#সন্ধ্যাতারা
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

আমি নীলিমার হাত চেপে ধরে বললাম, ” নীলিমা কি হয়েছে আমাকে দয়া করে সবটা খুলে বলো। এই গোলকধাঁধা আমি আর নিতে পারছি না।

নীলিমা ও-র চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে বললো, ” জানো তো তানিয়া, জীবন কখনো কখনো সিনেমাকেও হার মানায়! আমার বাড়ি বাগেরহাট জেলার একটা ছোট্ট গ্রামে। জন্মের সময় মা মারা গেছে, বাবাও অন্য একজনকে বিয়ে করে আবার ঘর বেঁধেছে। কিন্তু তাদের সংসারে কাঁটা হয়ে গেছি আমি। আমার সৎ মা যে আমাকে খুব একটা খারাপ জানতো এমনটা না। কিন্তু আশেপাশের লোকজন বারবার মনে করিয়ে দিতো আমার মা নেই, আমি যাকে মা বলে ডাকি সে আমার নিজের মা নয়। মায়ের কাছেও বলতো সৎ মেয়ে বলে ও-কে তুমি কষ্ট দিও না। মা প্রথম প্রথম এসব মেনে নিলেও পরে আব্বুকে বলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আমি থাকলে তাকে রোজ নানান লোকের নানান কথা শুনতে হয়। কথাটা মা একটুও মিথ্যা বলেনি জানো। আমি নিজেও অনেকবার অনেক লোককে মা’কে বিনা কারণে কথা শোনাতে দেখেছি। একদিনের একটা ঘটনা বলি, আমি সারাদিন না খেয়ে স্কুলে ছিলাম। পরে খেলতে গিয়ে সন্ধ্যার পরে বাড়ি এসেছি বলে মা আমাকে মেরেছে, সকাল বেলা তিন-চারজন মহিলা মা’কে বলছে, সৎ মেয়ে বলে মেয়েটাকে মারতে পারলে! এ ভাবেই আমাদের দিন কাটতে থাকে। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা করে একটা চাকরি করবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো। মা বাবা আমাকে কখনো বাঁধা দেয়নি। সৎ মা হওয়ার পরও আমার মা কখনো আমার বাবাকে আমার পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু গ্রামের দিকে মেয়েরা স্কুলের গন্ডি পেরোলেই বিয়ে বয়স হয়ে যায়। সেখানে আমি অনার্স পড়ি। নানান লোকের নানান রকমের কথা। বাবাকে তেমন কিছু বলতে না পারলেও মা’কে রোজই সকলে কথা শোনাতো। সৎ মেয়ে বলে মা নাকি আমাকে ঘরের খুঁটি করে রাখতে চায়। এমন অনেক কথা। লোকের এতো কথা মা আর সহ্য করতে পারেনি। তাই বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আল্লাহর রহমতে আমার স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসে। বেশ কয়েক মাস আগে আমার স্বামী কাজের খোঁজে ঢাকায় আসে। মোবাইলে আমাদের রোজ কথা হতো। কয়েকদিন আগে সে আমাকে ঢাকায় আসতে বলে, এখন থেকে আমরা দুইজন নাকি ঢাকাতেই থাকবো। কথা ছিলো আমি বাগেরহাট দিয়ে বাসে উঠবো আর সে আমাকে এসে নিয়ে যাবে। বাগেরহাট থেকে আব্বু আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বাস থেকে নামার পর তাকে আর খুঁজে পাইনি। সে বলেছিলো আমাকে বাসস্ট্যান্ডে নিতে আসবে কিন্তু কেন আসেনি জানি না। এমনকি তার মোবাইলটাও বন্ধ। ঢাকার শহর আমি কিছুই চিনি না। কোথায় কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

–” তাহলে আলভির সাথে তোমার পরিচয় হলো কি করে? আর তোমাদের বিয়েই বা হলো কি করে?”

নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” আমি বারবার আমার স্বামীকে কল দিচ্ছিলাম কিন্তু প্রতিবার ফোন বন্ধ বলছিলো। কি করবো বুঝতে না পেরে বাসস্ট্যান্ডের পাশেই একটা পার্কে বসে কাঁদছিলাম। তখন আলভি সাহেব আমার কাছে আসে। তারপর আমার সাথে কি হয়েছে সবকিছু জানতে চায়। আমিও তাকে সব খুলে বলি। তখন আলভি আমাকে বলে সে আমার স্বামীকে খুঁজতে আমাকে সাহায্য করবে। ”

–” এ পর্যন্ত তো স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা মানুষ কাঁদলে তার কাছে কারণ জানতে চাওয়া বা তাকে সাহায্য করবে বলে আস্বস্ত করা দোষের তো কিছু না৷ তারপর কি হলো?

নীলিমা খাটের পাশে টেবিলের উপরে রাখা পানির বোতল থেকে একটু পানি খেয়ে নিলো তারপর বললো,

আসলে সেদিন,

আলভি নীলিমার সব কথা শোনার পর নীলিমাকে বললো, ” আপনি এইভাবে কাঁদবেন না। আমি আপনার স্বামীকে খুঁজতে সাহায্য করবো। আপনি তো মনে হয় সে-ই সকালবেলা বেরিয়েছেন। রাস্তায় কি কিছু খেয়েছেন?”

নীলিমা মাথা নেড়ে না বললো। নীলিমা কিছু খায়নি দেখে আলভি পাশের একটা দোকান থেকে সামান্য খারাপ কিনে নীলিমাকে দিয়ে বললো, ” আপনি এগুলো খেয়ে নেন। ”

নীলিমার চোখে কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠলো। আস্তে আস্তে খাবারগুলে শেষ করে আলভির দিকে তাকিয়ে বললো, ” একটু পানি এনে দিবেন? ”

নীলিমা মেয়েটা যেন বাচ্চাদের মতো আবদার করছে। আলভি দেকান থেকে একটা পানি কিনে নিয়ে এলো। পানির বোতলটা নীলিমার হাতে দিতেই কয়েকজন পুলিশ নীলিমা আর আলভির কাছে আসলো।

–” কি রে পার্কে বসে প্রেম করিস নাকি?”

আলভি উনাদের সবকিছু খুলে বললো। কিন্তু উনারা আলভির কোনো কথা বিশ্বাস না করে বললো, ‘ বহুকাল ধরে এসব কাহিনী শুনে আসছি। এসব সিনেমার কাহিনী এখানে বলে কোনো লাভ নেই।’

আলভি উনাদের বললো, ” স্যার আমি মিথ্যা বলছি না। তাছাড়া একসাথে কোনো ছেলেমেয়ে থাকলেই তারা প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে যায় না৷ বা তাদের ভিতর কোনো অবৈধ সম্পর্ক থাকে না। ‘

–‘ আমরা তোর কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। চল তোদের আজ বিয়ে দিয়ে দিবো। এভাবে রাস্তাঘাটে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। ‘

বিয়ের কথা শুনে আলভি চমকে উঠলো। হাতজোড় করে বললো, ” স্যার বিশ্বাস করেন আমি বিবাহিত। এই মেয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা এসব করতে পারেন না। এদেশের নাগরিক হিসাবে আমার স্বাধীন ভাবে চলার অধিকার আছে। ‘

–” আমরা কি পারি আমরা বুঝবো! তোদের ভিতর যদি কোনো প্রকার সম্পর্ক না থাকে তাহলে তোদের গার্জিয়ানদের কল দে। ”

আলভি মোবাইল বের করে কাদের জানি কল দিছিলো অনেকবার কিন্তু কেউ কল ধরেনি। আর আমার মানুষটার ফোন তো বন্ধ। আব্বুর সাথে পুলিশের সামান্য কথা হলেও ওঁরা কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। এজন্য আলভি অনেক রেগে যায়। কিন্তু রেগে যাওয়ার কারণে ফল আরো খারাপ হয়। পুলিশের লোকরা আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সই করিয়ে তারপর ছাড়ে। কাজী অফিসে কে জানি আলভিকে দেখে ফেলে আর নিমেষেই আলভি বিয়ে করেছে এ কথা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কাল আসার পথে আলভি কার সাথে সারাপথ কথা বলতে বলতে এসেছিলো। তুমিই তো ছিলে মনে হয়। তোমার নাম ধরে ডেকেছিলো অনেকবার । তারপর তো তোমাদের বাড়িতে চলে আসলাম। এরপর থেকে তো তুমি সব জানো। এখন বলো এইভাবে দুইজন মানুষের বিয়ে দিলে কি কখনো কারো বিয়ে হয়? বিয়ে জিনিসটা কি এতোটাই সহজ? তাছাড়া আমি আমার স্বামীকে অনেক বেশি ভালোবাসি। সে ছাড়া অন্য কারো কথা আমি চিন্তাও করতে চাই না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, তোমার স্বামী তোমারই আছে। আমি আমার বরকে খুঁজে পেলেই তার কাছে চলে যাবো।’

নীলিমার কথা শুনে আমার মোবাইলটা চেক করতে লাগলাম। কাল আলভি আমাকে কল দিয়েছিলো কিনা দেখার জন্য। মিসকল চেক করতে গিয়ে দেখলাম আলভির ১৭৫টা মিসকল। সাথে কিছু এমএমএসও আছে। এসএমএসগুলোতে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ন কথা নেই কিন্তু বেশ কয়েকবার বলেছে যে ম্যাসেন্জার চেক করো।
ডাটা অন করে ম্যাসেন্জার চেক করতে লাগলাম। আলভি অনেকগুলো ভয়েস রেকর্ড দিয়েছে। শেষে একটা এসএমএসও দিয়েছিলো,

” তানিয়া আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার জীবনে অন্যকারো প্রয়োজনীয়তা নেই”

হ্যাঁ তাই তো। গতকাল গোসলে যাওয়ার আগে ম্যাসেন্জার চেক করেছিলাম, আলভি কিছু বলেছে কিনা দেখার জন্য। তখন আলভির এই এসএমএসটা আমি দেখেছিলাম, আলভির ভয়েস রেকর্ড আর এসএমএসের কথাটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছিলো কারণ আলভি বাইরে গেলে ভয়েস এসএমএস দেয়। কিন্তু ভয়েস এসএমএসগুলো শুনতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যেতো গোসল করতে তাই মোবাইল রেখে গোসলে যাচ্ছিলাম আর তখনই কাকি আমাকে আলভির দ্বিতীয় বিয়ের খবর দেয়। কি বলেছিলো আলভি?

ভয়েসগুলো এক এক করে শুনতে লাগলাম। এতো সময় নীলিমা আমাকে যেসব বললো আলভিও ঠিক তাই বলেছে। তার মানে আলভি মনে করেছে আমি নীলিমা আর ও-র বিয়ের ব্যাপারে সবটা জানি। কারণ সব এসএমএস সিন করা। কিন্তু এদিকে আমি কিছুই জানতাম না। ওরে আল্লাহ এ কোন বিপদে পড়লাম আমি! সে-ই জন্যই আলভি কাল বাড়ি ফিরে আমাকে কিছুই বলেনি। কারণ ও জানতো আমি সব জানি।
(নোটঃ অনেকে বলবেন যে পুলিশ এইভাবে বিয়ে দেয় না। কিন্তু আমাদের এখানে এক পার্কে একদিন পুলিশেরা ছেলেমেয়েদের একসাথে পেয়ে ৩২ জোড়া বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। তাদের ভিতর আমার এক পরিচিত মেয়ে ছিলো যে বিনা কারণে ফেঁসে গেছিলো এবং তারও বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো অপরিচিত একটা ছেলের সাথে)

স্বভাবত আলভি অনেক জেদি একটা ছেলে। রাগ অভিমান সব কিছু অনেক বেশি। সামান্য কিছু হলেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। আর এখন তো অনেক বড় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমার উপর রাগ করে আলভি নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো? আল্লাহ ও জানি কিছু করে না বসে। এ কোন পরীক্ষায় পড়লাম আমি! দেরী না করে আলভির নম্বরে কল দিলাম। ওপাশ থেকে কোকিলকণ্ঠী এক মেয়ে জানান দিলো, ‘আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ‘

এখন আলভিকে আমি কোথায় খুঁজে পাবো? সবকিছু না জেনে আলভিকে এইভাবে অবিশ্বাস করা আমার উচিত হয়নি। আসলে সমাজে এখন পরকীয়া এতোটা বেড়ে গেছে যে আমরা অন্যকিছু ভাবতেই পারি না। কোনো ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলেই মনে করি তাদের ভিতর প্রেমের সম্পর্ক।
আলভির নম্বরে বারবার কল দিতে লাগলাম। প্রতিবারই মোবাইল বন্ধ। এই ছেলেকে এখন কোথায় খুঁজে পাবো আমি? নিমেষেই চোখের পাতা ভিজে গেলো। এতো সময় এক কষ্টে কষ্ট পাচ্ছিলাম, এখন অন্য চিন্তায় মরে যাচ্ছি। কি করবো এখন?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here