#ললাট_লিখন
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৭

ওরা বেশ কিছুদুর এগিয়ে আসলো। আরশী বারবার পেছন ফিরে তাঁকিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে কেউ ওদেরকে অনুসরণ করছে। কিন্তু এই নির্জন রাস্তায় কেইবা ওকে অনুসরণ করবে? কথাটা ভেবে ও ঐতিহ্যের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হাটতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না অভ‍্যাস আছে কিন্তু কেনো জানি পা ভীষণ ভারি হয়ে আছে। কিছুতেই উঠতে চাইছে না। ঐতিহ্য সবটা বুঝতে পারছে কিন্তু কিছুই তো করার নেই। শহরের বাইরে বা ভেতরে কোথাও কোনরকম একটা থাকার জায়গা যে চাই। তাছাড়া বন্ধু বান্ধবী কাউকে ভরসা করা বোকামি হবে। কারণ কাছের মানুষগুলো ইতিমধ্যেই বেইমানি করে ফেলেছে নতুন করে ঝটকা খেলে হজম হবে না। হার্টের সহ‍্য ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে আসছে। যেকোনো সময় এটাক দিতে সময় লাগবে না। কথাগুলো ভেবে ওরা হাটতে হাটতে অভার ব্রিজ পার করে ছোট একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়লো। রাস্তার দুধারে সারি সারি দৈত্যাকার বিল্ডিং মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আরশীর বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। অজানা ভয়ে শরীর কাপছে। কিছুদূর এগিয়ে আসার পরে হঠাৎ পেছন থেকে ডাক পড়লো,
> এই যে আপা আপনারা কোথায় যাবেন?
আরশী চমকে উঠে পেছনে তাঁকিয়ে দেখলো অল্প বয়সি একটা ছেলে চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশীর ভয় করছে। মনে হলো বাড়িতে কি সবাই জেনে গেলো? এই মূহুর্তে কি করা উচিৎ দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া নাকি চিৎকার করা? আরশীর ভাবনার অবসান হলো ছেলেটির দ্বিতীয়বারের প্রশ্ন শুনে।
> আমার রিকশা আছে যাবেন? কোথায় যাবেন চলুন নামিয়ে দিব।
আরশী মলিন হেসে এগিয়ে আসলো। তারপর ছেলেটার পা থেকে মাথা অবধি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো। ছেলেটা ময়লা একটা চাদর শরীর ঢেকে মাথা আবধি জড়িয়ে রেখেছে । আরশী কিছুটা অবাক হলো কারণ এখন খুব একটা শীত পড়ছে না। শীতের শুরু হতে না হতেই লোকটা চাদর মুড়ি দিয়েছে কেনো? তাছাড়া রিকশা চালালে তো গরম লাগার কথা। আরশী কিছু বলতে গেলে ততক্ষণে ঐতিহ্য ওর হাত ধরে রিকশার দিকে এগিয়ে গেলো। আরশী বুঝলো ঐতিহ্যের মতামত। ও নিরুপায় হয়ে রিকশায় গিয়ে বসলো। ছেলেটা ওকে জিঙ্গাসা করলো করলো ওরা কোথায় যেতে চাই। আরশী শহরের শেষে নেমে যেতে চাইলো। ছেলেটা এবার আর কথা বলল না। দ্রুতগতিতে রিকশা এগিয়ে নিয়ে চলল। কিন্তু কিছুদূরে এসে হঠাৎ রিকশা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। আরশী ঝুল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে গেলো কিন্তু পড়লো না ঐতিহ্য ওকে ধরে ফেলল। আরশী ছেলেটাকে বকতে চাইলো কিন্তু ততক্ষণে ছেলেটা রিকশা থেকে নেমে অন্ধকার গলির মধ্যে মিলিয়ে গেলো। আরশী আশেপাশে তাকিয়ে চিৎকার করে ডাকলো

> ভাইয়া কোথায় গেলেন? আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসুন প্লিজ।
নির্জন রাস্তায় আরশীর আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসলো। শহরের এই দিকটা বেশ নির্জন আর আশেপাশে তেমন ঘরবাড়িও নেই। ছেলেটা হয়তো ইচ্ছে করেই ওদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে। আরশী কথাটা ভেবে ঢোক গিলল। ও ঐতিহ্যকে জড়িয়ে ধরে নামতে চাইলো কিন্তু পারলো না। চারদিক থেকে কয়েকজন ওদেরকে ঘিরে ধরলো। চাঁদের আলোতে লোকগুলোর হাতের চাকু চকচক করে ঝিলিক দিচ্ছে। আরশীর জ্ঞান হবার জোগাড়। কি হবে এখন ভাবতেই বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। শহরে রাত বিরাতে একটু শান্তিতে চলাফেরা করার মতো আর নেই। চোর ছ‍্যাচড়াতে ভরে উঠেছে। আরশীর ধ‍্যান ভাঙলো গম্ভীর একটা আওয়াজ শুনে,
> ভালো চাইলে কাছে যা কিছু আছে দিয়ে দে। কোনো কথা হবে না।
আরশীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই পাশ থেকে একজন ওর লাগেজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আরশী সর্বশক্তি দিয়ে লাগেজ আটকে ধরলো। লাগেজ নিয়ে টানাটানির একপর্যায়ে পাশ থেকে একটা ছেলে ওর হাতের উপরে ছুরি চালিয়ে দিল। চোখের পলকে সব ঘটে গেলো। ঐতিহ্য তাড়াতাড়ি আরশীকে জড়িয়ে ধরে ছেলেগুলারে বাধা দিতে চাইলো কিন্তু আরশী কিছুতেই ওকে রিকশা থেকে নামতে দিচ্ছে না। আতঙ্কে ওরা চিৎকার করতে ভূলে গেছে এর মধ্যেই হঠাৎ ডান দিক থেকে একটা বাইক আসার শব্দে ছেলেগুলো থমকে গেলো। বাইকের শব্দ ক্রমশ গভীর হচ্ছে আর রাস্তায় আলো পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইকের দেখা মিলল আর ছেলেগুলো যেমন এসেছিল তেমনিভাবে দ্রুত দৌড়ে চলে গেলো। আরশী যেনো জীবন ফিরে পেলো। ও থরথর করে কাপছে। কাটা হাত থেকে অনরব রক্ত ঝরে ঐতিহ্যের সাদা শার্ট রঙিন করে দিচ্ছে। আরশী চুপচাপ বসে আছে শব্দ করছে না ঐতিহ্য ভয় পাবে এই জন্য। বাইক পাশে থামিয়ে একটা ছেলে নেমে আসলো। ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে বলল,
> আপনারা ঠিক আছেন? আপনার হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে। ডাক্তার দেখাতে হবে। অপেক্ষা করুন আমি ব‍্যবস্থা করছি।
ছেলেটা নিজের পরিচয় বা ওদেরকে কিছুই বলতে দিল না। ফোন বের করে কাকে যেনো আসতে বলল। ছেলেটার পকেটে ফোন রাখতে দেরী হলো কিন্তু অপর দিক থেকে গাড়ি আসতে দেরী হলো না মূলত ওটা পুলিশের গাড়ি। পুলিশের ভ‍্যান দেখে আরশী ঘাবড়ে গেল। যদি বাড়িতে খবর দেয় বা জেনে যায় তখন কি হবে? ও ভয়ে ভয়ে পাশের ছেলেটাকে বলল,
> ভাইয়া প্লিজ আমাদের কোনো হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে সাহায্য করুণ। চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে। এখানে পুলিশের ঝামেলায় আমাদের জড়াবেন না।
> বোন ভয়ের কিছু নেই। আমি পুলিশ ইনেসপেক্টর মোহাম্মদ আলামিন হক। ছিনতাইকারীদের ধরার জন্য কিছুদিন ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারছি না। আমাদের লোকজন গেছে ওদেরকে ধরতে। আর এই রিকশা ধরেই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।
ঐতিহ্য আরশীকে নামিয়ে নিয়ে আলামিন সাহেবের পেছনে গিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। আরশী চুপচাপ ঐতিহ্যের বুকে মাথা লাগিয়ে শুয়ে আছে । হাতটা খুব যন্ত্রণা করছে।সামনে সিটে আলামিন সাহেব বসে আছেন। ছেলেটা এবার পেছনে তাকিয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> এতো রাতে আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন? কাজটা কিন্তু আপনাদের ঠিক করেননি। দিনকাল ভালো না। আমি ঠিক সময়ে না আসলে আরও বিপদ হতে পারত।
> বিপদ থেকে বাঁচতেই চেয়েছিলাম ভাই। আসলে কি জানেন? বিপদ আমাদেরকে চিনে ফেলেছে তাই আমরা না চাইলেও ভদ্রলোক ঠিক আমাদের কাছে সময় মতো পৌঁছে যায়।
> আপনাদের পরিচয়?
> আমার সঙ্গে আছেন উনি আমার স্বামী ঐতিহ্য চৌধুরী। উনি কথা বলতে পারেন না। বলতে পারেন না বললে ভূল হবে কারণ উনাকে কথা বলতে দেওয়া হয়না। চাবি দেওয়া পুতুলের মতো আর কী।
> আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বিস্তারিত খুলে বললে ভালো হয়। ভাই ডেকেছেন আমি কথা দিচ্ছি বোনের জন্য যতটা পারি সাহায্য করবো।
আরশী যা কিছু হয়েছে সবটা বিস্তারিত খুলে বলল। ওদের সঙ্গে এরকম টা কে করছে ওদের কাছে ধোয়াসারতো মতো। যদিও কিছুটা অনুমান করেছে কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। আর ওরা আজ কোন পরিস্থিতিতে রাস্তায় নেমেছে সব ক্লিয়ার করে বলতেই আলামিন সাহেব বললেন,
> তুমি করে বলার জন্য দুঃখিত।বোন এই মূহুর্তে তোমাদের আমি হাসপাতালে নিতে পারবো না। তোমাদের জীবনের ঝুকি আছে। আমার বাড়ি নিকটবর্তী সবটা বাড়িতে গিয়ে হবে।
কথাটা বলেই উনি গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে নিলেন। আরশী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাবলো এই বুঝি একটা ভরসাস্থল জায়গা পেলাম। সবাই এরকম ভালো মানুষ হয়না। হয়তো এর হাত ধরেই আমরা সঠিক বিচার পাবো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here