#সময়ের_পালাবদল
শামসুল ইসলাম
১ম পর্ব
.
« বাহার! ও বাহার!!
বাপরে, সালেহার খুঁজে পাচ্ছিনে। একটু দেখতো ঘাটের দিকি গিয়েছ কিনা? না জানি আল্লাহ্ আজকে আবার কোন বিপাদ দেই।
« কি কও আম্মা! কখন থেকে পাচ্ছো না?
« সন্ধের পর থেকে পাচ্ছিনে, আমার খুব টেনশন হচ্ছে। বিকেলে দেখিলাম ঘাটে নৌক নিয়ে খেলছিল, মনেহচ্ছে আজগে আবার পুরোনো সেই বিয়ারামডা (রোগ) আবার চাগান দিয়েছ!
« চিন্তা কইরো না! আমি দেখছি।
এতক্ষণ যে সালেহাকে নিয়ে মা ভায়ের দুশ্চিন্তা! সে হচ্ছে গ্রামের সবার সুপরিচিত সালেহা পাগলী নামে পরিচিত।
জন্মের পর থেকেই মাথায় সমস্যা, অনেক ডাক্তার কবিরাজ বেটে খাইয়েও কোনো সুফল পাননি সালেহার পিতামাতা।
সালেহা পাঁচ ভায়ের এক বোন, অনেক আদরের কিন্তু আল্লাহ্ পাক তাকে অসুস্থ করে রেখেছেন।
সালেহা সর্বোচ্ছ ৩০-৩৫ দিন সুস্থ থাকে, আবার অসুস্থ হয়ে যায়। অনেক টাকা পয়সা খরচা করেও তাকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি।
সালেহা যখন অসুস্থ হয়ে যায় তখন অপরিচিত কেউ বুঝতে পারেনা মেয়েটি পাগলী! কারন সে অনেক সাজগোছ পছন্দ করে। মার্জিত পোশাকআশাক পরে থাকে, অন্যান্য পাগল পাগলীরা যেমন বিশ্রী নোংরা পোশাক ও বেআবরু থাকে সালেহা তাঁর উল্টো। তাঁর সমস্যাটা হচ্ছে যখন কথা বলে তা উল্টাপাল্টা হয় ও এদিক সেদিকে চলে যায়।
আজ ঠিক তাই হলো! সালেহার ভাই বাহার এসে দেখলেন ঘাটে নৌকা নেই! তারমানে সালেহা নৌকা নিয়ে কোথাও চলে গেছে।
বাহারের খুব দুশ্চিন্তা হলো,না জানি বোন আমার কোথায় চলে গেলো!
নদীমাতৃক এলাকাই যারা বসবাস করেন তাঁদের ছেলেমেয়ে সবাই কমবেশি নৌকা চালাতে অভ্যস্ত। তারই ধারাবাহিতায় সালেহা পাগলীও নৌকা চালাতে পারে।
সালেহার ভাই নিরাশ হয়ে এদিক সেদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও পাওয়া গেলো না তাকে।
বাহার বাড়ি যেয়ে মাকে জানালেন-‘ কোথাও পাওয়া যায়নি সালেহাকে।’
বাড়ির সবাই অনেক দুশ্চিন্তা করতে লাগলেন, সবগুলো ভাই তাকে খুঁজতে গ্রামের মাঝে ছড়িয়ে পড়লেন। এবং তাঁর মা বিলাপ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেন।
★
দুইপাশে দুটি গ্রাম মাঝে নদী, একপাশে বসন্তপুর অন্যপাশে সুন্দরপুর। সালেহা পাগলীর বাড়ি বসন্তপুর, সে নৌকা বেয়ে আস্তেআস্তে সুন্দরপুর সর্দারবাড়ি ঘাটে পৌঁছাল। রাত প্রায় ৯ টা হবে! গ্রামাঞ্চলে এমন সময় অনেক রাত।
বসন্তপুর অনেক বড়ো বাজার আছে, সুন্দরপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বিকালবেলা নৌকা পার হয়ে সেই বসন্তপুর বাজারে আড্ডা দিতে যান।
সালেহা পাগলী নৌকা থেকে নেমে পাশে একটা জায়গাতে দাড়িয়ে থাকে। সে ভেবে পাইনা কোথায় যাবে না যাবে!
এমন সময় বসন্তপুর বাজার থেকে ফিরছেন সুন্দরপুর গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি আব্দুল মজিদ মিয়া। তাঁর নিজেস্ব নৌকাতে বাজারে যাতায়াত করেন, এবাং একজন তাঁর ব্যক্তিগতভাবে মাঝি রাখা আছে।
আঃ মজিদ সম্পর্কে কিছু তথ্য দিই, তিনি গ্রামের প্রভাবশালী ও অনেক সম্পদের মালিক। নদীতে চরপড়া অধিকাংশ জমিজমা তাঁর দখলে। গরিব কৃষকদের দ্বারা চাষাবাদ করে তাঁদেরকে চুষে খাওয়া সমাজের নব্য পিচাশ।
যখন ফসলের মুল্য কম থাকে তখন গরিব কৃষকদের ভিতরে বাকিতে বিক্রি করে, আবার যখন ফসলের মুল্য বৃদ্ধি পায় তখন দাম উসুল করেন।
যে কৃষক আঃ মজিদের দেনা পরিশোধ করতে পারেননা, তাঁদের ওপরে চলে অকথ্য নির্যাতন এবং সেই গরিবের সমস্তরকম সম্পদ আঃ মজিদ কুক্ষিগত করেন।
যাইহোক, আঃ মজিদ নৌকা থেকে নামলেন, নেমেই চোখ পড়লো সালেহার দিকে। নৌকার মাঝিকে হাতের ইশারা করলেন এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য।
কারন এই রাত্রে ভূতপ্রেত ভেবে ভয় পাওয়ার আশংকা কেটে গেছে, সালেহাকে দেখেই আঃ মজিদ চিনতে পেরেছেন। রাতটা আজ চাঁদনি, যারকারনে দুর থেকে পরিস্ফুট বোঝা গেছে।
সালেহা খিলখিল করে হাসছে! অপরিচিত কোনো মানুষ দেখে তাকে ভয় পাবে এটা ভেবে যে, সে হয়তো সদ্য আকাশ থেকে নেমে আশা ডানাকাটা পরী।
আঃ মজিদ সালেহার দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে কোনো লোকজন আছে কি না!
সালেহা বর্তমান অসুস্থ হলেও আঃ মজিদকে দেখে কিঞ্চিৎ ভয় পেলো। এক কদম দুকদম করে পিছাতি লাগলো, আঃ মজিদ শইতানি একটা হাসি দিয়ে বললো-‘ অন্ধকারের রূপসী! কাছে এসো, তোমাকে আজ ইচ্ছামত আদার করবো। তুমি পাগলী হও আর যা হও তাতে আমার আপত্তি নেই। আজ আমি তোমার লাবণ্যময়ী যৌবনা উপভোগ করতে চাই।
কথাগুলো বলেই দ্রুতপায়ে সালেহার কাছে গিয়ে খপাৎ করে হাত ধরলো।
সালেহা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কয়েকবার, কিন্তু নরপিশাচ আঃ মজিদের লালসা থেকে সালেহা নামের নিষ্পাপ পাগলীটা আর রক্ষা পায়নি।
★
ভোরবেলা ফজরের সালাত আদায় করে যখন নৌকার মাঝিমাল্লা তাঁদের নৌকার কাছে ছুটে আসেন, তখন প্রথমে একজন আবিস্কার করলেন দুরে একটা নারী আকৃতির মানুষ পড়ে আছেন।
কাছে গিয়ে দেখেন সবার পরিচিত সালেহা পাগলীটা রক্তাক্ত ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
সালেহার পরিবারকে খবর দিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারলেননা, সালেহা আঃ মজিদ নামের নরপিশাচের লালসার স্বীকার হয়েছে গতরাতে।
সালেহাকে বাড়িতে নিয়ে জেয়ে গ্রামের কবিরাজ ভেজাল ডাক্তারের চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা হলো।
সালেহার দিন অতিবাহিত হতে লাগলো, এভাবে একমাস দুমাস তিনমাস পর পরিস্ফুট হতে লাগলো সালেহার মাতৃত্ব চিহ্ন। তাঁর গর্ভে আঃ মজিদের অবৈধ সন্তান।
সালেহার মা তাঁর এমন লক্ষন অগ্রাহ্য করেন, ভেবেছিলেন এমন হওয়ার কথা না। কিন্তু ভেজাল ডাক্তারের দ্বারা সালেহা গর্ভবতী সেটা প্রমানিত হলো। সালেহার মা যখন বুঝতে পারলেন সে গর্ভবতী, তখন তাঁর পেটের বাচ্চার বয়স ৬ মাস।
সালেহার ভাই সহ পরিবারের প্রতিটা সদস্যের মুখে একই কথা এই অবৈধ সন্তান রাখা যাবে না। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সালেহা ধর্ষিতা হওয়ার পর থেকে আজ অবধি আর অসুস্থ হয়নি। সালেহা রাজি নই তাঁর গর্ভের সন্তান নষ্ট করতে, তা নিয়ে পরিবারের মাঝে রীতিমত বাগবিতণ্ডা লেগেই থাকে।
সালেহা পরিবারের সাথে যুদ্ধকরে তাঁর গর্ভজাত সন্তানকে আর নষ্ট করিনি। অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করার পর নয় মাস অতিবাহিত হলো।
হঠাৎ একদিন সন্ধার সময় সালেহা অনেক অসুস্থ হয়ে যায়! আজ একটু ভিন্নরকম আচরণ করছে সে। আবোলতাবোল বকাবকি করছে, নিজের মাথার চুল ছিড়ছে, সাথে নিজের শরিরের পোশাকআশাক ঠিক রাখছেনা। খাওয়াদাওয়া করে না ঠিকমতো, নিজের হাতে কামড়াতে থাকে। এভাবে অনেক অসুস্থ হয়ে যায়।
এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সালেহার একটা ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করলো, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নিজ সন্তানের মুখখানি দেখার পূর্বেই তাঁর মালিকের ডাকে সাড়া দিলো।
সালেহার পাগল থাকা সময়টা আল্লাহপাক তাঁর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন, কারন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেন-
“ তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে ( তাদের অপরাধ লেখা হয়না):
১. ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ ঘুম থেকে জাগ্রত না হয়,
[ অনেকে ভাবেন স্বপ্নদোষ হলে গোনাহ হয়, আসলে তা নই। স্বপ্নদোষটা শইতানের পক্ষথেকে আসে এবং বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারনে হয়। আবার অনেকে ভাবেন সিয়ামরত অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে সিয়াম ভেঙ্গে যায়, কিন্তু না! স্বপ্নদোষের কারনে সিয়ামের কোনো ক্ষতি হয়না]
২. অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু যতক্ষণ সে বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক না হয়।
৩. পাগল ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত সে জ্ঞান বা চেতনা ফিরে না পায়।
__ নাসায়ি, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, দারিমি। হাদিসটি সহিহ”
হাদিসের বর্ণনামতে সালেহা পাগলী গোনাহ মুক্ত, তবে সুস্থ থাকা অবস্থায় কোনো গোনাহ করলে তাঁর হিসাব পেশ করা লাগবে।
আব্দুল মজিদ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে-
“উবাদাহ ইবনু সামিত (রাযি.) যিনি বাদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও লায়লাতুল ‘আকাবার একজন নকীব ‘উবাদাহ ইবনুস সামিত (রাযি.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পাশে একজন সহাবীর উপস্থিতিতে তিনি বলেনঃ তোমরা আমার নিকট এই মর্মে বায়‘আত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে না এবং সৎকাজে নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে তা পূর্ণ করবে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হলো এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তবে তা হবে তার জন্য কাফ্ফারা। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং আল্লাহ তা অপ্রকাশিত রাখলে, তবে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যদি চান, তাকে মার্জনা করবেন আর যদি চান, তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। আমরা এর উপর বায়‘আত গ্রহণ করলাম।”
(মুসলিম ২৯/১০ হাঃ ১৭০৯, আহমাদ ২২৭৪১)
(চলবে……..