শাপলার মৃত্যু
(১৮+ সতর্কতা)
নদীর ধারে ছয় বছরের মেয়ে শাপলার নিথর দেহ পরে আছে। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় তার দেহ ঝলমল করছে। চারিদিকে বসন্তের ফুরফুরে বাতাস। কিন্তু এ বাতাসে ফুলের কোনো সুবাস নেই বরং হীম জাগানো রক্তঘ্রাণ মরীয়া হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে।
সেই বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে স্রোতস্বিনীর স্রোত তেপান্তরে গিয়ে মিলছে। আর স্রোতের সাথে মিলছে গাঢ় লাল বর্ণের রক্ত!
শাপলার মাথা ভারী কোনো পাথর দিয়ে থেতলে দেওয়া হয়েছে। খুলি ফেটে, মগজ এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে। নাম না জানা কয়েকটি পোকা মগজের চারিপাশে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। নদীর পার দিয়ে চলে যাওয়া এই রাস্তাটি বেশ সুনসান। সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহূর্ত থেকেই কোলাহল কমতে থাকে। রাতে এদিকটায় কারো যাতায়াত নেই। তবুও আজ গ্রামের পূর্ব দিক থেকে সাইকেল চালিয়ে কোনো একজনকে এদিকটায় আসতে দেখা গেলো।

*

মনোয়ারা বেগম বাড়ির বারান্দায় বসে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছেন। তার মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ। পাড়া-প্রতিবেশিরা বাড়ির উঠোনে ভীড় জমিয়েছে। কেউ কেউ মনোয়ারাকে শান্তনা দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ দুচোখ ভরা কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শুধুমাত্র শাপলার বাবা হোসেন আলম নির্বিকার ভঙ্গিতে চৌকিতে বসে আছেন। সস্তা বিড়ি জ্বলছে তার ঠোঁটে।
স্বামীর এহেন আচরণে মনোয়ারা বিলাপ করতে করতে বলল,
মাইয়াডারে সন্ধ্যাকাল থিকা পাওয়া যাইতাছে না। আর হের বাপ পায়ের ওপর পা তুইলা বিড়ি টানতাছে। খোদায় কি বানানোর সময় বুকে একটুখানি মায়া দয়া দেয় নাই নাকি!

হোসেন কোনো উত্তর দিলো না। স্ত্রীর দিকে রাঙা চোখে একবার তাঁকিয়ে বিড়ি ফুঁকায় মনোযোগী হল। শাপলার বাড়ি থেকে হুটহাট গায়েব হয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। মেয়েটি অশান্ত প্রকৃতির। তার দুরন্তপনার কথা পুরো গ্রামবাসী জানে। এর আগেও বহুবার এরকম ঘটনা সে ঘটিয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পাশের গ্রামের কোন এক পাতানো বান্ধবীর বাড়িতে আছে! হোসেন সাহেবের বিশ্বাস তার মেয়ে ফিরে আসবে।

মনোয়ারা বারান্দা থেকে হাঁক ছাড়ল,
ও শাপলার বাপ! মাইয়াডা কই গেছে একটু খোঁজ নিয়া দেহো না। রাইত বাড়তাছে। মেয়েডা এহনো আইলো না।

হোসেন বিরক্তি নিয়ে বলল,
মেলা জ্বালাইতাছোস কইলাম! বারান্দায় বইসা বইসা তামাশা বাদ দিয়া ঘরে আইসা হুইয়া থাক। নটি পয়দা দিছোস একটা। কথা শুনে না। সারাদিন টই টই কইরা ঘুইরা বেড়ায়। মেয়ারে সামলাইয়া রাখবার পারস না?

মনোয়ারা এবার উঁচু গলায় হোসেনের বিরোধিতা করল। বলল,
খবরদার আমার মাইয়ারে গাইল দিবি না। তোর মায় নটি। হের লিগাই তোর মত হারামজাদারে জন্ম দিছে। মাইয়ারে খুঁইজা পাওয়া যাইতাছে না। আর তুই পায়ের ওপর পা তুইলা বিড়ি টানস!

হোসেন বিড়ি পায়ের নিচে পিষে মনোয়ারার দিকে তেড়ে আসল।
কি কইলি? আমি হারামজাদা? আমার মায় নটি?

পাড়া প্রতিবেশিদের সামনেই মনোয়ারাকে বেধড়ক প্রহার করতে থাকে হোসেন। মনোয়ারা ব্যাথায় কোঁকাতে থাকে। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীরাও যেনো একেকটি পাথরের মূর্তি। যেনো তাদের সামনে কোনো বাংলা চলচিত্রের শুটিং চলছে। দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর কোনো করণীয় নেই!

হোসেন ঠিক ততক্ষণ তার স্ত্রীকে প্রহার করতে লাগলো যতক্ষণ না তার তেষ্টা পেলো। গলা শুকিয়ে আসার পর সে স্ত্রীকে ফেলে ঘরে গেলো। মাটির কলস থেকে স্টিলের গ্লাসে পানি ঢেলে খেলো।
তারপর পুনরায় বারান্দায় এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের উদ্দ্যেশ্যে হুংকার ছেড়ে বলল,

তামাশা চলতাছে এইহানে? দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কি দেখতাছেন? যে যার বাড়ি যান। মাইয়া আমার নাকি আপনাগো? যার বিয়া তার খোঁজ নাই, পাড়ার মাইনষের ঘুম নাই! যান। যে যার বাড়িত যান।

উঠোনের লোকেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। ভীড় থেকে কোনো একজনকে বলতে শোনা গেলো,
বাপের এমন অবহেলা কোনদিন না মাইয়াডার জন্য কাল হইয়া দাঁড়ায়!

হোসেন ঘরে গিয়ে আবার একটি বিড়ি ধরালো। মনোয়ারা এখনো বারান্দায় বসে কাঁদছে। শাপলাকে হোসেন পছন্দ করে না। পছন্দ না করার পেছনে একটি বড় কারণ রয়েছে।
হোসেনরা দুই ভাই। তিনি ছোট। বাবা মারা যাওয়ার আগে বড় ভাই মোমেনের নামে তার সকল জায়গা জমি লিখে দিয়ে গেছে। হোসেনের নিজের বলতে শুধুমাত্র এই ভিটা-ই রয়েছে। মোমেনের এক ছেলে, এক মেয়ে। এদিকে হোসেনের একটা মাত্র মেয়ে। গত পাঁচ বছর ধরে আরেকটি বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্ত্রী কনসিভ করছে না। কত ডাক্তার, কবিরাজ দেখানো হলো। স্ত্রীকে কত গাছের রস, শিকর খাওয়ানো হলো। অমুক মাজারের তাবিজ, তমুক মাজারের তাবিজ এনে গলায় ঝোলানো হলো। হাতে বাঁধা হলো। নাহ। কোনো কিছুতেই লাভ হচ্ছে না। মেয়ে তো আর তার ভিটা বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। ছেলে না হলে, এই ভিটাও মোমেনের ছেলে হাতিয়ে নিবে।
এদিকে মেয়েটা হয়েছে অসম্ভব চঞ্চল। তার দুরন্তপনার কথা এগ্রাম কেনো? পাশের গ্রামে পর্যন্ত রটে গেছে। এই মেয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক!

হোসেন বিড়ি শেষ করে আরোও এক গ্লাস পানি খেলো। এরপর বিছানায় শুয়ে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে গভীর নিদ্রায় হারিয়ে গেলো।

রাত কয়টা বাজে তা আঁচ করা যাচ্ছে না।
মনোয়ারার চোখ দুটি এখন কাঁদতে কাঁদতে বেশ ক্লান্ত। সে ঝিম ধরে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছে। শীতল বাতাসের স্পর্শে তার শরীর মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে।

হঠাৎ উঠোনে সাইকেলের হর্ণ বাজিয়ে কেউ একজন ঢুকলো। মনোয়ারা তাড়াহুড়ো করে শাড়ির আঁচল দিয়ে বুক ঢাকলো। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় দেখতে পেলো পুরান বাজারের মকবুল ভাই এসেছে। তার চোখেমুখে এক অজানা আতঙ্ক। সে আমতা আমতা করে বলল,
ভাবী শাপলা!

কি হইছে শাপলার?

শাপলারে কেরা জানি মাইরা ফেলছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here