শেষটা_সুন্দর পর্ব____০৪ (বোনাস পার্ট)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
দুরুদুরু বুকে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তরী।নির্ঝরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস তার নেই।হাতের খাবারের প্যাকেট গুলো শক্ত করে চেপে ধরে শরীরের কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল।
মাথা নিচু করেই বিছানার পাশের টুলটাতে খাবারের প্যাকেটগুলো রাখলো।পানির বোতলটা একপাশে রেখে দ্রুত পেছন ঘুরে দাঁড়াল।উদ্দেশ্য এখান থেকে পালিয়ে যা-ওয়া!দু পা এগোতেই পেছন থেকে কেউ ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
‘এই মেয়ে!’
তরীর পা থেমে গেল।হার্টের গতিবিধি বেড়ে গেল।চারিদিক থেকে ভয়ের আভাস এসে যেন তাকে বরফের মতো জেঁকে ধরলো।চোখ বন্ধ করে মুখ অল্প হাঁ করে শ্বাস নিল সে।পেছন না ঘুরে কম্পিত কন্ঠে বলল,
‘খাবার গুলো খেয়ে নিন আপনি!’
‘পেছন ঘুরে আছো কেন?এদিকে!এদিকে, আমার দিকে তাকাও!’
পেছনের কন্ঠস্বরের তীব্রতা বেড়ে চলেছে।তরী বড় করে ঢোক গিলে চোখ খুলল।জোরপূর্বক ঘুরে দাঁড়াল।ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে বিছানার দিকে তাকালো।নির্ঝর দু হাত বুকে ভাঁজ করে তার দিকেই চেয়ে আছে।ফর্সা মুখটা কেমন পান্ডুর মতো গেছে।অনেক রক্ত বের হয়েছে!
তরীর নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।কি থেকে কি করে ফেললো সে!এতটা অবুঝ না হলেও পারতো।কয়েক সেকেন্ড নির্ঝরের দিকে চেয়ে থেকে গুটিগুটি পায়ে, বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।নির্ঝরের কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেমে গেল।হঠাৎ ধপাস করে ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলো।
তরীর জলতরঙ্গের মতো কান্নার শব্দে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল নির্ঝর।এই মেয়ের সবকিছু এত অদ্ভুত কেন?এই রুদ্রমূর্তি,তো এই কান্না!সে ঝটপট তরীর দিকে এগিয়ে আসতে নিতে তরীর কান্নামিশ্রিত নাঁকি সুর কানে এলো।তরী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আমি ভেবেছিলাম আপনি মরে গেছেন!এতটা সময় সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরছিল যে আমি একটা খুন করেছি।একটা মানুষকে মেরে ফেলেছি।কি করে করলাম আমি?আমি অপরাধী!আমার জেল হবে, ফাঁসি হবে।সবাই ছি ছি করবে!আপনি মরে না গিয়ে ভালো করেছেন।’
তরীর এহেন কথা শুনে নির্ঝর স্তব্ধ হয়ে গেল।আর এগিয়ে গেল না।পুনরায় বালিশের উপর হেলান দিয়ে বসে পড়লো।হাতদুটো বুকে ভাঁজ করে বলল,
‘এই মেয়ে।কান্না করছো কেন?কে তুমি?’
”কে তুমি” বাক্যটা কানে যেতেই তরীর কান্না থেমে গেল।চোখে মুখের সর্বত্র এসে ভর করলো অবাকত্ব।চোখ উল্টে বলল,
‘কি বললেন?মাত্র কি বললেন যেন?’
‘জিগ্যেস করলাম কে তুমি?’
তরী একলাফে উঠে দাঁড়ালো।হাতের উল্টো পিঠে গাল মুছে এগিয়ে এলো।বিছানার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নির্ঝরের দিকে সামান্য ঝুঁকে দাঁড়াল।নিজের মুখের দিকে ডান হাতের একটা আঙুল তুলে বলল,
‘আমায় চিনতে পারছেন না আপনি?’
নির্ঝর নিজের মাথাটা একটু পিছিয়ে নিল।সাবলীল ভাবে বলল,
‘চেনার কথা নাকি?’
‘হ্যাঁ, চেনার কথা।অবশ্যই চেনার কথা।আমি তরী!আপনার বড় মায়ের একমাত্র ভাইঝি আমি!চিনতে পারছেন না?’
নির্ঝর সুবোধ বালকের মতো মাথা ডানে বায়ে কাত করলো।অর্থাৎ সে চিনতে পারছে না।তরীর চোখে মুখে পুনরায় আতংক ছড়িয়ে পড়লো।মাথায় আঘাত লেগে স্মৃতি হারিয়ে গেল?এখন কি হবে!ফুপি কি জানে যে নির্ঝর ভাই সব ভুলে গেছে?
সে ঠোঁট কামড়ে বিছানার কাছে থেকে সরে আসলো।রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে হঠাৎ করেই থেমে গেল।পুনরায় নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গিয়ে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি সব ভুলে গেছেন নির্ঝর ভাই?আপনার নাম-ধাম,বাবা-মা, বড় মা, বড় বাবা, আপনার বন্ধু-বান্ধব সব?সব মানে সব?’
‘নাহ!সবাইকে ভুলিনি।সব মনে আছে।ডাক্তার বলেছে, মাথার আঘাতের জন্য অল্প অল্প স্মৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।শর্ট টাইম মেমোরি লস যাকে বলে!কিছুটা সময় গেলে সেগুলো রিগেইন হবে।আপাতত আমার হারিয়ে যাওয়া অল্প স্মৃতির মধ্যে বোধ হয় তুমি!তোমাকে ভুলে গেছি।’
‘শুধু আমাকে ভুলে গেছেন?’
‘হুঁ!শুধু তোমাকে!’
তরী অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নির্ঝরের মুখ পানে চেয়ে রইলো।শর্ট টাইম মেমোরি লসের কথা সে এর আগে শুনেছে।একটুপর তার কুঁচকানো কপাল শিথিল হয়ে আসলো।থমথমে মুখের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ভুবনভুলানো হাসিটা ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সেই হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়লো।সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল,
‘তার মানে আপনাকে কে আঘাত করেছে সেটা মনে নেই!আপনি জানেন না কে আঘাত করেছে, তাই তো?শোকর আলহামদুলিল্লাহ।আমি অনেক খুশি!সবই আল্লাহর মেহেরবানি!আমি তো ভ……..’
মাঝপথে তরীকে থামিয়ে দিয়ে নির্ঝর কঠিন গলায় বলল,
‘থামো!একটু দম নাও!কার বদৌলতে আমি হসপিটালাইজড হয়েছি সেটা বড় মা বলেছে।বলেছে যে, তরী মানে তুমি আমার মাথায় আঘাত করেছ!এবার বলো কেন মাথায় আঘাত করেছ?কি করেছিলাম আমি? ‘
তরীর মুখটা চুপসে গেল।কিছু বলার চেষ্টা করেও পেরে উঠলো না।আস্তে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো।কিছুদূর পিছাতে নির্ঝর এক ধমকে তাকে স্ট্যাচুর মতো থামিয়ে দিল।নিজের ফর্মে ফিরে বলল,
‘মিস তরী!আপনার জন্য আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতিগুলো হারিয়ে ফেলেছি।আমার মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। এখন আমি সহজে কিছু মনে রাখতে পারবো না।মাঝে মধ্যে সব ভুলে যাব।এখন আপনি বলুন, আমার মতো এমন স্মৃতিকানা মানুষকে কে বিয়ে করবে?কে আমার সারাজীবনের দায়িত্ব নিবে?’
তরী কাঁদো কাঁদো স্বরে হাতজোড় করে বলল,
‘খুবই দুঃখীত।আমায় ক্ষমা করুন।প্লিজ মাফ করে দিন।’
নির্ঝর বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,
‘মাফ করার প্রশ্নই আসে না।স্মৃতি হারানো এই নির্ঝর শাহরিয়ারের দায়িত্ব তুমি নিবে।সারাজীবনের জন্য।বুঝতে পেরেছ?’
‘কিহ!’
‘হ্যাঁ,তুমি।কিভাবে দায়িত্ব নিবে সেটা জানি না।দায়িত্ব তোমাকে নিতেই হবে।না হলে মার্ডার কেসের আসামী করে জেলের ফুটবলসম ভাত খাইয়ে ছাড়বো।জেলের ভাত গলা দিয়ে নামবে তো?’
‘আ-আমি কিভাবে দায়িত্ব নিবো?’
নির্ঝর বিছানা ছেড়ে উঠতে নিতে মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠলো।এক হাতে বিছানার চাদর খামচে ভারসাম্য বজায় রাখলো।আরেক হাতে মাথা স্পর্শ করে চাপা আর্তনাদ করে।
তরী বাতাসের গতিতে এগিয়ে এলো।নির্ঝরের দু কাঁধ চেপে ধরে ভয়ানক চিন্তিত গলায় বলল,
‘এমন নড়াচড়া করছেন কেন আপনি?চুপচাপ শুয়ে থাকুন।’
নির্ঝর শরীর দুলিয়ে তরীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।কপাল কুঁচকে বলল,
‘চুপচাপ শুয়ে থাকবো মানে?আমি চুপচাপ শুয়ে থাকার অবস্থায় আছি নাকি?স্মৃতিকানা হয়ে গেছি।বউ পাব না এখন আমি!কেউ বিয়ে করবে না আমায় এখন।বুঝতে পেরেছ তুমি?আমাকে সারাজীবন চোখবুড়ো মানে আইবুড়ো থাকতে হবে।’
তরী একের পর এক বিস্ময়ের ঢেউয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।অল্প সময়ের ব্যবধানে এত এত ঘটনা মস্তিষ্ক নিতে পারছে না।সে হাঁপিয়ে উঠেছে।নির্ঝর শাহরিয়ারের কোন চরিত্র এটা?এটা তো তার স্বভাব বর্হিভূত মনে হচ্ছে।এত কথা তো উনি বলার মতো মানুষ নয়!মাথায় আঘাত পেয়ে নির্ঝর কি পাগল হয়ে গেছে নাকি সে আঘাত করে সে নিজেই পাগল হয়ে গেছে?চারপাশ কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
তরীর আত্মবিশ্বাসে যেন চিড় ধরেছে।সে অগোছালো ভাবে নির্ঝরের কাঁধের কাছে খামচে ধরলো।জোরপূর্বক বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল,
‘এভাবে শুয়ে থাকুন।’
‘থাকবো না।তুমি হাত সরাও!ব্যথা পাচ্ছি।নখ দিয়ে মাংস তুলে নিবে নাকি?’
আচমকা তরীর নিজের কাঁধের কথা স্মরণে এলো।সিঁড়ি দিয়ে নামানোর সময় নির্ঝর এভাবে তার গলা,ঘাড় আঁকড়ে ধরেছিল।তখনই বোধ হয় নখ ডেবে গিয়েছিল।ভয়ে এতক্ষণ স্মরণে আসেনি।সে ইচ্ছেকৃত ভাবে নির্ঝরের দু কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরলো।কয়েক সেকেন্ড পর হাত ঢিলে করে সে সরে আসতে নিল। তৎক্ষনাৎ নির্ঝর দুপুর বেলার মতো খপ করে তার ডান হাত ধরে ফেলল।তরী প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তাকাতে নির্ঝর বলে উঠলো,
‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।এক্ষুণি।আমার সাথে সাথে তিনবার বলো!বলো কবুল, কবুল, কবুল।’
তরীর চোখে মুখে কাঠিন্যতা ভর করলো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘বিয়ে করবো?আপনাকে?কস্মিনকালেও না!হাত ছাড়ুন!এভাবে কবুল বললে বিয়ে হয়ে যায় কোন বলদ বলেছে আপনাকে?কবুল বললেই বিয়ে হয়ে যায়? কবুল বলবো না আমি!’
তরীর কথা শেষ হতে না হতে নির্ঝর হ্যাঁচকা টানে তাকে বুকের উপর ফেলে বলল,
‘মিস তরী!স্যরি, মিসেস নির্ঝর শাহরিয়ার।তুমি অলরেডি তিনবার কবুল বলে ফেলেছ!তার মানে আজ থেকে আমরা স্বামী স্ত্রী।’
(চলবে)
পার্টটা বেশি ছোট হয়ে গেল।অল্প সময় নিয়ে অনেক দ্রুত লিখেছি।ভাবাভাবির সময় পাইনি!ভুলত্রুটি মার্জনীয়!কাল দুপুরে বড় করে দিবো!🤎
আগের পর্বের লিংক, পর্ব__০৩