#শৈবলিনী—৩৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★অনুষ্ঠানের সব আয়োজন শেষ হতে হতে প্রায় অনেক রাত হয়ে গেল। নূর বাইরে এসে কোনো সিএনজি, ট্যাক্সি কিছু পেলনা। গাড়ি বানিয়ে ফেললেও নিজের জন্য এখনো ব্যবহার করা আরম্ভ করেনি সে। আগে মার্কেটিং ভালোভাবে জমলে তবেই নিজের জন্য ব্যবহার করবে ভেবেছে৷ অনেকক্ষণ হলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো ট্যাক্সি বা সিএনজির দেখা মিলছে না। আর এখান থেকে হাইওয়ে রোডও অনেক দূরে, তাই বাসে করেও যেতে পারছেনা। তখনই সোহানও সেখানে এগিয়ে এলো। নূরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কাছে গিয়ে বলল,
–মিস নূর,চলুন আমি আপনাকে বাসায় ড্রপ করে দিচ্ছি।

–না না, ইটস ওকে আমি ম্যানেজ করে নিবো।

–আরে কি ম্যানেজ করবেন? এখানে আপনি কোনো ট্রান্সপোর্ট পাবেন না। রাত করে আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? চলুন আপনাকে নামিয়ে দিবো আমি।

আসলেই এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, তার চেয়ে সোহানের সাথে যাওয়াই ঠিক মনে করলো নূর। আর তখনকার ওই বিষয়ে সবটা ক্লিয়ারও করে দিবে নূর। বুঝিয়ে দিবে নূরকে বিয়ে করার চিন্তা যেন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে।এটা সম্ভব না। এই মনস্তাপ করে নূর সোহানের কথায় রাজি হয়ে গেল। সোহান ওর ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলার জন্য ফোন করলো। কিন্তু ড্রাইভার জানালো,গাড়ির নাকি টায়ার পানচার। সোহান নূরকে বলল,
–ওহ হো, একটা ঝামেলা হয়ে গেল। গাড়ির নাকি টায়ার পানচার হয়ে গেছে।

নূর সৌজন্যমূলক মুচকি হেসে বলল,
–নো প্রবলেম। আমি চলে যেতে পারবো।

–কিন্তু আপনি কতক্ষণ গাড়ির জন্য এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? এক কাজ করি, দুজন মিলে অপেক্ষা করি। এক ট্যাক্সিতেই দুজন নাহয় চলে যাবো।

–ওকে।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কোনো গাড়ি গুড়ি পেলোনা তারা। আজ যেন সবাই হর,তালে বসেছে।এমনিতেতো সবসময় সিএনজি, ট্যাক্সির মেলা লেগে থাকে। অথচ আজ একটাও দেখা যাচ্ছে না। একসাথে সবকিছু গায়েব হঠাৎ যেন গায়েব হয়ে গেছে। ওদের অপেক্ষার মাঝেই হঠাৎ আদিত্য ওর গাড়ি নিয়ে ওদের সামনে এসে ঠেকালো। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে সে। জানালার কাচ নামিয়ে সোহানের উদ্দেশ্যে বলল,
–মিঃ সোহান দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন নামিয়ে দেই আপনাকে।

সোহান বলল,
–হ্যাঁ মিঃ আদিত্য, লিফট দিলেতো ভালোই হতো। আসলে আমি আর মিস নূর দুজনেই ফেঁসে গেছি।

–আমি থাকতে কোনো ঝামেলা নেই। আসুন উঠে পড়ুন গাড়িতে। নামিয়ে দিচ্ছি।

সোহান নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–চলুন মিস নূর, আপনিও চলুন। মিঃ আদিত্য আমাদের লিফট দিবে।

আদিত্যর গাড়িতে ওঠার মোটেও ইচ্ছে নেই নূরের। সে মানা করে দিলো। কিন্তু সোহানের জোরাজোরিতে পেরে উঠলনা। অতঃপর সে রাজি হতে বাধ্য হলো। তাছাড়া আদিত্যর সামনে সে সোহানের সাথে মিল দেখাতে চায়। তাই সোহানের কথা মেনে আদিত্যর গাড়িতে উঠে বসলো। সোহান সামনে আদিত্যর পাশে বসলো। আর নূর পেছনের সিটে বসলো। গাড়িতে আদিত্য নূরের সাথে কোনো কথা বললো না। আর না তাকালো তার দিকে। সোহানের বাসা আগে আসে। তাই প্রথমে সোহানকে নামিয়ে দিলো আদিত্য। সোহান নেমে গিয়ে নূর আর আদিত্যকে গুড নাইট বলে চলে গেল।আদিত্য সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, সো সরি মিঃ সোহান,আপনার নাইট আজ গুড হবেনা। সোহান চলে যাওয়ার পর আদিত্য কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। নূরের কোনো হেলদোল না দেখে আদিত্য পেছনে না তাকিয়েই বলে উঠলো,
–এখনকি আমাকে সেই ফিল্মি ডায়লগ বলতে হবে তারপর সামনে এসে বসবে,নাকি গাড়ির মালিক হয়ে গিয়ে এখন আমাকেও ড্রাইভার মনে হচ্ছে?

আদিত্যর খোঁচা মারা কথায় রাগতো প্রচুর হলো নূরের। তবে আপাতত সে কোনো প্রতিত্তোর করলোনা। এই লোকের সাথে কোনো তর্কে জড়াতে চায়না সে। পারলে সে এখুনি এই গাড়ি থেকে নেমে চলে যেত। তবে এতে আরও সীন ক্রিয়েট করতে পারে এই লোক। তাই কিছু না বলে চুপচাপ সামনে এসে বসলো নূর। আদিত্য গাড়ি স্টার্ট দিলো। আদিত্য এখনও নূরের দিকে তাকাচ্ছে না। না তার সাথে কোনো কথা বলছে। নূর ভাবছে হয়তো তার ট্রিক কাজে লেগেছে। লোকটা হয়তো এবার তার জিদ ছেড়ে দিবে। আর কখনও ওর পিছে আসবেনা। এই ভাবনা নূরকে ভেতরে পুড়িয়ে দিচ্ছে। দিক,তবুও এটাই ভালো। সারাজীবনের গ্লানির থেকে ক্ষণিকের কষ্ট শ্রেয়। আমাদের পথ সবসময় আলাদা ছিলো আর আলাদাই থাকবে। সেই পথে চলার চেষ্টা বৃথা,যার কোনো মঞ্জিল নেই।

এভাবেই চলতে চলতে হঠাৎ রাস্তায় গাড়ি থেমে গেল। নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কি হয়েছে? গাড়ি থামালেন কেন?

আদিত্য জবাবে বলল,
–জানি না, হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। দেখছি স্টার্ট হয় নাকি।

আদিত্য বারবার গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। নূর বিরক্তি নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। জায়গাটাও কেমন নিরিবিলি জনশূন্য একদম। রাস্তার পাশে ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা। তাই কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। এমন একটা জায়গায় এভাবে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়াটা কেমন যেন লাগছে নূরের কাছে। লোকটা কী ইচ্ছে করে গাড়ি বন্ধ করে দিলো? কিন্তু স্টার্ট দিচ্ছে সেটাতো নূর দেখতে পাচ্ছে। একজন মেকানিককে তো আর বোকা বানাতে পারবেনা সে। আদিত্যকে অনেকবার চেষ্টা করতে দেখে এবার নূর বলে উঠলো।
–দেখি সরেন, আমি দেখছি কি হয়েছে।

আদিত্য নূরের কথা অনুযায়ী পেছনে সিটের সাথে চেপে গিয়ে নূরকে জায়গা করে দিলো দেখার জন্য। নূর নিজের সিটবেল্ট খুলে আদিত্যর কোলের সামনে ঝুঁকে গিয়ে গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো কি সমস্যা হয়েছে। গাড়ি আসলেই স্টার্ট হচ্ছে না। নূর ট্রাই করতে লাগলো। নূর ঝুঁকে যাওয়ায় ওর চুলগুলো ঝুঁকে এসে সব আদিত্যর কোলের ওপর পড়ে আছে। এই অবস্থায় বাইরে থেকে কেউ দেখলে বিষয়টা অন্যরকম মনে হবে। এবং হলোও তাই। হঠাৎ গাড়ির জানালায় টোকা পড়লো। আদিত্য তাকিয়ে দেখলো পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। শব্দ শুনে নূরও ওই অবস্থাতেই শুধু মাথাটা উপর দিকে তুলে বাইরে তাকালো। পুলিশকে দেখে নূর একটু চকিত হয়ে ঝট করে সোজা হয়ে বসলো। আদিত্য গাড়ির কাচ নামিয়ে বলল,
–ইয়েস ইন্সপেক্টর, কিছু বলবেন?

পুলিশটি কেমন কু,শ্রী ভাবে তাকিয়ে বলল,
–এসব কি হচ্ছে এখানে হ্যাঁ? রাস্তাঘাটে এসব কি নোংরামি চলছে? এসব করার হলে হোটেলে গিয়ে করুন। এখানে রাস্তার মাঝে কি?

পুলিশের কথায় নূরের মাথা প্রচন্ড লেভেলের গরম হয়ে গেল। সে রেগে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
–এই ইন্সপেক্টর, ভদ্রভাবে কথা বলুন। কি আবোলতাবোল বলছেন আপনি?

–ও আচ্ছা, তো এখন আপনাদের মতো লোকের কাছ থেকে আমার ভদ্রতা শিখতে হবে?

নূর আরও রেগে গিয়ে বলল,
–আপনাদের মানুষ বলতে কি বোঝাতে চাইছেন আপনি? পুলিশ হয়েছেন দেখে কি যা খুশি তাই বলে যাবেন?

–ও ম্যাডাম,মনে হচ্ছে অনেক বেশি তেজ আপনার। চলুন, বের হোন গাড়ি থেকে। এখুনি পুলিশ স্টেশনে চলুন৷ তারপর দেখাবো আপনাকে ভদ্রতা।একেতো রাস্তাঘাটে অবৈধ কাজ করছেন আবার উল্টো পুলিশের সাথে তর্ক হচ্ছে! নামুন।

অবস্থা বেগতিকের দিকে যেতে দেখে আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে এসে পুলিশের উদ্দেশ্যে বললো,
–আরে ইন্সপেক্টর আপনি ভুল বুঝছেন। এখানে এমন কিছুই হচ্ছে না। আসলে আমার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখানে গাড়ি থেমে গেছে দ্যাটস ইট।

পুলিশটা এবার আদিত্যর দিকে ভালো করে খেয়াল করে বলল,
–আপনি! আপনিতো ওই সিনেমার হিরো, আদিত্য না?

আদিত্য বিনয়ী সুরে বলল,
–জি জি, আমিই সেই।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সেখানে আরও দুই তিনজন কনস্টেবল পুলিশ এসে হাজির হলো। তারাও আদিত্যকে দেখে চিনে ফেললো। ইন্সপেক্টর এবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
–ওওও তো এই ব্যাপার! হ্যাঁ ভাই জীবন তো আপনাদেরই। নায়কের জন্য মাইয়ারা পাগল। আপনেরা চাইলেই যাকে খুশি নিয়ে ফূ,র্তি করতে পারেন। তারপর বছর বছর একটা করে বাচ্চার খবর সামনে আসে। নাজানি কতো জায়গায় একাউন্ট খুলে রেখেছেন আপনারা। আর কিছুদিন পরপরই সেটা সুদ বের হয়ে আসে। তা মেয়েলোক নিয়ে ফূ,র্তি করবেন, কোনো ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে করুন। টাকার কি কমতি আছে আপনাদের? রাস্তাঘাটে কেন এসব করছেন? জানেন না পাবলিক প্লেসে এসব করা আইনত অপরাধ?

ব্যাস এবার আর সহ্য হলোনা নূরের। পুলিশের এতো বি,শ্রী কথাবার্তা শুনে মাথা ব্লাস্ট হয়ে গেল তার। তীব্র রাগের বশে সে তেড়ে গিয়ে হিং,স্র বাঘিনীর মতো পুলিশের কলার চেপে ধরে ক্ষিপ্র স্বরে বলল,
–এই পুলিশের বাচ্চা, তোর সাহস কি করে হলো আমার ব্যাপারে এতো জ,ঘ,ন্য কথা বলার? একটা ছেলে মেয়ে একসাথে দেখলেই কি মাথায় শুধু এই নোংরা ধারণাই ঘোরে? আজ তোদের মতো এই চিপ মেন্টালিটির পুলিশদের জন্যই দেশের এই অবস্থা। তোদের দ্বারা মানুষের বিপদ উদ্ধার হওয়ার বদলে উল্টো আরও বেশি বিপদে পড়ে। কাজের কাজ করতে পারিসনা, শুধু পারিস নিরপরাধীদের হ্যা,রা,স করতে।

অবস্থা আরও বেগতিক মোড় নিলো।আদিত্য কোনোরকমে নূরকে ছাড়িয়ে এনে ফিসফিস করে বলল,
–কি করছ নূর? সব জায়গায় এতো মারপিট দেখাতে হয়না। এতে সিচুয়েশন আরও বিগড়ে যায়।ভুলে যেওনা এরা পুলিশ। এদের সাথে লাগতে গেলে আমাদেরই বেশি ক্ষতি হবে।

নূর তবুও রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
–কেন বলবে ও এসব কথা? পুলিশ হয়েছে তো কি মাথা কিনে নিয়েছে?

নূরের এ্যাকশনে পুলিশ চরম রেগে গেল। কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে বলল,
–কনস্টেবল, গ্রেফতার করো দুটোকেই। লকাপে নিয়ে চলো এখুনি। পুলিশের গায়ে হাত তোলা! এর পরিণাম কি ভয়াবহ হবে তা হারে হারে দেখিয়ে দিবো। এদের উপর এমন এমন ধারা লাগিয়ে দিবো যে সারাজীবন মনে রাখবে। আর মিডিয়াকেও খবর দাও। সবাইকে এই নায়কের কর্মকাণ্ডের ব্রেকিং নিউজ দেওয়া তো জরুরি। লোকজনের একটু এন্টারটেইনমেন্ট হবে।

আদিত্য অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
–প্লিজ অফিসার, এমনটা করেন না। আমরা একটু শান্ত ভাবে কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি।

–কোনো কথা শুনতে চাইনা আমি। যা বলার পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বলবেন। কনস্টেবল নিয়ে চলো এদের।

দুজন কনস্টেবল ওদের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। আদিত্য অনেক রিকুয়েষ্ট করে বোঝানোর চেষ্টা করলো তবে পুলিশ কোনো কথায় শুনলোনা। সিচুয়েশন একেবারেই আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেল। এবারতো নূরও ঘাবড়ে গেল। এভাবে রেগে গিয়ে পুলিশের গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হয়নি। ওতো জানেই পুলিশের স্বভাব তবুও এভাবে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো সে? এখন কি হবে? নাজানি এই পুলিশের জা,ত কি করবে এখন ওদের সাথে?
আদিত্য আর নূরকে পুলিশ জিপে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পুলিশ স্টেশন। জিপের ভেতর আদিত্য নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–এইজন্যই তোমাকে বলি নিজের রাগকে একটু কন্ট্রোল করতে শেখ। সবসময় ঝাঁসির রানির মতো তলোয়ার বের করে ফেলো। এখন দেখলে তো কি হলো? মিডিয়াতে এসব জানাজানি হয়ে গেলে কী হবে ভাবতে পারছ একবারও?

নূর নিজের ভুল বুঝতে পারলেও আদিত্যর ওপরও তার রাগ হলো। সে রাগ দেখিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, তাতো অবশ্যই। দ্য সুপারস্টার নায়কের ইমেজ বলে কথা। লোকের সামনে ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে আপনার। কে বলেছিল গাড়িতে তুলতে? আমাকে না তুললে তো আর আপনার মহান ইমেজ লোকের সামনে নষ্ট হতোনা।

আদিত্য হতাশার সুরে বলল,
–তুমি আবার কবে আমাকে বুঝেছিলে যে আজ বুঝবে। আমাকে ভুল বোঝাটাতো তোমার ফেবারিট হবি। এখানেও তোমার মনে হচ্ছে আমি আমার নিজের ইমেজের কথা ভাবছি। একবারও ভাবছনা এখানে আমার সাথে তুমিও জড়িত আছ। আমার না হয় যা হবে, হবে। কিন্তু এসবের জন্য তোমার ইমেজের কী হবে একবারও ভেবে দেখেছ?

নূর এবার সত্যি ঘাবড়ে গেল। সে বুঝতে পারছে অনেক বড়ো ব্লেন্ডার হয়ে গেছে। নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছে না নূরের। চিন্তা হচ্ছে পরিবারের জন্য। অমালিয়ার ওই ঘটনার পর থেকে এমনিতেই ওদের পরিবারের ওপর দিয়ে অনেক তুফান গেছে। বদনামি, লোকজনের খোঁচা মারা কথার তীর সব সইতে হয়েছে। যার জের এখনো আছেই। এসব দেখে মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।তারপর থেকেই সে বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ থাকে। ইদানীং তো তাঁর শারিরীক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। সপ্তাখানেক আগেই হসপিটালাইজড করতে হয়েছিল মাকে। মাত্রই একটু ঠিক হয়েছে সে। এখুনি যদি আবার এসব নিয়ে কোনো বদনামি ছড়ায় তাহলে মা সইতে পারবেনা। তাঁকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে। না না,মাকে কিছু হতে দিতে পারবোনা আমি। কিছুতেই না। যে করেই হোক সিচুয়েশন সামাল দিতে হবে।

পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসা হলো ওদের। জিপ থেকে নামতেই দেখতে পেল একঝাক মিডিয়া এরই মাঝে এসে উপস্থিত হয়ে গেছে। এসব দেখে নূর প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে তার। বারবার শুধু মায়ের চিন্তা হচ্ছে ওর। আদিত্য যেতে যেতে নূরের দিকে হালকা ঘাড় কাত করে ফিসফিস করে বলল,
–দেখ, যা করার করে ফেলেছ। এখন একটু দয়া করে চুপ থেক। সিচুয়েশন আমাকে হ্যান্ডেল করতে দাও প্লিজ।

নূর আদিত্যর কথায় সায় দিয়ে সম্মতি স্বরূপ মাথা নাড়ালো। এখন আর ওর হাতে কিছু নেই। এখন এই লোকটাই যদি কিছু করতে পারে। তাছাড়া আর কোনো পথ নেই। আদিত্য আর নূর এগিয়ে যেতেই সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলো তাদের। একেকজন একেক ধরনের প্রশ্নের তীর ছুড়তে লাগলো।প্রথমে পুলিশ ওদের কোন অবস্থায় ধরেছে সেটা আরও মসলা লাগিয়ে মিডিয়াকে জানলো।এসব শুনে একজন সাংবাদিক বলল,
–মিঃ আদিত্য, এসব কি সত্যিই? পুলিশের দেওয়া ইনফরমেশন কী সত্যি?কে এই মেয়ে? আপনি কি এই মেয়েকে ডেট করছেন? নাকি শুধুই ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড?

সাংবাদিকদের এমন বি,শ্রী প্রশ্নে নূরের রাগতো প্রচুর হলো। তবে নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো সে। এমনিতেই অনেক অবস্থা বেগতিক হয়ে গেছে। এখন আরও খারাপ করতে চায়না সে। হঠাৎ একজন সাংবাদিক বলে উঠলো,
–আরে উনিতো সেই মেয়েটাই, যাকে নিয়ে এর আগেও একবার ছবির সাথে নিউজ লিক।হয়েছিল। এসব কী মিঃ আদিত্য? আপনাদের এই সম্পর্কের কী বিশ্লেষণ দিবেন আপনি? আমরা কী ভাববো এই সম্পর্কে?

এভাবে একেকজন সাংবাদিক একেক ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো ওদের। সিচুয়েশন সামলাতে আদিত্য বলে উঠলো,
–আপনারা সবাই একটু শান্ত হোন। আমি সবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আসলে ইন্সপেক্টর আর আমাদের মাঝে শুধু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তাছাড়া আর কিছুই না। উনি আমাদের ভুল বুঝে ধরে এনেছেন। আমাকে বোঝানোর সময়ও দেননি উনি। তবে এখন আমি সবাইকেই বিষয় টা বুঝিয়ে বলছি। আসলে আপনারা যেমনটা ভাবছেন আসলে তেমন না। আসল ব্যাপার হলো, আমরা দুজন স্বামী স্ত্রী।

“স্বামী স্ত্রী” দুটো শব্দই নূরের ওপর বিস্ফোরণ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। ভুমিকম্পের মতো বিস্ফোরক ঘটলো যেন সবার ওপর। নূর চমকে উঠে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো আদিত্যর পানে। ভড়কে উঠে কিছু বলতে যাবে তখনই আদিত্য হাত চেপে ধরে নূরকে চুপ থাকার ইশারা করলো। লোকজনের সামনে নূর চেয়েও কিছু বলতে পারলোনা। সাংবাদিকরা এতো বড়ো নিউজ শুনে প্রশ্নের হুড়োহুড়ি লাগালো। আদিত্য তখন বলল,
–আসলে এটা আমি এভাবে বলতে চাইনি আপনাদের। তবে এখন সত্যিটা না বললে ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে না। ওর নাম নূর,আমাদের সম্পর্ক বছরখানিক হলো। দুমাস আগেই আমরা ঘরোয়া ভাবে বিয়ে করেছি। মিডিয়াকে জানায়নি কারণ বড়ো করে একটা এনাউন্সমেন্ট করার অপেক্ষা করছিলাম। ততোদিন বিষয় টা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন না বললেতো আপনারা বিষয়টাকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই বলতে বাধ্য হলাম। কারণ নিজের বউকে নিয়ে গাড়িতে লং ড্রাইভে যাওয়াটা নিশ্চয় কোনো অপরাধ না! তো এভরিওয়ান,মিট মাই ওয়াইফ মিসেস নূর সাদমান শাহরিয়ার।
আদিত্য পুলিশের উদ্দেশ্যে বলল,
–তো ইন্সপেক্টর,এখন নিশ্চয় কোনো কনফিউশান নেই? প্লিজ এবার যেতে দিন আমাদের।

পুলিশ বিদ্রুপ হেঁসে বলল,
–এসব নাটক রোজ দেখি আমরা। ধরা পরলে তখন সবাই নিজেদের স্বামী স্ত্রীই বলে। কী প্রমাণ আছে আপনার কথার? আগে প্রমাণ দেখান।তবে ছবি চলবেনা। কারণ ছবির ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। ম্যারেজ সার্টিফিকেট বা অন্যকিছু থাকলে দেখান।

–ইনস্পেক্টর, ম্যারেজ সার্টিফিকেট কী কেউ পকেটে নিয়ে ঘোরে নাকি? এখন এমুহূর্তে কীভাবে দেখাবো আপনাদের? দেখুন প্লিজ আমার কথা বিশ্বাস করুন।

–এসব মুখের কথায় কাজ হবে না। প্রমাণ করতে না পারলে হাজতে থাকতে হবে।

হঠাৎ এক কনস্টেবল বলে উঠলো,
–একটা উপায় আছে স্যার। উনারা যেহেতু স্বামী স্ত্রী। তাহলে নিশ্চয় আরেকবার বিয়ে করতেও সমস্যা হবে না। এক কাজ করা যাক পাশের কাজী অফিস থেকে কাজী এনে এখানে সবার সামনে বিয়ে পড়ানো হোক। তাহলে প্রমাণ হয়ে যাবে যে এরা স্বামী স্ত্রী।

ইন্সপেক্টর কনস্টেবলের কথায় সায় দিয়ে বলল,
–ঠিক বলেছ কনস্টেবল। যাও গিয়ে কাজী সাহেব কে ডেকে নিয়ে এসো।

কনস্টেবল কাজীকে ডাকতে গেল। নূর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। মাথা ভনভন করে ঘুরছে তার। এসব কি হচ্ছে? বিয়ে? উনার সাথে? নো নো নো, এটা সম্ভব না, কিছুতেই না। নূর অস্থির হয়ে ওখান থেকে চলে যেতে লাগলো। আদিত্য নূরের হাত ধরে আঁটকে দিয়ে ফিসফিসানো কন্ঠে বলল,
–কোথায় যাচ্ছ নূর? এভাবে এখান থেকে যাওয়া সম্ভব না। এতে আরও বড়ো মাপের অপরাধী হয়ে যাবে তুমি।

নূর দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–হোক যা খুশি তাই। আপনি কীসব আবোলতাবোল বলে যাচ্ছেন তখন থেকে? আর কি চাইছেন বসে চুপচাপ বিয়ে করে ফেলবো আপনাকে?

–দেখ নূর,শান্ত হয়ে বোঝার চেষ্টা করো। এখন এই সিচুয়েশনে এই ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা। সেই মুহুর্তে তোমাকে আমাকে দুজনকেই এই সিচুয়েশন থেকে উদ্ধার করতে এটাই সঠিক রাস্তা মনে হয়েছিল আমার। তাছাড়া এখান থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় ছিলোনা। আর এরা যে এভাবে বিয়ের কথাটা তুলবে সেটাকি আমি আগে থেকে জানতাম নাকি?

–বাহ্! জানতেন না। কি সুন্দর করে বলে দিলেন। তো এখন কী আপনার মিথ্যে প্রমাণ করতে সত্যি সত্যিই বিয়ে করবো আমি? পাগল হয়ে গেছেন আপনি?

–দেখ এই ছাড়া কোনো উপায় নেই এখন। না চাইতেও এটা করতে হবে।

–করবোনা আমি। দেখি কে ঠেকায় আমাকে।

বলেই নূর আবারও চলে যেতে লাগলো। কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ এসে আঁটকে দিলো নূরকে। সাংবাদিকেরা আবারও সন্দেহমূলক বাজে ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো তাকে।এরই মাঝে কাজীকে নিয়ে চলে এলেন কনস্টেবল। নূর হতবুদ্ধি হয়ে গেল। সবকিছু কেমন গোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। চেয়েও সে কিছু করতে পারছেনা।না পারছে এখান থেকে ছুটে পালাতে। অন্যদিকে মায়ের চিন্তাও হচ্ছে তার। এসব মিথ্যে বদনাম খবরে দেখালে তার মা নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবেন। অতঃপর আর কোনো উপায় না পেয়ে পুলিশ, মিডিয়া সবার সামনে কবুল বলতে বাধ্য হয় নূর আর আদিত্য। বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় তারা। অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা তাদের স্বামী-স্ত্রীতে রুপান্তর করে দিলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here