#শৈবলিনী—৩৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বিয়েতে আদিত্য আর নূরের পরিবারও এসেছে। শুধু অমালিয়া আর আদ্র বাদে। মিছরি বিয়ে বাড়িতে মনের আনন্দে ছোটাছুটি করছিলো।দুই হাতে কাবাব নিয়ে খেতে খেতে এদিক ওদিক ঘুরছে সে। হঠাৎ কারোর সাথে ধাক্কা লেগে গেল তার। ফলস্বরুপ তার হাতের কাবাব গুলো নিচে পড়ে গেল। মিছরি রাগান্বিত চোখে সামনে তাকালো। তাকাতেই দেখতে পেল এক কিশোরকে। যে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মিছরি রাগান্বিত স্বরে বলল,
–এই ছোকরা,কে তুমি? চোখ কি পকেটে নিয়ে ঘোরো? দিলেতো আমার কাবাব গুলো ফেলে।
ছেলেটার বোধহয় হয় হুঁশ হলো।মিছরিকে দেখে সে থমকে গিয়েছিল। সিনেমার মতো লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইড টাইপ কিছু হচ্ছে ওর। ছেলেটা ফিচেল হেঁসে বলল,
–সরি সরি আমি দেখতে পাইনি।
–তোমার সরি দিয়ে আমার পেট ভরবে?
–ব্যাপার না, আমি এখুনি অনেকগুলো কাবাব এনে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি এই টেবিলে বসো।
–হুম,ঠিক আছে।
ছেলেটা একটু পরেই এক প্লেট ভর্তি কাবাব নিয়ে এসে মিছরির সামনে টেবিলে রাখলো। তা দেখেতো মিছরি ভীষণ খুশি। প্রফুল্লিত হয়ে কাবাবের প্লেটটা টেনে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
–ওয়াও,এত্তগুলা!
ছেলেটা মিছরির সামনের চেয়ারে বসে হাসিমুখে বলল,
–হ্যাঁ এগুলো সব তোমার। এখন আর রাগ নেইতো আমার ওপর?
–না না, আর রাগ নেই। তুমি খারাপ না।
মিছরি দুই হাতে দুটো করে কাবাব নিয়ে মনের আনন্দে খেতে লাগলো। আর কিশোর ছেলেটা টেবিলের ওপর দুই হাতের কনুই ঠেকিয়ে হাতের মাঝে থুতনি রেখে বিস্তৃত হাসিমুখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে দেখতে লাগলো মিছরিকে। পেছন থেকে যেন ব্যাকরাউন্ডে মিউজিক বাজছে, ♬ তুমহে যো মেনে দেখা, তুমহে যো মেনে জানা যো হোশ থা ওতো গায়া…..
খাওয়ার এক পর্যায়ে মিছরি একটা কাবাব ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–তুমি খাবে?
–না না, তুমিই খাও। তুমি খেলেই হবে। আচ্ছা তোমার নামটা তো বললেনা। আমার নাম তীর্থ আর তোমার নাম?
মিছরি গালভর্তি কাবাব নিয়ে বলল,
–আমার নাম মিছরি। বাসায় সবাই চিনি বলে ডাকে।
তীর্থ এবার মুগ্ধতার অতলে ডুবে বলল,
–ওয়াও, জানো কালই মা বাবাকে বলছিলো বাসায় নাকি চিনি শেষ হয়ে গেছে। তোমাকে আমি সাথে করে নিয়ে যাই বাসায় তাহলে আর চিনির অভাব হবেনা।
তীর্থর কথায় মিছরি কাবাবের তেল লেগে থাকা চিকচিকে ঠোঁটে খিলখিল করে হেঁসে দিলো। যে হাসিতে মুগ্ধতার সপ্তমে পৌঁছে গেল তীর্থ। প্রেম প্রেম ফিলিংসে ভাসছে সে।
দূর থেকে এসব দেখে মাথা নেড়ে হাসলো আদিত্য। এই মিছরিটারও প্রেমের গাড়ি চালু হয়ে গেল। শুধু এই অভাগারই কপাল পোড়া।আন্ডার মতো পুঁচকে পুঁচকে ছেলেরা মেয়ে পটিয়ে ফেলছে আর আমি অভাগা কিছুই পারলাম না। মিছরির মতো ওর বোনটাও একটু নরম হলে কি হতো? বিধাতা যেন দুনিয়ার যতো কঠোরতা ওই একজনের মাঝেই দিয়ে রেখেছে। জীবন কয়লা কয়লা হয়ে গেল।
মিছরি আদিত্যেকে দেখে দৌড়ে গেল ওর কাছে। হাসিমুখে বলল,
–আরে নায়ক ভাইয়া! তুমি এখানে?
আদিত্য মিছরির গাল আলতো করে টেনে দিয়ে হাসিমুখে বলল,
–হ্যাঁ, আমিও এখানে। তা কেমন আছ কিউটিপাই?
–ভালো আছি। কিন্তু আমি তোমার ওপর রাগ করেছি।
–কেন? কেন? কি দোষ এই অধমের?
মিছরি বুঝতে না পেরে বোকার মতো বলল,
–অধম? সেটা আবার কে? আর অধমের দোষ কেন ধরতে যাবো আমি? আমিতো আপনার কথা বলছি। আপনি আর আমাদের বাসায় আসেন না কেন? তাই রাগ করেছি আমি।
আদিত্য আহ্লাদী ভঙ্গিতে বলল,
–আলে আলে, আমার কিউটিপাই টা রাগ করেছে? কিন্তু আমার কি দোষ? দোষতো তোমার আপুর।সেইতো আমাকে আসতে বারন করেছে। নাহলে কি আমি না এসে থাকতাম? তুমি তোমার আপুকে বলবে যে, আমাকে যেন আবার আসতে দেয় তোমাদের বাসায়। বলবে,নায়ক ভাইয়াকে আসতে বলো।
মিছরি ভীতু স্বরে বলল,
–আমি! আমি বলবো আপুকে! না বাবা না, এতো সাহস নেই আমার। দেখা গেল আপু আমাকে লবণ ছাড়াই কাঁচা খেয়ে ফেলবে। এই বয়সেই মরার ইচ্ছে নেই আমার। এখনতো বিয়েই হলোনা আমার।
মিছরির কথায় না হেঁসে পারলোনা আদিত্য। নূরের ত্রাসে গোটা বিশ্বই বুঝি আতঙ্কিত। আদিত্য আর মিছরির আহ্লাদী কাজকর্ম দূর থেকে খেয়াল করলো নূর। হঠাৎই যেন নিজের মন মস্তিষ্কে যুদ্ধ শুরু হলো নূরের। এই লোকটার কোন সত্তাটা আসল? এটাই কি সেই লোক যে ওকে ধোঁকা দিয়েছিল? তাহলে ওরই বোনের সাথে এতো মায়া কিসের? এগুলও কী কোনো ছলনা? নূর যেন গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছে। লোকটা কী এতই নিখুঁত অভিনয় জানে? নাকি ওরই কোথাও বোঝার ভুল আছে? না না,কোনো ভুল নেই। এই লোকটার কোনো ষড়যন্ত্রই আর সে সফল হতে দিবেনা।
রেহনুমা এতদিন পর ছেলেকে দেখে নিজেকে আটকাতে পারলেন না। আদিত্য যে টেবিলে বসেছিলো সেখানে গিয়ে ওর পাশে বসলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল,
–কেমন আছিস আদি? চেহারার একি হাল করে ফেলেছিস? আমাদের কথা কি একটুও মনে পরেনা তোর? এভাবে একা একা না থেকে বাড়ি ফিরে আয়না?
আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–যে পরিবারে থেকেও নিজেকে পর মনে হয় এমন পরিবারের চেয়ে একাই ভালো। শুধু শুধু আমার চিন্তা করতে হবে না তোমাদের। আমি যেমন আছি বেশ আছি। আফটার অল তোমাদের দেওয়া সুখইতো ভোগ করছি৷
–আর কতো রাগ করে থাকবি বাবা। অনেকতো হলো। জানি তোর সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু আমিতো একজন মা। ছেলের জন্য নাহয় একটু স্বার্থপর হয়েছিলাম। কিন্তু তোকেও আমি কম ভালোবাসি না। তুই আমার প্রথম সন্তান। তোকে এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে থাকতে দেখে আমারযে কলিজা পোড়ে। দেখ তোর খুশি ওই নূরের মাঝে তাইতো। ঠিক আছে তাহলে তোর চাওয়াই পূরণ করবো আমি। প্রথমে আমিই মানা করেছিলাম। কিন্তু এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি নিজে তোদের বিয়ের কথা বলবো। নূরের মায়ের সাথে কথা বলবো। এখনতো তারা আত্ময়ই হয়। আমি বললে নিশ্চয় উনি মানা করবেনা। তাহলেতো তুই খুশি? এমনিতেও মেয়েটা এখন আর আগের মতো নেই। এখনতো ওরও একটা নাম হয়েছে।
আদিত্য আবারও তাচ্ছিল্যপূর্ন এক অট্টহাসি দিয়ে বলল,
–ওয়াও,ওয়াও,ওয়াও লাইক রিয়েলি ওয়াও। মানে আর কতো,আর কতো তুমি ছেলের চোখে নিজেকে নিচে নামাবে? যে নূরের নাম শুনলেও তোমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগতো আজ তাকেই খুশিমনে মেনে নিচ্ছ? কেন, কারণ নূর আজ প্রতিষ্ঠিত বলে? তার এখন নামডাক হয়েছে দেখে?এখন তুমি তাকে সোসাইটির সামনে মাথা উঁচু করে দেখাতে পারবে বলে? বাহ, কি চিন্তা তোমার!
–না আদি,তুই ভুল বুঝছিস আমাকে। আমি সত্যিই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। কারণ আমি বুঝে গেছি তোর খুশি নূরের মাঝে। নূরকে ছাড়া তুই ভালো থাকতে পারবিনা। আমি আমার ছেলেকে এভাবে জীবনযাপন করতে দেখতে পারছিনা। নিজের ভুল শুধরে নিতে চাই আর সাথে তোর জীবনটাকেও।
আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–সরি টু ডিসিপয়েন্ট ইউ মা। সেই পথ তুমি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছ। নূরকে বিয়ে করে নিজের বউ করাটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন। থ্যাংকস টু ইউ এন্ড ইউর সান, সেই স্বপ্ন মাঝপথেই থেমে গেছে। এখন নূর আমাকে বিয়ে করাতো দূরের কথা। আমার মুখও দেখতে চায়না। জানি না নূরকে আর কখনো ফিরে পাবো কিনা তবে তোমার সামনে হাত জোর করে বলছি,প্লিজ আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও।তোমাদের যা করার ছিলো তা করে দিয়েছ এখন আমি নিজের টা নিজে বুঝে নিবো। আমাকে নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না। আর নূরের মাকেও কিছু বলতে হবে না।
বলেই উঠে চলে গেল আদিত্য। রেহনুমার ভারাক্রান্ত মন আরও ভারী হয়ে গেল। এটা কি করে ফেলেছে সে! নিজের হাতেই নিজের ছেলের খুশি কেঁড়ে নিয়েছি। আমি সত্যিই মা হওয়ার যোগ্য না।
বিয়ের অনুষ্ঠানে কমিউনিটি সেন্টারে কর্মরত এক নারী কর্মি কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ এক বেয়ারার হাতের বোল থেকে কিছুটা তরকারির ঝোল তার শাড়ীর ওপর পড়ে যায়। সেটা পরিষ্কার করতে সে ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুমের পাশেই একটু সাইডে গিয়ে আবির সি,গা,রে,টের নেশাটা একটু মিটিয়ে নিলো। হালকা সি,গা,রে,ট টেনে অর্ধ খাওয়া জ্বলন্ত সি,গা,রে,ট,টা হাতে নিয়ে আবির ফিরতে নিলে হঠাৎ দেয়ালে ডেকোরেশন করা তারের সাথে ওর শার্টে টান লেগে শার্টের ওপরের বোতাম ছিঁড়ে যায়। আবির শার্ট ছাড়িয়ে ছেঁড়া বোতামের দিকে তাকিয়ে বোতাম ঠিক করার চেষ্টা করতে করতে সামনে এগিয়ে এলো। অন্যদিকে সেই নারী কর্মিটি তার শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। আর এই নেহাৎ-ই কাকতালীয় ভাবে দুজনের এভাবে একসাথে আসাকে কোনো একজনের মস্তিষ্কে ভিন্নরকম এক কাহিনি তৈরী করে দিলো। সে হলো আহানা। আহানাও ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য এদিকেই আসছিলো। আর তখনই সে দেখতে পেল এই দৃশ্য। আর এই দৃশ্যের অন্য একটা মানে তৈরি করে নিলো তার মস্তিষ্ক। যদিও আবিরের ইমেজ অনুযায়ী এটা ভাবা খুব একটা অস্বাভাবিক না। এসব দেখে তার মনে যেন আবিরের প্রতি তীব্র ঘৃণার এক মহাপ্রলয় উপচে পড়লো। সীমাহীন ঘৃণার তিক্ততা জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো চোখে মুখে। দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো দুইপাশের লেহেঙ্গা। তিগ্ম বিষধর কন্ঠে এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ ঘৃণা স্বরুপ বলল,
–ছিহহহহহ্
আবির নিজের শার্টের বোতাম দেখছিলো। হঠাৎ এমন ঝংকার পূর্ণ আওয়াজ শুনে মাথা তুলে সামনে তাকালো সে। আহানাকে এভাবে ঘৃণিত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। আহানা বিষাক্ত কন্ঠে আবারও বলে উঠলো,
–ছিহহ্, শেষমেশ কাজের মেয়েদেরও ছাড় দিলেন না!! এতটা নিচ আপনি!
আবির আহানার এই রিয়্যাকশনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো একটা মেয়ে ওয়েট্রেস সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবির বুঝতে পারলো আহানা নিশ্চয় ওকে নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করছে। অন্য কেউ হলে হয়তো এখুনি আহানার ভুল ধারণা দূর করে দিতো। তবে আবির সেটা করবেনা। আজপর্যন্ত আহানার এতো প্রবল ঘৃণার বিষাক্ত নজর দেখেনি আবির। এটাতো তার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এই নজরের তীব্রতা আবিরকে অনাবিল আনন্দ দিচ্ছে। এই আনন্দের মাত্রা আরও বাড়াতে আবির এগিয়ে গেল আহানার কাছে। আহানার মুখের সামনে হালকা ঝুঁকে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–তোর ভাবনার থেকেও বেশি নিচ আমি। কী বলবো আন্নি,এসব মেয়েদের ব্যাপারই আলাদা। সী ইজ আ ফায়ার….
গা গুলিয়ে এলো আহানার। সারা পৃথিবীর ঘৃণা ভলকে উঠলো চোখের পাতায়। মাত্রাতিরিক্ত ঘৃণায় কণ্ঠনালীও যেন আঁটকে এলো তার। আবারও সেই একই শব্দ উচ্চারণ করলো সে,
–ছিহহ্
আবির এক হাত নিজের মুখের ওপর চেপে ধরে মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে প্রসন্নচিত্তে বলল,
–উফফ! উফফ! উফফ! কি দিলি আন্নি! কলিজাটা জাস্ট আইসক্রিম হয়ে গেল। তোর আজকের “ছিহ” টা জাস্ট প্রো লেভেলের ছিলো। কেমনে, মানে কেমনে করস তুই! এমন মাইন্ড বোলিং ছিহ এর জন্য তোকে নোবেল দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।আই সোয়্যার, আরেকবার এই প্রো লেভেলের ছিহহ্ শুনলে খুশিতে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবো। তাই আমি এখন যাই। এতো খুশি হজম করতে কষ্ট হচ্ছে আমার।
বলেই উল্টো ঘুরতে নিলো আবির। আহানার মন মস্তিষ্ক বিষে বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠলো। ঘৃণা, রাগ, কষ্ট মিলে এক ভয়ংকর অনুভূতির টর্নেডো বইতে লাগলো।অতিরিক্ত ক্ষোভের বশে আহানা তিক্ত স্বরে বলে উঠলো,
–আপনাকে চরিত্রহীন ভেবেছিলাম। তবে আপনি যে এতটা নিকৃষ্ট লোক তা কখনও ভাবিনি। আসলে আপনার কাছ থেকে আর আশাই কী করা যায়।চরিত্রহীনতা তো আপনার র,ক্তে মিশে আছে। যেখানে আপনার মা বাবাই এসব করে বেড়ায়, তাদের সন্তান হয়ে আপনার কাছ থেকে এরচেয়ে ভালো আর কী আশা করা যায়?
থমকে গেল আবিরের কদম। চেহারার রং হঠাৎই পাল্টে গেল।কঠিন হয়ে এলো চোখ মুখ। ঘুরে থাকায় তা দেখতে পেল না আহানা। আহানার কথার প্রতিত্তোরে আবিরের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হলোনা আহানার সামনে। তবে আবিরের হাতের মাঝে নির্মম ভাবে চেপে ধরা জ্বলন্ত সি,গা,রে,ট টা আর আহানার নজরে এলোনা। কিছুক্ষণ স্থির থেকে ঘাড় বাকিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো আবির। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আহানার পানে।আহানা হালকা ঘাবড়ে গেল। রাগের বশে এভাবে বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি। মানুষ যেমনই হোক, তারজন্য মা বাবা তোলা ঠিক হয়নি। আবির হয়তো এখন চরম রেগে যাবে। তবে আহানার ধারণাকে আবারও ভুল প্রমাণ করে, আবির হঠাৎ মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে সেই বিখ্যাত বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–বংশের ধারা বজায় রাখাতো একজন বংশধরের কর্তব্য। মা বাবার এই মহৎ কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে কেমন সন্তান হলাম! আমি আমার কর্তব্য পালন করতে সক্ষম হয়েছি এটা যেনে ধন্য হলাম। ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে আমার প্রশংসা করার জন্য।
আহানা আর পারলোনা এই জঘন্য লোকের সামনে থাকতে। নাহলে নির্ঘাত আজ ওর হাতে খু,ন হয়ে যাবে। এই নিকৃষ্ট লোককে মেরে নিজের হাত নোংরা করতে চায়না সে। তাই দ্রুত গতিতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো সে। আহানা যেতেই মুখভঙ্গি আবারও কঠিন হয়ে এলো আবিরের। হাতের মাঝে চেপে ধরা সি,গা,রে,ট টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। এখন আর এই সামান্য নেশায় কাজ হবেনা। এখন তীব্র নেশার প্রয়োজন ওর। সেই তাগিদে হল ছেড়ে বেড়িয়ে গেল আবির।
ফাংশন শেষে বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে হলের বাইরে এলো নূর। ইভান মিছরিকে নিয়ে আগেই চলে গেছে।মিছরির ঘুম পাচ্ছিল আর বাসায় মা অসুস্থ আছে। তাই ওরা আগে চলে গেছে। নূরও চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শিখার জোরাজুরিতে আর পারেনি। তাই শিখার বিদায়ের পালা শেষ করেই যেতে হচ্ছে ওকে। নূরের নজর না চাইতেও এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। হয়তো কাউকে দেখতে চাওয়ার বেয়াড়াপনা আবারও শুরু করেছে এই অবাধ্য নজর। ওই বদ লোকটা কী চলে গেছে? যাক গে, আমার কি? হঠাৎ ফট করে নূরের মুখের সামনে এসে দাঁড়াল আদিত্য। আচমকা এমন হওয়ায় নূর থতমত খেয়ে গেল। আদিত্য নূরের মুখের খুব কাছাকাছি গিয়ে বলল,
–আমাকেই খুঁজছিলে বুঝি? এতো মিস করছিলে? এতই যখন ভালোবাস তাহলে চাপিয়ে কেন রাখ?
নূর আমতাআমতা করে বলল,
–এমন কিছুই না। আপনাকে কেন মিস করতে যাবো আমি? আমিতো বাসায় যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি খুঁজছিলাম।
–আর কতো শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করবে? তোমার চোখ যেটা চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছে, তোমার মুখ কেন সেটা বলতে চাইছেনা? কেন নিজেকে আর আমাকে দুজনেই কষ্ট দিচ্ছো? একবার শুধু বলে দাওনা মনের কথা। সত্যি বলছি তারপর যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো।
নূর তিরস্কার করে বলল,
–মনে হচ্ছে মেন্টালি ডিস্টার্ব আছেন আপনি। ভাঙা টেপ রেকর্ডারের মতো একই রেকর্ড বারবার বাজিয়ে যাচ্ছেন। কতবার বলবো আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে ভালো টালো কিছু বাসিনা।
–আমি ভুল ভাবছিনা নূর। হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, ভালোবাসা বোঝা যায়। তুমিযে আমাকে অনেক ভালোবাসো সেটাও বুঝতে পারি আমি। শুধু তোমার স্বীকারোক্তির মোহর চাচ্ছি ব্যাস। আর তোমার স্বীকারোক্তি তো এবার আমি নিয়েই ছাড়বো। তারজন্য যা কিছু হয়ে যাকনা কেন।
–আপনি এক কাজ করুন। স্টাম্প পেপার নিয়ে আসুন। সেখানে আমি বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে সই করে দিবো। তারপর সেটা দেয়ালে টানিয়ে রেখে সকাল, দুপুর, রাত তিনবেলা দেখবেন। তাহলে হয়তো আপনার মানুষিক সমস্যা টা দূর হবে। লাস্ট টাইম বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি নাআআআ…..
বলেই নূর চলে যেতে নিলো। কয়েক কদম এগুতেই আদিত্য পেছন থেকে বলে উঠলো,
–সময় থাকতে বলে দাও নূর। নাহয় দেখা যাবে মনের কথাটা বলতে এতটাই দেরি করে ফেলেছ যে, সেটা বলার মানুষটাকেই আর পেলেনা।
থমকে গেল নূর। বুকের মাঝে ভয়াবহ এক কম্পন ঘটলো। পেছনে ফিরে তাকালো না নূর। সামনেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে দ্রুত পায়ে সেটাতে উঠে বসলো নূর। লোকটা আবারও তাকে বশিভূত করতে চাইছে। আবারও ভাঙতে চাইছে ওকে। কিন্তু এবার যতযাই হয়ে নূর নরম হবে না। বাঁধবে না আর ওই মায়াজালে।
চলবে….