শুভ্রনীড়

পর্ব১৩
#shamu_choudhury
পড়ন্ত বিকেলে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে৷
তাতেই একমনে ভিজে যাচ্ছে শুভ্রা। সে শুভ্রনীড় থেকে অনেক দূরে কোথাও আছে। সে জাপানীজ ভাষা পারেনা তাই জানেনা সে কোথায় আছে। হাটতে হাটতে আপন মনে চলে এসেছে। রাস্তার পাশে বড় একটা রেইন-ট্রি দেখে তার নিচে বসে পরে।
বৃষ্টি তে একাকী শুভ্রা ভিজেঁ একাকার হয়ে যাচ্ছে, তবুও সেদিকে তার খেয়াল নেই। হাজার দুঃখের ঝুঁড়ি নিয়ে সে হয়ত বৃষ্টি উপভোগ করছে৷ নয়ত বা অন্য কিছু। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে অন্য দিন হলে সে হয়ত ভয়ে শিউরে উঠত।
কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম।
তার মনে হচ্ছে তার মত আকাশটার ও ভারী মন খারাপ, আকাশটার মন খারাপের কারণ কি সে কি নিজে? যদি সে হয় তাহলে সে আকাশ কে ছুঁয়ে দেখবে, তার উৎফুল্লতার কারণ হবে। আকাশ কে ছোঁয়া আদৌও কি তার পক্ষে সম্ভব?? হয়ত না। সে যতবার যা কিছু সম্ভব ভেবেছে তার ধারণা ততবার ভূল প্রমাণিত হয়েছে। আর সাধারণের কাছে তা অসম্ভব হলেও সে ভেবেছিল তার কাছে তা সম্ভব কিন্তু তা মোটেও সম্ভব ছিলোনা।
তার মনে তিলে তিলে গড়ে উঠা সেই ভালোবাসার রংমহল এক ঝড়বাতাসে যেন উড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।

এই তো সে ভেবেছিল আমান নামক মানুষটাই তার ছোটবেলার ইউভী যাকে সে প্রাণপণে চাইতো। যাকে সে প্রতিটা নিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত রাখতো, তাকে মনে রাখতো। তাই তো সেদিন খুশিতে সব কিছু না জেনেই বিয়ে করে বসে আমান নামক কালপ্রিট টাকে।
কিন্তু সে তো জানতোনা সব ছিল প্রতারণাপূর্ণ,বানোয়াট এবং অলোক।
কিন্তু এতকিছুর পর ও তার মন মানতে চাচ্ছেনা। আমানের ভালোবাসার প্রতিটা স্মৃতি শুভ্রার পরোতে পরোতে গেথে আছে। তার মনে হচ্ছে সব যেন কল্পনাতীত। কল্পনা শেষে আমান ই তার ইউভী। কিন্তু বাস্তবে সবাই আলাদা। আমানের সব কিছু মিথ্যে, সবকিছু ছিল সাজানো নাটক। এমন কি শ্রাবণ তার ভাই নামক মানুষটাও তাকে ঠকিয়েছে।
কিন্তু তাদের ভালোবাসা কখনো সাজানো মনে হয়নি কখনো মনে হয়নি তারা তাকে ঠকাচ্ছে ৷ সব কিছুই তো ঠিক ছিল। তাহলে?? সে কেন সব কিছু জানতে চাইলো।
তার নয়ন থেকে নয়ননীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে মিশে যাচ্ছে বৃষ্টি তে।

আজ তার পাশে কেউ নেই,
তার ইউভী কে প্রয়োজন,শুধু প্রয়োজন না খুবই প্রয়োজন। তার কাধে মাথা রেখে সে কাদঁবে,খুব কাদঁবে।
কিন্তু ইউভী তো নেই সে ঠিক করে সেও রেইনবো ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারা যাবে। বুকের ভিতর তার হু হু করে উঠে,
এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা যায়?
সে তো আমান কে খুব ভালোবেসে ছিল,
না না আমান কে না ইউভী নামক মুখোশধারী কে।আর সেই আমানের মনে এই ছিল তা সে জানতোই না। এই কয়দিনে কত বার আমান তাকে ভালবাসি প্রাণপাখি বলেছে, তাকে বলেছে ছায়াবিনী ছায়া হয়ে থাকতে সব মিথ্যে ছিল? তার বাসার তো সব কিছুতেই শুভ্রতার ছোয়াঁ ছিল। শুভ্রা যখন আমান কে প্রশ্ন করেছিল এই বাসাতে সব কিছু এমন কেন?? জবাবে সে বলেছিল,

_এই শুভ্রনীড়ে শুধু শুভ্রতার ছোঁয়া থাকতে পারবে অন্য কিছু না, আমার শুভ্রাকে যারা শুভ্রতার ছোয়াঁয় আগলে রাখতে পারবে শুধু তারাই থাকবে। কেন না, আমি চাই না আমার ছায়াবিনীর কিছু হয়ে যাক।তাকে যে বড় ভালোবাসি, তাকে ছাড়া আমি বড্ড অচল। তার খুশির জন্য সব কিছু।

সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে সে ভাবেনি, সে তো একটু ভালোবাসা চেয়েছিল, চেয়েছিল তার ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে,বিনিময়ে এই??শুভ্রা এই সব কিছু ভাবতে ভাবতে গগনবিদারী চিৎকারে কেঁদে উঠে। সে ছোট বেলা থেকে বৃষ্টি তে ভিজতে পারতো না। খুব জ্বর বাধাঁতো। এতক্ষণ বৃষ্টি তে ভিজার কারণে শুভ্রা জ্বরে কাপঁতে থাকে। এক পর্যায়ে সেখানেই বেহুশ হয়ে টলে পরে।

__ইউভী দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রনীড়ের সামনে৷ বাংলোটা অনেক বড়। চারদিকে শুধু চোখ ধাধানো মনমাতানো সাদাতে পরিপূর্ণ রয়েছে। ইউভীকে আমান ভিতরে নিয়ে যেতে চাইলে সে বলে সে বাংলো টা ঘুরে দেখতে চায়। আমান না করেনা তাকে বাংলো টা ঘুরে দেখায়। এখানে আসার আগে ইউভী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে পারেনি। সবসময় আমান তাকে পাহারাতে রেখেছিল।পরে ইউভী কে জোর করেই আমান শুভ্রনীড় এ নিয়ে আসে। ইউভী না আসতে চাইলেও৷ আসার সময় অনেক বাহানা করে তবুও সে ছাড় পায়না। সে ভিতরে যেতে চায়না বলেই বলেছিল বাংলোটা ঘুরে দেখার জন্য। বাংলো ঘুরে দেখার পর আমান তাকে বলে ভিতরে যেতে আমানের অনেক ক্ষুধা লেগেছে। আমানের ক্ষুধা লেগেছে শুনে ইউভী আর না করতে পারেনা। সেও ভিতরে ঢোকে। ঢুকেই দেখে শ্রাবণ কার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছে। আগে শ্রাবণ কে এই রকম ভাবে কথা বলতে আমান কোনদিন দেখেছি। তাই সে বিচলিত হয়ে শ্রাবণ এর ঘারে হাত রাখে মুহুর্তেই শ্রাবণ চমকে উঠে,,

ত ত তুই??

হ্যাঁ,কেন? ভয় পেয়েছিস নাকি? কি হয়েছে তোর বলতো। (আমান এই কথা বলে শ্রাবণ কে সোফায় বসায় আর ইউভী কে ইশারায় বসতে বলে। শ্রাবণ বলে,)

আমান শুভ্রা কে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি পুরো বাংলো খুজে দেখেছি৷ সামিহাকে বললাম সে বলল সে নাকি রুমেই ছিল জানেনা। তোর রুমে গিয়ে দেখি তোর ল্যাপটপ এ তোর শুভ্রা আর ইউভীর ছবি। মনে হয় শুভ্রা সব জেনে গেছে তাই সে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। বাহিরে অনেক খুজেছি কিন্তু পায়নি। তোকে যে বলব সেও সাহস আমার হয়নি।

আমান শ্রাবণ এর কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তবে কি সে শুভ্রা কে আবার হারিয়ে ফেলল?? সে ওখানেই ধপ করে বসে পরে। একদম চুপচাপ হয়ে যায়। তারপর ইউভীর হাত ধরে বলে,,

ভাইয়া তুমি তো ছোটবেলায় আমাদের সাথে খেলোনি,মিশোনি৷ আমি যতদিন থেকেছি ততদিন আমার ছায়াবিনী কে আগলে রেখেছি সে তো আমাকে বলেছিল আমায় কোনদিন ভূলবেনা। আমার ছায়াবিনী ছায়া হয়ে থাকবে তাহলে আমাকে সে কিভাবে ভুলে গেল?? আমার বদলে তোমায় কেন ভালোবাসলো ভাইয়া তুমি তো তাকে ভালোবাসো না। আমি কাউকে আপন করে পাইনা ভাইয়া। সবাই আপন হওয়ার আগেই চলে যায়। খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। আব্বুর জায়গায় আমাকে কেন খুন করলেনা বল??? আমাকে খুন কর ভাইয়া তোমার দোহায় লাগে৷

এই বলে আমান ইউভীর দুই পা ধরে কাদঁতে থাকে। ইউভী বাকরুদ্ধ তবেও তার নয়নেও নয়ননীর। সে কখনো আমান কে ভালোবাসেনি সব সময় তাকে ঘৃণা করেছে আর আমান তাকে ভালোবেসেছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে আমান কে উঠায় উঠিয়ে একনজর তার দিকে তাকায়। আমান এখনও কেদেঁ যাচ্ছে তার কান্না দেখে ইউভীর বুক ভারী হয়ে আসে৷ সে তার ছোট ভাই কে কখনো বাবার আদর পেতে দেয়নি এই ভেবে সেও ডুকরে কেদেঁ উঠে। শ্রাবণ এগিয়ে আসতে চাইলে ইউভী হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়৷

ইউভী আমান কে বলে খুব ভালোবাসিস শু কে??

আমান কান্নারত অবস্থায় কথা বলতে পারেনা। মাথা ঝাকিঁয়ে হ্যা উত্তর দেয়৷

ইউভী নিচে তাকিয়ে আবার আমানের দিকে তাকায়। আবার নিচে তাকায়৷ তার মন চাচ্ছে সে আমান কে জড়িয়ে ধরুক তার ও তো কেউ নেই। তবুও যেন বিবেক তাকে বাধাঁ দিচ্ছে। এমত অবস্থায় আমান তাকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে উঠে৷ মায়ের পর এই প্রথম ইউভী কে কেউ জড়িয়ে ধরল। আমানের নয়ননীর এ ইউভীর শার্ট ভিজে যাচ্ছে। ইউভী এবার আমান কে জড়িয়ে ধরে এতদিন পর তার ভালোলাগাকে সে খুজে পেয়েছে। যে শান্তি সে কালোজাদুতে খুজে বেরাতো তা সে তার ভাইয়ের মাঝে পেয়েছে। সে কান্নারত অবস্থায় হেসে বলে,

তুই তো বলেছিলি আমান যে আমি যেমন থাকি তেমন ই তোরা ভালোবাসবি। আমাকে ক্ষমা করে দিবি ভাই?? একবার মাফ করে দেনা আমিও সুখে নেই। আমিও তোদের ভালোবাসতে চাই। আমিও এই শুভ্রনীড়ের সদস্য হতে চাই। চল আমরা তিন জন শুভ্রা কে খুজতে যাবো। এরপর আমার আরোও অনেক কাজ বাকি আছে৷ এই বলে আমান আর শ্রাবণ কে নিয়ে ইউভী বেরিয়ে পরে শুভ্রার খোজে।

__আমানের সাথে যখন ইউভী দাঁড়িয়ে ছিল তখন সামিহা তাদের দেখে নেয়৷ তাদের দেখে সে বুঝে যায় ইউভী আর তাদের দলে নেই। তাই সে তাদের আগেই শুভ্রা কে খুজতে বেরিয়ে যায়। সে এক পর্যায়ে শুভ্রাকে পেয়েও যায়। কেননা শুভ্রা শুভ্রনীড় থেকে সোজা বেরিয়েছে কোন বাকে ওদিক সেদিক যায় নি। তাই তাকে খুজে পেতেও সামিহার বেগ পেতে হয়নি। সে গিয়ে দেখে শুভ্রার প্রচন্ড জ্বর এসেছে। জ্বরের কারণে সে অজ্ঞান হয়ে গেছে।সে কোন মতে শুভ্রাকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসায়। আর বেড়িয়ে পরে তার প্রধানের উদ্দেশ্য। সে তাকে গিয়ে বলবে এখন সব কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ইউভীও ভালো হয়ে গেছে এই রকম চললে তো তাদের উদ্দেশ্য সফল ই হবেনা। আর ইউভী আমান যে তাদের তো বলি দেওয়া যাবেইনা শুভ্রাকেও পেতে দিবেনা। তাই বেশি ভালো হয় শুভ্রাকে আজই বলি দেওয়া। তারপর না হয় ইউভী আমানের পালা। এই ভেবে সামিহা তাড়াতাড়ি গাড়ি চালায়।

_অন্যদিকে মিরা তাদের কাজের লোক কে পুরো বাংলোটা ঝাড়ু দিতে বলে। সে সব রুমে ঝাড়ু দিতে গিয়ে দেখে প্রতিটা রুমের বেডের নিচে ছাই জাতীয় কিছু রাখা আছে। প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে যখন সব রুমে পায় তখন মিরাকে বলে দেয়৷ মিরা ভেবে পায়না এসব কি?? এমনিতেই শুভ্রাকে পাওয়া যাচ্ছেনা তার ভিতর এইগুলা? তাই সে কাজের লোক কে বলে এইগুলা যেন না ভাবে৷ আর তাকে বলে স্টোর রুমটাও পরিষ্কার করতে৷কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো রুমের আসল চাবি দিয়েও তালা খুলছেনা। অনেক চেষ্টা করে যখন পারেনা তখন কাজের লোকটি আবার মিরা কে বলে। মিরা এবার বিরক্ত হয়ে যায়। নিজেই দেখতে যায় আসল ঘটনা কি? সে এসে দেখে সত্যি তাই। তাহলে তালা কে পাল্টালো?? মিরা কাজের লোক কে বলে তাদের মালী কে খবর দিতে এসে আসলে সবাই মিলে দরজাটাই ভাঙবে। মালী আসলে সবাই মিলে অনেক কষ্ট করে দরজা ভাঙে তারপর দেখে____

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here