#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#১৮তম_পর্ব
তখন ই একটা মেইল আসে শান্তের মোবাইলে। মেইলের নোটিফিকেশন সাউন্ড আসলে নবনীতার চোখ যায় মোবাইলে। মেইলটির উপরে লেখা “নবনীতা”। অন্যের মেইল চেক করাটা নিতান্ত অভদ্রতা। নবনীতার সেটা বেশ ভালো করেই জানা আছে। তবুও কৌতুহল দমাতে পারছে না। কারণ মেইলটিতে তার নাম লেখা। তার নামে কে মেইল পাঠাতে পারে, শান্তের মোবাইলে। নবনীতা একবার পেছনে তাকালো, শান্ত কাজে ঢুবে আছে। তার চোখ এখনো ল্যাপটপে। শান্তকে না বলে চোরের মতো কাজটা করাটা কি ঠিক হবে? তার পারমিশন বাদে মেইলটা ওপেন করাটা কি ঠিক হবে? দ্বিধায় কিছুক্ষণ নিজেকে প্রশ্ন করেছে নবনীতা। মস্তিষ্ক বলছে,
“ওপেন করো। এখানে তোমার নাম লেখা। মেইলটা তোমার সাথে জড়িত।“
কিন্তু মন বলছে,
“এটা ভালো হবে না, শান্ত কি ভাববে?”
অনেক দ্বিধা দ্বন্দ, তর্ক বিতর্কের পর অবশেষে মেইলটা ওপেন করলো নবনীতা। মেইল ওপেন করতেই মাথা ঘুরে যাবার যোগাড় তার। বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপ, এবং সাথে একটা নোট ও রয়েছে। মেইলটি আবিদ পাঠিয়েছে। নোটটিতে লেখা,
“স্যার,
খুব কষ্টে এই ভিডিওগুলো ম্যানেজ করেছি স্যার। সেদিন মলের থেকে এখন অবধী নবনীতা ম্যাডামকে যেখানে যেখানে দেখা গিয়েছিলো এবং তার আশেপাশে কে কে ছিলো যখন ডিটেইলস এই ভিডিও তে আছে। আমি একজন স্পাই ফিট করেছিলাম, ম্যাডামের পেছনে। সেই স্পাই আজ আমাকে এই ভিডিও গুলো পাঠিয়েছে। স্যার কিছু ভিডিও দেখলেই আপনার অনেক অংক মিলে যাবে
আবিদ”
নবনীতা মূহুর্তের জন্য থমকে যায়। শান্ত তার অগোচরে এখনো সেদিনের ঘটনার মূল রহস্য উন্মোচনে লেগে আছে সেটা জানা ছিলো না তার। নবনীতা ভেবেছিলো শান্ত হয়তো তাকে বিশ্বাস করেছে। কিন্তু না, সে ভুল ছিলো। শান্তও নীলয়ের মতো সেদিনের রহস্য উম্মোচনে ব্যাস্ত। কথাটা ভাবতেই চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো নবনীতার। তাকে বিশ্বাস করাটা কি এতোটাই কঠিন। নবনীতার ভয় হচ্ছে ভিডিও গুলো অন করতে। নিজেকেই অবিশ্বাস হচ্ছে তার। সত্যি খুব তিক্ত, তিক্ত সত্যি সহ্য করারা ক্ষমতা সবার থাকে না। নবনীতার ও নেই। নবনীতা মোবাইলটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। এর মাঝেই শান্ত তার পেছনে দাঁড়ালো। তার কাজ শেষ। এখন বউকে সময় দিবে সে। নবনীতার সেদিকে খেয়াল নেই। শান্ত নবনীতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কি দেখছো?”
শান্তের কন্ঠ কর্ণকুহরে যেতেই পেছনে তাকায় সে। তার নয়নজোড়া চকচক করছে। নবনীতার অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে শান্ত প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেনো?”
মোবাইলটা শান্তের হাতে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
“আপনিও সবার মতোই”
নবনীতা ব্যালকনি থেকে রুমের ভেতরের চলে যায়। শান্ত থমকে যায়। নবনীতার কথাটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও মোবাইলের দিকে তাকাতেই বুঝে যায়। নবনীতা আবিদের মেইল গুলো দেখেছে। পর পর সব গুলো ভিডিও দেখা যাচ্ছে। শান্ত ব্যাস্ত কন্ঠে বলে,
“নবনীতা, তুমি যা মনে করছো ব্যাপারটা তেমন না। আমি তোমাকে কখনোই সন্দেহ করি নি।“
“তাহলে এতো লুকোচুরি কেনো শান্ত? কেনো আমার অজান্তে আমাকে এতোটা নজরে রাখা?”
অকপটে প্রশ্ন করে বসে নবনীতা। নবনীতার প্রশ্নের উত্তর নেই শান্তের কাছে। তাই বাধ্য হয়ে সে চুপ করে থাকে। আবিদের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আবিদকে নীতির পিছু নিতে বলা হয়েছিলো। সে সেটা না করে নবনীতার পেছনে লোক লাগিয়েছে। শান্তকে চুপ থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে নবনীতা। কাঁপা স্বরে বলে,
“আমি ভেবেছিলাম আপনি আলাদা, আমি শুধু শুধু এতোদিন আপনাকে ভুল বুঝেছি। আপনি কখনোই আমাকে সন্দেহ করেন নি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। সব কিছুই আপনার নাটক। সবকিছু।“
“নবনীতা, তুমি ভুল বুঝছো”
“কি ভুল বুঝছি? বলুন? এখানে সিসি টিভি এর সকল ফুটেজ পাঠিয়েছে আপনার এসিসট্যান্ট। শুধু তাই নয়। সে আমার পেছনে স্পাই ও লাগিয়েছে। এখানে আমার ভার্সিটির কিছু ভিডিও আছে। তাই না? ভুল বলছি? আমাকে সারাটাক্ষণ কেউ ফলো করেছে। ভাবতেই আমার বুক কেঁপে উঠছে। এখনো বলবেন? আমি ভুল?”
“ট্রাস্ট মি, আমি আবিদকে তোমার পিছু নিতে বলি নি।“
“তাহলে সে কেনো আমার পেছনে লোক সেট করবে। আমি প্রতিটা মূহুর্ত ভয়ে থাকি, ভয়ে থাকি কেউ যেনো আমাকে ফলো করছে। কারোর সূক্ষ্ণ চোখ আমাকে গিলছে। আপনার কোনো ধারণা আছে? এটা কতোটা ভয়ংকর। লোকটা হয়তো এখানেও আমাদের পিছু নিচ্ছে।“
নবনীতার গলা আটকে আসছে। তার ভয় লাগছে। তার পা কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে সে। কাঁপা স্বরে বলে,
“আপনার কোনো আইডিয়া আছে? আমার উপর কি চলছে? একটু বিশ্বাসই তো চেয়েছিলাম আমি। সেটা কি খুব কঠিন।“
শান্ত এগিয়ে আসে তার কাছে। আকুল কন্ঠে বলে,
“নবনীতা, আমার কথাটা তো শোনো। আমি আবিদকে বলি নি তোমার পিছু নিতে। আমি শুধু চেয়েছিলাম সেদিনের ক্যামেরা ফুটেজ গুলো। এজন্য নয় যে আমি তোমাকে সন্দেহ করি। আমি সত্যটা জানতে চেয়েছিলাম। সেদিন যদি সত্যি তোমার সাথে কেউ অসভ্যতামী করে থাকতো আমি তাকে নিজ হাতে শাস্তি দিতাম। নবনীতা আমাকে ভুল বুঝছো।“
নবনীতা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। শান্ত এর কোনো কথাই তাকে স্থির করতে পারছে না। জীবনের কাছে আরোও একবার হেরে গেলো সে। শান্ত তার কাঁধে হাত রাখতে গেলেই হাতটা সরিয়ে দেয় নবনীতা। কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় দিকে। তারপর উঠে দাঁড়ায় সে। শীতল কন্ঠে বলে,
“আমি একটু একা থাকতে চাই শান্ত। আমার দম বন্ধ লাগছে এই রুমে।“
বলেই বেড়িয়ে যেতে নিলে শান্ত হাত টেনে ধরে,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“যেখানে একটু স্বস্তি পাবো। প্লিজ, এখন অন্তত আপনার স্পাইকে আমার পিছু নিতে মানা করুন। আর আপনিও আমাকে খুঁজতে আসবেন না। আমি নিজ থেকেই রুমে চলে আসবো।“
নিজের হাত ছাঁড়িয়ে নেয় নবনীতা। তারপর বেড়িয়ে বলে সে। শান্তের মেজাজ খারাপ লাগছে। আবিদকে পেলে হয়তো খুন করে ফেলতো সে। কিন্তু পারছে না। ক্রোধ সীমা ছাড়াচ্ছে তার। দুহাত দিয়ে মাথা চেপে বসে পড়ে সে। নবনীতা এতোদিন কতোটা মানসিক যন্ত্রণায় ছিলো সেই কারণটা এখন বুঝতে পারছে সে। সেকারণেই এন্টিকাটার রাখতো মেয়েটা ব্যাগে। নবনীতার কান্নারর মুখশ্রীটা চোখের সামনে ভাসছে শান্তের। নিজের উপর এতোটা রাগ কখনোই হয় নি শান্তের। কিন্তু আজ হচ্ছে, নিজের অপারগতার উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রাগের চোটে সজোরে লাথি মেরে দিলো সামনের চেয়ারটিতে। জড় পদার্থটা শান্তের প্রকোপে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। শান্ত এবার ফুসতে ফুসতে ফোন দিলো আবিদকে। আবিদ ফোন রিসিভ করেই উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,
“স্যার, ভিডিও গুলো দেখেছেন? এবার আমার ইনক্রিমেন্ট নিশ্চিত। তাই না?”
“তোমাকে আমার চাপকাতে ইচ্ছে করছে। সামনে থাকলে খুন করে ফেলতাম।“
দাঁতে দাঁত পিসে কথাটা বললো শান্ত। আবিদ হতবাক হয়ে যায়। শান্তকে এতোটা রেগে যেতে এই প্রথম দেখছে সে। অবাক কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে স্যার?”
“আমি কি তোমাকে বলেছিলাম নবনীতার পেছনে লোক লাগাও। তাহলে কেনো করেছো এটা?”
“স্যার, আপনি ই তো ম্যাডামের আশেপাশের সকল লোকের প্রতিক্ষণের খবর চেয়েছিলেন।“
“সেটা শুধু সেই শপিং মলের কথা বলেছিলাম। তোমার স্পাই এর জন্য নবনীতা এতোদিন ভাবতো কেউ তাকে ফলো করছে। জানো তুমি ও কতোটা ভয়ে ছিলো।“
“অসম্ভব স্যার, আমার স্পাই কখনো ম্যাডামের ৫ মিটারের মাঝে আসে নি। স্যার, আপনি আদৌও ভিডিও গুলো দেখেছেন? আমি অকারণে কিছু করি নি। ম্যাডামকে সত্যি ই কেউ ফলো করছিলো। কিন্তু সে আমার স্পাই না। সেদিন মল থেকে নীতি এবং নবনীতা ম্যাডাম এক সাথেই বের হয়েছিলেন। কিন্তু নীতি ম্যাডাম মাঝ রাস্তায় ম্যাডামকে একা ছেড়ে দেন। কারণ ওয়াশরুমে শুধু নবনীতা ম্যাডাম একা গিয়েছিলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ম্যাডাম যখন স্টেয়ারক্যাস নেন, তখন একটা লোক তার পিছে যায়। সেই লোকটি ই ম্যাডামকে প্রায় ফলো করে। কিন্তু সে সুবিধা করতে পারে নি।“
আবিদের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় শান্ত। কিন্তু বিস্ময় চেঁপে বলে,
“লোকটা কে জানো?”
“জ্বী স্যার, তার ব্যাবস্থা আমি করে ফেলেছি। এখন শুধু আপনার আসার বাকি।“
“আর নীতি, ওর কিছু পেলে? স্যার নীতি ম্যাডামের রিপোর্ট টা আপনি আসলেই পেয়ে যাবেন।“
“সরি, আবিদ। আসলে “
“সমস্যা নেই স্যার, খুব বড় কিছু না হলে আপনি এভাবে রিয়াক্ট করতেন না। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে না বলে এই কাজটা করেছি। আই এম সরি স্যার।“
আবিদের সাথে কথা শেষে ফোনটা রেখে দেয় শান্ত। নিজেকে অতিকষ্টে স্বাভাবিক করে সে। এখন নবনীতাকে খুজতে যেতে হবে। মেয়েটা রাগ করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। নবনীতাকে যতক্ষণ না সব খুলে বলবে ততক্ষণ স্থির হতে পারবে না। শান্ত ওয়ালেটটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য নবনীতাকে খোঁজা।
হোটেল থেকে খবর নিয়েছে নবনীতা সি বিচে গিয়েছে, তাই শান্ত ছোটে সি বিচে। সি বিচে এখন বিপদ সংকেত চলে। কাউকে সাগরে থামতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু সি বিচে মানুষের ভিড় কমে নি। নবনীতার মোবাইলটা রুমে, তাই এই বিশাল সৈকতে তাকে পাগলের মতো খুজে যাচ্ছে শান্ত। এর মাঝেই এক পাশে বেশ ঝটলা লেগে আছে। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, গার্ডের নিষেধ না শুনে একটা মেয়ে নাকি সাগরের দিকে অন্য মনস্ক ভাবে হেটেছিলো। মেয়েটা সাঁতার জানতো না। সাগরের প্রবল ঢেঊ অতর্কিতে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। লাইফগার্ডরা খুব কষ্টে মেয়েটাকে তুলে এনেছে। কথাটা শুনতেই বুক কেঁপে উঠে শান্তের। দম বন্ধ হয়ে আসছে শান্তের। এতোটা ভয় কখনোই পায় নি সে। পা জোড়া বালিতে আটকে গেছে যেনো ভয়ে। এগোতেই চাচ্ছে না। খুব কষ্টে এগিয়ে যায় শান্ত। ভিড় ঠেলে মেয়েটার কাছে যেতেই দেখে………………
চলবে