#সময়ের_পালাবদল
শামসুল ইসলাম
পর্ব – ৩
.
তাহেরা তালহার প্রতি খুবি দুর্বল, কয়েক বছর পূর্বে তাঁদের মাঝে অপ্রিতিকর একটা ঘটনা ঘটে, সেদিনের পর থেকে তাহেরা সম্পুর্ন পরিবর্তন হয়ে যায়।
তাহেরা পূর্বের সেই সময়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায়। একটা সময় ছিলো তাহেরা তালহার কাছে আরবী পড়ত, সেখান থেকে দিন গড়িয়ে সপ্তাহ! সপ্তাহ গড়িয়ে মাস বছর এভাবে তালহাকে ভালোলেগে যায়।
তাহেরা প্রস্তাব দেই, তালহা তা প্রত্যাখ্যান করে। তাহেরার মনে জিদের বসে তালহাকে ঘায়েল করার চক্রান্ত করে, সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সে।
তাহেরা গ্রামের এক ন্যাড়ার ফকিরের সাহায্যে তালহাকে তাবীয কবজ করে, ঘটনাক্রমে তা ধরা পড়ে যায় তালহার কাছে। তাহেরাকে সেদিন অনেক বুঝিয়েছিল এবং কিছু কথা বলেছিলো যা তাঁর কাছে তিতা মনে হয়েছিল।
তাবিয সম্পর্কে তাবিয়ী ঈসা আবি লাইলা বলেনঃ-
“ আমরা সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উকাইম আবু মা’বাদ জুহানীকে (রাঃ) অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গেলাম। আমরা বল্লাম, আপনি কোনো তাবিয ব্যবহার করেন না কেন? তিনি বলেন: আমি তাবিয নেব? অথচ রাসুল (সাঃ) বলেছেন: যদি কেউ দেহে তাবিয লটকায় তাকে উক্ত তাবিযের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়।”
[ হাদিসটি হাসান, তিরমিযী ]
অন্য একটি হাদিসে তাবিয়ী উরওয়া ইবনুয যুবাইর বলেনঃ-
“ সাহাবী হুযাইফা (রাঃ) একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে যান। তিনি লোকটির বাজুতে একটি রশি দেখতে পান। তিনি রশিটি টানদিয়ে ছিড়ে ফেলেন এবং বলেন: (অধিকাংশ মানুষই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং তারা শিরকে লিপ্ত থাকে। সুরা ইউসুফ-১০৬)”
[তাফসিরে ইবনে কাছির]
সুতরাং তাবিয কবচ শিরক, তবে ঝাড়ফুঁক করার বৈধতা আছে হাদিসে এবং ঝাড়ফুঁক করে বিনিময় নেওয়ার বিধান আছে।
এসব নিয়ে তাহেরা খুব লজ্জিত ও অনুতাপ্ত, সেদিনের পর থেকে তালহার সামনে কখনো যায়নি তাহেরা।
কিন্তু আজ তাঁর মায়ের মুখে বিয়ের প্রস্তাব শুনে মনের আকাশে আতসবাজি ফুটলেও তা নিমিষে বন্ধহয়ে যায়।

হাসু ঠিকমতো সালাত আদায় করেনা, তালহা অনেকবার সালাতের দাওয়াত দিয়েছে, কিন্তু প্রতিবার তা প্রত্যাখান করেন।
তালহা এবার সরাসরি হাসুকে সালাতের জন্য একটু বেশিই গুরুত্ব দেই। তাকে সালাত না পড়লে কুফল বা পরিনতি কি সবিস্তারে আলোচনা করে শুনাই।
হাসুর চিন্তাচেতনায় তাহেরা, ইদানীংকাল তালহাকে দেখলে হাসুর সমস্ত শরির জ্বলে। তবুও একবাড়ি থাকার খাতিরে তালহাকে শ্রদ্ধা করে চলে। আব্দুল মজিদের প্রিয়ভাজন তালহা যারকারনে হাসু তাঁকে অসম্মান করতে পারেনা, তবে সুযোগের অপেক্ষায় কখনো সে সুযোগ উপস্থিত হলে পরিপুর্ন কাজে লাগাবে।
একদিন তালহা হাসুকে ডাক দিলো-
« হাসু ভাই এদিকে আসুন?
« কি খবর তালহা ভাই?
« আলহামদুলিল্লাহ, তবে আপনাকে কিন্তু সালাতে মটেই পাচ্ছিনা।
« সালাত পড়ে কি হবে শুনি! আর সালাত কার পিছনে পড়বো?
« কি বলেন! সালাতের গ্রুরুত্ব অপরিসীম। কোরআন হাদিসে অসংখ্য যায়গা এব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে।
« হুম জানি! তবে মসজিদের কমিটি সব সুদখোর ঘুষখোর লুচ্চা বাটপার তাদের সাথে কিভাবে আমার সালাত হবে?
« হাসু ভাই এটা কিন্তু কথা না, বরং যারযার হিসাব তাকে দিতে হবে। সালাত কবুলের সাথে মসজিদের মুছল্লিদের কোনো সম্পর্ক নেই।
হাসু একটু রাগান্বিত স্বরে বললো-
« তা বুঝলাম তালহা সাহেব, কিন্তু আপনি যে গোপনে অবৈধ কাজকাম করেন তাহলে আপনার পিছনে আমাদের সালাত কেমনে কবুল হবে?
তালহা বেশ অবাক হলো! সে কি!! হাসু বলে কি আমার নামে?
তালহা স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলো-
« ভাই হাসু, আমি কি অবৈধ কাজকাম করি?
« শুনুন, আমি সময় হলে প্রমান করবো আপনার কুকর্মগুলো। যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আমি নিশ্চুপ।
তালহা কথা না বাড়িয়ে বললো-
« এসব অজুহাতে সালাত পরিত্যাগ করা কঠিন বোকামি হচ্ছে হাসু ভাই।
« আপনার মত লম্পট ইমামের পিছনে সালাত পড়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
« বিষয়টা ভুল বলছেন ভাই, ইমাম যেমনি হোক তাঁর পিছনে সালাত পড়তে হবে।
কারন হাদিসে আসছেঃ-
“তাবিয়ী ইবরাহীম নাখয়ী বলেন, বেদুঈন, দাস, জারয সন্তান যদি কোরআন পাঠ করেন তাহলে তাঁদের ইমামতিতে অসুবিধা নেই।”
[মুহাম্মাদ কিতাবুল আসারের সহিহ সনদে বর্নিত ]
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলেন। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ- “তোমাদের উপর সালাত অত্যাবশ্যকীয় যে কোনো মুসলিমের পিছনে, সে নেককার হোক বা পাপী হোক, যদিও সে কবীরা গোনাহ করে থাকে।”
[ আবু দাউদ – ২৫৩৩]
সমাজের এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, যাদের সালাত আদায়ের কথা বললে এমন কিছু অজুহাত দাড় করাই। একজনের জন্য অন্যজনের সালাতে বাধাপ্রাপ্ত হবে না।
তাঁদের মাঝে আরো কিছু কথা হলো, একপর্যায় তালহা সেখান থেকে ফিরে আসে।

আব্দুল মজিদ তালহার কাছে সরাসরি তাহেরার বিয়ে প্রস্তাব পেশ করলো।
তালহা বললো-
« চাচা একটু ভেবে দেখি, আর পরিবারের সাথে কথা বলি পরে জানাবো ইনশাআল্লাহ্‌।
আব্দুল মজিদ তাকে সময় দিলো, এভাবে সপ্তাহ পর তালহা আব্দুল মজিদকে জানিয়ে দেই তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
তালহা বললো-
« চাচা আমি তাহেরার সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলতে চায়!
« ঠিকআছে বাবা তোমরা কথা বলে নিও আমি সব ব্যবস্থা করে দিব, আজ সন্ধ্যায় তাহলে আমার বাড়ি এসো?
« ইনশাআল্লাহ্‌ আসবো।
সেদিন মাগরিবের সালাত আদায় করে তালহা তাহেরার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে তাঁদের বাড়িতে গেলো। গত তিনবছর হলো তালহা তাহেরা পরস্পর কেউ কারো সামনাসামনি দেখা হয়নি কথাও হয়নি। যদিও তাঁরা এক বাড়ি পাশাপাশি থাকে।
তাহেরা মাগরিবের সালাত আদায় করে বাইরে হাটাহাটি করছে, এমন সময় খেয়াল করলো তালহা!
প্রায় তিনবছর পর তালহাকে দেখে তাঁর বুকের ভিতরে ধপাৎ ধপাৎ করা শুরু হলো। কারন সে জানেনা তাঁরসাথে কথা বলতে বাড়িতে উপস্থিত।
তালহাকে একপলক দেখেই ক্ষণিকের ভিতরে হাওয়া হয়ে যায় তাহেরা।
তালহা তাঁর এমন কাণ্ড দেখে মুচকি হাসলো, বুঝতে পারলো মেয়েটি গত ঘটনার জন্য এখানো লজ্জিত।
আব্দুল মজিদ তালহাকে সরাসরি তাহেরার ঘরে বসতে দিলো। তাহেরা তাঁর বড়ো মায়ের ঘরে আত্মগোপন করে, সে জানেনা তালহা তারঁ ঘরে বসে আছে।
তালহাকে নাস্তা করতে দিলো তাহেরার বাবা, অনেকক্ষণ পর তাঁহেরা ভাবলো সে হয়তো চলে গেছে।
তো কথাবার্তা না বলে সরাসরিভাবে তার ঘরে প্রবেশ করে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে।
ঘরে প্রবেশ করে তাহেরা হতচকিত হয়ে গেলো, তাঁর ঘরে তালহা কিভাবে?
দ্রুতবেগে যেমন ঘরে প্রবেশ করলো, তালহাকে দেখে তেমন দ্রুতবেগে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালো।
তালহা পিছন থেকে মজা করে ডেকে বললো-
« এই কণ্ঠশিল্পী গান না শুনিয়ে চলে যাও কেন?
তাহেরা তো একদম বেআক্কেল হয়ে যায়, এক পা বাড়িয়ে আরেক পা উঠাতেই তালহার কথা শুনে লজ্জাই তার গা হাতপা ঘামতে শুরু করে, হাটার শক্তি ম্লান হয়ে যায়।
তালহা তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো-
« আমি কি সেই কয়বছর পূর্বের তাহেরাকে দেখছি, না অন্য তাহেরাকে দেখছি!! অনেক পাল্টে গেছো মনেহচ্ছে।
তাহেরা নিশ্চুপ কোনো কথা বলে না, লজ্জাই মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে।
তালহা বললো-
« তাহেরা আমার সামনে আসো?
তাহেরা ভয়েভয়ে পা বাড়িয়ে তাঁর সামনে যেয়ে দাড়ালো।
তালহা তাকে বসতে বললো, বিছানার একপাশে বসলো তাহেরা।
তালহা বলতে শুরু করলো-
« চাচা তোমার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন, আমার তাতে আপত্তি নেই। শুধু এখন দরকার তোমার মতামত। এইজন্য তোমার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে এসেছি।
তাহেরার ভিতরে খুশির ঠেলাই ড্রাম বাজতে লাগে, আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, কোনো কথা বলে না। নিচের দিকে তাকিয়েই থাকে, তালহা অনেক কথা বললো কোনো কথার উত্তর হ্যাঁ না পর্যন্ত করলো না।
তালহা বললো-
« এ বিয়েতে কি তোমার আপত্তি আছে?
তাহেরা চুপ কোনো কথা বলেনা, তালহা তখন একটু রাগান্বিত স্বরে বললো-
« থাক কথা যেহেতু বলছো না, তারমানে তুমি রাজি না! ভালো থাকো যায় আমি।
তাহেরা মাথা উচু করে চোখে ছলছলানি এক ঝাঁক অশ্রকণা নিয়ে তালহাকে পিছন খেকে ডেকে বললো-
« শুনুন!!
তৎক্ষণাৎ তালহা ঘাড় ফিরিয়ে তাহেরার দিকে তাকিয়ে বললো-
« বলো! তোমার কথা শুনার জন্যই আমি অপেক্ষমাণ।
« আমি নিজেকে শুধরে নিয়েছি সেদিনের পর থেকে, নিজেকে আপনার যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছি। অসংখ্যবার তাহাজ্জতে আপনাকে চেয়েছি জীবনসঙ্গী হিসাবে। সেই চাওয়া আল্লাহপাক কবুল করেছেন, তা কিভাবে আমি অরাজি হয় বলুন?
বলেই মাথা নিচু করে তাহেরা আনন্দে কেঁদে দিলো।
তালহা দ্রুতপায়ে তাঁর কাছে এসে পাশে দাড়িয়ে বললো-
« আরে পাগলী কেঁদনা, আমিও তোমাকে চাই। তবে সেই চাওয়া কখনো অবৈধভাবে না বৈধপথে বৈধভাবে সারাজীবন ইহকাল পরকালে তোমাকে চায়।
তালহার মুখে এমন কথা শুনে তাহেরা আরো লজ্জা পেলো, বিষয়টা তালহা লক্ষ্যকরে, তখন বললো-
« সেই ছোটবেলার দুষ্টু তাহেরা এখন অনেক ভদ্র ও মার্জিত তবে মনেহচ্ছে এ বিয়ে করা হবে না আমার..!
তাহেরার নিঃশ্বাস বন্ধহয়ে যাবার উপক্রম একথা শুনে, তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললো-
« জানতাম এই ভয়টা আমার ছিলো!! আমি আপনার যোগ্য না, আমাকে আপনি বিয়ে করতে রাজি হবেননা।
কথাগুলো বলে নিরবে অশ্র ঝরাতে লাগলো।
তালহা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো-
« উত্তম স্ত্রী হওয়ার সব যোগ্যতাই তোমার আছে, কিন্তু স্বামীর দায়িত্ব নেওয়ার গুনাবলি কিছুটা অভাব আমার ভিতরে।
তাহেরা বললো-
« কেমন অভাব?
« এই যে তুমি ধনীর দুলালী! ছোটবেলা থেকে কোনো সখ আহ্লাদ অপূর্ণ রাখেননি চাচা। আমি গরিব! আমার সম্পদ নেই। বাবা দরিদ্র, সামান্য ইমামতি করে কিছু উপার্জন করি তা দিয়ে তোমার চাহিদা পুরন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমিই তোমার অযোগ্য পাত্র।
তাহেরা তালহার দিকে চোখতুলে বললো-
« শুনুন!!
« বলো!
তাহেরা আবার মাথা নিচু করে লজ্জিত স্বরে বললো-
« আমাকে বিয়ে করুন!! আমাকে শুধু ভালোবাসবেন তাতেই হবে। ওসব চাহিদা নিয়ে ভাবতে হবে না কখনো, আমি আপনার সামার্থের বাইরে কখনোই অতিরিক্ত বিলাসিতা বা চাহিদা করবো না।
« আলহামদুলিল্লাহ, কোনো আপত্তি নেই আর। তবে আমি অবাক হচ্ছি কি বেহায়া মেয়েরে বাবা!! নিজের মুখে বিয়ে করার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে না!!!
কথাগুলো বলে তালহা তাঁর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
তাহেরা লজ্জাই আর মাথা উঠালো না, মুখটা লাল নিল বেগুনী করে ফেললো।
ভালোথাকো, ইনশাআল্লাহ্‌ অতিদ্রুত আমরা জান্নাতী সাথী হবো, আসসালামু আলাইকুম বলে তালহা বের হয়ে গেলো রুম থেকে।………
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here