#শব্দহীন_অনুভূতি
#পলি_আনান
#পর্ব_১৫

দুপুরের কিছু আগ মূহুর্তে বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় মাইশা।কিন্তু যাওয়ার আগে সবার সাথে দেখা হলেও দেখা হয়নি নোমানের সাথে।

নিয়াজ মাইশাকে দেখেই ভড়কে যায়।কথা বলার স্টাইল আচার-আচরণ পোশাকে একদম ভিন্ন মাত্রর একটি মেয়ে।তানিয়ার কাছ থেকে জানতে পারে এই মেয়ে সদূর লন্ডন থেকে নোমানের জন্য বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখে আর নোমান কি না মেয়েটাকে এত কাছে পেয়েও পায়ে ঠেলে দূর করে দিচ্ছে। বিষয়টি হাস্যকর নিয়াজের কাছে।সে ঘাড় ঘুরিয়ে দোতালার রেলিঙের দিকে তাকালো। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি পরিধানকারী একটি মেয়ে। যার চোখ, মুখ কিছুই দেখা যাচ্ছে না।মেয়েটি হৃদিতা।

হৃদিতা আরাফের ভয়ে নিচে নামতেও পারছে না। তাই উপর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা পরখ করছে।নিয়াজ কি ভেবে যেন সরে গেলো কিচেনের দিকটায় আড়ালে সরে গেলো।নিয়াজকে আড়াল হতে দেখেই হৃদিতা মুখের দিকটায় শাড়িটা সরিয়ে নেয়।আর প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। এতোক্ষণ তার কাছে দম বন্ধ লাগছিলো। কিন্তু বেচারি যানে না তার দিকে দুটো চোখ বিস্ময় চাহনীতে তাকিয়ে আছে।নিয়াজ কিচেন থেকেই হৃদিতার মুখের একপাশটা দেখলো।বেগুনি রঙের শাড়িটায় তাকে যেন নিয়াজের কাছে একদম আবেদনময়ী লাগছে।মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে সে বলে”উফফফ পুরাই আগুন!
আরাফকে এগিয়ে আসতে দেখে আবারো কিচেনের দিকাটায় আড়াল হয় সে।হৃদিতাও তার রুমে ডুকে দরজা আটকে দেয়।

বাড়ির সবার আড়াল হয়ে নোমানকে ফোন করলো আরাফ।পার্টির কাজে ইদানীং নোমান একটু বেশি ব্যস্ত থাকে,
– হ্যালো নোমান ভাই,
– হ্যা বল।
– মাইশা তো চলে গেছে একটু আগে।
আরাফের কথা শুনে একবার ঢোক গিলে নোমান।বুকের ভেতরটায় হঠাৎ করে যেন তান্ডব হচ্ছে। সারা শরীরে অস্থিরতা যেন বৃদ্ধি পেয়েছে।চোখের সামনে থাকা সব এলোমেলো লাগছে,কিন্তু কেন এমন হচ্ছে নোমান নিজেও যানে না।

– তো আমার কি তাতে?সে গেছে যাক।
– এইভাবে তাকে ফিরিয়ে দিবি দাভাই।মেয়েটার ভালোবাসা কিন্তু মিথ্যা নয়।
আরাফের ব্যাকুল কন্ঠে চুপ থাকে নোমান। কিছু একটা ভেবে আরাফকে বলে,
– মেয়েটা কোথায় এখন?
– বাড়ির গাড়ি দিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেছে।
– ওকে আমি রাখছি।
নোমান ফোন রাখতেই আরাফের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি।

নোমানের সাথে কথা বলা শেষ করে পকেটে ফোন রাখতেই আবারো বেজে উঠে ফোন।স্কিনের দিকে তাকিয়ে প্রভার নামটা দেখতেই বিরক্তে চোখ কুঞ্চিত করে।
– হ্যা বলো,
– কেমন আছো তুমি?
– হুম ভালো।
– রেগে আছো,সেদিনের জন্য?
– না রাগবো কেন।কি প্রয়োজনে ফোন করেছো সেটা বলো প্লিজ, আমার একটু কাজ আছে।
– নেক্সট মান্থে বিডিতে আসবো.।
-হোয়াট?
আরাফের ধমকে চমকে যায় প্রভা।দূর থেকে নিয়াজ আরাফের হঠাৎ রেগে যাওয়াটাকে স্বাভাবিক চোখে দেখছে না।ফ্রিজ থেকে ক্যান হাতে নিয়ে তার মধ্যে কয়েক চুমুক দিয়ে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে আরাফের দিকে।

– আমি বুঝলাম না আরাফ,আমার বিডিতে আসার নিউজটা শুনলেই তুমি খেপে যাও কেন?
– লিসেন প্রভা,তুমি এই মূহুর্তে বিডিতে আসবে না।না মানে না।
– তুমি এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছো বলে মনে হচ্ছে , সমস্যা কি তোমার?
– আমার সমস্যা তোকে নিয়ে, প্লিজ আসবি না তুই বিডিতে,যদি ও বা এসেই পড়িস তবে আমাকে পাবি না, এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।

আরাফ ফোন হাতে নিয়ে হনহন করে উপরে তার রুমে চলে যায়।রুমে গিয়েই বিছানার উপরে মোবাইলটা ছুড়ে মারে।আবারো ওয়াশরুমে ডুকে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে থাকে।

এদিকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছিল হৃদিতা কিন্তু আরাফের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারনটা না বুঝতে পেরে কয়েক সেকেন্ড নিরবদর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।বিছানার দিকে তাকাতেই ফোনটা চোখে পড়ে এখনো কেউ কলে আছে।আর অপর পাশের ব্যক্তিটি অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে।হৃদিতা ফোনটা হাতে তুলে নেয়, স্কিনে ভেসে উঠে একটি মেয়ের নাম “Prova”। কানের কাছে ফোনটি ধরতেই হৃদিতার সব সাজানো সপ্ন গুলো যেন একে একে ভেঙ্গে যেতে লাগলো।পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেছে তার। আচমকা মাথাটা ঘুরে উঠতেই ধপ করে বিছানায় বসে যায়।আর নিশ্চুপ ভাবে শুনতে থাকে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটির কথা,

– আরাফ তুমি এমন করছো কেন হঠাৎ ।দেখো আর মাত্র এক দুই বছর পর আমাদের বিয়ে।তুমি আমাকে ইগ্নোর করা শুরু করলে কেন?আমি আসবো,হ্যা আমি আসবো, আমি বিডিতে সামনের সাপ্তাহেই আসবো। প্রয়োজনে সেদিনা আমাদের বিয়ে হবে।তোমার অবহেলা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।নোমান ভাইকে বিষয়টা জানাতে গিয়েও সেদিন জানালাম না একমাত্র ভাই তোমার উপর ক্ষুব্ধ হবে দেখে। কিন্তু আর না আমি আসছি,!

প্রভা দ্রুত ফোনটা কেটে দিল। হৃদিতা কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে ফোনটা আগের জায়গায় রেখে দিলো।দুচোখের পানি টলমল করছে তার।চোখ বন্ধ করলেই দু-গাল বেয়ে ঝরে যাবে সে পানি।গত রাতে আরাফের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটায় চাপা কষ্টের অনুভব হয়।কাল আরাফের বুকে মাথা গুজে যে ঘুমটা দিয়েছিল তা যেন ছিল কত জনমের শান্তির ঘুম।
ছিটকিনির শব্দে নিজেকে ধাতস্ত করে নেয় হৃদিতা।দু হাতের তালু দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে আরাফের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে,
– কি রে রেগে আছিস কেন হঠাৎ?
– কিছু না।

আরাফ বারান্দায় চলে যায়। হৃদিতাও শান্ত হয়ে আগের জায়গায় বসে থাকে।কিছুক্ষণ পর আরাফ রুমে এলে হৃদিতা গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– প্রভা কে আরাফ?
হৃদিতার মুখে ‘প্রভা’ নামটি শুনেই বিষম খেলো আরাফ।
– ক..কই কেউ না। কেউ না প্রভা।
হৃদিতা একটু হাসলো। আরাফের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখতেই আরাফ তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।মনের ভেতরটায় বারবার অপরাধ বোধটা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
– আমি তোর বন্ধু হয়ে নয় বরং স্ত্রী হয়ে সত্যিটা জানতে চাইছি।আশা করি স্ত্রী হিসেবে তোর সব বিষয়ে অবগত থাকা আমার কর্ত্যবর মধ্যেই পরে। আর মিথ্যা বলিস না প্লিজ!তুই ফোন না কেটেই ওয়াশরুমে গেছিলি যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি কিন্তু আমি তোর মুখ থেকে জানতে চাই।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।
আরাফ বিছানার এক কোনায় বসে যায়।হাটুতে দুই হাত রেখে মাথা ঠুকে, শুরু থেকে শেষ সবটা বলতে থাকে হৃদিতাকে।বিয়ের কারন,নোমানকে রাজী করানো,প্রভার সাথে পরিচয়।সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে হৃদিতা।দুচোখ ফেঁটে শুধু বার বার অশ্রু কণারা গড়িয়ে পড়তে চায়।কিন্তু না এই মূহুর্তে চোখের পানিকে আশকারা দেওয়া যাবে না।নিজেকে করতে হবে শক্ত দৃঢ়।আরাফের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। তাই অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে আড়াল করে মনে মনে সিধান্ত নিচ্ছে সে।
যদি একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে আরাফকে দেখতো তবে তার চোখে পড়তো , দু গাল আর নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়া নেত্রবারি গুলো আরাফের হাটুটা ভিজিয়ে দিয়েছে।দ্রুত টিস্যু নিয়ে দুচোখ মুছে নেয় আরাফ।হৃদিতাকে পাওয়া তার সাধ্যের বাইরে ভাবলেই দুনিয়া যেন আধাঁর হয়ে যায় ।

– আরাফ সবটাই বুঝলাম।আমার দায়িত্ব নিয়েছিস ভালো কথা। তবে এবার আমাকেও আমার দায়িত্ব নিতে হবে।আমি আগের টিউশনি গুলোতে আবার জয়েন হবো।হঠাৎ প্রভা দেশে চলে এলে আমাকে এমনিতেও সরে যেতে হবে তাই আমার ভিত্ত আগে থেকেই আমাকে শক্ত করতে হবে আশা করি তুই নিষেধ করবি না আমায়।
– এটা হয় না। তোকে আমি বাইরে খেটে খেটে টিউশনি করতে দেবো না।আমি যতদিন আছি ততদিন তুই আমার আন্ডারেই থাকবি।

আরাফের দৃঢ় কথায় অম্লান হাসে হৃদিতা।

– আরাফ এনায়েন, এখনো বাবার হোটেলে দিন পার করছো তাই হয়তো দুনিয়া বুঝতে শেখনি।আমার মতো লাথি উষ্টা খেয়ে বড় হলে তবেই তোমার দুনিয়া চালচলন বুঝতে শিখতে।আমি আমার কাজে দৃঢ় সংকল্প করলাম।

হৃদিতা চলে যায় রুমের বাইরে। আরাফ এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।সত্যিটা তো সামনে আগেই আসার কথা ছিল তাহলে এখন কেন ভেঙ্গে পড়ছে সে।

– তুই আমার নীরদ ভালোবাসা।যাকে দেখা যায় ছুঁয়ে দেওয়া যায় না।ছুঁতে গেলেই কান্না হয়ে আছঁড়ে পড়িস আমার বুকে।এই মন না মতির বালকটার তুই অবর্ণীয় রানী!

হৃদিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কথাটি বলেই থামলো আরাফ।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আবারো ধুপ করে বিছানায় বসে যায়।

খুশি আজ যেন মাইশার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে গেছে।নিরিবিলি শুনসান রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে গাড়ি জানলা দিয়ে মাথা বের করে প্রশান্তির শ্বাস নিচ্ছে। হুট হাট গেয়ে উঠছে এক দুই লাইন গান।আর তার এমন বেমালুম কান্ড দেখে অদ্ভুত চাহনীতে তাকিয়ে আছে ড্রাইভার।
একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কি করে ভুলবে সে।নোমানের চাহনী, ধমক, সবটা দেখে আরো একবার ফিদা মাইশা।
কিছুক্ষন আগে নিরিবিলি পিচ ঢালা রাস্তায় এগিয়ে চলছিল মাইশার গাড়ি তখবি তাদের গাড়ির সামনে দুইটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। বিষয়টি হঠাৎ হওয়ায় মাইশা চমকে যায়।পরবর্তীতে সেই গাড়ি থেকে মাক্স সানগ্লাস দিয়ে নিজেকে আড়াল করে বেরিয়ে আসে নোমান।
মাইশাকে আবারো এনায়েত মঞ্জিলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।কিন্তু প্রথমে বাদ সাধলেও পরবর্তীতে ঠিকি আবার এনায়েত বাড়ির উদ্দেশ্য গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়।
মাইশা ঠোঁটের কোনে ফুটে আছে তৃপ্তিত হাসি।যেন না পাওয়া কোন মূহুর্ত সে খুব সহজেই জয় করে নিয়েছে।

কেটে যায় দুইদিন।হৃদিতা আগের টিউশনি গুলোতে আবারো জয়েন করেছে।বাড়ির কেউ বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেনা।আরাফের প্রাণ প্রিয় জেঠিমা হুমায়রাও অনেক বার নিষেধ করে হৃদিতা যেন বাইরে টিউশন করতে না যায়।কিন্তু আরাফ হৃদিতাকে বারণ করতে পারলোনা।সে ভালো করেই যানে এটা হৃদিতাত জেদ থেকেই করছে।সেদিনের পর আরাফ আর হৃদিতার সম্পর্ক সম্পূর্ণ পালটে গেছে।আগের মতো প্রয়োজন ছাড়া একজন আরেকজনের সাথে কথা নেই।দুজনের মাঝেই কেমন যেন পালাই পালাই ভাব।
আজ রেজাল্ট প্রকাশ হবে আরাফ আর হৃদিতার।হৃদিতার নিজের উপর কনফিডেন্স আছে।সে নিজে পাশ করে এলেও আরাফের জন্য তার মনটা ভীষণ খচখচ করছে কে জানে, কি লিখে এসেছে খাতায়।
লাইব্রেরিতে একা উৎকন্ঠা মনে বসে আছে সে।আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। সবাই রেজাল্ট দেখতে গেছে। বইয়ের তাক থেকে ফিলোসোফির একটা বই নিয়ে দু-চার পাতা উল্টাতেই হঠাৎ করে এমন একটা ঘটনা ঘটে যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে।
#চলবে….

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here