শিশির_কণা
শামসুল ইসলাম
#(পর্বঃ- ৬)
।
-” আপু এখনি উত্তম সময় ক্ষমা চাওয়ার!”
-” এখন হবে কেন? সময় অসময় আছে না!”
-” না আপু ইস্তেগফার ও তওবার কোনো নির্দিষ্ট সময় অসময় নেই। ভুলবশত পাপ করে ফেললে সাথেসাথে ইস্তেগফার করতে হবে। তবে এখন আরেকটি উপায়ে তোমার মনে শীতলতা আনতে পারবে।”
-” কিভাবে?”
-” এখন রাত প্রায় ৩ টা বাজতে গেলো, চলো দুইবোন কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জত আদায় করি। এই সালাত নফল ইবাদতের ভিতরে সবথেকে উত্তম ও ফজিলতপূর্ন সালাত।
শেষরাতে উঠে আমরা যদি আমাদের মনের সমস্ত জালা যন্ত্রণা ব্যাকুলতা চাওয়া ইত্যাদি প্রকাশ করতে পারি তাহলে দেখবে আমাদের মনের ভিতরে আল্লাহপাক প্রশান্তি ঢেলে দিবেন।
আমাদের নাবী কারিম (সাঃ) বলেছেন-
আল্লাহপাক প্রতিদিন রাতের এক তৃতীয়াংশে প্রথম আসমানে আগমন করেন এবং বলতে থাকেন, আমি রাজাধিরাজ, আমি রাজাধিরাজ। কে আছো ক্ষমা প্রত্যাশী? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। কে আছো রিযিক প্রত্যাশী? আমি তাকে রিযিক প্রদান করবো। এভাবে আল্লাহপাক সুবহে সাদিক পর্যন্ত ঘোষনা করতে থাকে।
যারা আল্লাহপাকের এই অফুরন্ত নেয়ামত হতে বঞ্চিত না হতে চান তারা ঠিকি মধ্য রাতের এই সময়টা লুফে নেই।”
-” চল তাহলে এখনি তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করবো?”
-” চলো আপু?”
নিচে নেমে ওযু করে সালাতে দাড়ালাম। সালাত পরিসমাপ্তি করে সত্যিই এক শীতলতা মনের ঘরে বয়ে যাই। যা কখনোই অনুভব করিনি। সালাত পড়ে কোরআন তেলায়ত করতে বসলাম, কিছুক্ষণ পর মসজিদ থেকে নানুর কণ্ঠে সুমধুর আযানের ধ্বনি ভেসে আসলো।
আম্মু একটু ঘুমিয়েছিল, তাঁকে ডাকলাম। তিনি উঠে ওযু করে আলেন, তিনজন সালাত আদায় করলাম।
আম্মু বললেন-
-” সারারাত ঘুমাসনি তোরা এখন ঘুমা।”
বাধ্য মেয়ের মতো ঘুমের রাজ্যে ডুবে যাই।
সকাল ৮টার সময় আম্মু আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।
উঠে ফ্রেশ হলাম, মণি আমাকে ডেকে বললো-
-” আপু আরুজ মাতবরের ছেলে ড্যানি আমার কলেজে যাওয়ার পথরোধ করে দাড়ায়। মাঝেমধ্যে ঝামেলা করে এমন।”
-” কি বলিশ!! এতদিন বলিসনি কেন?”
-” ভেবেছিলাম কিছু নীতিকথা শুনিয়ে দিবো, আল্লাহপাক চাইলে তাঁর হেদায়েত নসিব হবে।”
-” নসিব হয়েছে?”
-” না দিনদিন বেশিবেশি বিরক্ত করছে, প্রতিটাদিন প্রায়ই তার কিছু দুষ্টু বন্ধুবান্ধব আছে তাদের নিয়ে আমাকে কোনোদিন সরাসরি ব্যাঙ্গ করে আবার কোনোদিক দুর থেকেই কটুকথা বলে।”
মণির কথায় মহাজাগতিক সমস্ত চিন্তা আমার মাথাই ভর করলো, কি করা যাই?
কারন ড্যানি এলাকার একমাত্র কুলাঙ্গার, যে শতশত মেয়ের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। অনেক অবলা নারী তার ফাঁদে পা দিয়ে অকালে জীবন হারিয়েছে আত্মহত্যা করে।
আরুজ মাতবর এলাকার সম্ভ্রান্ত লোক যার অন্যায় কুকর্মের জুড়ি নেই। সমাজের নিরীহ মানুষগুলোকে কিছু নেতার ছত্রছায়ায় তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে।
আমার ভয় হচ্ছে, এসব কথা যদি আম্মু ও মামারা শুনতে পাই তাহলে আমাদের দুইবোনের কাওকে আর কলেজে যেতে দিবেনা সরাসরি শশুরবাড়ি যেতে হবে আমাদের।
নানা মামারা কখনোই ঝামেলাবাজ পছন্দ করেননা, অনেক সরল সোজা কথার মানুষ তাঁরা। ড্যানির কথা শুনে মহা বিপদে পড়লাম, এসব ভাবছি গভীরভাবে।
মণি আবার বললো-
-” আপু কি করা যাই বলো?”
-” কি করবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না মণি!”
-” মামারা যদি জানতে পারেন তাহলে তো আমাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে!”
-” হ্যাঁ, আচ্ছা তোকে কি কি কথা বলে?”
-” জঘন্যতম কথা বলতে পারবোনা।”
-” আচ্ছা থাক তাহলে, শোন?
-” বলো আপু!”
-” তোকে প্রতিদিন আমি এগিয়ে দিয়ে আসবো। তোর কোনো বন্ধুবান্ধবি থাকলে ভালো হতো তাদের সাথে নিয়মিত যাতায়াত করতে পারতিস। কুলাঙ্গারদের কটু কথা থেকে রেহাই পেতিস।”
-” তা হতো, তবে এখন কলেজে যাবো তাহলে চলো এগিয়ে দিয়ে আসবে?”
-” আচ্ছা রেডি হ, আমি একটু মাথাটা আঁচড়িয়ে নিই।”
-” তুমি কি খালি মাথাই যাবে?”
-” না, ওর্না থাকবে। ভয় নেই ঢেকেঢুকেই যাবো।”
-” আচ্ছা রেডি হও।”
★★★
মণিকে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলাম, যাওয়ার সময়ে পথে কাউকে দেখতে পেলামনা। ফিরতি পথে আসার সময়ে দেখি রাস্তার মোড়ে ড্যানি সহ তার সাঙ্গপাঙ্গরা দাড়িয়ে আছে।
আমার বুকের ভিতরে ধকধকানি শুরু হলো, তবুও নিজের ভিতরে সাহস সঞ্চার করলাম। মনেমনে ইচ্ছা পোষন করলাম, যদি আমাকে কটু কথা বলে তাহলে উত্তমমধ্যম কিছু বাণী শুনিয়ে ছাড়বো।
মাথানিচু করে হাটতে থাকলাম, হাটার মাঝেই এক পলক খেয়াল করলাম তার ভিতরে একজন আমার দিকে ক্ষুধার্ত কুত্তার মতো চেয়ে আছে।
আমি তাদেরকে অতিক্রম করলাম, কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। মনেমনে খুশি হলাম, যাকগে বেয়াদবগন হয়তো মানুষ হয়েগেছে।
কিন্তু তাঁদের থেকে পাঁচ গজ সামনে না যেতেই শুনতে পেলাম-
-” কি গো বোরখা সুন্দরীর বোন কমলা সুন্দরী?”
কমলা সুন্দরী বলার কারন, আমার থ্রিপিচের রঙ কমলা।
আমি হাটা থামিয়ে দিলাম, মনেমনে কিছু একটা ভেবেচিন্তে তাঁদের দিকে তাকালাম। দেখি আরো কটুকথা বলে হাসি তামাশা করছে। মেজাজ আমার গরম হয়ে গেলো।কালক্ষেপণ না করে দ্রুতপায়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলাম, বললাম-
-” তোদের ঘরে কি মা বোন নেই?”
-” মা বোন সব আছে সুন্দরী, কিন্তু তোমার মতো মাল নেই।”
ড্যানি কথাটি শেষ করার সাথেসাথে সবাই ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসতে থাকে।
তাদের অসহ্য হাসিতে আমার মাথাই খুনচাপা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।
একপর্যায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে যতো জঘন্যতম গালি আছে সব তাদের প্রয়োগ করলাম।
ড্যানির সাথের সমস্ত সাঙ্গপাঙ্গরা আমার কথায় একদম চুপসে যাই।
কিন্তু ড্যানি বললো-
-” ঐই এতিমের বাচ্চা এতিম, তোর বাবার কোনো পৈতৃকভূমির ঠিক নেই তোর মুখে এতোবড় কথা আসে কোথা থেকে?
আমি তোকে দেখে নিবো, সেদিন সুদেআসলে সব উসুল করে নিব।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা করলাম।
সারাপথ চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি পৌঁছালাম, কাউকে কিছু বললাম না। বাবা হারা সন্তান আমি মানুষের কটু কথা ও আমারা সমাজের জন্য কীট হিসাবে আবির্ভাব হয়েছি এসব বলে মোনকে শান্ত করলাম।
মণি দুপুরবেলা বাড়ি পৌঁছে আমাকে বললো-
-” আপু মনেহচ্ছে শয়তানদেরকে আল্লাহপাক হেদায়েত দান করেছেন। আজ দেখে হলো কিন্তু কিছুই বললো না।”
-” কি বলবে তোকে! যা বলার আমাকে বলেছে।”
-” কি বলো আপু!! কি বলেছে?”
মণিকে সবিস্তারে বর্ণন করলাম,সে আমার কথা শুনে রীতিমত থমকে যাই।
বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললো-
-” আপু সে চরম নষ্টালোক, যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে তাহলে তো মহাবিপদ।”
-” কিছুই হবেনা তুই ভয় পাসনা।”
★★★
বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলো, পরিক্ষা চলে এলো সাথে রমজানের আগমন। যারা ভুক্তভোগী তারাই অনুভব করবেন রমজানে পরিক্ষার কি যন্ত্রণা।
মোন দিয়ে পড়াশোনা করছি আর পরিক্ষা দিচ্ছি, দেখতে দেখতে প্রায় শেষের দিকে পরিক্ষা। এতোদিন পরিক্ষা দিতে গেছি শহরস্থ একটি কলেজে, সাথে মামা বা আম্মু যেকোনো একজন যেতেন আমার সাথে, কিন্তু আজ কাউকে পাচ্ছি না। আম্মু জরুরি কাজে বাইরে গেছেন, মামারা সকাল থেকেই প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে অবস্থান করছেন। মণিকে সাথে নিব তা হলোনা, নানি একটু অসুস্থ যারকারনে তাঁর কাছে অবস্থান করছে সে।
নিরুপায় হয়ে একাএকা বের হওয়ার নিয়েত করলাম। আমাদের বাড়ি থেকে প্রধান রাস্তা পর্যন্ত অনেকক্ষণ হেটে যেতে হয় খোলা মাঠ অতিক্রম করে।
গত প্রতিটাদিন বের হবার সময় মণি একটা দো’আ শিখাই দিত তা হচ্ছে……
“بِسْمِ اللَّهِ، تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ
আল্লাহ্র নামে (বের হচ্ছি)। আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎকাজ করার) কোনো শক্তি কারো নেই।
উচ্চারণঃ- বিসমিল্লাহি, তাওয়াককালতু ‘আলাল্লা-হি, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”
কিন্তু আজ ভুলে গেছি পড়তে, অন্যদিন বোরখা পরে ভালোভাবে স্কার্ফ জড়িয়ে নিতাম মাথাই, কিন্তু আজ সখ করেই মুখটা খুলে রাখছি।
দশটার সময় পরিক্ষা দেড়ঘন্টা পুর্বে রওনা করলাম। ৮.৩০ দিকে বাড়ি থেকে বের হলাম, খোলা প্রান্ত মাঠ পাড়ি দিতে হবে, হাটা শুরু করলাম।
অনেকক্ষণ মাঠ পাড়ি দেওয়ার পর একটা গাছের পাশে দেখি ড্যানি সহ আরো দুতিন জন মানুষ দাড়িয়ে আছে।
তাদের দেখেই আমার ভিতরে ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। এই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে যদি কুলাঙ্গারের দলেরা আমার ওপর ছুটে আসে তাহলে কি করবো আমি একলা একটা অসহায় অবলা নারী?
ভিতরে নানান প্রশ্ন উকি দিতে থাকে, হাটার গতি মন্থর করে দিয়েছি। পা উঠতে চাইনা, তবুও হাটিহাটি পায়েপায়ে তাদের কাছে পৌঁছালাম, আমি সেখান থেকে দ্রুতপায়ে সামনের দিকে হাটা শুরু করলাম।
দেখি পিছন থেকে আমার নাম ধরে ডাকে-
-” এই কণা থাম, তোর দেমাক ছুটাবো আজ। তোর কবর থেকে বাবা এসে রক্ষা করে কি জীবিত বাবারা রক্ষা করে, তা না দেখে যাচ্ছি না।”
আমি ভয়ে শেষ, মনেহচ্ছে গলার পানি শুকিয়ে গেছে। তাদের দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে জুতা খুলে দৌড় দিলাম, অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর দেখি কুলাঙ্গারের দল আমার পিছুপিছু দৌড়াই। খোলা প্রান্ত মাঠে কোনো জনমানব নেই যে আমাকে শিয়াল কুত্তার হাত থেকে রক্ষা করবে।
আমি মনেমনে দোয়া ইউনুছ পড়ে ভোঁদৌড় দিলাম যা হয় হবে।………(চলবে)