ভোর রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সারা সকালেও থামার নাম নিলো না। আজ মিহাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা। শুধু দেখাই নয়, বোন-ভাগ্নীর পছন্দ হলে বিয়েটাও সেড়ে রাখবেন মিহার মামা আনোয়ার সাহেব। তেমনই কথা হয়েছিলো পাত্রের বাবার সাথে। ছেলে এবং তার পরিবারকে তিনি আগে থেকেই চেনেন বিধায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সকাল দশটা বাজতে চললো। মিহা এখনো বিছানায় গড়াগড়ি করছে। বৃষ্টির ফলে পরিবেশটা শীতল। কোমর অবধি কাথা টেনে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে সে। কাল রাতে উত্তেজনায় ঘুমাতে পারেনি। জীবনে প্রথমবার পাত্র পক্ষের সামনে বসবে মিহা। কিভাবে সাজবে, কিভাবে হাটবে, কিভাবে কথা বলবে কিংবা কি কি জিজ্ঞেস করা হবে সেইসব নিয়ে বেজায় চিন্তিত হয়ে রয়েছে সে। তাই ফজরের নামাজ শেষে সেই অপূর্ণ ঘুমটা আদুরে আবহাওয়ায় পুষিয়ে নিলো কিছুটা।

মিহার বৃষ্টি খুব পছন্দ। তবে আজ মন খারাপ লাগছে বৃষ্টি দেখে। কাল রাতের সমস্ত ভাবনা, পরিকল্পনায় যেন জল ঢেলে দিলো বৃষ্টি। এখন এই পরিবেশে পাত্রপক্ষ আসবে কিনা কে জানে। মিহা উঠে বসলো। বাহিরে থেকে মায়ের গলা পাওয়া যাচ্ছে। তিনি রান্নার আয়োজন নিয়ে ছোটাছুটি করছে। মেয়েকে ডাকছেন সাহায্য করার জন্য। মিহা জানালা গলে আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টি আজ থামবে বলে মনে হয় না।

পিতৃহীন মিহার প্রধান অবিভাবক মামা। আনোয়ার সাহেব মিহাকে নিজের মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে। তিনি মনস্থির করেছেন সামনে হজ্জে যাবেন। কিন্তু যাওয়ার আগে আদরের ভাগ্নীর একটা সুখের সংসার নিশ্চিত করে যেতে চান। তার এই ইচ্ছাতে সকলেই একমত পোষন করেছেন। মিহা নিজেও নিরব সম্মতি দিয়েছে। ওর কোনো পছন্দ বা ভালোবাসার মানুষ নেই। একুশ বছরের জীবনে প্রেম, ভালোবাসা জিনিসটা অধরা রয়ে গেছে মিহার। সেদিকে পা বাড়ানোর সাহস কখনো করে উঠতে পারেনি। ঠিক করে নিয়েছিলো বিয়ের পরে স্বামীর সাথেই হালাল প্রেম করবে। সংসারী হয়ে উঠবে।

মিহার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে এই একটা জিনিসই। সুখী সংসারের সুখী গৃহিণী হওয়া। এটাকে সে পৃথিবীর সবথেকে মূল্যবান এবং সম্মানের কাজ মনে করে। যদিও সবাই তা বোঝে না। মিহা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে চুলে হাত খোপা করতে করতে রুম ত্যাগ করলো।
সুমা বেগম রান্নাঘরে খুবই ব্যস্ত। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছেন। মিহা রান্নাঘরের দরজায় দাড়িয়ে বললো,
“তুমি শুধু শুধু এতো ব্যস্ত হচ্ছো মা। এই বৃষ্টি আজ থামবে না। আর ঝর জল ঠেলে তারাও আসবে না।”

সুমা বেগম এক পলক মিহার দিকে তাকিয়ে আবার রান্নায় মন দিলো। বললো,
“বৃষ্টি থামবে না কে বললো তোকে? যদি থেমে যায় এবং তারা এসে পড়ে! তখনতো ছোটাছুটি লেগে যাবে। তারচেয়ে বরং রান্না করে রাখি। না আসলে আমরাই দুইদিন লাগিয়ে খাবো। তুই যা হালকা কিছু মুখে দিয়ে এসে আমায় একটু সাহায্য কর। বৃষ্টি দেখে হালিমা আজ কাজে আসবে না। আর তোর মামীর শরীরটাও ভালো না।”
মিহা চলে গেলো ডাইনিং টেবিলে। পেটের খিদেটা এতোক্ষণে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

বৃষ্টি থামলো না দুপুরেও। সকলে এবার হতাশ হতে শুরু করলো। বোধহয় সত্যিই আজ পাত্রপক্ষের আসা হবে না। মিহা গোসল সেড়ে কলাপাতা রঙের থ্রিপিস পড়ে নিলো। ভেজা চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টির ছাট এসে ওর গায়ে স্পর্শ করছে। মিহার সরে গেলো না। ওর মন খারাপ করছে। মামা এর আগে বেশ কয়েকবার পাত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছে। মিহাকে সামনে বসিয়ে পাত্রের গুনগান গেয়েছে।

মিহা জানে তার মামা ভালো বলেছে মানে সত্যিই ভালো পরিবারই হবে। ছেলের ছবি দেখতে বলেছিলো একবার। তবে তখন তেমন গুরুত্বই দেয়নি বিষয়টাতে। কিন্তু মামা যখন বললো সত্যিই তারা দেখতে আসবে তখন মিহার আফসোস হচ্ছিলো। ইশ একটু দেখলে কি হতো! মামাকে আর পরে বলতেও পারেনি ছবির কথাটা। শুধু মনে মনে একটা অবয়ব তৈরি করে নিয়েছে সে। আজ সেই অবয়বটা পূর্ণতা পাওয়ার কথা ছিলো। হয়তো মনের মতো হতো বা হতো না।
বাড়ির সবাই আজকের দিনটা নিয়ে একটু বেশিই আনন্দিত ছিলো। সেই আনন্দে ভাটা পড়ে গেলো বৃষ্টির জন্য। বারান্দায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মিহা পিছনে তাকালো। ওর মামাতো বোন শোভা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে তাকাতে দেখে মিষ্টি হাসলো। মিহাও একটা হাসি উপহার দিলো। শোভা মিহার থেকে দুই বছরের ছোট। কিন্তু স্বভাবে বড় বড় ভাব নিয়ে চলে।

শোভা ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আপু তোমার কি মন খারাপ?”

“নাহ রে। মন খারাপ হবে কেনো?”

শোভা মিহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
“আমাকে মিথ্যা বলে লাভ নেই। আমি জানি তোমার মন ভালো নেই। আজ পাত্রপক্ষ আসেনি তো কি হয়েছে? কাল আসবে। আর সে যে তোমার পছন্দের মানুষ হবে তারওতো ঠিক নেই। দেখা গেলো পাত্র একটা টাকলা, ভুড়িওয়ালা লোক। হাহা।”

মিহা মুচকি হেসে বললো,
“মামা বুঝি এমন লোককে ধরে আনবে? তিনি তো পাত্রের সম্পর্কে খোজ নিয়েই রেখেছেন।”

“তাই বলে তোমার এই চুপসানো ভাবটা আমার একটুও ভালো লাগছে না। লোকটাকে দেখার এতো ইচ্ছা থাকলে আগে বলতে। বাবা ছবি নিয়ে আসতো। তুমিই তো দিলে না আনতে। আর এখন মন খারাপ করে আছো। হতেও তো পারে লোকটাকে তোমার বা আমাদের কারো পছন্দ হলো না। না দেখে কাউকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই যে নিজের মন খারাপ হয়। তোমাকে চঞ্চলতায় বেশি মানায় আপু। তাই এসব বিরহী ভাব ছাড়োতো। সকাল থেকে গম্ভীর হয়ে আছো।”

মিহা হাসার চেষ্টা করলো। মনটা একটু হালকা লাগছে। আসলেইতো! যাকে দেখেনি তাকে নিয়ে এতো ভাবার কি আছে? তারচেয়ে বরং বৃষ্টিটা মন দিয়ে উপভোগ করা যাক। দুইবোন একসাথে পুরো দুপুর বারান্দায় গল্প করে কাটালো ওরা।

__________

সন্ধ্যা নাগাদ সকলে আশাহত হয়ে পাত্রপক্ষের আসার চিন্তা ছেড়ে দিলো। বাহিরে তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পসরা। সকলকে অবাক করে দিয়ে আবছা আধার ঠেলে একটা সাদা গাড়ি এসে থামলো মিহাদের বাড়ির সামনে। আনোয়ার সাহেব একবার দেখেই বুঝে গেলেন তারা এসে গেছে। তিনি ব্যস্ত হয়ে সকলকে ডাকতে লাগলেন।

মিহা ফোন স্ক্রল করছিলো একমনে। মামার কন্ঠ কানে আসতেই ওর হৃতস্পন্দ দ্রুত হয়ে গেলো। হাতের ফোনটা রেখে উঠে দাড়াতেই শোভা এবং মামি শিরিন বেগম দরজা ঠেলে ঢুকলো। শিরিন বেগমের কোমরে ব্যথার ফলে সারাদিন ঘরেই ছিলো। এখন অনেকটা সুস্থ বোধ করায় নিজেই চলে এসেছে মিহাকে সাজাতে।

শোভা মিহাকে বললো,
‘তোমার মন খারাপ দূর হওয়ার কারন চলে এসেছে। এবার খুশিতো? জলদি রেডি হওতো। গিয়ে দেখি কোনো টাকলা কিনা।”

শিরিন বেগম মেয়ের মাথায় আলতো থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“বাজে বকছিস কেনো? মেয়েটা এমনিতেই ঘাবড়ে গেছে।”

“ঘাবড়ে গেছে না ছাই। বরং পাত্র আসবে না বলে মন খারাপ করে ছিলো। এখন তো খুশি হওয়ার কথা।”

মিহা মামির সামনে লজ্জা পেয়ে গেলো। শোভাকে চোখ গরম করতে গেলে শোভা দুষ্টুমি করে চোখ মারলো। তা দেখে মিহা এবার রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেললো।

পাত্র, পাত্রের মা-বাবা এবং ভাবী এসেছে। তাদের আপ্যায়নে আনোয়ার সাহেব এবং তার বোন সর্বোচ্চ দিচ্ছেন। আনোয়ার সাহেবের সাথে পাত্রের বাবা নাজমুল হকের পরিচয় থাকায় ইতিমধ্যে আড্ডা বসে গেছে বসার ঘরে। শোভা রুম থেকে একবার উঁকি দিয়ে পাত্রকে দেখে নিলো। ফর্মাল লুকে এসেছে লোকটা। কালো স্যুটের ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে সাদা শার্ট। সুদর্শন ব্যাক্তি বলা যায়। বেশ ভদ্রভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

শোভা ফিরে এসে মিহার কাছে মজা করে বললো,
“পাত্রতো পুরাই টাকলা রে আপু। তোর কি হবে এবার?”

মিহা চুল আঁচড়ানো থামিয়ে শোভার মুখের দিকে তাকালো। শোভা মুখটা করুন করে ঠোঁট উল্টালো। মিহা হুট করেই দমে গেলো। সত্যিই কি টাকলা? নিজেকে একবার আয়নাতে দেখে নিলো। খয়েরী রঙের শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। মামি যত্ন করে কিছু গহনাও ছুইয়ে দিয়েছে কানে গলায়। চোখে কাজলের গাঢ় টান, লিপস্টিকের হালকা প্রলেপ পড়েছে ঠোঁটে। উজ্জ্বল মুখশ্রীর জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। এতো যত্নের সাজ যার জন্য তাকে যদি পছন্দ না হয়? লোকটা কেমন হবে কে জানে।

শোভা বোনের করুন মুখ দেখে হাসলো নিঃশব্দে। মেয়েটা একটু বোকা ধরনের। তবে উচ্ছলও। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে সেই উচ্ছ্বলতায় ভাটা পড়েছিলো বছর দুই আগে। শোভার সংস্পর্শে এসে তা অনেকটাই কেটে গেছে।
মিহা আনমনে চুড়ি পড়ছিলো হাতে। তখনই মামি ঘরে ঢুকে তাড়া দিয়ে বললো পাত্রের সামনে যেতে হবে। মিহার ধুকপুকানি ট্রেনের গতিতে ছুটতে লাগলো। বিচলিত লাগছে ভীষণ। মামি এগিয়ে এসে মিহার মাথায় ঘোমটা উঠিয়ে দিয়ে আশ্বাস দিলো।

“ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমরা সাথেই আছি। যা জিজ্ঞেস করবে সেগুলো সুন্দর করে উত্তর দিবে।”

পাত্রের মুখোমুখি সোফায় বসানো হলো মিহাকে। বিচলিত হয়ে মিহার হাত ঘামছে। পাত্রের ভাবী ফাইজা মিহাকে দেখেই প্রশংসা করে নাম জানতে চাইলো।
মিহা মিইয়ে যাওয়া গলায় স্বর আনার চেষ্টা করে বললো,
“মিহা মাহযাবীন।”

ফাইজা বললো,
“মাশা-আল্লাহ। চেহারার মতো নামটাও সুন্দর।”

আরো নানান কথা হলো সবার মাঝে। মিহাকে খুব একটা প্রশ্ন করা হলো না। মিহা একবার চোখ তুলে সামনের লোকটাকে দেখতে চাইলো। ক্ষনেই দুজনের দৃষ্টিবদল হলো। দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। দুজন সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো। মিহার কান গরম হয়ে উঠেছে। বোধহয় গালগুলো লাল হয়ে গেছে। লোকটা তো টাকলা নয়। তারমানে শোভা মজা করেছে! মনে অন্যরকম এক অনুভূতি খেলে গেলো মিহার। তবে ওর মনে হলো সামনে বসা এই সুদর্শন লোকটাকে ও আগে দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে হাজার ভেবেও মনে করতে পারলো না। আরেকবার চোখ তুলে তাকাতে গিয়েও পারলো না।

শোভা দুজনের অবস্থা দেখে হেসে ফেললো৷ মিহাকে খোঁচা দিয়ে আলতো স্বরে বললো,
“টাকলাটাকে কি পছন্দ হলো?”
মিহা সকলের অগোচরে শোভাকে চিমটি কাটলো।

ছেলে-মেয়েকে আলাদা কথা বলার জন্য বলা হয়েছিলো। কিন্তু মিহার তখনো নার্ভাসনেস কমেনি। সে মামিকে আস্তে করে মানা করে দিলো কথা বলবে না। দেখা যাবে শেষে পাত্রের সামনে কাপুনি হচ্ছে। তখন আরো লজ্জা পাবে। কিভাবে এমন লজ্জাবতী হয়ে উঠলো মিহা নিজেও বুঝতে পারছে না। কালকের মিহা এবং আজকের মিহার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য।

উভয় পক্ষের কথার মাধ্যমে ঠিক করা হলো আজই বিয়ে পড়ানো হবে। আনোয়ার সাহেব হজ্জ করে ফেরার পর বড় করে আয়জন করা হবে। মিহার ঘরে এসে মামা তাকে পাত্র সম্পর্কে আবারো খুলে বললো। প্রশংসাও করলো খুব। ছেলের পুরো নাম মাহমুদুল হক নিশান্ত। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ভালো চাকরি করে। নাজমুল হকের দুই ছেলের মধ্যে সে ছোট। বড়ভাই ডিফেন্সে জব করে তাই আসতে পারেনি। তারা মিহাকে মেয়ের মতো করে রাখবে। আনোয়ার সাহেব মত চাইলে মিহা নিরব সম্মতি দিলো। তা দেখে আনোয়ার সাহেবের মন ভরে উঠলো। মেয়েটা কতটা বিশ্বাস করে তাকে যে এক দেখায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো। আনন্দে তিনি মিহাকে জড়িয়ে ধরলেন।

পরের মূহুর্তগুলো খুব জলদিই চলে গেলো। কাজি এনে দুজনের বিয়ে পড়ানো হলো। সুমা বেগম কেদে ফেললেন মেয়ে কবুল বলার সময়। মিহা নিজেও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কবুল বললো।

শোভা মিহার কাছে এসে বললো,
“আমি ওনাকে কি ডাকবো? দুলাভাই নাকি নিশান্ত ভাইয়া?উম.. নিশান্ত ভাইয়া ঠিক আছে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো। তোমার সাথে মানাবেও দারুন। আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না আজই তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।”

শোভা বকবক করেই চললো। মিহার কানে সেসব ঢুকলো না। ও মনে মনে নামটা বেশ কয়েকবার আওড়ালো,
‘নিশান্ত। আজ থেকে আপনি আমার স্বামী। আমার প্রেম নগরের প্রেমিক পুরুষ হবেন তো!”

চলবে…

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#সূচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here