শিশির কণা
শামসুল ইসলাম
(পর্বঃ- ৫)

আম্মু আর মণির ঘুমন্ত পবিত্র মুখখানি এক পলক দেখে নিলাম। আজ আর এজীবন রাখবোনা, মানুষের অপমান তাচ্ছিল্য দুর্ব্যবহার আর সয্য হবার নয়। আল্লাহ মনে হয় আমাকে সৃষ্টি করেছেন সমস্ত কষ্ট সইবার জন্য, এইজন্য বাবা হারা আমি।
ঘরের পিছনে যাওয়ার জন্য হাটা শুরু করলাম। আমি অন্যদিন রাতে ঘর হতে একাএকা বের হতে অনেক ভয় পেতাম। কিন্তু আজ মনে দুর্দান্ত সাহস সঞ্চার করছি, জানিনা কিভাবে এতোটা সাহসিনী হয়ে পড়লাম।
দ্রুতপায়ে আমগাছের কাছে পৌঁছে গেলাম, কালক্ষেপণ না গরে ওর্নাটা ডালে বাঁধার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হচ্ছে না খাটো হবার কারনে কারন ওর্নার থেকে গাছের ডাল মোটা।
অনেকক্ষণ ব্যর্থ চেষ্টার পর হঠাৎ মনে পড়লো এসব না করে বাড়ির ভিতর থেকে রশি জোগাড় করি।
বাড়ির ভিতরে চারিদিকে খোঁজখবর করে অবশেষ একটা রশির সন্ধান পেলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। এদিকওদিক তাকিয়ে কাউকে পেলামনা, আর সময় নষ্ট না করে আম গাছের দিকে হাটা শুরু করলাম।
গাছে দড়ি বাঁধবো এমন সময় পিছন থেকে দ্রুতবেগে এসে জড়িয়ে ধরে চিৎকার শুরু করলেন বড়ো মামি-
-” কে আছো এদিকে আসো, কণা গলাই ফাঁশি দিচ্ছে।”
আমি ভেবাচেকা খেয়ে গেছি কি হতে কি হলো?নিজেকে প্রশ্ন করছি।
ইতিপূর্বে নিজের ভিতরে অনেক শক্তি সঞ্চার করেছি, কিন্তু এখন ভয়ে জড়সড় হয়ে যাচ্ছি। গা হাতপা মৃদু কাঁপছে, ভিতরে অজানা এক ভয়ে ঘেমে যাচ্ছে সমস্ত শরির।

আম্মু মণি দ্রুতবেগে আমার কাছে ছুটে এলো, আম্মু হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন-
-” মা আমার কেনো এমন করতে গেলি, বল তোর কি হয়েছে?”
কথাটি বলেই মা কাঁদতে থাকলো। মণি কাছে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো-
-” বুবু কেনো তুমি আমাদের ছেড়ে এমন ভুল সিদ্ধান্তটা নিতে যাচ্ছিলে?”
আমি নির্বাক কণ্ঠনালী স্তব্ধ কি উত্তর দিবো এবং কি বা জাবাব দিবো তাঁদের কাছে এই প্রশ্নে আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
আস্তেআস্তে ক্রমান্বয় লোকজন জড়ো হতে লাগলেন। আম্মু অনবরত কেঁদেই যাচ্ছেন সাথে মণি। নানা নানিও অনেক কাঁদছেন, সাথে মামারা নির্বাক আমার আচরণে কেনো এমন করতে যাচ্ছি আমি?
আমাকে ঘরে নিয়ে বসানো হলো, আম্মু সবাইকে চলে যেতে বললেন। আর বললেন-
-” আমার কণাকে একা থাকতে দিন, কেউ কোনো প্রশ্ন করেননা তাকে! আমি সাথে আছি।”
মণি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে, মনেহচ্ছে আমি সত্যিকার মৃত্যুবরণ করেছি। এতক্ষণ পরে একটু মায়া হচ্ছে আম্মু ও মণির প্রতি।
সবাই নিরব মনে কথা না বলে আম্মুর কথায় বিদায় নিলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর আম্মু বললেন-
-” মা তুই কেনো ও কোন কষ্টে এমন ভুল করতে গেলি আমি জানিনা। তবে তোকে আজ কয়েকটি কথা বলবো, তোরা দুইবোন মনযোগী হয়ে শুনতে থাক।”

★★★
দীর্ঘক্ষণ টুকিটাকি কথাবার্তা শুনলাম, এবার আম্মু বলতে শুরু করলেন-
-” তোর বাবা অনেক কম বয়সে মারা গেছেন, আমার বয়স ১৯-২০ বছরের বেশি নই। তবুও তখন দুই সন্তানের জননী আমি। তোদের মুখের দিকে চেয়ে আমি আর কখনোই দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা করিনি। মা বাবার কাছে এসেছি তোদের মানুষ করার জন্য।
আমি আমার জীবনের সমস্ত সখ আহ্লাদ ত্যাগ করেছি তোদের সুখের জন্য। তোর বাবা প্রবাসী ছিলেন, প্রবাস যাওয়ার তিনবছর পর তিনি কঠিন রোগে মারা যান। এই তিন বছরের ভিতরে একবার মাত্র অল্প কিছু দিনের জন্য বাড়ি এসেছিলেন। যেতে মানা করি এতো টাকা দরকার নেই আমাদের, আল্লাহপাক আমাদের দুইটা জান্নাত দান করেছেন তাদের সযত্নে মানুষ করবো তাতেই চলবে আমাদের।
কিন্তু তোদের দাদার সম্পদের লোভ, যারকারনে আবার প্রবাসী হন। এবার আর সশরীরে ফিরে আসেননি, এসেছেন সাদা কাফনে জড়ানো একটা কাঠের বাক্সে।
তোদের বাবা মারা যাবার দুইমাস পর দেশে লাশ পৌঁছে, যখন তিনি মারা যান তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একদম পাগলিনী হয়ে গেছিলাম, তোদের দুইবোনের ঠিকমতো খোঁজখবর পর্যন্ত নিতে পারতাম না। এক পর্যায় চরম অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি।
যাক সে কথা অন্যদিন শুনাবো, তো যা বলছিলাম তোদের বাবা!
তোদের বাবা যখন মারা যান তখন তেমন মাধ্যম ছিলোনা যোগাযোগ করার। চিঠির যুগ ছিলো তখন, আমি তোদের দুইবোনকে নিয়ে তোর নানুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। হঠাৎ একদিন তোর দাদা এসে বললেন-
-” বউমা বাড়ি চলো, কণার বাবা প্রবাসে অনেক অসুস্থ সেই চিঠি এসেছে।”
আমি কালক্ষেপণ না করে দ্রুতবেগে তোর দাদার বাড়ি চলে গেলাম।যেয়ে শুনি তিনি মারা গেছেন।”
কথাগুলো বলছেন আর আম্মু বারবার চোখ মুছছেন। আমি নির্বাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা দেখছি আর কথাগুলো শুনছি।
আম্মু আবার বললেন-
-” কণা! তোর বাবার লাশ দেশে আনা নিয়েও অনেক অনেক কথা।
যখর তিনি মারা যান, একদিন চিঠি আসলো লাশ দেশে ফেরত পাঠানো হলে সাথে টাকা পয়সা কিছু পাবেনা। আর যদি সেখানে দাফন করা হয় তাহলে অনেকগুলো টাকা পাওয়া যাবে।
তোর দাদা অকপটে বলে দেই-
-” সন্তান যেহেতু বেঁচে নাই লাশ দিয়ে কি করবো? কিছু টাকা আসুক যা দিয়ে তার এতিম সন্তানসন্ততিদের জন্য পুঁজি হবে।”
আমি তখন এককথাই বলি টাকা পয়সা কিছু চাইনা একমাত্র লাশ চাই, আমার সন্তানসন্ততি অন্ততপক্ষে বাবার আদর সোহাগ না পেলেও কবরটা দেখতে পাবে।
সবাই জোরাজোরি করার পর
দীর্ঘ দুইমাস পর লাশটা দেশে আসে।
তোর বাবার লাশের সাথে কিছু টাকা আসে, যা তোর দাদা চাচারা ভাগাভাগি করে ভক্ষণ করে। তোদের কথা কখনো ভাবিনি তাঁরা।
তোর বাবার লাশ দাফনকাফন সম্পন্ন হলে, তোদের নিয়ে আমি বাবার বাড়ি চলে আসতে চাইলে অনেক বাঁধা বিপত্তি দেখা দেই।
তোর দাদা বলেছিল-
‘তুমি একা যাও, এতিম মেয়ে দুটি রেখে যাও তোমার এখন কাচা বয়স আবার বিয়াশাদী করবে তখন বাচ্চা দুটি সব কুল হারাবে।
আমি বলেছিলাম-
‘ না বাবা কখনোই এমন হবেনা। আমার সন্তান নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিব।’ তাঁরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করিনি, যারজন্য তোদের দিতে কেউ রাজি হয়নি। তোদেরকে আমার কাছে রাখতে কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছি।
এই যে এতো বছর হয়ে গেলো, তোদের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। তোদের ভবিষ্যতের চিন্তাচেতনা মাথাই রেখে কতো মানুষের কতো কটুকথা হজম করেছি তার হিসাব নেই। আমার বাবা মা বেঁচে আছেন তাই এখানো শান্তিতে এখানে থাকতে পারছি আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে। ভাবিরা অনেক সময়ে আমাদের নিয়ে গালমন্দ করে সেদিকে কখনোই খেয়াল করিনি শুধু তোদের কথা ভেবে সব সহ্য করেছি।
এখন বল মা আমি তোকে কি এমন কষ্ট দিয়েছি যারকারনে এই মাকে রেখে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিচ্ছিলি?”
কথাগুলো বলে মা ডুকরে কেঁদে দিলেন। আমার চোখেও অশ্রুর ফোয়ারা গড়াচ্ছে। কথা না বলে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে-
-” আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দাও, এমন ভুল আর কখনোই করবো না।”
মণিও আমাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
আমরা তিনজন অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমার আম্মুর জীবনে ঘটে যাওয়ার প্রতিটা কথায় যা ইতিপূর্বে শুনিনি।
বেশ কিছুক্ষণ পর মণি বললো-
-” আপু চলোনা ছাদে যাই, দুইবোন জোছনাকুমারী হয়ে যাবো কিছুক্ষণ। চলো এক জাদুর পরশ দিবো যা তোমার হ্রদয় ছুয়ে যাবে।”
আমি কথা না বাড়িয়ে রাত দুইটার দিকে দুজনে ছাদের উপরে উঠালাম।
মণি কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললো-
-” আপু তোমার বোনকে মিথ্যা বলবেনা, কিছু জিজ্ঞেস করবো?”
-” বল, বলব না!!”
-” এমন মহাপাপ কেনো করতে গেছিলে?”

অনেকক্ষণ পর বললাম-
-” তোকে কথা দিয়েছি যে বলবো তাই বলছি, কারন একদিন বলেছিলি কথা না রাখা মুনাফিকের চরিত্র। তাই বাধ্যহয়ে সত্যাটা প্রকাশ করছি তোকে।”
-” জ্বি আপু সত্যকথায় আশা করি।”
শিশিরের বিষয়টা সম্পূর্ণ বর্ননা করলাম।
মণি হেসে উঠে বললো-
-” আল্লাহ কি বলো এ!! সামান্য একটা অপরিচিত ছেলের জন্য তুমি মহাপাপ করতে যাচ্ছিলে?
আপু যে তোমাকে চাইনা তাকে তুমি কেনো চাইবে?
যে তোমাকে তোমার দুর্বলার মুল্য না দিবে তাকে কেনো চাইবে?
যে তোমার এতিম হওয়াটা মেনে নিতে পারবেনা, সে পরে তোমার অন্যান্য দিকগুলো মেনে নিবে তার নিশ্চয়তা কি?
সবথেকে বড়ো কথা হচ্ছে তুমি যে প্রেম করেছো এটা ব্যভিচার। তোমার প্রতিটা কর্ম কিন্তু অবৈধ ছিলো, তোমার কথাবার্তা মোনের ভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি সব কিছু যেনার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
তোমরা যখন চ্যাটিং করতে গোপনে রাতের পর রাত তোমাদের মাঝে তৃতীয়পক্ষ ছিলো কিন্তু ইবলিশ?
সামান্যত প্রেমের ছ্যাকা খেয়ে বাকা হয়েগেছ, কিন্তু এই গোনাহের জন্য তোমাকে কঠিন জবাবদিহিতা করতে হবে তা কি তুমি জানো?
হয়তো জানো আবার জানোনা, খুব ভয়ঙ্কর সময় তখন সামনে উপস্থিত হবে তখন সন্তান বাবা মাকে দেখে পালাবে, বাবা মা সন্তানকে দেখে পালাবে আর শিশির! শিশিরকে তো পাবেই না সেদিন। সেদিন আমি তুমি কেউ কারোর নই, সামান্য দুনিয়ার মোহে পড়ে কতোনা পাপাচার করছি।
আর আল্লাহপাক তো ঘোষনা করেছেন কষ্টের পর স্বস্তি আসবে, তো দেখো তোমার সুখে মানুষ হিংসে করবে। মামানিরা তখন তোমার সুখ দেখে ঈর্ষান্বিত হবে।
আমরা আল্লাহপাকের এই বাক্যটি ভিন্ন অর্থ করে ফেলেছি, যেমন আল্লাহপাক সুরা ইনশিরাই বলেছেন-
“ নিশ্চয় কষ্টের পর স্বস্তি আসে”
কিন্তু আমরা অধিকাংশ বলি-
“ নিশ্চয় কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে”
কথাটা কতো বড়ো দেখলে আপু?
কেষ্ট হিন্দুদের একজন দেবতার নাম, যা আল্লাহপাকের বানীর ভিতরে প্রবেশ করেছি। বড়ো আফসোস আমাদের।
আরেকটি কথা আপু-
মানুষকে কটুকথা বলতে দাও, যদি প্রকৃত দোষী না হয় আমরা। তাহলে যে অপবাদ আমাদের দেই তারা সে অপবাদের গোনাহ তাদের আমোল নামাই জমা হবে।
মানুষকে কখনোই কষ্ট দিতে নেই, তাঁর ভুল হলে ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হয়। কখনোই সে বুঝ দেবার জন্য নিকৃষ্ট উদাহরণ উপস্থাপন করতে নেই।
মানুষের সব থেকে বড়ো আমোল হলো অন্যের প্রতি প্রিয়ভাষী হওয়া।”
-” সত্যিই বোন আমার তুই জাদুর ছোয়া দিলি আমার অন্তরে, অনেক পাপাচার করেছি এবার ক্ষমা চাওয়ার পথটা ধরিয়ে দিস?”
-” আপু এখনি উত্তম সময় ক্ষমা চাওয়ার!!”
-” কিভাবে?” …………(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here