#শেষটা_সুন্দর পর্ব___২৮
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)

তরী জড়ানো কন্ঠে কোনোরকমে দুবার বলল,

‘আশিক। আ-আশিক!’

‘হুঁ! মনে আছে দেখছি। তোমার স্মরণ শক্তি তো ভালো। তাহলে গত বছর তিন সাবজেক্টে ফেইল করেছিলে কিভাবে বেইবি?’

আশিক ফিচেল হেসে তরীকে ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়েই সামান্য পিছিয়ে গেল তরী। ঘুরে দাঁড়িয়ে আশিকের চেহারা আবিষ্কার করে রুহ কেঁপে উঠলো তার। রুমের জানালা, দরজা বন্ধ থাকলেও আবছা আলো। সেই আবছা আলোতে তরী ভয়ার্ত চোখে আশিকের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে অজানা আতংক। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। চোখের কোণ ভিজে উঠছে। আর তার সামনে কুটিল হাসি নিয়ে নির্বিকার ভাবে আশিক দাঁড়িয়ে আছে। তার কুৎসিত হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সে তরীর ভয়ার্ত চেহারা ভীষণ উপভোগ করছে।

প্যান্টের পকেট থেকে একটা গোল্ডলিফ বের করে ঠোঁটে গুঁজলো আশিক। বুক পকেট থেকে লাইটার হাতে নিয়ে তরীর সামনে বাড়িয়ে বলল,

‘সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দাও তো!’

তরীর চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। হাত মুঠ করে চেঁচিয়ে বলল,

‘আমায় যেতে দিন।’

‘এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? যাবে তো! যেখানে আমি পাঠাব।’

তরীর পিলে চমকে উঠলো। আশিক তাকে কোথায় পাঠানোর কথা বলছে? মেরে ফেলবে তাকে? বুক কেঁপে উঠলো তার। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। মনের পর্দায় নির্ঝরের গম্ভীর মুখের চেহারা ভেসে উঠলো। এক দৌঁড়ে দরজার কাছে পৌঁছানোর আগেই আশিক তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ধাক্কার বেগ প্রচন্ড ছিল বলে তরী ছিটকে সরে গেল। বেঞ্চ থাকার কারণে ফ্লোরে না পড়ে বেঞ্চের উপর গিয়ে পড়লো। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো সে। তার ব্যথাতুর কন্ঠে পাত্তা দিল না আশিক। কয়েক পা এগিয়ে এসে নিজে থেকে সিগারেটে আগুন ধরাল। একটা ফুঁক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,

‘অামার বহুদিনের মনোবাসনা ছিল মাঝরাতে দুজন একত্রে ড্রিংক করবো। শুধু তুমি আর আমি! তারপর দুজন একই সিগারেটে ফুঁক দিবো। একবার করে সিগারেটে টান দিবো আর তোমার ঠোঁটে একটা করে চুমু খাব। কিন্তু তুমি মনোবাসনাটা পূরণ করতে দিলে না। তোমার নৌকায় আমি উঠার আগেই অন্য কাউকে উঠিয়ে ছেড়ে দিলে। বাহ!’

তরীর চোখ মুখ কুঁচকে গেল। ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো। কোমড়ে ব্যথা পাওয়ার জায়গায় হাত বুলিয়ে শকুনের দৃষ্টিতে আশিকের দিকে তাকালো। তবুও অনুরোধের স্বরে বলল,

‘এমন করছেন কেন? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। কি চান আপনি?’

‘এক সময় বিছানায় নিতে চাইতাম। ভীষণ চাইতাম। এখন অন্য কিছু চাই।’

তরীর গা গুলিয়ে উঠলো। এক দলা থুথু ফেলে বলল,

‘ছি! ঘৃণা হচ্ছে আমার। নিজের প্রতি। এমন একটা জঘন্য মানুষের জন্য ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলাম আমি।’

‘সেদিন রাতেই তুমি শেষ হয়ে যেতে তরী বেইবি। ভাগ্যিস ওই রাতে আমি জেরিনের সাথে হোটেলে ছিলাম। ড্রাংক হয়ে অন্য ভুবনে ছিলাম বলে তুমি বেঁচে গিয়েছিলে।’

‘জেরিন?’

তরীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিস্ফারিত নয়নে শুধু চেয়ে রইলো। শেষ মেশ আশিকের ফাঁদে সে পা দিয়ে ফেলল? কি হবে এবার? কে তাকে রক্ষা করবে? একই ভুল সে দুইবার কি করে করলো? প্রথম বার না হয় নির্ঝর তাকে রক্ষা করেছিল। চরিত্রে কালিমা লেপন হতে দেয়নি। এবার কি করে রক্ষা করবে? তরীর বুক চিঁড়ে চিৎকার বেরিয়ে এলো। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সে।

তখনি দরজায় টোকা পড়লো। আশিক তরীর দিকে এক পলক চেয়ে আধ খাওয়া সিগারেট হাত থেকে ফেলে দিল। জুতা দিয়ে আগুন নিভিয়ে দরজার লক খুলে দিল। দরজার পাল্লা অল্প একটু খুলতে জেরিন হাসিমুখে ভেতরে ঢুকল। নিজে থেকে দরজা পুনরায় বন্ধ করে আশিকের গলা জড়িয়ে ধরলো। তরী কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে বলল,

‘জেরিন? তুমি? ছি!’

জেরিন ঝটপট আশিককে ছেড়ে দিল। মুখে হাত রেখে অবাক হওয়ার ভান করলো। বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘তরী আপু? তোমার এ অবস্থা কেন?’

মুখে হাত রেখেই সে আশিকের দিকে তাকালো। পরক্ষণে গলা ফাটিয়ে হাসা শুরু করলো। কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে রেখে আশিকের দিকে এগিয়ে এলো। আশিক দ্রুত তার কোমড় জড়িয়ে কাছে নিয়ে এলো। জেরিন ফিসফিস করে বলল,

‘তুমি কিন্তু বলেছ তরীকে স্পর্শ করবে না। ইভেন আমি বাদে দ্বিতীয় কোনো নারীদেহ স্পর্শ করবে না। আমি বিশ্বাস করেছি।’

আশিক ফু দিয়ে জেরিনের চোখের উপরের চুল গুলো সরিয়ে দিল। কুটিল হেসে বলল,

‘আমি তোমাকে চিট করতে পারি বাবু? এতগুলো মাসে আমি অন্য কোনো মেয়েকে স্পর্শ করেছি?’

‘না!’

‘তাহলে? আমার জেরি বাবু মিথ্যে দোষারোপ করছে কেন? বুকে কষ্ট হয় তো!’

‘কি ঢং!’

জেরিন হেসে ফেলল। আশিক মুখটা জেরিনের মুখের কাছে আনতে সে মুখ পিছিয়ে নিল। নাক কুঁচকে বলল,

‘সিগারেটের গন্ধ! সিগারেট কখন খেয়েছ?’

‘তুমি ছিলে না। তাই একটু টেনশন বোধ করছিলাম।’

তাদের এই লুতুপুতু মার্কা কথাবার্তা তরীর আর সহ্য হলো না। সে এগিয়ে এসে ফ্লোরে পড়ে থাকা ফাইলটা পুনরায় আঁকড়ে ধরলো। ওদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোতে লাগলো। কিছুদূর এগোতেই আশিক জেরিনকে ছেড়ে একদৌঁড়ে গিয়ে তরীর বাহু চেপে ধরলো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো তরী। আশিক হাত আরো শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘এই আশিকের হাত থেকে একবার পালানো সহজ। কিন্তু দ্বিতীয় বার না! তোর কপাল ভালো যে এখনো তোর উপর হামলে পড়িনি আমি! কারণ অন্যের ব্যবহৃত জিনিস আমি ব্যবহার করি না।’

তরী অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। সে এটা বুঝতে পারছে যে বড়ো ধরনের বিপদে পড়েছে সে। ভয়ে আচমকা নিচু হয়ে সে আশিকের পা জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘প্লিজ আমায় যেতে যাও তোমরা। আমার পরীক্ষা শেষ। আমি আগামীকাল ঢাকায় চলে যাব। আর কাউকে কিচ্ছু বলবো না। প্লিজ যেতে দাও।’

‘ঢাকা তো তুমি ফিরবে তরী। কিন্তু নির্ঝরের বাসায় নয়।’

বলেই আশিক লাথি দিয়ে পা ছাড়িয়ে নিল। তরী আর অপেক্ষা করলো না। বসা থেকে উঠে এক দৌঁড়ে দরজা দিকে এগিয়ে গেল। আশিক ফের তাকে পেছন থেকে দু হাত বাঁকিয়ে ধরে ফেলল। ব্যথায় তরীর চোখ মুখ নীল হয়ে গেল। তবুও প্রাণপনে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল। তাকে দরজা খুলে বের হতে হবে। পালিয়ে যেতে হবে। নিজেকে মুক্ত করতে হবে। তার কিছু হয়ে গেলে নির্ঝর পাগল হয়ে যাবে। তার বাবা-মা পাগল হয়ে যাবে। এতগুলো মানুষটাকে সে পাগল হয়ে যেতে দিতে পারে না।

আরো কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে অবশেষে সে আশিকের হাতে কামড় বসিয়ে দিল। আশিকের হাত আলগা হতে সে দরজার কাছে পৌঁছাল। এলোমেলো হাতে দরজার ছিটকিনিতে হাত রাখতে পেছন থেকে চুলে টান অনুভব করলো। ব্যথায় তরী চোখে আঁধার দেখলো। চুল টেনে ধরা হাতটা চেপে ধরে আর্তনাদ কর উঠলো। জেরিন চুলের মুঠ আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

‘এত পালানোর শখ তোর?”

আশিক রক্তলাল চোখে এগিয়ে এসে ঠাস করে তরীর গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তরীর মাথা ঘুরে উঠলো। পা শরীরের ভর রাখতে চাইলো না। ভেঙে ফ্লোরে বসে পড়লো সে। ঠোঁটের কোণে আঙুল ছুঁইয়ে ভেজা ভেজা লাগলো। ধস্তাধস্তির ফলে মাথার হিজাব খুলে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে। ভেজা চোখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘এমন করো না তোমরা। আমায় যেতে দাও। প্লিজ যেতে দাও!’

আশিকের রাগ তরতর করে বেড়ে গেল। তরীকে ছুঁতে না পারার রাগে নিচু হয়ে তার গাল চেপে ধরলো। মাথাটা দরজার সাথে ঠুকে দিয়ে বলল,

‘আর একবার মুখ খুলবি তো জিহ্বা কেটে ফেলবো তোর।’

তরী আর কথা বলার শক্তি পেল না। ব্যথায় মাথা টনটন করে উঠলো। চোখে অন্ধকার দেখছে। বাঁধা দেওয়ার শক্তি ফুরিয়ে গেছে। চোখ দুটো আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। জোরপূর্বক চোখ খুলে সে সামনে মেয়েলি মুখোচ্ছবি দেখতে পেল। জেরিন তরীর মুখ চেপে সাদা একটা স্প্রে করলো। সঙ্গে সঙ্গে তরীর দু চোখ বন্ধ হয়ে এলো। জড়ানো কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলো,

‘নির্ঝর সাহেব। দেখুন না, আপনার তরীরাণী ভালো নেই। কষ্ট পাচ্ছে, ব্যথা পাচ্ছে সে। আপনি দেখতে পারছেন না? যেই ডিঙিরাণীকে এতগুলো দিন নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখলেন, ছিঁটেফোঁটা কষ্ট পেতে দিলেন না সে আজ কষ্ট পাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। আপনি এই নিষ্ঠুরতা দেখলেন না। দেখলেন ন……’

তরীর ঠোঁট নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তেজ হয়ে ফ্লোরে ঢলে পড়লো সে। আশিক বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
দুজনের মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠলো।

আশিক ফোন বের করে কারো সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। পেছন থেকে জেরিনের স্পর্শ পেয়ে ঝটপট ফোন কেটে দিল। একটানে জেরিনকে সামনে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। পরমুহূর্তে গাঢ় চুম্বনে লিপ্ত হলো দুজন।

____________

নির্ঝরের গাড়ি জ্যামে আটকা পড়ে আছে ঘন্টাখানেক হলো। আজ পরীক্ষার শেষ দিন বলে রাস্তাঘাটে প্রচুর ভিড়। গাড়ি আর গাড়ি! ঘন্টা খানেক সময় ধরে সে দশ হাতের বেশি এগোতে পারেনি। একটু পর পর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটু করে এগোচ্ছে তো আবার আটকে পড়ছে।

গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। তরীর পরীক্ষার দেড় মাস সময় তার একটু চাপের উপর দিয়ে কেটেছে। তরীর দিকে খেয়াল রাখা, পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়া, দূরে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করা, তরীর ছুটির দিনগুলোতে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা ফিরে অফিস ধরা, আবার পরীক্ষার আগের দিন রাতের বেলা সিলেট যাওয়া। সব মিলিয়ে কিছুটা ক্লান্ত সে। ফাইনালি তরীর পরীক্ষা শেষ। সাথে তাদের মন দেওয়া নেওয়া শেষ। এখন আর কোনো বাঁধা থাকবে না।

মুখে হাসি ফুটে উঠলো নির্ঝরের। এসিতে কেন জানি দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বন্ধ করে জানালা খুলে দিল সে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে পাশের সিটে তাকাল। সিটের উপর একগুচ্ছ গোলাপ ফুল। টকটকে লাল। ঢাকা থেকে আসার পথে কেনা হয়েছে। বিক্রেতার হিসাব মতে এখানে ছিয়াত্তর টা গোলাপ আছে। নির্ঝর গুণে দেখেনি। ডালাতে যতগুলো ছিল সব কিনে নিয়েছে তরীর জন্য। তরীকে তার সেরকম ভাবে প্রোপোজ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত একটা গোলাপ দেয়া হয়নি। ভীষণ অন্যায় হয়েছে।

আশপাশে তাকিয়ে জ্যাম ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখলো না সে। অতঃপর গোলাপগুলো হাতে তুলে নিল। হাতে নিয়ে তার মন খারাপ হয়ে গেল। পাঁপড়ি গুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। টকটকে রঙ টা কেমন ফিকে হয়ে এসেছে। সেই ভোরবেলা কেনা হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। শুকিয়ে যাওয়ার কথা! মন খারাপ নিয়ে সে গোলাপগুচ্ছ সতেজ রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিল। পেছনের সিট থেকে ব্লেজার নিয়ে বিকেলের রোদ আড়াল করার চেষ্টা করলো। একটুপর সামনে থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বড় মায়ের ফোনে দিল তরীর সাথে কথা বলার জন্য।

ক্রমাগত চার বার রিং হয়ে কেটে গেল। কেউ ফোন রিসিভ করলো না। নির্ঝরের মন আরো খারাপ হয়ে গেল। গাড়ির পেছনের সিট থেকে একটা শপিং ব্যাগ সামনে এনে নেড়েচেড়ে দেখলো। তরীর জন্য নতুন এন্ড্রয়েড ফোন কিনেছে সে। এতদিন পরীক্ষার জন্য ফোন দেয়নি। পরীক্ষা শেষ এবং সে জানে এবার মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করবে তরী। আপাতত এডমিশন নিয়ে সে চিন্তা করছে না। পাবলিকে ভর্তি হতে না পারলে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিবে। কিন্তু তরীর একটা একান্ত ফোন প্রয়োজন। অফিসের সময়টাতে তরীর খোঁজ নেওয়ার জন্য, তার সাথে হুটহাট ফুসুরফুসুর করার জন্য হলেও একটা ফোন প্রয়োজন।

ফোনটা হাতে নিয়ে ওয়ালপেপারে নিজের ছবি সেট আপ করে দিল নির্ঝর। নতুন সিমে নিজের নাম্বারটা ভালোবাসা দিয়ে সেইভ করে দিল। নিজের কাজে নিজেই হেসে ফেলল সে। পুনরায় ফোন প্যাকেটজাত করে ব্যাগে ভরে রাখলো। গাড়ির গিয়ারে হাত রেখে সে সময় দেখতে নিল। হঠাৎ পেছন থেকে ধাড়াম করে একটা গাড়ি তার গাড়িকে ধাক্কা দিল। প্রস্তুত ছিল না বলে হ্যান্ডেলে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল তার। চোখ মুখ কুঁচকে গেল রাগে। সিটবেল্টের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেল। কপাল কুঁচকে দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো সে। কোন ব্যাক্কেল থেমে থাকা গাড়িতে আঘাত হানে তা দেখা দরকার।

গাড়ির দরজা বন্ধ করে পেছনে ঘুরে তাকাতে কপালের খাদ আরো গভীর হলো তার। একটা মেয়ে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পরণে জিন্স আর লং টপস! কপাল কুঁচকে আরো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো নির্ঝর এবং এটা বুঝতে পারলো তাকে দেখে মেয়েটার চিন্তিত মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। মেয়েটি হঠাৎ ঝলমলে সুরে বলল,

‘শাহরিয়ার কেমন আছিস?’

কন্ঠটা কানে যেতে নির্ঝরের কুঁচকানো কপাল প্রসারিত হলো। মুখের পেশি শিথিল হয়ে এলো। সে মুচকি হেসে বলল,

‘প্রভা তুই? কেমন আছিস? ঠিক কতগুলো বছর পর দেখা বল তো?’

‘আমি ভালো। চার বছর প্লাস! দেখা হয় না আমাদের। তোর কি অবস্থা? পড়াশোনা কতদূর?’

নির্ঝর হাসলো। প্রভা তার কলেজ জীবনের ক্লাসমেট। বন্ধুও বলা চলে। তবে ততটা গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল না। সে বলে উঠলো,

‘আমার সব ঠিকঠাক। চাকরি করছি,সাথে মাস্টার্সে অধ্যয়নরক। সবচেয়ে বড় চমক বিয়ে করে ফেলেছি। বাচ্চা বউ!’

‘সে কি! সত্যি? এত দ্রুত? মিথ্যে বলছিস!’

নির্ঝর গাড়ি থেকে ফোন হাতে নিল প্রভাকে তরীর ছবি দেখানোর জন্য। হাতে নিয়ে লক প্যাটার্ণ খুললো। তরীর ছবির দিকে চেয়ে সে সিদ্ধান্ত পাল্টালো। প্রভাকে তার ছবি দেখাল না। পুনরায় ফোনটা পকেটে পুড়ে বলল,

‘সিলেট বিয়ে করেছি। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিল। আমার বড় মায়ের ভাইয়ের মেয়ে। সম্পর্কে কাজিন হয়। লাভ ম্যারেজ! তোর খবর বল!’

‘বাহ! কনগ্রাচুলেশনস! আমি ইন্টার্ণ ডাক্তার। সাথে আনম্যারেড!’

‘সব ঠিক আছে। কিন্তু আমার গাড়িতে ধাক্কা মারলি কেন?’

নির্ঝর গাড়ির পেছনের অংশ দেখে বলল। প্রভা জিভ কেটে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। তার ড্রাইভিং এখনো আনাড়ি। অথচ এই আনাড়ি হাতে গাড়ি নিয়ে সে ট্রিপে বের হয়েছে। সে বলল,

‘স্যরি রে! সময় মতো ব্রেক কষতে পারিনি। তবে অল্পের উপর দিয়ে গেছে। গাড়ির কোনো ক্ষতি হয়নি। এক কাজ কর। বউ নিয়ে ঢাকায় একদিন আমার সাথে দেখা কর। এর খেসারত হিসেবে ট্রিট দিবো।’

জ্যাম ছেড়ে গেছে। পেছন থেকে গাড়ির হর্ণ বেজে যাচ্ছে। নির্ঝর প্রভাকে জিগ্যেস করলো,

‘ ঠিক আছে। এখন কোথায় যাচ্ছিস?’

‘বিছানাকান্দি। ট্রিপে। বন্ধুরা সব চলে গেছে। ওদের গিয়ে ধরতে হবে। আচ্ছা আসি। টাটা! আবার দেখা হবে।’

প্রভা হাত নেড়ে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নির্ঝর প্রতিত্তরে একটু হেসে ড্রাইভিং সিটে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাম হাতে আবার বড় মাকে কল করলো। কেউ রেসপন্স করলো না।

____________

সন্ধ্যার পর নির্ঝর বাড়ি পৌঁছাল। ইতোমধ্যে তার শরীর ভীষণ ভেঙে পড়েছে। সারাটি দিন কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষুধাও লেগেছে বেশ। তাছাড়া মন কেমন খুঁতখুঁত করছে। সেই সকাল বেলা পরীক্ষার আগে তরীর সাথে কথা হয়েছে। আর তার কন্ঠ শুনতে পায়নি। গাড়ি পার্ক করে সে খালি হাতে বের হলো। ফুলসহ গিফটগুলো এক ফাঁকে এসে লুকিয়ে নিয়ে যাবে। এখন নিলে ড্রয়িং রুম থেকে তরীর চোখে পড়বে।

সদর দরজা খোলা ছিল। নির্ঝর ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় হাত পা মেলে বসে পড়লো। ড্রয়িং রুমের চারপাশে নজর বুলিয়ে তরীকে চোখে পড়লো না। ঘাড় উঁচু করে রান্নাঘরের দিকে তাকালো। নাহ! তরী নেই, এমনকি কাউকে চোখে পড়ছে না। সদর দরজা খোলা রেখে সবাই কোথায় গেছে?

নির্ঝর উঠে দাঁড়ালো। তরী বোধ হয় রুমে ঘুমাচ্ছে। সে ঝটপট সিঁড়ির দিকে এগিয়ে প্রথম ধাপে পা রাখতে পেছন থেকে মমতাজ বেগম রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

‘নির্ঝর রে! তরী! তরীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই দুপুর বেলা পরীক্ষা দিয়ে আর ফেরেনি।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here