‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১৩.
তাবিনা মাহনূর

__________

নিশ্চুপ আঁধার নেমে এসেছে ধরণী তলে। এ সময়টা নব দম্পতির জন্য উপভোগ্য। কিন্তু আরশ ও রিশতার জন্য এটা আলোচনার উপযুক্ত সময়। নিস্তব্ধ পরিবেশ, কোনো শোরগোল নেই। বারান্দার দোলনায় বসে দুজন একান্তে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলছে যেন শীতল হাওয়ায় মনের প্রশান্তি মস্তিষ্কের গতি ভালো বাড়িয়ে দেয়।

রিশতাকে লাবিবের বিষয়টা বলার পর সে প্রথমেই বলে উঠলো, ‘সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা! এমনটা হয় কি করে?’

আরশ ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। তার কাছেও ঘটনা ঘোলাটে মনে হচ্ছে। রিশতা বললো, ‘শুনুন, লাবিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।’

– সেটা সম্ভব নয়। লাবিব এখন গা বাঁচিয়ে চলছে। দল থেকে বহিষ্কারের আভাস সে পেয়েছে। সাংবাদিকদের কানে ইতিমধ্যে লাবিবের বিষয়টা চলে গিয়েছে। এখন সব কিছু পুলিশের হাতে, সিআইডি ডিপার্টমেন্টের কাজ শেষ।
– আপনি তো পুলিশ ছিলেন।
– এখন সিআইডি। আমার দায়িত্ব শেষ। আর তাছাড়া আমি কাজের ক্ষেত্রে খুব ফাঁকিবাজি করেছি। আমাকে ওরা বিশ্বাস করবে না।

রিশতা কপাল কুঁচকে বললো, ‘ষড়যন্ত্র, পুরোটাই ষড়যন্ত্র। আফজাল লাবিবকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এতে দলের অন্যান্য লোকজনেরও লাভ আছে নিশ্চয়ই। তাই সম্মিলিতভাবে এই কাজটা চলছে। এখানে লাবিব যতই বলুন না কেন তিনি নির্দোষ, কেউ সেটা মানতে চাইবে না। কারণ তারা খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছে। এখন সব প্রমাণ শুধু ড্রাইভার মকবুল। লোকটাকে টাকা খাইয়ে লাবিবের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে।’

আরশ প্রশ্ন করলো, ‘আপনি এতোটা নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছেন?’

রিশতা কিছুটা জোড় দিয়ে বললো, ‘এটা খুবই সহজ বিষয় ইফতিখার। আপনি পুরো ঘটনা মনে মনে সাজিয়ে নিন। বুঝতে পারবেন কোথায় তারা ভুল করেছে।’

আরশ চোখ বন্ধ করে অনিরুদ্ধর বলা কথাগুলো মনের মাঝে গেঁথে নিলো। কথাগুলো মস্তিষ্কে বারবার প্রতিধ্বনি করছে। সে বলে উঠলো, ‘আফজাল মাদক সেবনে অভ্যস্ত ছিলেন, লাবিব না।’

রিশতা বললো, ‘আরো পয়েন্ট আছে।’

– ড্রাইভার মকবুল লাবিবের পুরোনো বাড়ির কেয়ারটেকার ছিল। এটা না জেনেই আফজাল কেন তাকে নিজের ড্রাইভার বানিয়ে ফেলবেন? কোনো খোঁজ খবর ছাড়াই?

রিশতা উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘একদম! এটাই বলতে চাইছি। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কীভাবে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই শুধুমাত্র নেশাদ্রব্য পেতে একটা ড্রাইভার রেখে দিবেন? যেখানে উনি নাকি পনেরো বছর ধরে রাজনীতিতে আছেন!’

চোখ খুললো আরশ। রিশতার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভুবনের ফোন। এটা কেন লুকানো হয়েছে? নিশ্চয়ই এতে প্রমাণ আছে?’

– ঠিক বলেছেন। আর ভুবন কেন নিজের ফোন বাদ দিয়ে কবরস্থানের ল্যান্ডফোন দিয়ে আতিকের সাথে শেষ যোগাযোগ করেছিলেন? সবটা ধোঁয়াশা।

আরশ দোলনায় বসে থাকতে পারছে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার এ প্রান্ত, ও প্রান্ত পায়চারি শুরু করলো। রিশতাও উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘সজলকে কেন জেলে দেয়া হয়েছে?’

আরশ বারান্দার প্রাচীর ধরে দাঁড়ালো। রিশতার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জানি না। কার্তিক স্যার বললেন সজল নাকি নিজেই বলেছে সে আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে না।’

– আপনি যেভাবেই হোক সজলকে রিমান্ডে নিন।
– এটা আমিও ভেবেছি রিশতা। সজলের সাথে আমি আজকেও কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু লাবিবের ঘটনা সব উল্টে দিলো।
– আর কোনো কথা নয় ওদের সাথে। এই কার্তিক, জাহাঙ্গীর আর অনিরুদ্ধ আপনাকে বোকা বানাতে চাইছে আপনি সৎ বলে। এরা সবাই জানে। আফজালের কাছ থেকে এরা টাকা খেয়েছে।

আরশকে রিশতার বলা শেষ কথাটা খুব ভাবালো। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘যা করার আমি একাই করবো। সবটা ওদের অগোচরে ইন শা আল্লাহ।’

রিশতা বললো, ‘কিন্তু সজলের সাথে দেখা করতে হলে আপনাকে ওদের অনুমতি নিতে হবে। ওরা তো সব জেনে যাবে তখন?’

– না। রাজীব ভাই আছেন। উনিই পারবেন আমাকে সাহায্য করতে। আমি উনাকে খুব অনুরোধ করবো যেন এ ব্যাপারটা কাউকে না জানানো হয়।
– জানাজানি হলে চাকরিটা হয়তো…
– না থাকবে চাকরি। শুরুতেই আমাকে বোকা বানানোর কৌশল! আমিই এবার ওদের বোকা বানিয়ে ছাড়বো।

আরশ অপমান হজম করতে পারছে না। তার মাঝে বিশাল ক্রোধ তৈরি হয়েছে। এখনই সে রাজীবের সাথে কথা বলতো, কিন্তু রাত অনেক হয়েছে। রিশতা তাকে থামিয়ে বললো, ‘থাক। উনি হয়তো ঘুমাচ্ছেন। আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল ঠান্ডা মাথায় কাজ করবেন ইন শা আল্লাহ।’

ঘুম ভালো হলো আরশের। রিশতা আদুরে হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। আরশ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো। মন যখন ঘুম রাজ্যে প্রবেশ করবে, তখন সে কপালে কোমল উষ্ণ পরশ টের পেলো।

_____

পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আরশ বহুদিন পর এসেছে। রাশেদ এখনো আসেননি। রাজীবকে দেখে সে মুচকি হেসে সালাম দিলো। রাজীব তার সালাম গ্রহণ করে তাকে আপ্যায়ন করলো। আরশ হেসে বললো, ‘ভাই, আমি কি এখানে নতুন?’

– নতুন না হও, তোমার মত ছেলেকে প্রতিদিন অতিথির মতো আপ্যায়ন করা উচিত। এই বিভাগে সৎ ছেলে পাওয়াই মুশকিল।

এমন বেশ কিছু আন্তরিক আলাপের পর আরশ তার আর্জি পেশ করলো। রাজীব তা শুনেই বলে উঠলো, ‘মনে হয় পারবে না। রাশেদ স্যারের অনুমতি ছাড়া দেখা করা নিষেধ।’

– অনুমতি ম্যানেজ করে দেন না ভাই?
– আরশ, তুমি হঠাৎ সজলের সাথে দেখা করতে চাইছো যে?
– আমার খুব দরকার ভাই। সজল যদি কোনো তথ্য দিতে পারে তাহলে ঘটনার মোড় উল্টে যাবে।
– কিন্তু লাবিব সাহেব যে দোষী, এটা এখন সবাই জানে। আর কি বদলাবে বলো?

আরশ যতটা সম্ভব তার ধারণা গোপন রেখে রাজীবকে বোঝালো লাবিবকে ফাঁসানো হচ্ছে বলে মনে হয় তার। রাজীবও তাতে সম্মতি পোষণ করে বললো, ‘আমি স্যারকে জানাবো বিষয়টা।’

রাশেদ এসে পৌঁছানোর পরপরই রাজীব তার কেবিনে গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে আরশকে ঢোকার অনুমতি দেয়া হলো। আরশ ভেতরে ঢুকে সালাম দিলে রাশেদ উত্তর করলেন না। বেশ গম্ভীর হয়ে ইশারায় বসতে বললেন। তারপর বললেন, ‘তোমাকে নিয়ে আমি অনেক আশা করেছিলাম। কিন্তু তুমি এতোটাই বাজে পারফরম্যান্স দেখিয়েছো যে তারা তোমাকে সিআইডি ডিপার্টমেন্টে আর দেখতে চাইছে না।’

আরশ এই অপমান আপাতত হজম করে নিলো। রাশেদ আরো কিছু তিরস্কারের পর আসল ঘটনা জানতে চাইলেন। আরশ বললো, ‘আমার মনে হয় এখানে কোনো সমস্যা আছে স্যার।’

রাশেদ ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘ঠিক বলেছো আরশ। আমিও সন্দেহ করেছি এ বিষয়ে। ওরা আমাকে ঠিকঠাক কোনো তথ্যই দিচ্ছে না। পুলিশ হিসেবে যা দায়িত্ব তা পালন করছি শুধু। লাবিব সাহেবের বাসায় আজ বাদে কাল পুলিশ যাবে।’

আরশ রাজীবকে যা বলেছে তা সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললে রাশেদ মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আরশ, তুমি যা করতে চাইছো করো। কিন্তু অতি গোপনে। আজ তো দেখা করতে পারবে না, কারণ আজ কার্তিক আসবেন আমার এখানে। তুমি বরং কাল যাও।’

রাশেদ এতো সহজে মেনে নিবেন তা ভাবতেই পারেনি আরশ। সে আল্লাহর কাছে মন ভরে দুআ করেছিল যেন সজলের সাথে দেখা করা যায় কোনো উপায়ে। রাশেদের পরবর্তী কথাতেই আরশ বুঝতে পারলো মূল কারণ কি।

– ওরা শুধু তোমার নামে আমাকে বিচার দিয়েছে যে তুমি নাকি কোনো কাজই মনোযোগ দিয়ে করোনি। কার্তিক বলেছে এরপর তোমাকে সিআইডি ডিপার্টমেন্টে পাঠালে যেন তার সাথে কাজ না দিই। আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমার পক্ষ থেকে গিয়েছো বলেই ওদের রাগ। আমাকে ওরা আলাদা করে দেখছে। ফল ভালো হবে না।

_____

বাসায় ফিরে দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে আরশ সজলকে কি কি প্রশ্ন করবে তার একটা ছক তৈরি করে ফেললো। রিশতা আজ খুব ব্যস্ত। ফাতিহা দুপুর বেলায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। প্রেগনেন্সি কীট থেকে উত্তর পজিটিভ এসেছে। তাই আমান অফিস থেকে ফিরেই স্ত্রীকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে নিয়ে গিয়েছে। নাজিফা খুব খুশি। ঘরে দুটো নতুন বাবু আসতে চলেছে।

আমানের ছোট ছেলে মুয়াজের বয়স দুই বছর। মাকে না পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছিল। নাজিফার কাছেও তার শান্তি মিলেনি। নাজিফার কোমর ব্যথা বলে তিনি বেশিক্ষণ হাঁটতে পারেন না। মুয়াজকে কোলে নিয়ে না হাঁটলে সে ঘুমোতে চায় না। এই দায়িত্ব তাই রিশতার কাঁধে পড়েছে। মুসআবের বয়স সাত বছর হওয়ায় তাকে খেলতে দিয়ে মায়ের অভাবটা বুঝতে দেয়া হয়নি। কিন্তু মুয়াজ তো এসব মানবে না।

তাই আরশের সামনে কোলে মুয়াজকে নিয়ে ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছে রিশতা। আরশ কাজে ব্যস্ত, আর সে ঘুম পাড়ানোয় ব্যস্ত। মুয়াজের মাথা রিশতার কাঁধে। আরশকে একবার ডেকে রিশতা বললো, ‘দেখেন তো ঘুমিয়েছে কিনা?’

গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে মুয়াজ। আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘দুষ্টুটা তাকিয়ে আছে।’
রিশতা হতাশ হওয়ার বদলে হেসে ফেললো। হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘আধা ঘণ্টা ধরে হাঁটছি। তবু ঘুমায় না। খুবই দুষ্টু দেখছি।’

ঝলমলে হাসি হাসলো মুয়াজ, যেন সে সবই বুঝেছে। রিশতা আর হাঁটতে পারলো না। বাবুকে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। মুয়াজের কাছে হাতে থাকা খেলনা দিলে মুয়াজ কোলের মাঝে খেলতে শুরু করলো। তা দেখে আরশ উঠে আসলো। মুয়াজকে কোলে নিয়ে বললো, ‘অন্য সময় কান ফাটানো চিৎকার করতো। আজ চুপচাপ খেলছে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ কত সহজ করে দেন সবকিছু।’

তার দিকে রিশতা তাকালে সে বললো, ‘আমি দুআ করছিলাম যেন বাবু ঘুমিয়ে যায়। আপনার পায়ে ব্যথা করছে বুঝতে পারছিলাম। বাবু ঘুমিয়ে না গেলেও শান্ত হয়ে আছে আলহামদুলিল্লাহ।’

রিশতা হেসে আরশের বাহুতে গাল ঠেকালো। সে একমনে বাবুর খেলা দেখছে। আরশ তা খেয়াল করে বললো, ‘আপনি ছেলে বাবু পছন্দ করেন?’

– হঠাৎ এ প্রশ্ন?
– সেদিন মেয়ে বাবুর কথা বলায় আপনি না বলেছিলেন।

রিশতা আরশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি সুস্থ সন্তান চাই। সেটা মেয়ে কিংবা ছেলে যা-ই হোক। এজন্যই বলেছিলাম মেয়ে না, সন্তান। আপনি ছেলে বললেও একই কথা বলতাম।’

আরশ মুচকি হাসলো। রিশতা সোজা হয়ে বসে বললো, ‘কিন্তু রাশেদ স্যার এতো সহজে মেনে নিলেন কীভাবে? তাও আবার গোপনে কাজ করতে সাহায্য করছেন তিনি!’

আরশ বাঁকা হাসলো। তার দুষ্টু হাসি দেখে রিশতা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘এভাবে হাসছেন কেন?’

– আপনি বুঝতে পারেননি রিশতা? রাশেদ স্যারকে কার্তিক স্যার নিজেদের ভাগে বসাতে চায় না। তাহলে যে টাকার পরিমাণ কমে আসবে।
– মানে?
– মানে কার্তিক, জাহাঙ্গীর আর অনিরুদ্ধ আফজালের কাছ থেকে টাকা খেয়েছে। এটা আমাদের অনুমান। আর এটা রাশেদ স্যারও অনুমান করেছেন। তাই তিনি তার অনুমান সত্য হয় কিনা যাচাই করবেন।
– সত্য হলে?
– সত্য হলে তিনিও ভাগ বসাবেন।

আরশের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো রিশতা। কিছুক্ষণ পর সে বললো, ‘মানুষ কত ধুর্ত হতে পারে! একজন আরেকজনকে একটুও ছাড় দেয় না। তাও আবার অসৎ কাজে!’

রিশতার বোকা বোকা চেহারা দেখে আরশ অন্যমনষ্ক হয়ে পড়লো। এক হাত দিয়ে তার গাল টেনে সে বললো, ‘সবাই কি তোমার মতো গোলগাল বোকা নাকি?’

_____

(ইন শা আল্লাহ চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here