির রুমে ঢুকে বিছানায় বসলো। অগোছালো হয়ে আছে। বিছানার চাদর কুঁচকে চারপাশে। যেমন, হাডুডু খেলেছে কেউ৷ হাত বাড়িয়ে বুনির হাত ধরলো শক্ত করে।
– রুমের এ-অবস্থা কে করেছে?
বুনির জবাব,
– আমি।
– কেনো?
প্রশ্নের ঠিক কী জবাব দেবে, বুঝতে পারছে না বুনি। মায়াবী নয়নে তাকিয়ে রইল শান্তর দিক। হৃদয় কম্পনের ঢেউয়ে, অপ্রকাশিত অনুভূতি বিচরণ করছে শান্তর মনে। হয়ে যাক না, একটু স্পর্শ। মন ভরে ছুঁয়ে নেক একটু। হাজার মনকে শক্ত করেও ছুঁয়ে দিতে অক্ষম শান্ত। বরং শক্ত গলায় কথা শোনালো,
– এতটা অপরিষ্কার একটা মেয়ে কীভাবে হয়?
বুনির জবাব নেই। মাথা নিচু হয়ে আছে। শান্ত আঙুলের সাহায্যে বুনির, থুতনি তুলল। আদুরে আদরে চুমু খেল কপালে। হঠাৎ বাবার শব্দ।
দ্রুত, শান্ত বেরিয়ে গেলো। মেহমান চলে গিয়েছে। সম্পুর্ন বাড়ি খালি হতেই স্পষ্ট জানলো.. তাকে দেখতে এসেছিল শান্তর পরিবার। শান্ত দেশ ছাড়ার পূর্বে বিয়ে করে যাবে। আজকালকার মাঝে বিয়ে। বেশিদিন নেই শান্তর ফ্লাইটের।
বুনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। ঠোঁট জোড়া উচ্চারণ করলো,
– সর্বনাশ।

চলবে _
নাবিলা ইষ্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here