‘সত্যপিঞ্জর’
পর্ব ১৭.
তাবিনা মাহনূর

__________

ফজরের সালাতের সময় হয়েছে। রিশতা মধ্যরাতের শেষ অংশে মন ভরে দুআ করলো। পুরো ঘরের শূন্যতার চেয়ে তার মনের শূন্যতা সে গভীরভাবে অনুভব করে। আজ দ্বিতীয় ফজর পড়তে হলো আরশকে ছাড়াই। একদিন পূর্ণ না হলে থানায় নিখোঁজ হওয়ার জিডি করা যাবে না। রিশতার অবশ্য জিডি করার কোনো ইচ্ছে নেই। কাদের কাছে সে সাহায্য চাইবে? যারা নিজেরাই এই ভয়াবহ ফাঁদ পেতেছিল?

সালাত আদায় শেষে সে আনিকার ঘরে গেল। আনিকা অনেক অভিমান করেছে। ভাই তার সাথে দেখা না করেই চলে গিয়েছে, আর ফিরে আসেনি। এটা সে মেনে নিতে পারছে না। রিশতা দরজায় টোকা দিলে আনিকা অশ্রু ভেজা চোখে দরজা খুললো।

আরশ যাওয়ার পর রিশতা এক মুহূর্তের জন্য কাঁদেনি। শুধুমাত্র সালাত আদায় করতে গিয়েই তার চোখ ভরে ওঠে। আল্লাহর কাছে নিজের মনের কথাগুলো গুনগুন করে ব্যক্ত করার পর আবারো পাথর মানবী রূপে তার যান্ত্রিক জীবন চলে। কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করে না। তাকে নিয়ে চিন্তা করে না। এমনকি, রিশতা যে না খেয়ে আছে সেটাও কারো চিন্তার মাঝে নেই।

আনিকা বিছানায় বসে চোখ মুছে বললো, ‘কিছু বলবে রিশতা?’

রিশতার অনুভূতিহীন উত্তর, ‘না।’

আনিকা বুঝতে পারলো, রিশতা একাকী থাকতে চায় না। কারো সঙ্গ প্রয়োজন তার। আনিকা তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললো, ‘আজ আমি চুপ করে থাকবো, তুমি গল্প বলবে। কিন্তু মন খারাপের গল্প শুনবো না।’

রিশতা আনিকার দিকে তাকালে আনিকা দেখতে পেলো নিস্তেজ দুটো চোখ। যেখানে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে, কিন্তু ভাবনারা পলক ফেলতে দেয় না। রিশতা মৃদু স্বরে বললো, ‘মন ভালোর গল্প জানা নেই যে আপু।’

আনিকার চোখ ভিজে আসছে। কিন্তু রিশতার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা তার চেয়েও খারাপ হওয়ায় সে কিছুক্ষণের জন্য রিশতাকে দুঃসময়টা ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। সে বললো, ‘আমার ভাই তোমার কাছে কতখানি?’

রিশতা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘যতখানি আল্লাহ উনার জন্য আমার হৃদয়ে জায়গা করে দিয়েছেন।’

– একটা প্রশ্ন করি?
– হুম।
– আরশের জন্য তোমার অনুভূতি জন্মেছে কীভাবে?

রিশতা খেয়ালি মনে তার মানসপটে আঁকা গল্পটা বললো। কথার পুতুলের মতো শুধু বলেই গেল, কোনো অভিব্যক্তি নেই।

– আমি সবসময়ই নিজেকে আশ্রয়হীন ভাবতাম। পড়াশোনাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম কেননা ঐটুকু সময়ে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে থাকতে পারতাম। যখন পড়াশোনা থাকতো না, তখন উপন্যাস পড়তাম, ছবি আঁকতাম। কিন্তু একটা সময় আসতো যখন খুব অসহায় লাগতো নিজেকে। মনে হতো, চাচা চাচী বের করে দিলে আমার যাওয়ার জায়গা কোথায়?

একটু থেমে রিশতা আবার বললো, ‘রুদ্রর সাথে পরিচয় হওয়ার পর নিজেকে স্বাধীন ও বোঝাহীন মনে হতো। কারণ রুদ্রর হৃদয়ের একটা অংশ জুড়ে আমি ছিলাম। তবু সে কখনো আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতো না। এতে খুব শান্তি পেতাম। চলবো নিজের মতো মুক্তভাবে, থাকবো অন্যের উপর আস্থা রেখে- বিষয়টা কপটতা হলেও আমার মাঝে তখন এই ধারণাটা গভীরভাবে ঢুকে গিয়েছিল। তাই রুদ্র আমার আড়ালে কি কি করছে সেগুলো আমার ভাবনায় আসেনি কখনোই। স্বাধীনতা নামক ফাঁদে পড়ে আমি আবার আশ্রয়হীন হয়ে গেলাম।’

আনিকা বললো, ‘জানো? প্রতিবেশীরা তোমার জন্য কষ্ট পেতো। তারা সবাই জানতো রুদ্র ভালো ছেলে না। এজন্য তোমাকে দেখে সবার মায়া লাগতো।’

– রুদ্র ভালো না হলেও অসুবিধা ছিল না। কারণ আমি জানতাম সে সুদ নেয়, নেশা করে। কিন্তু অসুবিধা হলো অন্য মেয়ের আবির্ভাবে। মনে হলো, আমার আশ্রয় হারিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ইচ্ছেয় রুদ্র চলে গেল চিরতরে। এরপর আমি আজমেরী আন্টিকে আঁকড়ে ধরলাম। আন্টির সাথে আমার পরিচয় বিয়ের আগ থেকেই। উনি খুব আন্তরিক, আর হাসিমুখে কথা বলতেন। উনি আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। কিন্তু রুদ্রর মতো স্বভাব উনারও আছে জানার পর সব বিশ্বাস ভেঙে গেল। রুদ্রর বাবাও চলে গেলেন। আশ্রয় খুঁজতে শুরু করলাম আবারও। আল্লাহর দয়ায় পেয়ে গেলাম। কিন্তু, আশ্রয় যে কোনো একদিন ভালোবাসায় রূপ পাবে, তা কে জানতো?

আনিকা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। রিশতার কথাগুলো তাকে অনুভব করাচ্ছে রিশতার মনের অবস্থাটা।

– রুদ্রকে আমি ভালোবাসতাম না। এ কথা কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, আমার আল্লাহ জানেন। রুদ্রর মৃত্যুর পর আমি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলাম কোথায় যাবো এই ভেবে। তারপর এতটুকু বিচলিত হইনি আজমেরী আন্টি আছেন বলে। কিন্তু একে একে সবাই যখন দূরে সরে যাচ্ছিলো, তখন আমার মনে ভয় হতে শুরু করলো। আমি বিধবা, এতিম, সন্তানহীন। কীভাবে চলবো একা? তাই সাত পাঁচ না ভেবে দ্বীনদার ছেলে পেয়ে বিয়ে করে ফেললাম। ততদিনে আমার মাঝেও দ্বীনের জ্ঞান কিছুটা এসেছে।

আনিকা প্রশ্ন করলো, ‘আশ্রয় আর ভালোবাসা তো এক নয় রিশতা।’

রিশতা এখনো আনমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ঊষার ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সে বলে উঠলো, ‘ঠিক এমনভাবে আমার সুপ্ত ভালোবাসা জাগ্রত হয়েছিল দিনের আলোর মতো।’

আনিকা ভোরের দেখা পেতে জানালার কাছে দাঁড়ালো। রিশতা বললো, ‘তুমি ঠিক বলেছো আপু। রুদ্রকে আমি আশ্রয় ভাবতাম। ভালোবাসা নয়। আজ আমি যেই রিশতায় পরিণত হয়েছি, সেই রিশতার চিন্তাধারা অনেক ভিন্ন। এই রিশতা বোঝে আশ্রয় কাকে বলে। যে আল্লাহর আশ্রয় পেলো না সে কিসের আশ্রয়ে নির্ভর করে?’

আনিকা বললো, ‘সত্যিই, আল্লাহর আশ্রয় না থাকার অর্থ ধ্বংস!’

– আমার আশ্রয়, আমার আল্লাহ হলেন চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর সত্তা। তাই আমার কোনো ভয় হয় না। আমি এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা চলতে পারবো শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। কিন্তু মানবপ্রেম বলে যেই সত্তা আছে, যেই সত্তার অস্তিত্ব নেই আকার নেই, সেই সত্তা আমাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমার প্রেম আমার কাছে নেই।

রিশতা নিজের মাঝে নেই। অকপটে মনের কথাগুলো সে আনিকাকে বলছে, এই চেতনা তার নেই। আনিকা শুনছে তার সামনে বসে থাকা পাথর মানবীর গল্প।

– রবের প্রতি যেই ভালোবাসা, সেটার কোনো তুলনা নেই। সুতরাং সব ভালোবাসা ফিকে হলেও, এই ভালোবাসায় খাদ পরে না। পরলেই তা হবে ধ্বংসের সূত্র। রব অতুলনীয় তাই এই ভালোবাসাও অতুলনীয়। মানবপ্রেম এর সাথে তুলনা করা যায় না। মানবপ্রেম সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এখানে মনের আদান প্রদান ঘটে, স্পর্শের ভাষা শেখা যায় আর অনুভূতির সাগরে ডুব দেয়া যায়। আমি এই প্রেম শিখেছি ইফতিখারের কাছ থেকে। তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ।

আনিকা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ইফতিখার?’
পরক্ষণেই সে বলে উঠলো, ‘ওহ! আরশের আরেক নাম এটা। কেউ ডাকে না বলে মনেও নেই।’

আনিকার উচ্চস্বর শুনে এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেলো রিশতা। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপু, আপনার ঘুমের প্রয়োজন।’

আনিকা বুঝতে পারলো রিশতা আর কিছু বলতে চাইছে না। সে বলে উঠলো, ‘সমস্যা নেই। আমার ভালোই লেগেছে। তুমি বিশ্রাম নাও। ক্লান্ত হয়ে পড়েছো।’

_____

আলো শূন্য ঘরে চেয়ারে বাধা অবস্থায় আরশ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। তার জ্ঞান ফিরছে একটু একটু করে। চোখ দুটো খুলে সে অন্ধকার হাতড়ে আলোর উৎস খুঁজতে চাইলো। জানালার ওপর ভারী পর্দা থাকায় বাড়ির পেছনে জ্বলতে থাকা বাতির আলো খুব বেশি ভেতরে ঢুকছে না। পর্দার ফাঁক গলে সরু আলো আসছে। তাতেই সে দেখতে পেল, তার পাশে তারই মতো বাঁধা অবস্থায় কেউ চেয়ারে পরে আছে। তার মাথা উঁচু করতে দেখে পাশে থাকা লোকটা বললো, ‘আরশ!’

রাশেদ স্যারের কন্ঠ শুনে ভ্রু কুঁচকে পাশ ফিরে তাকালো আরশ। স্যারের অবস্থা তার চেয়েও করুণ। দেখে বোঝাই যাচ্ছে কয়েকটা দিন কোনো খাবার পেট ভরে খাননি তিনি। রাশেদ বললেন, ‘ক্ষমা করে দিও।’

আরশ অপলক তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আপনি ইচ্ছে করেই আমাকে এখানে আসতে বলেছেন।’

– এটা ওদের আদেশ ছিল।
– ফোর্স নিয়ে আসতে বললেন কেন?
– যেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। একা আসতে বললে আসতে না।
– আসতাম। কারণ আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ সময় কাটলো। রাশেদ বললেন, ‘সত্যিই আরশ, আমি তোমাকে এখানে কখনোই ডাকতাম না। আমি মরে গেলেও না। কিন্তু… আমার মেয়েটাকে ওরা ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছে। শুধু আমার মেয়ে না, স্ত্রীকেও ছাড়বে না বলেছে।’

আরশ কিছু বললো না। সে অপেক্ষা করছে মাস্টারমাইন্ড কখন আসবে। যার পরিকল্পনা এতো সূক্ষ্ম।

রাশেদ বললেন, ‘তাই আমাকে বাধ্য হয়ে তোমায় এখানে ডাকতে হলো।’

আরশ প্রশ্ন করলো, ‘আমি আসার পর তারা আপনার কোনো ক্ষতি করবে না, এমন নিশ্চয়তা কীভাবে পেলেন?’

– নিশ্চয়তা ছাড়া আমি কোনো কাজ করি না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে আজ ভোরে দুবাই চলে যাচ্ছে। আমাকে ওরা ছেড়ে দিলে আমিও চলে যাবো।
– আর আপনার চাকরি?
– নেই।

আবার নিস্তব্ধতা। রাশেদ মলিন দৃষ্টিতে আরশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটার মতো সৎ উনার জীবনে দ্বিতীয়টা দেখেননি। দেখবেন কি করে? সারাজীবন অসৎ লোকদের সাথে কাটিয়ে দিলেন। নিজেকেও অন্যায় থেকে হেফাজত করতে পারলেন না। আবার একজন ভালো মানের মানুষকে বিপদে ডেকে আনলেন। তার মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপের প্রকাশ ঘটলো তার ভেজা কন্ঠ দ্বারা।

– আরশ, আমাকে স্বার্থপর ভেবো না।

আরশ ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘এমন পরিস্থিতিতে আপনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো একই কাজ করতাম।’
– তুমি করতে না।
– আল্লাহই ভালো জানেন।
– আল্লাহ কেন তোমার মত ভালো মানুষকে কষ্ট দিচ্ছেন?

আরশ রাশেদের দিকে তাকালো। মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘আল্লাহ কখনোই কাউকে কষ্ট দেন না। তিনি পরীক্ষা করেন। ধৈর্যের পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় যে উত্তীর্ণ হয়, তার প্রতিদান অনেক বড়।’

রাশেদ হতাশ হয়ে বললেন, ‘সবাই যদি তোমার মত ভাবতো! সবাই যদি তোমার মতো রাসূলের দেখানো পথকে আঁকড়ে ধরতো, তাহলে জীবন কতই না সুন্দর হতো!’

চোখ দুটো বন্ধ করে আরশ বললো, ‘প্রত্যেক মানুষের ভেতরে একটা করে খাঁচা আছে। সেই খাঁচার নাম সত্য পিঞ্জর।’

রাশেদ আরশের দিকে তাকালেন। দৃষ্টিতে তার কৌতুহল।

– এই পিঞ্জর কেউ খুলে রেখেছেন, কেউ বন্ধ। কেউ আবার মাঝে মাঝে খোলেন, মাঝে মাঝে বন্ধ করেন। সত্য পিঞ্জরে আবদ্ধ আছে আমাদের সকল অনুভূতি। আমরা যদি সত্যকে নিয়ে বাঁচতে চাই, তাহলে সেই খাঁচা খুলে রাখতে হবে। বন্ধ করলেই মিথ্যেরা খাঁচার বাইরে শিকলের বলয় তৈরি করবে। তখন চাইলেও সেই খাঁচা খোলা সম্ভব হবে না।
– আমার পিঞ্জর কেমন?

রাশেদের প্রশ্নে উত্তর দিলো আরশ, ‘আপনার পিঞ্জর বন্ধ। সেটা আপনি খুব খুলতে চাইছেন, কিন্তু মিথ্যের শিকল আপনাকে খুলতে দিচ্ছে না। তবে, ভবিষ্যতে আপনি যদি শিকলে মরিচা ধরিয়ে সত্য উন্মুক্ত করতে চান, তবে আপনাকে দ্বীন আঁকড়ে ধরতে হবে নতুন করে।’

– আর আফজালের পিঞ্জর?
– সেই পিঞ্জর সবসময়ই বন্ধ। ওটা এমনভাবে বন্ধ যে মিথ্যের বলয়ের কোনো প্রয়োজনই নেই। সিলমোহর মেরে দেয়া।
– সেটা কখনোই খুলবে না?

মুচকি হাসলো আরশ, ‘আপনি এ প্রশ্ন কেন করছেন আমি বুঝেছি। আপনার ধারণা, আফজালের মনে যদি একবার সত্য উড়াল দেয়, তাহলে হয়তো আমি ছাড়া পেয়ে যাবো।’

চুপ করে আছেন রাশেদ। আরশ বললো, ‘এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। আল্লাহ আমাকে মনের খবর পড়ার ক্ষমতা দেননি। এই বৈশিষ্ট্য একান্তই তাঁর। মানুষ শুধু অনুমান করতে পারে যেটা অন্যরা প্রকাশ করে তার উপর ভিত্তি করে।’

রাশেদ বললেন, ‘তোমার পিঞ্জর?’

– আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় খোলা ছিল। আল্লাহর সহায়তায় যেন আজীবন খোলা থাকে। এই দুআ করি।
– আমিন।

রাশেদ অনেক্ষন পর বললেন, ‘আমি খারাপ মানুষ। আমি মরলে সরাসরি জাহান্নাম পাবো। তুমি ভালো মানুষ, কোনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করোনি। তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে তুমি জান্নাত পেতে পারো।’

– জান্নাত জাহান্নাম মানুষ নির্ধারণ করতে পারে না।
– তারপরও, ঐযে তুমি বললে অনুমান। অনুমানের উপর ভিত্তি করে বলছি। আমি চাকরি ছেড়ে একবারে বিদেশ চলে যাবো। দুবাইয়ে আমার মোটামুটি চলার মতো সম্পত্তি আছে আলহামদুলিল্লাহ। জীবন না গেলে, এটাই সুযোগ নিজেকে পরিবর্তন করার।
– এই সুযোগ সত্যিই কাজে লাগাবেন তো স্যার?

সেসময় দরজা খোলার আওয়াজ এলো। ভেতরে কেউ ঢুকছে। ঢুকতে ঢুকতেই লোকটা বললো, ‘তোর বউ বাচ্চা বিদেশ গেছে। তুই বাকি। তোরে ছাইড়া দিতেছি।’

কন্ঠ শুনেই চিনতে পারলো আরশ। তারিক ঢুকছে। তার পিছে জাহাঙ্গীর আর অনিরুদ্ধ। তারিক ঢুকেই রাশেদের পায়ের উপর তার জুতোসহ পা তুলে বললো, ‘আমাদের ভোগান্তি ভালোই পোহাইছিস বুইড়া। তোরে ছাইড়া দিতেছি শুধুমাত্র বসের কথায়। কবে নাকি তুই স্যারের গোপন কথা লুকাইয়া রাখছিলি বিনা টাকায়! আচ্ছা সব বাদ। ওই লিটন, বাঁধন খুইলা দে।’

লিটন নামের একজন অল্প বয়স্ক ছেলে রাশেদের বাঁধন খুলে দিলো। রাশেদ দাঁড়াতে পারছেন না। খুব কষ্টে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কীভাবে যাবো?’

তারিক জাহাঙ্গীরের দিকে তাকালে জাহাঙ্গীর বললো, ‘আমার সাথে যাবেন। আপনার আর আরশের নিখোঁজ হওয়ার খবর এখনও মিডিয়ার মানুষ জানে না। তাই আপনাকে খুব গোপনে নিয়ে যেতে হবে। কথাটা যেন কারো কানে না পৌঁছায়।’

– পৌঁছাবে না।

রাশেদের হাত ধরে জাহাঙ্গীর এগিয়ে চলছে। একবার তিনি পেছন ফিরে তাকালেন। আরশ মুচকি হাসলো। রাশেদ হাসার চেষ্টা করেও পারলেন না। চোখ ভরে কান্না বেরিয়ে এলো তার। তিনি মুখ নিচু করে হাঁটার কারণে সেই কান্না দেখতে পেলো না কেউই।

রাশেদ চলে যেতে না যেতেই বড় আঘাতের শিকার হলো আরশ। মুখ বরাবর পা দিয়ে আঘাত করায় চেয়ার সহ পরে গেল সে।

– তারিক, এভাবে এখনই আঘাত করো না। আগে ওর মুখ থেকে তথ্য বের করতে হবে।

অনিরুদ্ধর বারণ শুনেও তারিকের ক্ষোভ কমে না। হাত কচলে বলে উঠলো সে, ‘মেরেই ফেলতাম। কি করেনি শালা! সুন্দরী বউ, বসের সম্মান নষ্ট, মাদক মামলায় ফাঁসানো, সব কিছুর মূলে এই শালা!’

অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেও শান্ত হচ্ছে না তারিক। মূলত তার রাগটা কি নিয়ে অনিরুদ্ধ ভালোভাবেই জানে। সে তারিকের কাঁধ চেপে বললো, ‘আপাতত রাগ নিয়ন্ত্রণে আনো। আগে ওকে কয়েকটা প্রশ্ন করে নিই। নিস্তেজ হয়ে গেলে কথা বের করতে কষ্ট হবে। উত্তর না দিলে ঝাল ঝেরে খায়েশ মিটিও।’

অনিরুদ্ধ চেয়ার সোজা করলো। আরশের মাথা ঝিমঝিম করছে। মাথার ডান দিকে বেশ আঘাত পেয়েছে সে যদিও রক্ত বের হচ্ছে না। তবে ছিটকে পড়ে যাওয়ায় তার গালের সাথে মাটির ঘর্ষণে গালের চামড়া ছিলে গিয়েছে। জায়গাটা খুব জ্বলছে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে চোখটা নষ্ট হয়নি বলে। বাংলোর মেঝে কাঠের তৈরি। সেখানে পেরেক দিয়ে কাঠগুলো লাগিয়ে রাখা। কোনো পেরেকের সাথে চোখ লেগে গেলেই অন্ধ হয়ে যেতো সে।

অনিরুদ্ধ আরশের সামনে আরেকটা চেয়ারে বসলো। তার পাশে তারিক বসলো। অনিরুদ্ধ স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘কাগজ কোথায়?’

সরাসরি কাজের প্রশ্নে চলে গিয়েছে সে। কোনো রকম দেরি করার সময় এখন নেই। আরশকে চুপ থাকতে দেখে অনিরুদ্ধ বলে উঠলো, ‘দেখো আরশ, তুমি যত দ্রুত মুখ খুলবে, ততই তোমার জন্য মঙ্গল। ব্যথা কম পাবে, পরিবার দেখতে পাবে।’

সহজেই মিথ্যে বলে দিলো অনিরুদ্ধ। আরশ স্বীকার করলেই তাকে প্রচন্ড যন্ত্রণার মাধ্যমে মেরে ফেলা হবে। আফজাল, মনিরুজ্জামান, কার্তিক, অনিরুদ্ধ সহ অনেকের ক্ষোভ আগুনের মতো ঝলসে দিতে চায় আরশকে। তাই তাকে ছেড়ে দেয়া কখনোই সম্ভব নয়। এছাড়া আরো একটা কারণ আছে যা খুবই নিকৃষ্ট।

আরশ তবু চুপ করে থাকলো। তারিক বললো, ‘এই ব্যাটা মুখ খুলবে না অনি ভাই। ওর মুখ থুবড়ে বের করতে হবে।’

– আরশ, আমি আবার বলছি। তাড়াতাড়ি সব বলে দাও তাহলে ছাড়া পেয়ে যাবে। প্রমাণগুলো কোথায় আছে?

আরশ মাথা উঁচু করে বললো, ‘বলবো না।’

গম্ভীর কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করলো অনিরুদ্ধ, ‘আরশ! জলদি বলো সব কোথায়?’
আরশের একই উত্তর, ‘বলবো না।’

সাথে সাথে তার মুখ বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিলো অনিরুদ্ধ। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে। আরশের মুখ শক্ত করে চেপে ধরে বললো, ‘তোর মুখ ছিঁড়ে ফেলবো বেয়াদব! প্রচুর ভুগিয়েছিস। বল জলদি!’

আরশ অতি কষ্টে উচ্চারণ করলো, ‘না!’

আবার আরশকে ছিটকে নীচে ফেলে দিলো অনিরুদ্ধ। তারিক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘অনি ভাই, বলছি না? এই ব্যাটা সহজে মুখ খুলবে না। প্রথম থেকেই মারা উচিত ছিল।’

অনিরুদ্ধ শীতের মাঝেও ঘেমে গিয়েছে অতিরিক্ত রাগের কারণে। বড় এক শ্বাস নিয়ে সে বললো, ‘মারো। মারতে মারতে হাড় ভেঙে ফেলো। যতক্ষণ না সত্যিটা বলবে, ততক্ষণ মারো।’

তারিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পা দিয়ে আরশকে অনবরত আঘাত করতে থাকলো সে। আরশ ঠোঁট চেপে সহ্য করছে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে। এক পর্যায়ে আরশের মাথার পেছন দিকে আঘাত করলে সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো, ‘ইয়া আল্লাহ!’
জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে।

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here