শিশির_কণা
শামসুল ইসলাম
( পর্বঃ- ৭)
আমি মনেমনে দো’আ ইউনুছ পড়লাম যা দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য সর্বোৎকৃষ্ট দো’আ-
لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
আপনি ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র-মহান, নিশ্চয় আমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত।
উচ্চারণঃ- লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায-যা-লিমীন”
পড়ে ভোঁদৌড় দিলাম যা হয় হবে। অনেকক্ষণ দৌড়াই কিন্তু পথ শেষ হয়না, সামনের দিকে দৌড়াই আবার পিছনে তাকাই। প্রায় বিশ মিনিট দৌড়ানোর পর সামনে একটা টগবগে যুবক পেলাম, দুহাত উঁচু করে বললাম-
-” প্লিজ ভাইয়া আমাকে সাহায্য করুন, কঠিন বিপদে আছি। আমি পরিক্ষা দিতে যাচ্ছি কিন্তু পথিমধ্যে একদল নরপিশাচ আমার সর্বনাশ করার জন্য আমার পিছু তাড়া করেছে।”
-” আচ্ছা আচ্ছা!! আপনি থামুন আমি দেখছি।”
অপরিচিত যুবককে দেখে বেশ নম্র ভদ্র মনে হলো, পরিমার্জিত পোশাক পরে বেশ পরিপাটি হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এপথে কয়েক গ্রামের জনমানব চলাচল করেন, যারকারনে অপরিচিত সাহায্যকারী আমার ভাগ্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আল্লাহপাক।
আমি অনবরত হাঁফাতেই আছি, খেয়াল করলাম নরপিশাচের দল অপরিচিতকে দেখে ফিরে গেলো।
অপরিচিত আমার এমন ভয়ার্ত চেহারা আর হাঁফানো দেখে এক ফালি মুচকি হাসি দিয়ে-
-” ভয় পাবেননা, আর কোনো সমস্যা নেই দুষ্টুরা ফিরে গেছে। আচ্ছা তাঁরা কেনো আপনাকে এমন পিছু নেই?”
সবকথা অকপটে খুলে বললাম অপরিচিতকে।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন-
-” কি পরিক্ষা হচ্ছে আপনার?”
-” এইসএসসি।”
-” বাড়িটা কোথাই?”
-” পাশে মোহনপুর গ্রামে।”
-” বাবার নাম কি?”
আমার রাগ উঠে গেলো, বাহারে!! আমাকে সাহায্য করেছো বেশ ভালোকথা এতো বাবার নামের কি দরকার?
তবুও নিরুপায় হয়ে বললাম-
-” বাবা নেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন অনেক বছর হলো। আমরা দুইবোন সহ আম্মু তিনজন নানু বাড়িতে থাকি।”
-” ওহ দুঃখিত !! তো নানার নামটা জানতে পারি?”
আমার সত্যিই রাগ হচ্ছে, এই ক্যাবলা টাইপের লোকটি বারংবার এতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে কেনো?
তবুও নিজেকে সংবরণ করে বললাম-
-” নানুর নাম জিন্নাৎ শেখ, বড়ো মামা আলতাফ হোসাইন।”
ক্যাবলা মার্কা লোকটি আমার দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-
-” তার মানে তুমি তাহমীনা আন্টির মেয়ে?”
আমার রাগ হচ্ছে প্রচণ্ড!! লোকটি আমাকে উদ্ধার করেছেন ঠিকআছে কিন্তু বারংবার প্রশ্ন করে কেনো?
এদিকে আমার পরিক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে।
অপরিচিত যুবককে কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না, আমি ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম-
-” অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে ভাইয়া, আমার কঠিন বিপদে সাহায্য করার জন্য। এখন আসি আমার যেতে হবে দশটা থেকে পরিক্ষা দো’আ করবেন।”
-” ওহ!! ভুলেই গেছিলাম তোমার পরিক্ষা, চলো এগিয়ে দিয়ে আসি।”
আমার রাগ চরমে উঠছে, একটু খানি পরিচিত হয়েই তুমি বলা শুরু করে দিয়েছে।
দুজনে হাটা শুরু করলাম, বেশ কিছুক্ষণ পর প্রধান সড়কে পৌঁছালাম। একটা গাড়িও পাচ্ছি না, আবার সময় হয়ে এলো প্রায়। আমি অস্বস্তিবোধ করছি ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারলেন।
আমাকে বললেন-
-” আচ্ছা যে তোমাকে এমন বিরক্ত করলো, তাঁর নামে একটা ডাইরি করোনা কেনো থানাই?”
-” আসলে ভাইয়া বিষয়টা বাড়িতে যাইনি এখানো তাই করা হয়নি।”
-” কাজটি ঠিক হয়নি, সদাসর্বদা যে কোনো নমস্যায় মুরুব্বীগনকে বলতে হয় তাদের পরামর্শ গ্রহন করতে হয়।”
-” জ্বি ভাইয়া!! বলবো।”
আমি চরম বিরক্ত হচ্ছি মানুষটির উপরে, বেশি কথা বলে যা আমার চরম অপছন্দ।
লোকটি বললেন-
-” একটা গাড়ি আসছে হয়তো যেতে পারবে, সাধানে চলাচল করবে। আর মোন দিয়ে পরিক্ষা দিও, তাহমীনা আন্টিকে বলবে রমিজ উদ্দিনের ছেলে শিশির সালাম দিয়েছেন, আসি তাহলে ভালো থেকো।”
“শিশির” শব্দটি শুনে আমার বুকের ভিতরে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। অপলক দৃষ্টিতে শিশির নামে চলে যাওয়া ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যতোক্ষন দেখতে পেলাম ততোক্ষণ তাকিয়েই থাকলাম।
শিশির নামটি শুনে আমার পুরনো সব স্মৃতিকথা মনের পর্দাই ভেষে উঠলো। মনের অজান্তে চোখের কোনে অশ্রুকণা জমা হলো নিজেকে সামলে নিয়ে পরিক্ষার উদ্দেশ্যে গাড়িতে রওনা করলাম।
★★★
পরিক্ষা শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসলাম, মণিকে বিস্তারিত খুলে বললাম। সে কথাগুলো শুনে রীতিমতো চুপসে যাই, সে বললো আর লুকিয়ে রাখা ঠিক হবে না বিষয়টা।
আমি আম্মুকে বিষয়টা জানালাম, তিনি অনেক রাগ করলেন এতোদিন না জানানোর জন্য। আম্মু কেঁদে ফেললেন, যদি আমার কিছু হয়ে যেত এভয়ে।
আম্মু বিষয়টা নানা সহ মামাদের খুলে বললেন। মামারা সিদ্ধান্ত নিলেন ড্যানি সহ তার চরদের বিরুদ্ধে ইভটিজিং এর মামলা দায়ের করবেন।
বড়ো মামা নানু ভাই আম্মুর সাথে পরের দিন থানাই গেলাম, গতকাল যেতাম কিন্তু রমজানের কারনে যাওয়া হয়নি সাথে আমিও অনেক ক্লান্ত অবসন্ন ছিলাম। সকাল ১১ টার ভিতরে থানাই পৌঁছালাম, পুলিসকে সবিস্তারে বর্ননা করে মামা বললেন-
-” আমরা ড্যানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে চাই, সে গ্রাম সহ আশেপাশে অনেক মেয়েকে ইতিপূর্বে অনেক নির্যাতন অপদস্থ করেছে। তার অপরাধের জুড়ি নেই, সাথে কিছু সাঙ্গপাঙ্গ আছে যারা অন্যায়ের চরম পর্যায় অবস্থান করছে।”
ওসি সাহেব বললেন-
-” আলতাফ সাহেব দেখুন আমরা সরকারি চাকরি করি এইজন্য কিছু বাধ্যবাধকতা আছে, যারকারনে সমাজের অপরাধ নির্মূল করা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাই। কিছু মানুষ সমাজের রাঘববোয়ালদের ছত্রছায়ায় নানাবিধ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করছে। সুতরাং আলতাফ সাহেব সরি!!
আমরা আপনার মামলাটি এই এমুহূর্তে নিতে পারছিনা। ”
একরাশ হতাশা নিয়ে আমরা থানা থেকে ফিরে আসলাম। বেশ অনেকদিন কেটে গেলো, মণির কলেজ বন্ধ এইজন্য তাঁকে বা আমাকে বাইরে যেতে হয়নি। ড্যানির সাথেও আমাদের আর দেখা সাক্ষাত হয়নি।
আজ রমজানের ২১তম দিন, মনে হচ্ছে এবার ২৯ টি রমজান হবে। হঠাৎ দুপুরবেলা শুনতে পেলাম যে ক্যাবলা মার্কা লোকটি আমাকে সাহায্য করেছিল সেই শিশির আমাকে নাকি বিয়ের জন্য দেখতে আসবে।
আমার মোনটা ভীষণ খারাপ, এই শিশির নামের ছেলেদের দেখতে পারিনা সেদিনের পর থেকে।
পরের দিন সকাল থেকে রান্নাবাড়ার কাজকর্ম শুরু করলেন মামিরা, ছেলে ও সাথে দুচার জন মুরুব্বীগন আসবেন। ইফতার পর্বঃ আমাদের এখানে এসেই করবেন তাঁরা। আম্মু বড়ো মামাকে দিয়ে প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যসামগ্রী কিনিয়ে আনলেন।
আমার মটেই ইচ্ছে নেই বিয়ে করার, একান্ত ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয় পড়বো এখন। কিন্তু ড্যানি আমার স্বপ্নের পথে সবথেকে বড়ো অন্তরায়।
মণিকে বললাম-
-” আমি বিয়ে করতে চাইনা পড়াশোনা করবো।”
-” কি বলা উচিৎ ঠিক বুঝতে পারছিনা আপু, তবে আম্মু মামারা তো দেখছি লোভনীয় সম্মন্ধ সুযোগে লুফে নিতে চাই। বর্তমান পরিস্থিতিতে তোমাকে বিয়ে করাটা খারাপ হবেনা কারন পারিপার্শ্বিক অবস্থা একদম বেহাল অবস্থা। সভ্যসমাজের অসভ্য জনমানবের জন্য অসহায় নিপীড়িত মানুষের জীবনযাপন অতিষ্ঠ। এদের বিচার দুনিয়ার প্রচলিত নিয়মে হবে না, পরকালে আল্লাহপাক জার্রার থেকেও ছোট পরিমান অপরাধের বিচার করবেন। হতাশ হবেনা সর্বাত্মক মাবুদ মাওলার প্রতি ভরসা রাখো ইনশাআল্লাহ্ সুফল পাবে।
তবে আরেকটি বিষয়ে চরম অপছন্দ আমার তা হচ্ছে বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্মকে প্রাধান্য না দেওয়া।
ছেলের টাকা আছে ও বংশমর্যাদা থাকলেই আমাদের বাবা মা তার হাতে কন্যাদান করে হাঁফ ছেড়ে বাচেন। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর তাকওয়া বা খোদাভীতি দ্বিনদারীতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা তা চরমভাবে অবহেলা করছি ফলে সংসার জীবনে অশান্তি অহরহ হচ্ছে যা আমাদের সামনে পরিস্ফুট।
তবে আপু আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যার মধ্যে দ্বীনদারীতা নেই তাকে বিয়ে করবো না ইনশাআল্লাহ্।”
মণির দীর্ঘক্ষণ কথাগুলো মনযোগী হয়ে শুনলাম। কি আর বলবো বুঝতে পারছিনা, তাই চুপ করে বসে থাকলাম।
বেলা গড়াতে গড়াতে আসরের পর বেশ কয়েকজন নতুন মেহমান আসলেন।
আমাকে সবাই সাড়ি পরিয়ে দিলেন, সাথে একটু আটা ময়দা (প্রসাধনী) মাখিয়ে দিলেন। কিন্তু মণির ব্যাপক আপত্তি এসব নিয়ে, একপর্যায় আম্মুকে রাগ করে বললো-
-” কি সব কাজ শুরু করেছো? ইসলামের হুকুম আহকাম অমান্য করে তুমি পরপুরুষের সামনে পাঠাচ্ছ। এসব বিধান শরিয়তে নেই, পরস্পর ছেলে মেয়ে শালীনতা বজাই রেখে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারবে। আর ছেলের পরিবার থেকে তাঁদের মেয়েগন দেখতে পারবেন। তাছাড়া এসব মুরুব্বিয়ানেরা দেখতে পারবেনা যতোই তুমি পুরনো রীতিনীতি দেখাও, ইসলাম কখনোই বাবা দাদা থেকে আসিনি, সুতারাং আম্মু তোমার মেয়েকে গরুর হাটের মতো সবার সামনে উপস্থাপন করবেনা দয়া করে।
আর এই যে প্রসাধনী মাখাচ্ছ, যদি চেহারার সামান্য বিকৃতি হয়ে যাই তাহলে সেটা প্রতারণা ছাড়া অন্য কিছুই নয়।”
-” সব বুঝলামরে মণি, কিন্তু এখন উপায় নেই সবাই অপেক্ষা করছে কণার জন্য।”
★★★
আমি খুব স্নায়বিক অনুভ করছি, একা একটা মেয়ে চেয়ারে বসে আছি চার পাঁচজন পুরুষের সামনে।
এক মুরব্বী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
-” আসআল্লাহ মেয়েডা ভালো, তো তুমার নাম কি মা?”
-” শামীমা আক্তার কণা”
-” কোন কিলাস পন্ত পড়েছ?”
-” এইসএসসি পরিক্ষা দিলাম এবার।”
পার্শ্ব থেকে আরেক মুরব্বী বললেন-
-” তা মা তুমি কি কি রানতি জানো?”
-” মোটামুটি প্রায় সব পারি।”
-” বলো দিনি কোন কাজ যতো করা হয় ততো পিছাতি হয়?”
-” ঘর লেপতে বা মুছতে গেলে।”
-” মেয়েডা তো ভালোই পারে দেখি!!”
সর্বশেষ আরেকটি মুরব্বী বললেন-
-” বলো দিনি মা কোন সুরোই মিসমিল্লাহ নেই?”
আমি চুপ হয়ে থাকলাম, কি উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছি না, কারন ইসলাম সম্পর্কে বেশি জ্ঞান নেই। গা হাত পা ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করেছে, শরির ঘেমে শাড়ী ও মেকাপের সইলাব হওয়ার উপক্রম। বিষয়টা প্রথম যে মুরব্বী প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বুঝতে পেরে বললেন-
-” যাও মা, আমাদের সবার পছন্দ। শুভ কাজে দেরি করতে নেই আগামী ঈদের পরে দিন বিয়ে।”
সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো।
বিয়ে শব্দটি শুনেই আমার ভিতরে ধপাৎ করে উঠলো। এক পলক শিশিরের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে চেয়ে লোকটি মিটিমিটি হাসছে। দেখে আমার গা জ্বলে গেলো, আমার বিয়ের প্রতি কোনো ইচ্ছে নেই একদম।
সবাই রাজি!! সপ্তাহ খানেক পর আমার বিয়ে। ছেলে পক্ষের কোন চাহিদা নেই।
আমি অরাজি তবুও আম্মু সহ সবাই অনেক বোঝালো। ড্যানির কথা বললো এসব সাতপাঁচ ভেবে বিয়েতে রাজি হলাম।
সেদিন রাতেই শিশির আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে আমাকে ফোন দেই।
আমি একবারে চিনতে পারি বেচারা কে!
এভাবে আমরা দুপাঁচ মিনিট করে কথা বলতে বলতে একপর্যায় দুজনে বিয়ের আগেই মোন আদান প্রদান করে ফেলি।
আগামীকাল বিয়ে, এখন রাত ৯ টা বাজে হয়তো। শিশির ফোন করলো, আমি সালাম দিলাম। সে জবাব দিয়ে বললো-
-” কণা আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমি পারিপার্শ্বিক কারনে তোমাকে বিয়ে করতে পারছিনা। যা খরচাপাতি হয়েছে সব আমরা পরিশোধ করে দিবো………(চলবে)