‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ২১.
তাবিনা মাহনূর
__________
দেড় মাস ধরে আরশের চিকিৎসা চলছে। বাম হাতের স্নায়ুতে সমস্যা ধরা পড়েছিল। তাই হাতে কোনো অনুভূতি ছিল না, অবশ হয়ে থাকতো। আল্লাহর রহমতে সে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। সিটি স্ক্যান করে মাথায় বড় কোনো আঘাত ধরা পড়েনি। সবই আল্লাহর অনুগ্রহ। এতটা আঘাত পেয়েও সে স্বাভাবিক মানুষের মতো হাটা চলা করতে পারছে।
দুপুরের খাবার খেয়ে আরশ একটু ঘুমিয়েছিল। বিকেলে আছরের আজান দিলে সে বারান্দার দোলনায় বসলো বাইরের নিস্তব্ধতা দেখে। তার নীরব আবহাওয়া খুবই ভালো লাগে। একটু পর রিশতা এসে বললো, ‘শরীর এখন ভালো লাগছে?’
এতোদিন ধরে রিশতা আপনি করে ডেকেছে। তার আচরণ আরশের নূরজাহানের মতো নয়। আরশ অসুস্থ থাকায় রিশতাকে কিছু বলেনি। আজ অনেকটা সুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। আজই সে রিশতার মনোভাব জানতে চাওয়ায় বলে উঠলো, ‘আমার পাশে বসুন।’
রিশতা তার পাশে বসে বললো, ‘রাশেদ স্যারের কোনো খবর পেয়েছেন?’
রিশতা কোনো স্ত্রীসুলভ কথাবার্তা বলে না। সবকিছু কাজ ও যত্ন কেন্দ্রিক। শরীরের খোঁজ নেয়া, খাবার-ওষুধের নিয়ম মানা ছাড়াও মনের প্রশান্তি বলে যে একটা বড় ঔষধ আছে, তা রিশতার খেয়াল নেই। আরশ তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে বললো, ‘স্যার দুবাই চলে গিয়েছেন। আমার জন্য উনাকেও শাস্তি পোহাতে হলো।’
– এটা উনার প্রাপ্য। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে উনি আপনাকে আসল অপরাধী খুঁজতে সাহায্য করেছেন। এর জন্যই আফজালের দাসগুলো তার উপর রাগ ঝেরেছে। কিন্তু উনিও অন্যায়ভাবে উপার্জন করতে চেয়েছিলেন, লোভ সামলাতে পারেননি।
– আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। উনি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছেন। আল্লাহ যেন সাহায্য করেন।
– আমিন। আচ্ছা, ভুবনের ফোন ওরা কবরে কেন লুকিয়েছিল? নষ্ট করে ফেললেই হতো। যেহেতু পুলিশের বড় এক অংশ ওদের হাতের মুঠোয় থাকে।
– ভুবনের ফোন ওদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধু মাদক নয়, লাশ বিক্রি ও পতিতালয়ের সাথে সংযোগ ছিল তার। সব মিলিয়ে ওর ফোনে কিছু ডকুমেন্টস ছিল যেগুলো আফজালের দল উদ্ধার করতে পারছিল না কেস নিয়ে জটিলতার কারণে।
কিছুক্ষণ নীরবতা। রিশতা বললো, ‘লিটন নামের ছেলেটাকে কীভাবে পেয়েছেন ইহসান স্যার?’
– ইহসান স্যার সবসময় শত্রুদের নজরে রাখতেন। কালীর বাজারের সামনে লিটনকে জাহাঙ্গীরের গাড়িতে উঠতে দেখেছিল স্যারের নিয়োজিত পুলিশ। তার পিছু নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল সেই পুলিশ ভাই। লিটন জাহাঙ্গীরের ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময় স্যার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। লিটন কিছুতেই স্বীকার করছিল না। স্যার তখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেন। আমি যেভাবে সজলের মুখ থেকে কথা বের করেছি, স্যার সেভাবেই লিটনের মুখ থেকে আমার ঠিকানা জেনে নিয়েছেন। এ ধরণের মানুষগুলো আল্লাহকে বিশ্বাস করে, ভয় করে। কিন্তু কুসংস্কার আর শির্কী কাজকর্মের ভিড়ে এদের ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।
রিশতা আবার চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বললো, ‘মলম লাগাতে হবে। চলুন।’
– আমার ব্যথা সেদিনই কমে গিয়েছে।
– কোনদিন?
– যেদিন আপনি আমার ব্যথার স্থানগুলো…
– সিনেমার ডায়ালগ!
– আমি সিনেমা দেখিনি কখনো।
রিশতা কিছু বললো না। আরশ বললো, ‘আপনার কি হয়েছে?’
রিশতা তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কি হবে?’
মৃদু স্বরে আরশ বলে উঠলো, ‘অচেনা মনে হচ্ছে আপনাকে।’
– খুব চেনা ছিলাম কি?
এই প্রশ্নে আরশ বুঝতে পারলো, রিশতার মনে কোনো ঝড় চলছে। যেটা সে থামাতে পারছে না বা চাইছে না। আরশ তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘ঝড় থামাতে সাহায্য করবো?’
রিশতা হাত বাড়ালো না। দোলনায় আরাম করে বসে বললো, ‘ঝড় নেই তো। থামাবেন কীভাবে?’
– আমি শুনতে পাচ্ছি। প্রবল বর্ষণ আর বজ্রপাত।
– ভুল শুনছেন।
– ঠিক কোনটা?
রিশতা সামনে তাকালো। শীত শেষে বসন্তের আগমনী বার্তা পাঠাচ্ছে সোনালী রোদের আবির মাখা আকাশ। গোধূলি বেলার কাল বেড়েছে। মনোমুগ্ধকর সময়টা রিশতার মনকে শীতল করে তোলে। নয়ন জোড়া বন্ধ করে মন ভরে শ্বাস নিয়ে সে বললো, ‘বকুল তলায় ঝরে পড়ছে ফুল। কুড়োনোর মানুষটা নেই। নিস্তব্ধ শান্ত আবহাওয়া, নির্জন সেই অঞ্চলের সাক্ষী একটা দীর্ঘশ্বাস। এই শ্বাসের আওয়াজ আপনি শুনতে পাননি, পাবেন না। ঝড় তো দূরের কথা!’
আরশ একমনে তাকিয়ে আছে রিশতার দিকে। খুব ইচ্ছে করছে রিশতার সবুজ চোখের মায়া মাখতে। আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে সে বললো, ‘মানুষটা তোমার পাশেই আছে।’
সঙ্গে সঙ্গে রিশতার উত্তর, ‘নেই! যে আছে সে আরশ। আমার ইফতিখার নয়।’
আরশের উত্তর, ‘যার দীর্ঘশ্বাস শুনছি সে রিশতা, আমার নূরজাহান নয়।’
চোখ খুললো রিশতা। আরশ ফিরে আসার পর আজ প্রথম তাকে নকল করে কথা বলেছে। রিশতা সেটা খেয়াল করে এক গালে হাত রেখে পায়ের উপর কনুইয়ের ভর রেখে ভাবুক ভঙ্গিতে বললো, ‘অতএব সমীকরণটি সিদ্ধ হলো।’
মুচকি হেসে উঠলো আরশ। নূরজাহান তখনই হবে যখন ইফতিখার প্রকাশ পাবে। আরশ বললো, ‘কি হয়েছে তোমার বলো না? হেঁয়ালি করো না।’
– বলছি তো। কি হবে?
– অভিমান?
– মনে হয়।
– সেদিন আমাকে যেতে মানা করেছিলে। আমি গিয়েছি বলে অভিমান হয়েছে?
চুপ করে আছে রিশতা। কিছুক্ষণ আরশের দিকে তাকিয়ে থেকে রিশতা বললো, ‘সেদিন আপনি রাজীব ভাইকে যখন আল্লাহর প্রতি ভরসার কথা বললেন, তখনই আমার মাথায় এলো ব্যাপারটা। আল্লাহ চাইলে আপনি বাসায় থাকলেও মৃত্যু দেখবেন, বাইরে থাকলেও দেখবেন। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে মরার চেয়ে ন্যায়কে আঁকড়ে ধরে শহীদ হওয়া অনেক অনেক বেশি সম্মানের। তাই সেদিন আপনাকে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল রেখে যেতে বলেছিলাম। তবে…’
আরশ অপেক্ষায় আছে বাকি কথা শোনার জন্য। রিশতাকে চুপ থাকতে দেখে সে বললো, ‘তবে?’
রিশতা সামনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তবে আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। এটা প্রমাণ পেয়েছি।’
খুব হাসি পাচ্ছে আরশের। রিশতার মুখশ্রী জুড়ে এখন শিশুর মতো অভিমান। অনেকটা তার নূরজাহানের মতো। রিশতা খুব চেষ্টা করেও নিজের গম্ভীরতা ধরে রাখতে পারছে না এখন। রুদ্ধ কণ্ঠে সে বললো, ‘আপনি চলে গেলেন। একবারও বলেননি আবার আসবেন। একবারও বলেননি আমি যেন আপনার অপেক্ষায় থাকি। একবার জড়িয়ে ধরেননি, আশা দেননি। আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে বারবার শুনতে চেয়েছিলাম আপনি আবার আসবেন। কিন্তু, আপনি নিজের মতো হাসিমুখে চলে গেলেন।’
আরশ মনে করলো সেই সময়ের কথা। সেই আবেগঘন মুহূর্তে, চিন্তার ঝুড়ি মাথায় নিয়ে তার এসব বলার কথা মনেই ছিল না। অথচ তার পুরোটা জুড়ে তখন রিশতা আর মায়ের চিন্তা ছিল। মাকেও সে বলেনি ফিরে আসার কথা। মা তবু অভিমান না করে ছেলেকে আগলে রেখেছেন। কিন্তু রিশতা? তার অভিমান হবে নাই বা কেন? তার মনের সবটা জুড়ে শুধু ইফতিখার। আর কাকে নিয়ে সে অভিমানের ঘর গড়বে?
আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘আমি যদি বলতাম আমি ফিরে আসবো, তারপর যদি না ফিরে আসতাম। তাহলে সেটা কথার আমানতের খিয়ানত হতো না?’
রিশতার গাম্ভীর্য আবার ফিরে এলো। স্থির চোখে তাকিয়ে সে বললো, ‘ইন শা আল্লাহ, দেখা হবে। এটুকুও বলেননি।’
আরশের হাসি থামছে না। অনেকদিন পর সে নূরজাহানকে দেখছে। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কি আছে! সে প্রশ্ন করলো, ‘কি করলে ক্ষমা পেতে পারি?’
রিশতা উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার চৌকাঠ পর্যন্ত গেল। তার উপর দাঁড়িয়ে আরশের দিকে তাকিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আমার ইফতিখার চাই।’
আরশ চুপ করে আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই শব্দহীন জলধারা ঝরে পড়লো সবুজ আঁখি জোড়া থেকে। আরশ উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল সেদিকে। রিশতার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বারান্দার দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো সে। হাত দুটো পেছনে রেখে মাথা উঁচু করে দরজায় ঠেকিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকলো রিশতার দিকে।
রিশতা আর আরশের মাঝে স্বল্প দূরত্বের ব্যবধান। সেই ব্যবধানে দেখা যাচ্ছে সামনের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের টকটকে লাল সৌন্দর্য। সেখান থেকে বৃষ্টির ন্যায় ঝরছে ফুল, ঝরছে পাতা। রিশতার অশ্রু এমন করে তার শুভ্র কপোল জোড়া রক্তিম করে তুলছে। আরশ সেদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার সত্তা জুড়ে তুমি। এখানে শুধু নূরজাহান পাবে। কোনো ইফতিখার নেই! তুমিই তো আমি।’
আরশের বলা শেষ কথাটি রিশতার মনের কথা। আজ কতদিন পর আরশ তাকে তার প্রিয় সম্বোধনে ডাকলো! রিশতা ভালোবাসে, তুমিই তো আমি শুনতে।
রিশতা সোজা হয়ে দাঁড়ালে আরশও শীতল দৃষ্টি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এখনো অশ্রু ঝরছে। আরশের বুকে মুখ গুঁজে তার বুক ভিজিয়ে তুললো। চোখ বন্ধ করে ফেললো আরশ। এ সময়টা অনুভবের।
মোহনীয়তা যখন অসীমকে স্পর্শ করেছে, তখন উভয়ের মুখ ফুটে একসাথে বের হলো, ‘ভালোবাসি!’
_____
আরশের এ দেশে থাকা হচ্ছে না। ভিনদেশে পারি জমানোর প্রক্রিয়া চলছে। এর মাঝে ইহসান একবার ফোন করে বলেছেন, আরশের দেশ ত্যাগের পর আর কোনো ধরণের আশংকা থাকবে না। কেননা ইতিমধ্যে দেশের লোকজন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যদি তার ক্ষতি করা হয় তবে শত্রু পক্ষের ক্ষমতা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। জনগণ একবার ক্ষেপলে রক্ষা নেই!
তাই তাকে মেরে ফেলে কিংবা গু-ম করে শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াতে চায় না অমানুষগুলো। তবে সে দেশে থাকলে ঝুঁকি আছে। বিদেশে গেলে তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না কেউই।
এসব জানার পর আমান তার ভাইকে বাইরে পাঠানোর জন্য কোনো ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেনি। কোন দেশে তাদের কেমন আত্মীয় স্বজন আছে, কোথায় গেলে আরশ আর রিশতা ভালো থাকবে, সকল খোঁজ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। জামিলও সাহায্য করছে এ ব্যাপারে। এমনকি মেঘ মর্জিনা খালার কাছ থেকে রিশতার বিষয়ে জানার পর আমেরিকায় নিয়ে আসার জন্য সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু আরশ বলেছে, ‘আর যা-ই হোক, আমেরিকার মাটিতে পা রাখবো না কখনোই!’
বাংলাদেশে আরশের অবস্থান আর অল্প কিছুদিন। নাজিফা তাই এখন বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। আনিকার অবস্থাও একই। আরশের মন খারাপ হয়। তার একমাত্র বোন কথা না বলে একটুও সময় কাটাতে পারে না। অথচ এই বোন এখন তাকে দেখলেই কথা হারিয়ে ফেলে। শুরুতেই বলে ওঠে, ‘ভাই, তুই গল্প কর আমি শুনি।’
আরশ গল্প জানে না। সে গালে হাত দিয়ে বলে, ‘তুমি বলো, আমি শুনি।’
আনিকা তখন খুব কষ্টে অশ্রু ধরে রাখে। দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে চোখ বন্ধ করে কথা বলে সে। আরশকে সে বোঝাতে চায়, তার হাসির জোরে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে। অথচ সে যে অশ্রু লুকাতে চাইছে, তা আরশ খুব ভালোভাবেই জানে। আরশ তখন বলে, ‘হাসিটা রেকর্ড করে নিয়ে যাবো আপু?’
আনিকা তখন অশ্রু ঝরায়। আরশ সেই অশ্রু হাতে নিয়ে বলে, ‘বোতলে নিয়ে যাই? তুমি জমা করে রেখো। গিয়ে ফ্রিজে রেখে দিব যেন কখনো না শুকায়।’
লুকমানের অভিমান কমে না। আরশ কখনো লুকমানের অভিমান ভাঙানোর জোর চেষ্টা করেনি। প্রতিবার সে দুটো কথা বলে চলে আসতো, ‘আব্বু সরি।’ কিন্তু এবার যেন সে ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। সবসময় লুকমানের পিছে শিশুর মতো লেগে থাকে। লুকমান যখন রাগ করে বলেন, ‘শুনোনি বাপের কথা। এবার এই চাকরিই তোমাকে পরিবার ছাড়া করছে। থাকো দূরে! তুমি তো পরিবার চাও না। শুধু একা একা থাকবে বলেই এই চাকরি নিয়েছিলে, তোমার চাল আমি বুঝি না নাকি?’
আরশ তখন মিটমিটে হাসি হেসে বাবার পাঞ্জাবির এক কোণ ধরে বলে, ‘আমাকে আইসক্রিম এনে দাও না আব্বু। আর একটা চিপস।’
এসব দেখলে লুকমানের চোখে জল চলে আসে। ছেলেটার বয়স যখন তিন থেকে চার বছর, তখন এমন আবদার কত করেছে! তখন তিনি বকতেন। এখন বকা আসে না। বকতে গেলেই গলা ধরে আসে। ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘অসুস্থ শরীরে আবার ঠান্ডা জিনিস খাবে। আমানের মা! দেখো তোমার ছেলে কী বলছে…’
তারপর তিনি মুখ লুকাতে রান্নাঘরে চলে যান নাজিফার কাছে। আরশ হেসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিক থেকে কোনো কথা ভেসে আসে না। আসবে কীভাবে? রান্নাঘরে দুজন স্তব্ধ কান্না কাঁদছে।
আমান অবশ্য স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। বাবার ব্যবসার একটা অংশ আমান পরিচালনা করে। এক অংশ আরশের। আরশ সেটা ভাইকে দিয়ে দিতে চাইলে আমান বলে, ‘উহু, তুই যতদিন না বিদেশে একটা ভালো পর্যায়ে যাবি, ততদিন তোর ভাগের ব্যবসার টাকায় চলবি।’
– আমিই তো থাকছি না। আমার অংশের ব্যবসা কে চালাবে?
– এটা কেমন কথা বললি আরশ? আমি থাকতে তোর কিসের চিন্তা?
আরশ হেসে বললো, ‘তুমি আমার ভাই। তোমাকে আমি আমার অংশ পুরোটা দিলাম। বিদেশে গিয়ে চাকচিক্যময় অবস্থায় থাকতে চাই না। সাধারণ জীবনযাপন করবো। যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু উপার্জন করবো ইন শা আল্লাহ।’
আমানের সাথে ব্যবসা ছাড়াও আরো অনেক গল্প করে আরশ। ছোটবেলার স্মৃতি, কিশোর বয়সের গল্প, এমন নানান বিষয়ে তারা একান্ত আলাপ জমিয়ে তোলে। ফাতিহা একবার আমানের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী দেখে দুআ করে, ‘জান্নাতে যেন সবাই একসাথে থাকি হে আল্লাহ!’
মুয়াজ আর মুসআবকে নিয়ে আরশের অবসর সময় কাটে। তাদের সাথে বসে ক্বুরআন তিলাওয়াত করা, নবীজির জীবন কাহিনী গল্প আকারে বলা, মজার ছড়া বলা- এসব কাজের মাঝে কেটে যায় সুন্দর মুহূর্তগুলো। একবার আরশ মুয়াজকে বিছানায় গড়াগড়ি করতে দেখে রিশতাকে বলে, ‘আমাদের কবে হবে?’
রিশতা মুচকি হেসে উত্তর দেয়, ‘আল্লাহ যেদিন চাইবেন।’
_____
দুই একদিনের মাঝেই আরশের বিদেশ যাত্রা শুরু হবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরশ একাকী সময় কাটাচ্ছে। এ বাড়িতে কত স্মৃতি জমে আছে! রিশতা তার কাছে গেল না। এ সময়টা একান্তই আরশের।
বিকেল উপভোগ করে মায়ের কাছে গেল আরশ। নাজিফা ইস্তেগফার করছেন। ছেলেকে দেখে বললেন, ‘কিছু বলবি?’
আরশ বিছানায় শুয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো, ‘গল্প বলবো।’
নাজিফা চুপ করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আরশ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ অনুভব করলো। তারপর বলে উঠলো, ‘পনেরো বছর বয়সে হজে গিয়েছিলাম। তুমি তখন আমাকে রেখেই দৌড়ে ক্বাবার সামনে চলে গিয়েছিলে। আমি অবাক হয়েছিলাম তোমার কাণ্ডে। আমার হাত ধরে আব্বু হেসে উঠেছিলেন আর বলেছিলেন, তোদের মা কেমন বাচ্চা মেয়েদের মতো করছে!’
নাজিফা হাসলেন। আরশ মুচকি হেসে আবার বললো, ‘তারপর হজের সব কৌশল সেরে যখন ফিরে আসবো, তখন খুব কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমার বুকের মধ্য থেকে হৃদপিন্ড ছিঁড়ে বের করছে কেউ। এখানে হৃদপিন্ড রেখে আমি বাংলাদেশ যাচ্ছি। কিশোর ছিলাম, অনুভূতি গাঢ় ছিল। আমান ভাই যখন আমাকে খুব কাঁদতে দেখলেন, প্রশ্ন করলেন, কাঁদছিস কেন? উত্তর দিলাম, এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।’
নাজিফা আনমনে সেসময়টা ভাবছেন। যেন তিনি অতীতে চলে গিয়েছেন। সাদার মিছিল, মাঝে কালো আবরণে ঘেরা বাইতুল্লাহ। সমস্বরে সবাই বলছে, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক!’
– আমার উত্তর শুনে আমান ভাই বললো, ‘পাগল, এখানে থাকতে ইচ্ছে সবারই করে। কিন্তু বাস্তবের কাছে হার মানতে হয়। তুই ছোট বলে বুঝতে পারছিস না। আবেগ দিয়ে ভাবছিস। কিন্তু বড় হলে বুঝবি, সবসময় আবেগকে প্রশ্রয় দিতে হয় না। এখন তোর থাকতে ইচ্ছে করছে। এটা আবেগ, বাস্তবতা নয়। সুযোগ হলে আবার আসবো এখানে ইন শা আল্লাহ। সবাই মিলে আসবো।’
নাজিফা বললেন, ‘তুই কি বলেছিলি?’
– আমি কিছুই বলিনি। ভাইকে সামনে এগিয়ে যেতে দেখলাম। ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে দেখলাম। মনে মনে বললাম, আবেগ হোক আর যাই হোক! আমি এখানেই থাকবো। তুমি আমাকে এখানেই রেখে দিও আল্লাহ!
নাজিফার দু চোখ বেয়ে দু ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো। আরশের কপালে এক বিন্দু অশ্রু স্পর্শ করলে সে চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকালো। এক হাত দিয়ে মায়ের গাল ছুঁয়ে পৃথিবীর সব থেকে দামি জল হাতে নিয়ে বললো, ‘সেবার মক্কা মদিনায় রাখেননি আল্লাহ। কিন্তু দুআ ঠিক কবুল করেছিলেন। তাই তো ত্রিশ বছর বয়সে এসে ফিরে যাচ্ছি রাসূলের দেশে।’
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)