#সভ্যতার_সভ্য
#একাদশাংশ
#NishchupSpriha
==============
কাল হলুদ রুশাপুদের বাংলো বাড়িতে হলেও, বিয়ে আর বৌভাত একসাথে কনভেনশন হলে হবে। রুশাপু নিজে জেদ করে দুপুর একটার আগে বিয়ে পড়াতে বলেছে। এজন্য বারোটার মধ্যে বর চলে আসবে। তাই সকালে নাস্তা করেই আমরা মেয়েরা রুশাপুর সাথে পার্লারে চলে এসেছি।

কাল রাতের পর থেকে এখন অবধি সভ্যর সাথে আমার দেখা হয়নি। শুধু এসএমএস আদান-প্রদান হয়েছে। আমি যে আজকের সব কিছু জানি তা সভ্যকে বলিনি।

ওকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কই তুমি?’
ও বলেছে, ‘কাজ করছি।’

পরে রুশাপু আমাকে বললো, ও কাল রাত থেকে ফাইয়াজ ভাইয়াকে পাহারা দিচ্ছে। যাতে করে ভাইয়া গায়েব হতে না পারে।

বারোটার কিছুক্ষণ পরেই আমরা রুশাপুকে নিয়ে কনভেনশন হলে পৌঁছালাম। বর বারোটার আগেই চলে এসেছে। আমরা সবাই আপুকে নিয়ে যখন স্টেজের দিকে যাচ্ছি, তখন কোথায় থেকে যেন এক বাচ্চা দৌড়ে এসে আমার শাড়ীতে আইসস্ক্রিম ভরিয়ে দিলো! ওউফ! কেমন লাগে? আমি এখনো বরকে দেখিনি। এখন চাইলাম বরকে দেখতে কিন্তু সেটাও হল না! রুশাপুকে আমি সবার সাথে পাঠিয়ে দিয়ে রেস্টরুমে ফিরে এলাম।

রেস্টরুম থেকে বের হতেই দেখি সভ্য একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। ওকে দেখেই আমি বরাবরের মতো আমার হার্টবিট মিস করলাম! গড! গড! গড! সে এত সুদর্শন কেনো?

সভ্য আমাকে দেখে ফোন রেখে আমার দিকে এগিয়ে এলো। সভ্য যত আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো, আমি তত ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো এখানে শুধু আমি আর সভ্য ছাড়া কেউ নেই।

সভ্য আমার কাছে এসে বললো,
— ‘ওহ্, গড! জান, ইউ লুক গর্জিয়াস!’

সভ্যর কথা শুনে আমি হেসে বললাম,
— ‘মিথ্যা প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। এন্ড ইউ লুক হ্যান্ডসাম!’

— ‘থ্যাংকস, জান। কিন্তু আমি মিথ্যা প্রশংসা করছি না।’

— ‘অবশ্যই তুমি মিথ্যা প্রশংসা করছো, কারণ আজ আমি প্রশংসা পাওয়ার মতো কিছুই করিনি। শুধু শাড়ী পড়েছি আর হালকা জুয়েলারি।’

— ‘সত্যি জান, এই হালকা সাজে তোমাকে দারুণ লাগছে। আমি কোন মিথ্যে প্রশংসা করিনি।’

— ‘হা হা হা! স্যো ফানি!’

— ‘ওকে, লেট ইট পাস.. বাই দ্যা ওয়ে জান, তুমি বর দেখেছো?’

সভ্যর কথা শুনে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ‘আর বলো না! বর দেখতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু কোথায় থেকে যেন একটা বাচ্চা এসে আমার শাড়ীতে আইসস্ক্রিম লাগিয়ে দিলো। তাই আবার রেস্টরুমে এসেছিলাম, ওয়াশ করার জন্য।’

আমার কথা শুনে ও হেসে বললো,
— ‘ওহ, আচ্ছা চলো.. তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’

— ‘কি সারপ্রাইজ?’

— ‘চল.. গেলেই দেখতে পারবে..’

বরকে দেখে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়লো! এই *** রুশাপুর বর! আমি সভ্যর দিকে প্রশ্ন চোখে তাকাতেই, ও চোখের ইশারায় হ্যাঁ বুঝালো। কিছুক্ষণের জন্য আমি বাকরুদ্ধ!

সভ্য বললো,
— ‘কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?’

আমি কিছুই বলতে পারলাম না। এটা সারপ্রাইজ নাকি অভিশাপ? এর মুখ আমি জীবনে দেখতে চাইনি। আর এর সাথেই কিনা আমার খুব কাছের মানুষের বিয়ে? যাক ভালোই হবে আপু বিয়েটা করবে না। শিক্ষা হবে এত মেয়ের জীবন নষ্ট করার জন্য।

সভ্য আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
— ‘চলো তোমাকে তোমার জিজুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।’

আমি কিছু বলারই সুযোগ পেলাম না! তার আগেই সভ্য আমাকে টেনে নিয়ে এলো। বরের কাছে যেয়েই বরকে বড়সড় একটা সালাম দিলো। আমি চুপচাপ সভ্যর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। অসভ্যটা আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে, ছাড়াতেও পারছি না। আর ও বরের সাথে হেসে কথা বলছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে, একরাশ বিরক্ত নিয়ে ওদের কথা শুনছি। এই ছেলের সাথে আমার কথা বলতে রুচিতে বাঁধছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে বর আমাকে দেখে কিছুই বলেনি! চিনেনি নাকি না চেনার ভান করছে? অবশ্য যত মেয়ের লাইফ ও নষ্ট করেছে, আমাকে তো চেনার কথা না।

কিছুক্ষণ পর রুশাপুর হবু বর আমাকে বললো,
— ‘আমি কি আপনাকে চিনি?’

ওর কথা শুনেই আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। এহ্! কি ভদ্রতা!!

আমি ত্যাড়া গলায় বললাম,
— ‘আপনি আমাকে চেনেন কি না আমি কিভাবে বলবো?’

আমার কথা শুনে উনি অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, হাসার চেষ্টা করে বললো,
— ‘না মানে আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে এর আগে কোথাও দেখেছি।’

আমি কিছু বলার আগেই একজন বললো,
— ‘আরেহ্ বন্ধু! কি অবস্থা? কেমন আছিস? অনেক দিন পর দেখা!’

আমি তাকিয়ে দেখি অনুভব! জ্বী, হ্যাঁ… রুশাপুর হবু বর হচ্ছে আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড অনিক!

অনুভবকে দেখে আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ‘তুই? তুই এখানে? কিভাবে?’

অনুভব হেসে বললো,
— ‘আব্বে গাধি! তুই আর মানুষ হইলি না? আমার কাজিনের বিয়া আর আমি আমু না?’

তারপর সভ্যকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— ‘ছোটভাই! কেম্নে সামলাও এইডারে?’

সভ্য মাথা নাড়িয়ে বললো,
— ‘উইমেনস আর ইম্পসিবল, ব্রো! আমার জীবন তেজপাতা।’

সভ্যর কথা শুনে আমি ওর দিকে চোখ পাকিয়ে বললাম,
— ‘তাই না?’

আমার কথা শুনে সভ্য জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
— ‘আই ওয়াজ যাস্ট কিডিং, জান! নাথিং সিরিয়াস!’

ওর কথা শুনে অনুভব হো হো করে হেসে ফেললো।

এবার অনিক বললো,
— ‘অনুভব তোরা পূর্ব পরিচত?’

অনুভব একবার আমার দিকে তারপর অনিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ‘ইয়াহ, ব্রো। উই আর ওল্ড ফ্রেন্ড।’

তারপর আমি, সভ্য আর অনুভব আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গল্পে গল্পে জানতে পারলাম আজকের ব্যাপারটা অনুভবও জানে। ইভেন সভ্যকে ও-ই হেল্প করেছে অনিকের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে।

সবকিছু শুনে আমি আহাম্মক হয়ে গেলাম! আমার বয়ফ্রেন্ড দেখি সুপার স্মার্ট!
===============
বিয়ের বর-কনের জন্য তাদের বন্ধু-বান্ধব আর ফ্যামিলি মিলে তাদের কিছু বিশেষ মোমেন্ট নিয়ে শর্ট ভিডিও তৈরি করেছে। বিয়ে পড়ানোর আগে সেটাই, প্রোজেক্টরের মাধ্যমে বড় স্ক্রিনে প্লে করা হলো।

প্রথমেই রুশাপুর ভিডিও। আপুর ছোট থেকে বেরে উঠার বিভিন্ন বয়সের ছবি, আমাদের সাথে, আপুর বন্ধুদের সাথে, ফাইয়াজ ভাইয়ার সাথে অনেক ছবি, শর্ট একটা ভিডিও প্লে করা হল। সব শেষে যেই ছবি এলো তা দেখে কনভেনশন হলে সবার টাস্কি খাওয়ার অবস্থা। আমি আপুর দিকে তাকালাম, দেখলাম আপু মিটমিট করে হাসছে। তারপর ফাইয়াজ ভাইয়ার দিকে তাকালাম, ভাইয়ার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার অবস্থা!

স্ক্রিনে এখন ফাইয়াজ ভাইয়া আর রুশাপুর একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবিটা কুয়াকাটায় তোলা।

সূর্য সমুদ্রের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, তার সামনে দু’জন যুবক-যুবতী দিন দুনিয়া ভুলে যেয়ে নিবিড়ভাবে অধর চুম্বনে ব্যস্ত। ফাইয়াজ ভাইয়ার দুই হাত রুশাপুর কোমর জড়িয়ে ধরা, আর রুশাপু দুইহাতে ফাইয়াজ ভাইয়ার বুকের কাছের টিশার্ট শক্ত করে খামচে ধরে আছে।

এই ছবিটা সভ্যর ক্লিক। আমাদের বিশাল কাজিন গ্রুপ সেবার কুয়াকাটা ট্যুরে গিয়েছিলাম। সভ্যর বিভিন্ন শখের মধ্যে ফটোগ্রাফি অন্যতম। সেদিন সভ্য সূর্যাস্তের ছবি ক্লিক করছিল। তখনই হঠাৎ এই ছবিটা উঠে যায়।

কনভেনশন হলে সবাই যখন এটা নিয়ে ফিসফিসানি শুরু করেছে, তখন হঠাৎ থাপ্পড়ের আওয়াজে সবাই চুপ হয়ে যায়। স্টেজে উঠে রুশাপুর বাবা, রুশাপুর গালে থাপ্পড় মেরেছে। আপু গালে হাত দিয়ে, জল ভর্তি টলমলে চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

আংকেলের পাশে মিসেস রোমা দাঁড়ানো, তাকে বলতে শোনা গেলো, ‘মায়ের মতো হয়েছো তাই তো? হবেই না বা কেনো? যেমন মা তেমন ছা। রক্ত তো… রক্ত তো কথা বল—-‘

ওনার কথা শেষ না হতেই রুশাপু বললো,
— ‘হুম! একদম ঠিক বলেছিস ডাইনি! রক্ত তো কথা বলবেই! আমার শরীরে তো একজন জঘন্য মানুষের রক্ত বইছে… তার মতোই তো হব, তাই নয় কি? হাজার হোক সে আমার বাপ! তার মতোই তো হব! তাও ভালো আমি তো মানুষের সংসার ভাঙিনি বা খুন করিনি অথবা বিয়ে না করে কারো মিস্ট্রেস হয়েও থাকিনি।’

রুশাপুর কথা শুনে সম্পূর্ণ হলে পিনপতন নিরবতা।

আংকেল বিস্ফোরিত চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে আছে, আর মিসেস রোমার চোখে আতঙ্ক।

কেউ কিছু বলার আগেই আবার স্ক্রিনে ভিডিও প্লে করা হল। এবার সবাই হতভম্ব হয়ে স্ক্রিনে দেখতে লাগলো।

এখন স্ক্রিনে অনিকের ম্যামোরিব্যাল মোমেন্ট প্লে করা হচ্ছে। প্রতিটি ছবি হচ্ছে আলাদা আলাদা মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তোলা। সবার শেষে কিছু সেক্স টেপ প্লে করা হল। এসব দেখে সবাই হতভম্ব! কেউ কিছু বলতে পারলো না।

সবার আগে রুশাপু তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
— ‘এটাই তো আপনার দেখা বেস্ট ম্যান তাই না, মি. রায়হান? ইজ’ন্ট হি? সব কিছু আপনার সামনেই..’

বলেই রুশাপু একটু থামলো, তারপর আবার বললো,
— ‘আপনি যেন কেনো এর সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন? আপনার মিস্ট্রেসের কথায় তাই না? ওই ডাইনি যেন কি বলেছিল? আমি মানুষের সাথে শুয়ে পেট বাঁধিয়েছি? আরেহ্ ওই এমজি সবাইরে নিজের মতো ভাবে?’

এবার মিসেস রোমা হুংকার দিয়ে বললো,
— ‘শাট আপ.. হাউ ডেয়ার ইউ? রায়হান তোমার মেয়ে আমাকে এসব কি বলছে? আমাকে অপমাণ? মিসেস রোমা রায়হানকে অপমাণ? আমি কিন্তু সহ্য করবো না… এর—–‘

ওনাকে শেষ করতে না দিয়েই রুশাপু চিৎকার করে বললো,
— ‘ইউ যাস্ট শাট আপ বিচ্.. তোর ওই নোংরা মুখ বন্ধ রাখ… হাউ ড্যার ইউ টু টক টু মি লাইক দ্যাট, ইউ ফ্রীকিং বিচ্? আর একবার আমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বললে আমি তোর টুটি টেনে ছিড়ে ফেলবো ***। এই *** আমি তোর খাই? নাকি তোর পড়ি? আরে আমি তো আমার স্যো কল্ড বাপেরও খাই না… ওই জঘন্য লোকটার থেকে আমার কিছু নিতেই ঘেন্না করে। আমি আমার আম্মুর রেখে যাওয়া অংশ থেকে চলি। আর কি বললি? মিসেস রায়হান? এই *** এই তোদের বিয়ে হয়েছো তো? কোন প্রমাণ আছে তোদের বিয়ের? একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ এই পৃথিবীতে একজনই মিসেস রায়হান ছিল। আর উনি হল আমার আম্মু। তুই যে আমার স্যো কল্ড বাপের মিস্ট্রেস, সেটা সবাই জানে।’

এবার রুশাপুর বাবা ধমকে উঠে বললো,
— ‘রুশা! তুমি এতটা নিচে নেমে গেছো? ছিহ্ ছিহ্ ছি.. আমার মান সম্মান সব শেষ করে দিয়েছো তুমি…’

রুশাপু পাল্টা ধমক দিয়ে বললো,
— ‘ইউ যাস্ট কিপ ইয়োর মাউথ শাট… এত দিন তুমি চুপ করেছিলে, স্যো এখনো চুপ করেই থাকো। আর কি বললে আমি তোমার মান সম্মান শেষ করেছি? আচ্ছা তোমার মান সম্মান ছিলই বা কবে বলবে একটু, আব্বু? তুমি তো এ যুগেও রক্ষিতা রাখো.. তখন কোথায় যায় তোমার মান..? তোমার তো নিজের মেয়ের বয়সী সুগার গার্ল আছে… তখন কোথায় যায় তোমার সম্মান? লজ্জা করে না তোমার? শুধু মাত্র তোমার জন্য আমার আম্মু আজ নেই।’
বলতে বলতেই রুশাপু ফোঁপানো শুরু করলো।

রুশাপুর বাবা স্তব্ধ হয়ে রুশাপুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু কি বলার আছে? না নেই… এত বছরের পাপ… যে সম্মানের জন্য খালামণির নামে এত বড় অপবাদ দিয়েছিল… আজ সেই সম্মান কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ।

সময় সত্যি কথা বলে… কর্মফল খুব সাংঘাতিক জিনিস, এটা কখনোই এড়ানো যায় না…!

আমি, ফাইয়াজ ভাইয়া, অনুভব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। সভ্য এতক্ষণ কোথায় ছিল জানি না।

হুট করে ও এসেই ফাইয়াজ ভাইয়াকে বললো,
— ‘ভাই, রুপির কাছে যাও.. ওর এখন তোমাকে দরকার…’

সভ্যর কথা শুনে ফাইয়াজ ভাইয়া স্টেজে উঠে গিয়ে রুশাপুকে জড়িয়ে ধরলো।

ফাইয়াজ ভাইয়া রুশাপুকে জড়িয়ে ধরতেই, আপু ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
— ‘যাও তুমি.. চলে যাও.. খবরদার আমাকে ছুঁবে না.. লাগবে না আমার কাউকে.. আমি একাই থাকতে পারবো… তুমিও সবার মতো স্বার্থপর.. তুমি বলেছো তুমি আমাকে ভালোবাসো না.. যাস্ট ইউজ করেছো… যাও তুমি চলে যাও…’

ফাইয়াজ ভাইয়া অসহায় চোখে আমাদের দিকে তাকালো। ভাইয়াকে এভাবে তাকাতে দেখে সভ্য চোখের ইশারা করলো। ফাইয়াজ ভাইয়া আবার আপুকে বুকে জড়িয়ে নিলো। এবার রুশাপু ধাক্কা দিলেও, ভাইয়া ছাড়লো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো।

রুশাপু এবার ভাইয়ার বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদা শুরু করলো। আপুর কান্না দেখে আমার চোখ কখন ভিজে উঠেছে বুঝতেই পারিনি।

সভ্য আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ‘হুস! সুইটহার্ট! কেঁদো না.. সব ঠিক হয়ে যাবে.. আজ থেকে রুপি আর কখনো কষ্ট পাবে না.. রুপির জন্য ফাইয়াজ ভাই আছে..’

আমি কিছুই বললাম না। সভ্যর বুকে মুখ গুঁজে দিলাম।

রুশাপু একটু শান্ত হয়ে, আংকেলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার বলতে শুরু করলো,
— ‘আমার আম্মুকে তুমি অনেক কষ্ট দিয়েছো আব্বু, অনেক। আমার আম্মুকে তুমি মেন্টালি, ফিজিক্যালি উভয় টর্চার করেছে.. প্রতি রাতে আম্মু আমার রুমে এসে কান্না করতো.. আমি ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। আমার আম্মুকে তোমার কখনোই পছন্দ ছিল না। কারণ আমার আম্মু ছিল সাদাসিধে একজন মানুষ, যে তোমার সাথে কখনোই উচ্চ আওয়াজে কথা বলেনি। তুমি ভাবতে তোমার সাথে আম্মুর যায় না.. আম্মু ড্রিঙ্ক করতো না, রাতবেরাত মাতাল হয়ে ফিরতো না.. আম্মু তোমার সাথে কখনোই পার্টিতে যেত না। আমার আম্মু ছিল ঘরকুনো… তার শখ ছিল স্বামী, সন্তান নিয়ে শান্তিতে বাস করার। কিন্তু সেটা তোমরা হতে দাওনি। আজ আমার আম্মুর সব কিছু একটা স্লাট দখল করে আছে… তুমি আর তোমার মিস্ট্রেস মিলে আমার আম্মুকে খুন করেছো… ওই ডাইনি আমার আম্মুকে আমারই চোখের সামনে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়েছে। এখনো ওই দৃশ্য আমার চোখে ভাসে। আচ্ছা আব্বু.. আম্মুকে না হয় ভালো নাই বাসতে কিন্তু নিজের রক্তকে তো ভালোবাসতে? নাকি সেটাও ছিল লোক দেখানো? অবশ্যই লোক দেখানো… তা না হলে তুমি আম্মুকে মারতে পারতে না। আব্বু তুমি কি জানতে না আম্মু প্রেগন্যান্ট ছিল? আম্মুর প্রেগন্যান্সির তখন ফাইভ মান্থ রানিং… আর তুমি কিনা আমার আম্মুর নামে জঘন্য একটা কথা ছড়িয়েছো..! সময় কথা বলে আব্বু… মনে রেখো.. এমন একটা সময় আসবে যখন তোমার পাশে কেউ থাকবে না.. নট ইভেন দিস বিচ্… ওয়ান্স আই হার্ড, ‘‘কারমা ইজ অ্যা বিচ্। ইট নেভার লিভস এনিওয়ান।’’ অলওয়েজ রিমেম্বার ওয়ান থিংগ আব্বু, ‘‘কারমা ইজ এ বিচ, শী নেবার লেটস গো।’’ পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এন্ড ওয়ান মোর থিংগস ডু ইউ নো আব্বু? কেনো এই ডাইনি আমাকে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায়? কারণ ও আমাকে পুরোপুরিভাবে শেষ করে দিতে চায়। এই স্লাট ভয় পায় যাতে তুমি তোমার সব কিছু আমাকে না দিয়ে দাও। হাহ্! আমি যে কখনোই তোমার থেকে কিছু নিব না, সেটা তুমি খুব ভালোভাবেই জানো। পারলে তোমার মিস্ট্রেসকেও কথাটা বুঝিয়ে দিয়ো। আমি তো তোমার সব কিছুতেই বাঁধা হয়ে আছি তাই না আব্বু? ডোন্ট ওয়্যারি.. আমি আজ এই দেশ ছেড়েই চলে যাচ্ছি। তোমার মিস্ট্রেসকে আর ভয় পেতে হবে না। আমি যেমন নিজের জিনিস কাউকে দেই না, তেমনি মানুষের জিনিসে ভাগ বসাই না।’
বলেই রুশাপু, ফাইয়াজ ভাইয়ার হাত টেনে ধরে কাজির সামনে নিয়ে গেলো।
===============
পাঁচটা পনেরোর ফ্লাইটে আমরা ঢাকা ব্যাক করলাম। সভ্য আগেই এয়ার টিকেট বুক করে রেখেছিল।

রুশাপুর বিয়ে উপলক্ষ্যে নানু বাসা থেকে শুধু আমরা ছোটরাই গিয়েছিলাম। বড়রা কেউ যায়নি, খালামণি মারা যাওয়ার পর আংকেলের সাথে নানু বাসার কেউ সম্পর্ক রাখেনি, শুধু রুশাপু ছাড়া।

আমাদের সব কাজিনদের পাঠানো হয়েছিল যাতে করে রুশাপু মন খারাপ না করে। কিন্তু এই বিয়েতে এসে আমরাই শকড!

থ্যাংকস টু গড! বড়রা কেউ আসেনি! মামারা এলে রক্তারক্তি হয়ে যেত। খালামণি মারা যাওয়ার ঘটনাটা এতটা ডিটেলসে কেউ জানে না।

আমরা কাছের মানুষেরা জানতাম খালামণি সুইসাইড করেছে, আংকেলের অত্যাচারে। অনেক আত্নীয়-স্বজন জানে যে খালামণি পা পিছলে ছাদ থেকে পড়ে গেছে।

আর এখানে কিনা খালামণিকে নিয়ে এত বিশ্রী, জঘন্য একটা গেম খেলা হয়েছে! এটা কি সত্যিই কোন সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ! না, কখনোই না। মানুষ কতটা বিকৃত মস্তিষ্কের হলে এমনটা করতে পারে?

খালামণি যখন মারা যায় তখনই মামারা সন্দেহ করেছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুই করতে পারেনি। আর রুশাপুও তখন মামাদের কিছু বলেনি, নয়তো মামারা শেষ করে ফেলতো সব কিছু।

খালামণির নামে যে মিথ্যা অপবাদ রটানো হয়েছে সেটা মামারা কেউ জানে না। যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে সেটা শুধু মাত্র উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না।

আমাদের কাজিন গ্রুপের প্লান ছিল রুশাপুর বিয়ে হলে আমরা সবাই রিসোর্টে উঠবো। সিলেটের অনেক কিছুই আমার এখনো দেখা হয়নি। এজন্য প্লান ছিল সবাই মিলে কিছু দিনের জন্য ঘুরাঘুরি করবো।

কিন্তু যা ভাবি তা সব সময় হয়না। এখন ফাইয়াজ ভাইয়া আর রুশা আপুর সাথে ঢাকায় ব্যাক করলাম। রাতে ভাইয়া আপুর ফ্লাইট। কিছু গোছগাছ আছে, সেগুলো করতে আপুকে হেল্প করতে হবে।

ভাইয়া আপু সাথে তেমন কিছুই নিবে না। শুধু কাপড়-চোপড় আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।

ফাইয়াজ ভাইয়া তার অফিসের কানাডার ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হয়েছে। নেক্সট উইকেই তার জয়েনিং। ফাইয়াজ ভাইয়া সেখানে ইনিচার্জ।

আর রুশাপু? রুশাপু বেশ কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে হায়ার স্টাডিজের জন্য এপ্লাই করেছিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যা হয়! কেপ ব্রিটন ইউনিভার্সিটিতে রুশাপু স্কলারশিপ পেয়েছে। এরকম মিরাকল কয়জনের ভাগ্যে হয়?

মজার বিষয় হচ্ছে এখন অবধি রুশাপু, ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেনি। আর এদিকে ভাইয়ার প্রাণ যায় যায় অবস্থা!

ওদের দুজনকে ভাইয়ার ফ্লাটে রেখে আমি আর সভ্য বের হলাম কিছু গিফট কেনার জন্য। এই সুযোগে ওরা দু’জন নিজেদের মধ্যের মান অভিমান ভাঙিয়ে নেক।

ভাইয়া আর আপু চলে যাচ্ছে, আবার কবে আসবে জানি না। স্পেশাল কিছু অবশ্যই দেয়া চাই।

গিফট কিনে ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি। সারাদিন রোদ না থাকলেও, কেমন একটা ভ্যাপসা গরম ছিল। বৃষ্টির ফলে ভ্যাপসা ভাবটা কমলো নাকি আরো বাড়লো বুঝতে পারছি না। তার উপর বৃষ্টির মধ্যে আবার জ্যামে পড়লাম। উফ! যাস্ট বিরক্ত লাগছে…

এই বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে সভ্য গুণগুণ করে গাওয়া শুরু করলো,

‘‘ অসময়ে এ বৃষ্টিতে আমি,
অসময়ে এ বৃষ্টিতে তুমি..
কিছু না বলা কথা দিলাম ভাসিয়ে…
ধুয়ে যাক না এ মন অভিমানী…
মেঘলা আকাশ,
হালকা হাওয়া..
যাই ভিজে আর নিজেকে ফিরে পাওয়া..
আধখোলা কাচ, বৃষ্টি ছোঁয়াচ..
তোমার নামে মেঘের খামে চিঠি দিলাম আজ..
আধভেজা প্রহর, আধভেজা শহর…
আধভেজা তুমিও আর আধভেজা আমার সফর..
আধভেজা প্রহর, আধভেজা শহর
আধভেজা তুমিও আর আধভেজা..
আমার সফর….’’

গান থামার পর আমি কিছুই বলতে পারলাম না। গানটা এত ভালো লেগেছে যে, এই বিরক্তিকর পরিস্থিতিতেও আমি ঘোরের মধ্যে চলে গেছি।

কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ সভ্য বললো,
— ‘আমি একটা জিনিস ভাবছি।’

সভ্যর গান শুনে বিরক্তিকরভাবটা চলে গেছে।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ‘কি?’

— ‘লেটস গেট ম্যারেড…’

ওর কথা শুনে, আমি ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। এটা কোন সময় হল এসব বলার?

হতভম্ব গলায় বললাম,
— ‘কিহ্! কি বলছো এসব? ঠিক আছো তো?’

— ‘ইয়াহ্, আ’ম অ্যাবসুলুটলি ফিট এন্ড ফাইন।’

— ‘তাহলে এসব কি বলছো?’

— ‘ভুল কিছু তো বলিনি। কয়েক বছর আগেই আমি তোমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছি.. এবং তুমি তা একসেপ্ট করেছো। তাহলে যে?’

— ‘অবশ্যই ভুল কিছু বলেছো… এটা কোন সময় বা পরিস্থিতি হল এসব কথা বলার?’

— ‘এটাই পারফেক্ট টাইম.. দেখো আজ ফাইয়াজ ভাইও বিয়ে করে ফেললো… ইভেন সাদাফ, নিশাত, আনান, নাফিস, ফয়সাল, রাদিব, আদিব ওরা সবাই কয়েক বছরের মধ্যে বিয়ে করে ফেলবে। তাহলে আমি করলে সমস্যা কোথায়?’

— ‘ফাইয়াজ ভাইয়া বিয়ে করেছে, কজ তার এবিলিটি আছে বউকে খাওয়ানোর। তোমার কি আছে? তুমি বিয়ে করে বউকে কি খাওয়াবে? আর যাদের কথা বললে তারা সবাই নিজের বাবার বিজনেসে ঢুকেছে। তুমি তো এখনো স্টুডেন্ট। নিজেই চলো বাবার টাকায়।’

— ‘আমার বাপ আর শ্বশুরের কি কম আছে, যে বউকে খাওয়াতে আমাকে কামাই করতে হবে?’

এবার আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ‘এই শোন প্লিজ বাজে বকে আমার মাথা ধরিয়ো না তো।’

— ‘আমি বাজে বকি?’

— ‘এনি ডাউট?’

— ‘দাঁড়াও..’
বলেই আমাকে ওর কাছে টেনে নিলো।

ওর এহেন আচরণে আমি চমকে উঠে বললাম,
— ‘সভ্য, কি করছো কি?’

ও কোন জবাব দিল না। আমাকে ওর সাথে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। তারপর আমার ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো,
— ‘এবার বলো আমি বাজে বকি?’

আমি কিছুই বলতে পারলাম না। সভ্যর তপ্ত নিঃশ্বাস ঘাড়ে পড়তেই আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বুকের ভিতরটা কেমন কাঁপছে, অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে, অদ্ভূত এই অনুভূতিটা বারবার জানান দিচ্ছে এই মানুষটা আমার, শুধু মাত্র আমার একার, একান্তই আমার আপনজন। যার উপর শুধু আমার অধিকার।

সভ্য এভাবে কতগুলো চুমু খেয়েছে জানি না। আমি দম বন্ধ করে বসে ছিলাম। আমি জানি না ও যখন আমার কাছে আসে আমি কেনো বাঁধা দিতে পারি না! মনে হয় অদৃশ্য কোন শক্তি আমাকে বাঁধা দিচ্ছে ওকে বাঁধা দিতে!

ভাইয়া আপুকে সি অফ করার জন্য আমি আর সভ্য গেলাম। আপুকে সি অফ করতে যেয়ে, আমি নিজেই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেললাম।

এয়ারপোর্টে অনেকেই আজব চোখে আমাকে দেখছিল। হয়তো ভাবছিল ‘‘এ কোন আজব চিরিয়া…’’

ফাইয়াজ ভাইয়া আর রুশাপু ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর আমরা ফিরে এলাম। ভাইয়ার ফ্লাটের চাবি বাড়িওয়ালাকে দিয়ে আমরা আজ নাইটেই বাসায় ফিরে যাবো।

গড! এত জার্নি! আমি একদম শেষ!
………………………..
(চলব)

[ বিঃদ্রঃ যারা আগে পড়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, ‘‘নো স্পয়লার প্লিজ…’’ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here