#শেষ_শ্রাবণ
পর্বঃ৪
কিভাবে যে আমার দিনগুলো পার হচ্ছে সে কেবল আমি-ই জানি। একদিকে আম্মাকে দেওয়া কথা,ছোট্ট শ্রাবণ অন্যদিকে সাজ্জাদ। দিন দিন সাজ্জাদ যেনো আরো হিংসাত্মক হয়ে উঠছে ছোট্ট শ্রাবণের উপর। আমি বুঝিনা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কিভাবে একটা নিষ্পাপ বাচ্চার উপর এতো ক্ষোভ রাখতে পারে? দিন পার হচ্ছে আর সাজ্জাদ যেনো শ্রাবণকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা শুরু করেছে। তার মতে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য ছোট্ট বাচ্চাটি দায়ী। আমি যখনই প্রতিবাদ করি যে, তার মা কে বড় ছেলে হয়ে সে নিজেই বা কি প্রতিদান দিয়েছে তখনই সাজ্জাদের নিকৃষ্ট রাগ আমি দেখতে পাই। আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে, কিভাবে আমি এমন একজন লোকের সাথে সংসার করবো সারাজীবন? কিন্তু এই সংসার ছেড়ে আমি যাবোই বা কিভাবে? আমি যে আম্মাকে কথা দিয়েছি যে কোনো মূল্যে তার কলিজার টুকরো ছেলেটাকে আমি আগলে রাখবো।

এভাবে দিন যাচ্ছিলো। ছোট্ট শ্রাবণ এখন ছয় মাসের শিশু। বাবা এই বয়সে যেভাবে ছোট্ট বাচ্চার লালন পালনের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন আমি অবাক হয়ে দেখি।ভেজা কাঁথা পালটানো,খাওয়ানো সব বাবা করেন। সাজ্জাদ বাড়ি না থাকলে আমিও বাবাকে সাহায্য করি। কিন্তু বেশির ভাগ কাজ বাবা-ই করেন। আমি যে সাজ্জাদের রাগকে ভয় পাই তা নয়। তবে ও রেগে যেয়ে এমন কুৎসিত ভাষায় ঝগড়া শুরু করে দেয়, আমি চাইনা বাবা এই বয়সে ওসব কথা সহ্য করুক। এমনিতে মানুষটার প্রতিটা দিন প্রিয়তমা হারানোর ব্যথায় কতোটা কষ্টে যাচ্ছে,তার উপর এসব আমি বাবাকে শোনাতে চাইনা। তাই সাজ্জাদ যতক্ষণ বাড়ি থাকে আমি আমার ঘরেই চুপ করে বসে থাকি। ও চলে গেলে আমি বাবাকে সাহায্য করি যতোটুকু পারি। তবে সোহেলীর ধীরে ধীরে বেশ পরিবর্তন এসেছে। প্রথম প্রথম মায়ের মৃত্যুতে বেশ ভেঙ্গে পড়লেও এখন শ্রাবণকে সে বেশ ভালোবাসতে শুরু করেছে। যতোটুকু সময় ক্লাস থাকে ঠিক ততটুকু সময়ই সে ভার্সিটি থাকে,এরপরই বাসায় ফিরে আসে। আগে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো ক্যাম্পাসে বসে, এখন আর তা করেনা। শ্রাবণকে রাতে নিজের কাছে রাখে। অবশ্য শ্রাবণকে ভালো না বেসে থাকার উপায়টাই তো নেই। এতো শান্ত লক্ষী বাচ্চা খুব কমই দেখা যায়। হয়তো সে বুঝে গিয়েছে এই পৃথিবীটায় তার মা নেই। আর মা শুন্য পৃথিবী সন্তানের অনুকূল স্থান হয়না। হয়তো ভালোবাসার অনেকেই থাকে,কিন্তু মায়ের অভাব যে কিছু দিয়ে পূরণ হয়না। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝি এটা বুঝে নিতে শিখেছে।

এরই মধ্যে একদিন সাজ্জাদ আমার কাছে সংসারের খরচের হিসাব চায়। সাজ্জাদের একটা বিষয় ছিলো, সে বেতন পেয়ে পুরোটা বাবার হাতে তুলে দিতো। বাবা-ই সংসার চালাতেন সেই টাকায়। কিন্তু এসব ঘটনার পর বাবা আর সাজ্জাদের টাকা হাতে নেন না। তাই আমার কাছেই সাজ্জাদ টাকা রাখে। কখনো সেভাবে হিসাব চায়না। সেদিন সকালে হঠাৎ করে সাজ্জাদ আমাকে ডাকে।
“বলো কি বলবে।”
“যা জিজ্ঞেস করবো সরাসরি উত্তর দিবে। কোনো ভণিতা করবে না।”
“তোমার সাথে ভণিতা করার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। কি বলতে চাও বলো।”
“হ্যা তাই তো, এখন তো স্বামীকে ভালো লাগবে না। স্বামীর চেয়ে শ্বশুরবাড়ির প্রতি টান বেশি। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি কথা আছে না? তোমার হয়েছে সেই অবস্থা।”
আমি বুঝতে পারি সাজ্জাদ আবার শুরু করতে যাচ্ছে তার কুৎসিত আচরণ। তাই আমি আর কথা বাড়াই না। চুপ করে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর সাজ্জাদই শুরু করে,”তো যা বলছিলাম। প্রতিমাসে আগে যা খরচ হতো,বিগত কিছু মাস থেকে তার থেকে তিন/চার হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে কেনো প্রতিমাসে?”
আমি অবাক হয়ে যাই সাজ্জাদের কথা শুনে। যে কোনোদিন কোনো টাকার হিসাব চায়নি আমার কাছে। হঠাৎ করে কেনো এগুলো বলছে?
“কি হলো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দাও।”
কি উত্তর দিবো আমি? শ্রাবণের খাবার আলাদা। সেগুলো কিনতেই কিছু টাকা বেশি লাগে প্রতিমাসে। বাবার চাকরিটা ছিলো বেসরকারি। এককালীন কিছু টাকা পেলেও, প্রতিমাসে তার কোনো আয় নেই সেভাবে। আমি ভেবেছিলাম সাজ্জাদ এসবের খোঁজ নিবে না কখনো। কিন্তু ও যে এভাবে আমাকে ডেকে এসব জিজ্ঞাসা করবে আমি কখনো ভাবিনি। আমি মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
“দেখো রুমকি, একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো। বাবা, তুমি, সোহেলী এরা আমার দায়িত্ব। তাদের জন্য আমি টাকা খরচ করবো। তাই বলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে না আমার টাকা দিয়ে। সাবধান করে দিলাম।”
আমার মাথা গরম হয়ে উঠলো। সামান্য চিৎকার করে বললাম,”আর শ্রাবণ? সে তোমার দায়িত্ব নয়?”
সাজ্জাদ কঠিন গলায় বললো,”না।”
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি,এতোটা খারাপ কিভাবে হয় একটা মানুষ? এমন না যে সে কম উপার্জন করে। বেশ ভালো টাকাই মাস গেলে সংসারে আসে,যা বেশিই হয়ে যায় আমাদের জন্য। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে টপটপ করে। আমি খুব করে চাচ্ছিলাম এসব কথা যেনো বাবার কানে না যায়। আমি ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নিতাম। কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলো না। সাজ্জাদ দরজার কাছে যেয়ে জোরে জোরে আমার উদ্দেশ্য বললো,”পরের মাস থেকে কোনো ফালতু খরচে যেনো আমার টাকা খরচ না হয়। এটা মাথায় রাখবে।” সাজ্জাদ এমন ভাবে কথাটা বললো যাতে বাবার কানে যায়। আমার যেনো অবাক হবার সীমাও অতিক্রম করে গেছে। এই সাজ্জাদই কিছুদিন আগে মায়ের মৃত্যুতে কিভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। এতোটা নিচে কিভাবে কেউ নামতে পারে?
আমার বাবার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। শ্রাবণের খাবার প্রায় শেষ হয়ে গেছে, কথা ছিলো সাজ্জাদ আজকে সংসার খরচ আমার হাতে দিলে আমি বাবাকে সেখান থেকে শ্রাবণের খাবারের টাকা দিবো,বাবা কিনে আনবেন। কিন্তু আমি এখন কিভাবে বাবার সামনে যেয়ে দাঁড়াবো?
“মামণি।”
বাবা নিজে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার ঘরের সামনে। আমি চোখ মুছে তাড়াতাড়ি উঠে আসি। আস্তে করে বলি,”বাবা কিছু বলবেন?”
“আমি শ্রাবণের খাবার কিনতে যাচ্ছি। তুমি একটু ওকে দেখো।”
“কিন্তু বাবা, টাকাটা…”
বাবা আমাকে থামিয়ে দেন,কথা শেষ করতে দেন না
“মা রে, সন্তান আমার। সাজ্জাদ সোহেলী যেমন আমার সন্তান। শ্রাবণও আমার সন্তান। ওদের যেভাবে মানুষ করেছি আমার দায়িত্ব শ্রাবণকেও সেভাবে মানুষ করা।সাজ্জাদ তার ভাইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেই পারে। কিন্তু বাবা হয়ে আমি কিভাবে সন্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই বলো?” শেষের কথাটা বলার সময় বাবার গলাটা একটু ধরে আসে। আমি তাকিয়ে থাকি বাবার দিকে।
“কিন্তু বাবা আপনি কোথায় টাকা পাবেন?”
“আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করে দিবেন মা, ও তুমি ভেবো না।”
এই বলে বাবা চলে যাচ্ছিলেন। আমি পিছন থেকে তাকে ডাকলাম,”বাবা একটু দাঁড়ান।”
বিয়ের আগে থেকেই টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং কাজ করি আমি। বিয়ের পর সেভাবে সময় না পেলেও মাঝে মাঝে করা হয়। তার থেকে পাওয়া কিছু টাকা আমার কাছে ছিলো। আমি সেই টাকাটা বাবার হাতে তুলে এনে দিই। “বাবা এটা রাখেন। এটা আমি দিলাম আমার ছোট্ট শ্রাবণের জন্য।”
বাবা ব্যস্ত হয়ে বলেন,”না না মামণি,সাজ্জাদের এক টাকাও আমি আমার শ্রাবণের জন্য খরচ করবো না।”
“বাবা এটা সাজ্জাদের টাকা নয়। আমার টাকা। দয়া করে আমাকে কিছু করার সুযোগ দিন শ্রাবণের জন্য। নাহলে যে আম্মাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারবো না। আপনি না করবেন না বাবা।”
বাবার চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে। চোখ মুছে বলে,”মা তোমার কাছে তো আমি দিন দিন আরো ঋণী হয়ে যাচ্ছি।”
“আপনি আমাকে মা বলে ডাকেন বাবা। আমি আপনার মা। মা হয়ে এটুকু করবো না?।”
বাবা আমার মাথায় হাত রেখে ঝরঝর করে কেঁদে দেন।

এরমধ্যে আমাদের জীবনে প্রায় দুইটা বছর কেটে গেলো। সাজ্জাদ শ্রাবণের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসেনি। শ্রাবণ এখন হাঁটতে শিখেছে। ছোট্ট ছোট্ট পা দুটো দিয়ে যখন সারাঘরে দৌড়ে বেড়ায় কি যে মিষ্টি লাগে দেখতে। তার যতো খুশি,আবদার যেনো আমাকে ঘিরে। আমি রান্নাঘরে থাকি বা ছাদে,একটু পর পর দৌড়ে যেয়ে আমাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরবে। আমি যখনই বলবো,”এইটা কি আমার ছোট্ট শ্রাবণ বাবু?” লজ্জায় মুখ লুকায় তখন সে। দূরে যেয়ে খিলখিল করে হাসে আমার দিকে তাকিয়ে। সেই হাসি মুখটায় আমি যেনো আম্মাকে দেখতে পাই। ঠিক যেনো আম্মা হাসছেন।উদাস হয়ে যাই আমি সেদিকে তাকিয়ে। আর ভাবি, সাজ্জাদ কেমন মানুষ? বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে কি নিজের মা কে দেখা যায়না? শ্রাবণ বড্ড ভয় পায় সাজ্জাদকে। সে কখনো সাজ্জাদের সামনে পড়তে চায়না। যতোক্ষণ সাজ্জাদ বাড়ি থাকে ও বাবা বা সোহেলীর কাছে থাকে। আমার কাছেও খুব একটা আসে না। অজানা এক ভয়ে ও কুঁকড়ে থাকে সাজ্জাদকে দেখলে। ছোট বাচ্চারা বুঝতে পারে অনেক কিছুই, হয়তো সে বুঝে গেছে তার কপালে ভাইয়ের আদর নেই। কিন্তু শ্রাবণ এখনো কোনো কথা বলে না। এই বয়সের বাচ্চারা আধো আধো বুলিতে অনেক কথা বলে। কিন্তু শ্রাবণ এগুলোর কিছুই বলে না। শুধু হাসে। বাবা মাঝে মাঝে বেশ দুশ্চিন্তা করেন এই ব্যাপারে। আমি বাবাকে বুঝাই কোনো কোনো বাচ্চা দেরিতে কথা বলা শিখে,এটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু বাবার দুশ্চিন্তা কমে না।

কিন্তু আমার জীবনে এর মধ্যে অনেক বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়, যা আমার জীবনটাকে ওলোট পালোট করে দেয় এক মুহুর্তে।
আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই খবরটা আমি আমার খুব কাছের মানুষ ছাড়া আর কাউকে জানাইনি। এই পাঁচ মাসে আমি যেনো সাজ্জাদকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। আমাকে যেনো পারলে মাথায় তুলে রাখে। আমাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। কাজ করার জন্য একজন সহকারী পর্যন্ত রেখেছে সে। খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। আমার কখন কি লাগবে,কখন কি খেতে ইচ্ছা করে সবকিছুর খোঁজ সে রাখে। বাবা খুব খুশি হন এগুলো দেখে। কিন্তু আমার কাছে বারবার করে আম্মার মুখটা মনে পড়ে। এই একই সময় আম্মাও পার করেছেন,কই তখন তো সাজ্জাদ এমন করেনি। বরং তাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছে। মায়ের জন্য যেটা করতে পারেনি,স্ত্রীর জন্য কেনো করবে সে? এই জিনিসটা আমি মাঝে মাঝে মেনে নিতে পারিনা। সাজ্জাদের এতো ভালোবাসা আমার ভালো লাগলেও আগের কিছু স্মৃতি আমার মনে পড়ে যায়। শ্রাবণের সাথে এখনো তার সম্পর্ক আগের মতোই। বাবার সাথেও প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি কথা বলে না।
আমার মা মাঝে মাঝেই আমাকে দেখতে আসেন। আমাকে তার নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চান। সাজ্জাদও তাই চায়,কারণ আমাদের বাড়ি অনেকটা কাছেই। সাজ্জাদ অফিস থেকে ওখানে যেতে পারবে। কিন্তু আমি এই সংসার থেকে একদিনও অন্য কোথাও যেতে নারাজ। আমি চলে গেলে শ্রাবণকে কে দেখবে? বাবাকে কে দেখবে? এই সংসার আমার প্রাণ। আমি এখান থেকে কোথাও যেতে চাইনা। এই নিয়ে আমার মায়ের খুব ক্ষোভ আমার উপর। তিনি ভীষণ বিরক্ত হন আমার এসব কথায় সে আমি বেশ বুঝতে পারি,কিন্তু তবুও আমি কোথাও যাবো না। মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে মা আর কিছু বলেন না। তবে প্রায় প্রতিদিনই আমাকে দেখতে আসেন এ বাড়ি। আমার পছন্দের খাবার বানিয়ে আনেন।তবে কোনো এক অজানা কারণে আমার মা ও শ্রাবণকে পছন্দ করেন না। আমার কাছে আসলেই মা ওকে চলে যেতে বলেন। একদিন থাকতে না পেরে আমি বলি,”মা তুমি এমন করো কেনো ও আমার কাছে আসলে? তোমাকে তো বিরক্ত করছে না ও।”
মা রাগ দেখিয়ে বলেন,”এখন তোমার খুবই নাজুক সময়। এই সময় ছোটখাটো আঘাত ভয়ানক কিছু হতে পারে। ছোট বাচ্চা,খেলতে যেয়ে কখন আঘাত করে বসবে,তার ঠিক আছে?” আমি হেসে দিই। শ্রাবণকে কাছে বসিয়ে ওর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলি,”শ্রাবণ ওরকম বাচ্চাই না মা। ও অনেক শান্ত।”
মা কিছু বলেন না, রাগী রাগী মুখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ঘটনার দিন সকালে সাজ্জাদ অফিসে যাওয়ার পর আমি যথারীতি ছাদে যাই কাপড় মেলতে। যদিও এই কাজ আমার করা নিষেধ, সাজ্জাদ জানলে খুব রাগ করবে। তবুও সারাদিন ঘরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগেনা। তাই কাউকে না জানিয়েই ছাদে চলে যাই আমি। আমার পিছু পিছু শ্রাবণও যায় আমার সাথে। আমি কাপড় মেলছিলাম আর শ্রাবণ নিজের মতো করে খেলছিলো। হঠাৎ একটা ইটের টুকরোতে পা বেঁধে আমি পড়ে যাই। ব্যথায় চিৎকার করে উঠি আমি। শ্রাবণ তখন কিছুটা দূরে বসে খেলছিলো।আমার চিৎকার শুনে ছুটে আসে আমার কাছে। আমি তখন কোনোদিকে তাকাতে পারছি না। অসহ্য যন্ত্রণায় মনে হচ্ছে আমি মরে যাবো যে কোনো মুহুর্তে। শ্রাবণ ভয় পেয়ে যায় আমাকে দেখে। কিছুক্ষণ ছটফট করতে থাকে। আমি জোরে জোরে বাবাকে আর সোহেলীকে ডাকি। কিন্তু দোতলার ছাদ থেকে নিচতলা পর্যন্ত আমার চিৎকার পৌঁছায় না। আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে ব্যথায়। ওঠার মতো শক্তিটুকু আমার নেই। আমি শুধু শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলি,”শ্রাবণরে আমি মনে হয় আর বাঁচবো না রে।” আমি জানিনা অতোটুকু বাচ্চা কি বুঝলো। যে এতোদিন কোনো কথা বলেনি, সে আকাশ কাঁপয়ে চিৎকার করে ওঠে,”মা।”
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই শ্রাবণের ডাক শুনে। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। আস্তে আস্তে শ্রাবণের মুখটা ঝাপসা হয়ে আসে আমার কাছে। আমি জ্ঞান হারাই।

যখন জ্ঞান ফেরে আমি নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পাই। আমার শরীর তখন ব্যথায় অবশ। হাত পা নাড়াতে পর্যন্ত পারছি না। দেখি পাশে আমার মা কাঁদছেন মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। সাজ্জাদ আমার পায়ের কাছে বসে আছে। তার চোখমুখ অন্ধকার, মনে হলো কেঁদেছে। সোহেলীও পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আর দরজায় বাবা দাঁড়িয়ে আছেন তার পাশে ছোট্ট শ্রাবণ। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম আমি। কি হলো সবাই কাঁদছে কেনো?
আমার কথা বলার শক্তি নেই। তবুও অনেক কষ্ট করে আস্তে করে বলি,”কি হয়েছে? সবাই কাঁদছো কেনো?”
আমার কথা শুনে আমার মা আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।”আমার মেয়েটার এ কি হলো আল্লাহ, আমার ফুলের মতো মেয়েটার এ কি হলো?” আমি মায়ের কথা কিছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার পেটে প্রচন্ড ব্যথা, কেমন যেনো বুকটা কেঁপে উঠলো আমার। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম,” আমার বাচ্চা? আমার বাচ্চা কোথায়? ও মা, আমার বাচ্চা কোথায়?” কেউ কোনো কথা বলেনা। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সবাই। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনিও কাঁদছেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আমি আর সহ্য করতে পারিনা। স্যালাইনের সুঁচ ছিড়ে উঠে বসতে গেলে সাজ্জাদ এসে আমাকে থামায়। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলে,”আমাদের নিষ্পাপ সন্তান জান্নাতের পাখি হয়ে গেছে রুমকি।”
আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। বিশ্বাস করতে পারিনা। আমার মনে হয় আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি।এক্ষুনি স্বপ্নটা ভেঙে যাবে, আর দেখতে পাবো এমন কিছুই হয়নি। সবাই কাঁদছে। আমার মনে হচ্ছে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে আমার। সাজ্জাদ এসে আমার মাথা ওর বুকে চেপে ধরে। আমার সামনে সারা দুনিয়া ঘুরছে মনে হচ্ছে। কি হয়ে গেলো এটা? কেনো হলো? এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। আমি সহ্য করতে পারছি না। চিৎকার করে কেঁদে দিই আমি। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সাজ্জাদকে জড়িয়ে ধরি। সাজ্জাদ কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলে,”শান্ত হও রুমকি,শান্ত হও। এমন করো না প্লিজ।তুমি অসুস্থ।” অনেক কথা বলতে থাকে সে। আমার কানে কোনো কথা যায় না। আমার মনে হচ্ছে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আমি তো কোনোদিন কারো কোনো ক্ষতি করিনি, আমার সাথে কেনো এটা হলো? কোনোভাবে মানতে পারছি না আমি। শারীরিক যন্ত্রণার থেকে আমার মানসিক যন্ত্রণা বেশি কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে।
মা ও কাঁদছেন,আমাকে এসে বললেন,”রুমকি, মা আমার। শান্ত হ। তোর শরীর এখন খুব খারাপ। এমন করলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবি। ডাক্তার বলেছে এখন কোনোভাবে তোকে উত্তেজিত করা যাবে না।” কিন্তু কোনোভাবে আমার চিৎকার কমে না।

“মা” হঠাৎ মাত্র একটা ডাকে আমার চিৎকার থামে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি আমার ছোট্ট শ্রাবণ তার নরম নরম হাতটা দিয়ে আমার আঙুল এসে ছুঁয়েছে। কি মিষ্টি করে ডাকছে,”মা।” আমার ভিতরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। সাজ্জাদ আজ আর কিছু বললো না ওকে,সোহেলী ওকে আমার কাছে বসিয়ে দিলো। আমি বিস্ফারিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আর শ্রাবণও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
সোহেলী জানালো,”ভাবী আজ ও না থাকলে কি হতো আমাদের জানা নেই।”
বাবা ওকে থামালেন,”থাক না সোহেলী। এখন মামণিকে এসব কথা বলার দরকার নেই। ও সুস্থ হোক। একটা ধাক্কা সামলে নিক আগে। পরে বলো এসব।”
বাবার দিকে তাকাই আমি। “বাবা আমাকে বলুন,কি হয়েছিলো?আমি শুনতে চাই”
সোহেলী বলে,”ভাবী আমি তখন আমার ঘরে ছিলাম,বাবাও বাবার ঘরে। হঠাৎ শ্রাবণ নিচে নেমে এসে খুব চিৎকার শুরু করে দেয়। আমি আর বাবা ছুটে আসি ওর কাছে। সবসময় এতো শান্ত, চুপচাপ ছেলেটা হঠাৎ এমন করছে কেনো? আমরা ভাবলাম মনে হয় ওর শরীর খারাপ করেছে। আমরা অস্থির হয়ে যাই। বাবা ওকে জিজ্ঞেস করেন অনেক কিছু। কোথায় খারাপ লাগছে,কি হয়েছে। ও কিচ্ছু বলতে পারে না। শুধু চিৎকার করতে থাকে। আর আঙুল দিয়ে সিঁড়ির দিকে দেখায়। আমরা তাও কিছু বুঝতে পারিনা। হঠাৎ করে শুনি ও বলছে, মা মা। আর আঙুল দিয়ে ইশারা করছে ছাদের দিকে। আমরা তো স্তম্ভিত হয়ে যাই। ওর মা ডাক শুনে। অনেকক্ষণ বুঝতে পারিনা ও কি বলছে। হঠাৎ আমার মনে পড়ে তুমি তো গিয়েছিলে ওকে নিয়ে ছাদে। তুমি এখনো কেনো আসোনি। আমি আর বাবা এক ছুটে ছাদে চলে আসি। আর ওখানে তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পাই। বাবা সাথে সাথে তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। সিএনজি ডেকে আনেন,আর এরপর তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।” সোহেলী একটু থামে। আমার হাতপা তখনো কাঁপছে। আমি শ্রাবণের দিকে তাকাই। ও এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে মায়া মায়া চোখে।
সোহেলী আবার বলে,”জানো ভাবী,ডাক্তার বলেছে আর কিছুক্ষণ দেরী হলে তোমার প্রাণনাশের আশংকা পর্যন্ত ছিলো। আল্লাহর দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া, শ্রাবণ এতোটুকু বয়সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে।”
আমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়না। আমি সাজ্জাদের দিকে তাকাই, ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। আমি শ্রাবণকে আস্তে আস্তে বলি,”কি বলে ডাকলি আমাকে, আরেকবার ডাকবি?”
শ্রাবণ ভয়ে ভয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকায়। কোনো কথা বলেনা। আমি আবার বলি,”একটু ডাক না আমাকে,কি বলে ডাকলি।”
শ্রাবণ আস্তে করে বলে,”মা।”
আমার বুক কেঁপে ওঠে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। সোহেলী এসে শ্রাবণের মাথায় হাত দিতে বলে,” মা কি রে শ্রাবণ? মা নয় বলো ভাবী মা। উনি আজ থেকে তোমার ভাবী মা।”
এতো বড় শব্দ থোড়াই ও বলতে পারে? ও সোহেলীর দিকে তাকালো, বুঝতে পারলো না এতো কঠিন শব্দ। আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”মা মা।” আমি ওকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। আম্মা তার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ উপহার আমার হাতে দিয়ে গিয়েছেন।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here