“শিশির_কণা”পর্ব ২

২।।
#শবে_বরাত
ফজরের সালাতের পর মুসলিমা অনেকক্ষণ কোরআন তেলায়ত করলো। আমি মায়ের বকবকানিতে বাধ্য মেয়ের মতো পড়তে বসলাম। ভোর ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত একটানা পড়লাম।
সকালের নাস্তা পর্ব শেষ করে রুমে বসে আছি এমন সময়ে মুসলিমা ঘরে প্রবেশ করলো।
দেখলাম চুপচাপ বোরখা হিজাব পরে কলেজে যাবার জন্য প্রস্তুত প্রায়। আমি বললাম-
-” কি রে এতো ঢেকে ঢুকে এই গরমে থাকবি কি করে কলেজে?”
-” কি যে বলো না আপু! মটেই কষ্ট হয়না বরং ভালো লাগে নিজেকে পরপুরুষের কুদৃষ্টি থেকে হেফাজত করতে পারি। এবং দ্বিন পালনের মাঝে অনাবিল সুখশান্তি আছে, আর এটা আল্লাহর খাচ রহমত হাত মোজা পামোজাতে গরম লাগেনা।”
-” ভেরিগুড কথা, তো সকাল সকাল আসিস কাজ আছে।”
-” ইনশাআল্লাহ্‌ আসবো।”
মুসলিমা আর কথা না বাড়িয়ে কলেজে চলে যাই। আমিও কিছুক্ষণ পড়াশোনা করলাম।
এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করতে করতে দুপুরের সময় হলো। আজ নাকি “শবে বরাত” ইচ্ছা আছে রুটি বানিয়ে হাসের গোশত দিয়ে খাব, সাথে নারিকেল চাউলের সুজি দারুচিনি তেজপাতা ও একটু বেশি করে কিসমিস দিয়ে হালুয়া করবো।সকালে রুটির সাথে খেতে সেই মজা লাগবে আহা মনে হতেই জিহ্বায় পানি চলে এলো।
আমি রান্নাবাড়া খুব পছন্দ করি, রাঁধতে বেশ ভালোবাসি কিন্তু মায়ের রান্নাই কখনো সাহায্য করিনা, মা করতে দেইনা তবুও মাঝেমধ্যে একটু আধটু উদ্ভট কিছু মেনু তৈরি করে সবাইকে চমকে দিই।
আজ নিয়েত করেছি সন্ধার পর “শবে বরাত” উপলক্ষে গোসল করে রাতে পেটভরে হালুয়া রুটি খেয়ে সবাই একসাথে চৌদ্দ রাকা’আত সালাত আদায় করবো।
কারন হাদিসে পড়েছি এরাতের গুরুত্ব অপরিসীম অনেক সওয়াব ও বরকতময় রজনী।

আজ নিয়েত করেছি আম্মু আমি মুসলিমা
নানি মামানিরা সবাই একসাথে চৌদ্দ রাকা’আত সালাত আদায় করবো।

দুইটার দিকে মুসলিমা বাড়িতে আসলো, সে বোরখা খুলে হাত মুখ ধুয়ে আমার কাছে ফ্যানের নিচে বসলো।
আমি বললাম-
-” তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে সালাত আদায় করে নে, কাজ আছে।”

সে উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো-
-” কি কাজ আপু?”
-” ও মা দেখি ভুলে গেছিস!! কেনো মনে নেই তোর আজ “শবে বরাত” তাই হালুয়া রুটি সাথে গোসত রান্নাবাড়া করতে হবে। আজ মাকে সারপ্রাইজ দিতে হবে রান্না করে!”
-” একটা গল্প বলি?”
-” “শবে বরাত” নিয়ে?”
-” হ্যাঁ, একটু শুনেই দেখো!!”
-” বল শুনি তোর গল্প।”
-” একটা কথা আছেনা “দাদার কবর কোথায় আর দাদি কাঁদছে কোথায়”? ”
-” হ্যাঁ আছে, তো এর সাথে এটার সম্পর্ক কি?”
-” আগে বলো প্রবাদ বাক্যটি দ্বারা কি বুঝলে?”
-” সোজা কথা একদম! যেখানে কবর সেখানে না কেঁদে অন্য জাইগাই কাঁদছে।”
-” ভালোকথা বলেছো, এইভাবে তোমার হালুয়া রুটি তৈরির কাহিনী মিলে যাই।”
-” কিভাবে?”
-” খুবি সুক্ষ্ম বিষয়, আমরা “শবে বরাত” জানি পালন করি কিন্তু দাদির যেমন আবেগ ভালোবাসা সব আছে শুধু কবর না চেনার জন্য অন্য জাইগাই কাঁদছে। ঠিক এমন বাঙ্গালি মুসলিম আমরা, যা আমাদের ভালোবাসা আছে কিন্তু “শবে বরাত” টা আসলে কি কোথা থেকে এসেছি তা জানিনা উদ্ভট কিছু নিয়মকানুন তৈরি করে খুব জাঁকজমকভাবে পালন করছি। আসলেই “শবে বরাত” বলতে কিছু আছে যা সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, কিন্তু দুঃখের বিষয় “শবে বরাত” নামে কোনো হাদিস নেই। নামটা ভিন্ন যা হাদিসের ভাষ্যমতে “লাইলাতু নিসফি শা’বান” বা “মধ্য শাবানের রাত” বলা হয়েছে।”

-” হাদিসটা বল শুনি?”
-” আল্লাহ তায়ালা মধ্য শাবানের রাতে তার সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। [ ইবনু মাজাহ]
এই হাদিসটি আটজন সাহাবীর সূত্রে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত। এটাই একমাত্র সহীহ হাদিস।”
[খুতবাতুল ইসলাম, ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ]

আপু এটা কিন্তু আরবি শাবান মাসকে কেন্দ্র করে।
রাসুল (সাঃ) এমাসে বেশিবেশি নফল সওম পালন করতেন। এমাসে প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করেছেন।
এবিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
“ এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালোবাসি যে, আমার সিয়াম রাখা অবস্থায় আমার আমোল উঠানো হোক।”

এমাসে বিশেষ রাত হলো “লাইলাতু নিসফি শা’বান” যা আমরা “শবে বরাত” বলি। বাংলাই আমরা এটাকে “ভাগ্য রজনী ” বলে থাকি।
এবিষয়ে কিছু হাদিস প্রচলিত আছে যে, এ রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত মওত ও রিযক ইত্যাদির বিষয়ে অনুলিপি করা হয়। এ অর্থে কোনো সহীহ, হাসান বা কোনো গ্রহনযোগ্য হাদিস বর্ণিত হয়নি।”

-” আচ্ছা মুসলিমা এক মিনিট বিরতি, কথা হচ্ছে এবিষয়ে হাদিস শুনলাম কোরআনে নাকি আছে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম তাহলে সেটার কি ব্যাখা?”

-” জ্বি আপু, পবিত্র কোরআনে সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩ ও ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে। এবং এটার ব্যাপারে আরেকটা অপব্যাখ্যা আছে যা অনেকের অজানা তা হচ্ছে,
إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةٍ مُّبَٰرَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ
অর্থঃ আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
অর্থঃ এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়
স্থিরীকৃত হয়।
এর ব্যাখায় তাবিয়ী ইকরিমাহ বলেন, এখানে “মুবারক রজনী” বলতে মধ্য শাবানের রাতকে বোঝানো হয়েছে। তার মতে, এরাতে গোটা বছরের বিষয়ে ফয়সালা করা হয়। কিন্তু অন্যান্য সাহাবী তাবিয়ীগন বলেছেন যে, এখানে “লাইলাতুম মুবারাকা” বলতে লাইলাতুলকদর বুঝানো হয়েছে। মুফাসসিরগন ইকরিমার মত বাতিল বলেছেন এবং অন্যান্য সাহাবি তাবিয়ীগন মত গ্রহন করেছেন। “শবে বরাত” ফজিলত প্রমাণিত।
তবে এ আয়াতে শবে বরাতের কথা বলা হয়নি। কারন আল্লাহপাক কোরআনে স্পষ্ট বলেছেন যে, তিনি রমজানে কোরআন নাযিল করেছেন।
কাজেই উদ্ভট ব্যাখা দিয়ে কোরআন নাযিলের ব্যাখা দেওয়াটা ভিত্তিহীন ও অর্থহীন।
পাঠকদের অনুরোধ থাকলো বিষয়টা বিস্তারিত জানার জন্য তাবারী, ইবনু কাসির, রুহুল মাআনী, মাআরিফুল কোরআন সহ যে কোনো তাফসির দেখে পড়ে নিবেন।”
-” আচ্ছা তাহলে “শবে বরাতের” রাতে বইয়ে যে অনেক ইবাদত বন্দেগির কথা উল্লেখ আছে সেটার ব্যাখা কি?”
-” এখন কয়টা বাজে খেয়াল আছে? তিনটা প্রায়, চলো যোহরের সালাত আদায় ও খাওয়াদাওয়া করে “শবে বরাত” বিষয়ে আরো আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্‌।

★★★
আমার রান্নাবাড়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ করে দিলো মুসলিমা। খুব ইচ্ছা বিস্তারিত জানার, তাই অতিদ্রুততার সাথে গোসল খাওয়াদাওয়াসহ সালাত আদায় করে নিলাম।
বেশ খানিকক্ষণ পর আবার মুসলিমা কথাবলা শুরু করলো।
মুসলিমা বললো-
-” শবে বরাত উপলক্ষে গোসল যা সন্ধার পুর্বে বা এশার পরে এটার ব্যাপারে কোনো হাদিস নেই। বরং এগুলো জাল মিথ্যা বানোয়াট হাদিস।
[হাদিসের নামে জালিয়াতি, পৃঃ ৪৭৮]
“শবে বরাত” রাত্রে হালুয়া রুটি বা মিষ্টান্ন বিতরণ ও এ রাতে সকল ইবাদত করলে বিশেষ সওয়াব বা অতিরিক্ত সওয়াব পাওয়া যাবে এই মর্মে কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি। যে হাদিস পাবেন সেটা জাল বানোয়াট।
[হাদিসের নামে জালিয়াতি, পৃঃ ৫৪৯]
আমরা দেখেছি রাসুল (সাঃ) শাবান মাসে বেশিবেশি সিয়াম পালন করতেন, এমনকি প্রায় মাসই সিয়ামরত থাকতেন। কোনো নির্দিষ্ট দিন উল্লেখ নেই যে এত তারিখে সিয়াম পালন করেছেন যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
একটা হাদিস আছে যা ১২,১৪,৩০ ইত্যাদি রাকা’আত সালাত আদায় করা এবং এতো বার এ সুরা ইত্যাদি ইত্যাদি পড়ে পরের দিন সিয়াম পালন করার ফজিলত আছে। কিন্তু এ হাদিসটা জাল।
এবিষয়ে আরেকটি হাদিস আছে যেমন,
“যে ব্যক্তি শাবান মাসে ১৫ তারিখ সিয়াম পালন করবে, জাহান্নামের আগুন কখনোই তাকে স্পর্শ করতে পারবেনা।”
এই হাদিসটা “মোকছুদোল মো’মেনিন পৃঃ২৩৫ ও মুফতি ছামদানী, বার চান্দ পৃঃ ২৫” উল্লেখ আছে একদম জাল হাদিস।
[ হাদিসের নামে জালিয়াতি পৃঃ৫৫০]
আরেকটি জাল হাদিস,
“ যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত ও মধ্য শাবানের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবেনা যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে”
এই হাদিসের একমাত্র বর্ণনাকারী উপর্যুক্ত ঈসা ইবনু ইবরাহিম ইবনু তাহমান বাতিল হাদিস বর্ণনাকারী হিসাবে সুপরিচিত।
ইমাম বোখারী, নাসাঈ, ইয়াহয়িয়া বিন মঈন ও আবু হাতিম রাযি ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী রাবি বলে উল্লেখ করেছেন।
[হাদিসের নামে জালিয়াতি, পৃঃ ৫৪৪]

আরো কিছু হাদিস আছে যেমনঃ-
«» নাওয়াইতু আন উছল্লি……… বলে নিয়েত করা।
«» নির্দিষ্ট রাকা’আত সালাত পড়া।
«» পাঁচ রাত্রি ইবাদতে জাগ্রত হওয়া।
«» শবে বরাত রাত্রি রহমতের দরজাগুলো খোলা হয়।
«» পাঁচ রাত্রির দোয়া বিফল হয়না তার ভিতরে “শবে বরাত”
«» এ রাতে ভাগ্য হায়াত মওত রিযক নির্ধারিত হয়।
«» এ রাতে নেক আমলের সুসংবাদ।
«» ১৫ শাবান দিনে সিয়াম পালন ইত্যাদি কথাগুলো সব জাল হাদিস থেকে বর্ণিত।
[হাদিসের নামে জালিয়াতি, ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, পৃঃ ৫৪৪-৫৫২]”

-” আচ্ছা মুসলিমা সব তো জাল হাদিস পেশ করলি, তাহলে রাসুল (সাঃ) কিভাবে ইবাদত বন্দেগী করেছেন “ লাইলাতুল নিসফি শা’বান” মাসে?”
-” সেটা অবশ্যই বললো ইনশাআল্লাহ্‌, তার পূর্বে আমাদের আসরের সালাত আদায় করতে হবে। কারন নানুভাই মসজিদে আযান দিচ্ছেন।”
আমার নানুভাই মসজিদের মুয়াজ্জিন।

হঠাৎ আম্মুর আগমন সাথে এক প্লেট কুচিকুচি করে কাটা আম, রুমে প্রবেশ করে বললেন-
-” পড়াশোনা না করে কিসের এতো গল্প হচ্ছে শুনি?”

আমি বললাম-
-” আম্মু তোমার ছোট মেয়ে হালুয়া রুটি খাওয়া ভেস্তে দিয়েছে।”
-” কি বলিশ কণা?”
-” হ্যাঁ আম্মু, তোমার ধার্মিক মেয়ে কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়েছে অনেক, যেখানে “শবে বরাত” নিয়ে কনো কথায় নেই। বরং “ লাইলাতু নিসফি শা’বান” নামে একটি রজনী আছে যা আরবি শাবান মাস হিসেবে খ্যাত।”
আম্মু বললেন-
-” মুসলিমা তাহলে “ লাইলাতু নিসফি শা’বানের” করণীয় কি?”
-” আম্মু সব বলবো ইনশাআল্লাহ্‌, আগে আসরের সালাত আদায় করে নিই।”
-” আচ্ছা মা, তারপূর্বে আমগুলো সিগ্গির খেয়ে নে তাছাড়া আমে পানি ঝরছে মসলাপাতি নষ্ট হয়ে যাবে।”

আম্মুর হাতের মাখানো প্রতিটা খাবার আমার কাছে অমৃতের মতো লাগে। আমি আর লোভ সামলাতে পারলামনা, খাওয়া শুরু করে দিলাম………(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here