#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৩৬]

প্রেগন্যান্সি পজিটিভ এসেছে আনহার। স্টিপ রেখে দিয়ে সে ধীরপায়ে হেঁটে এগোলো জাহেদার ঘরের দিকে। গলার কাছে কিছু আটকে আছে। নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি যেন। টলমল করছে পা জোড়া। জাহেদার ঘর থেকে গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। কান্নার আওয়াজ শুনে আর এগোলো না আনহা। আবার টালমাটাল পায়ে হেঁটে ঘরে এসে খাটে বসল। বেসিনের কাছে গিয়ে গড়গড় করে বমি করল। দেয়াল খামচে দাঁড়ানো চেষ্টা করল। মুখে পানি দিল ঘনঘন। তারপর বিছানায় এসে বসতেই মাথা ঘুরল ভীষণ। ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মূর্ছা গেল। এদিকে জায়িদের ফোন বাজল ঘনঘন। প্রায় পনের মিনিটের মতো একনাগাড়ে ফোন এলেও ফোন তুলতে পারলনা আনহা। জায়িদের মেজাজ চরম পর্যায়ে। ফোনটা ধপ করে টেবিলে রাখায় আওয়াজ হলো ভীষণ। আনহার এত খামখেয়ালী হলে চলে না। কোনদিকে যাবে সে?
এদিকে জেলের ভেতর আব্বা। ওদিকে মুননা নিখোঁজ। আর এদিকে আনহা ফোন তুলছেনা। আম্মার কান্না থেমেছে কিনা তা জানার জন্য ফোন দিচ্ছিল জায়িদ।
জিনিয়ার গলার আওয়াজ ভেসে এল হঠাৎ। একটা একটা পা ফেলতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হাঁটার সময় তা বুঝা যাচ্ছে। জায়িদ ফোন পকেটে রেখে সেদিকে দৌড়ে গেল। কনস্টেবল এসে বলল
‘ স্যার ইনশিরাহ ম্যাডাম কারো কথা শুনছেন না। ওনি নাকি ওনার বাবার সাথে কথা বলবেন।
জায়িদ বলল
‘ যেতে দাও।
কনস্টেবল বলল
‘ কিন্তু স্যার সত্যিটা পুলিশকে না বলা অব্দি আপনার বাবাকে কারো সাথে দেখা না করতে দেয়ার আদেশ আছে।
জায়িদ শান্ত স্বরে বলল
‘ ও যে কেউ নয়। ও এই কেসের উকিল। কেসটা ও লড়বে। তাই ও দেখা করার পারমিশন পাবে।
কনস্টেবল মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। জিনিয়া ততক্ষণে হাজির শফিক সাহেবের কাছে। জেলের গ্রিল ঝাঁকিয়ে সে কেঁদে ডাকল
‘ আব্বা?
শফিক সাহেব বসা থেকে উঠে বসেন। জিনিয়া কান্নাচোখে হাতের বক্স খুলার চেষ্টা করে বলে
‘ আব্বা তোমার জন্য আমি পাকোড়া বানিয়ে এনেছি। ফুডিং বানিয়ে এনেছি। তোমাকে ওরা কি খেতে দিয়েছে আব্বা?
শফিক সাহেব মুগ্ধ নয়নে মেয়ের দিকে তাকায়। জিনিয়া আবার গ্রিল ঝাঁকিয়ে বলে
‘ কেউ এটা খুলে দাওনা। আমি একটু আমার আব্বাকে ছুঁই।
জিনিয়ার চেঁচামেচি ভেসে আসছে ক্রমশ। জায়িদ চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল
‘ খুলে দাও হামাদ।
কনস্টেবল জেলের দরজা খুলে দেয়। জিনিয়া ডুকে পড়ে তড়িঘড়ি করে। কনস্টেবল আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। জিনিয়া বাবাকে ঝাপটে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলে
‘ আমার দুই আব্বাকে আমি আগের মতো খুঁজে পাচ্ছিনা কেন? আদর দিতে আর নিতে পারছিনা কেন আব্বা? আমার সাথে এসব কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে আব্বা?
শফিক সাহেব নিশ্চুপ। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
‘ পায়ে গরম তেল মালিশ করেছিস?ফোলা কমেছে?
জিনিয়া চুপটি মেরে যায়। কাল রাতে সাহিল মালিশ করে দিয়েছিল। লোকটাকে সে প্রতিবার পা ফুলে গেলে জ্বালিয়ে মারে। কাল সারারাত ঘুমায় ও নি। জিনিয়াকে বুকে আগলে ধরে রেখেছিল। জিনিয়া এই যে এল মানুষটা তখন ঘুম ছিল। সে না জানিয়ে চলে এসেছে। তাননা কাউকে ঘুমাতে দেয়নি সারারাত। ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগছে বোধহয়।
জিনিয়া কেঁদে উঠল৷ শফিক সাহেব তার গাল মুছে দিয়ে বলল
‘ তুই চলে যাহ মা৷
জিনিয়া শক্ত কন্ঠে বলে
‘ নাহ!
শফিক সাহেবের মুখে খাবার এগিয়ে দেয় সে। আবার কেঁদে দেয়৷ খাইয়ে দেওয়া শেষে প্রশ্ন করে
‘ তুমি কেন এসব করতে গেলে আব্বা? তোমার তো কিছুর অভাব ছিলনা আব্বা৷ আমরা যেরকম ছিলাম ভালোই তো ছিলাম।
শফিক সাহেব নিজেকে গুটিয়ে নেন। সরে পড়ে বলেন
‘ আমাকে প্রশ্ন করবিনা জুনু। যাহ এখান থেকে। তোর বাচ্চাকে খুঁজে বের কর।
জিনিয়া আবার ও ঝাপটে ধরে শফিক সাহেবকে। শফিক সাহেব তাকে সরিয়ে দেন। জিনিয়ার অস্ফুট বাক
‘ আব্বা?
শফিক সাহেব গলার আওয়াজ বড় করে ডাকেন।
‘ অফিসার? ইন্সপেক্টর?
জায়িদ এসেই হাজির। শফিক সাহেব তাকে দেখে বলেন
‘ আপনার বোনকে নিয়ে যান। আসামীর জন্য কাঁদতে নেই বুঝিয়ে দিন।
জায়িদ জিনিয়াকে বের করে আনে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে বলে
‘ আপনাকে শাস্তি পেতে হবে মিঃ তালুকদার। সত্যটা না বলার জন্য নয়, আমার বোনকে কাঁদানোর জন্য।
শফিক সাহেব পিছু করে দাঁড়ায়। চশমার নিচ বেয়ে জল গড়ায় কপোল বেয়ে।
জিনিয়া শফিক সাহেবের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে
‘ ভাইয়া ওনি আমার আব্বা নয়। আব্বা নয় আমার। আমার আব্বা আমাকে বকেনা কখনো।
জায়িদ ধমক দেয় জিনিয়াকে।
‘ চড় বসাবো জুননু। কার জন্য কাঁদছিস তুই? যে আমাদের কথা ভাবেনি, আম্মার কথা ভাবেনি তার জন্য কাঁদছিস? তোকে আর ও শক্ত হতে হবে জুননু। এই মানুষটার জন্য আর কাঁদবিনা। তুই আর কাঁদবিনা।

হাঁপাতে হাঁপাতে থানায় এসে পৌঁছায় সাহিল। জিনি তাকে না বলে বেরিয়ে গেছে। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে ওর। অথচ?
উফফ মেয়েটা ও পারে।
তখনি কানে আসে জিনিয়ার কান্নার শব্দ। সাহিল দৌড়ে যায় সেই কান্নার শব্দ অনুসরণ করে । জিনিয়া তাকে দেখে আর ও জোরে কেঁদে দেয়। সাহিল এগিয়ে গিয়ে ধরে জিনিয়াকে। জায়িদ বলল
‘ নিয়ে যাহ ওকে।
জিনিয়া কাঁদল।
” যাব না আমি।
সাহিল বলল
‘ তোমাকে এখন রেস্ট নিতে হবে।
জিনিয়া বলল
‘ না। আমার বাচ্চাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ আর আমি রেস্ট নেব?
সাহিল বলল
‘ তুমি তো কেসটা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ পাঠিয়েছ। দেখবে মুননা চলে আসবে। কেঁদোনা আর। ও আসবে।
সাহিল ওকে নিয়ে যায়। জায়িদ আবার তাদের পিছু পিছু দৌড়ে এসে সাহিলকে বলে
‘ সাহিল আনহাকে ফোনটা তুলতে বলিস তো। কখন থেকে ফোন করছি ও তুলছেনা৷
সাহিল বলল
‘ ঠিক আছে।
জায়িদ এসে চেয়ারে বসে। আনহার ফোনে কল দিতেই প্রথমবারেই ফোন তুলে আনহা। মাথা চেপে ধরে, দুর্বল কন্ঠে কিছু বলার আগেই জায়িদের কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
‘ কখন থেকে ফোন দিচ্ছি, তোমার এখন ফোন তোলার সময় হলো?
ঝরঝরে কেঁদে দেয় আনহা। শব্দহীন। জায়িদ বলল
‘ আম্মার কান্না থেমেছে? কিছু খেয়েছে?
আনহা কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল
‘ হ্যা। আপনি খেয়েছেন?
জায়িদ ফোন রেখে দিল। ফোন রেখে আবার কেঁদে দিল আনহা। সে খেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করেনি। তার ফোন ধরতে দেরি হয়না কখনো। আজ কেন হলো তা ও জানতে চায়নি।

__________

তখন আছরের আজানের পরপর৷ কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আজান পড়বে।
ঝলসানো সৌন্দর্যের অধিকারী মহিলাটি লাল টকটকে রঙ মাখা ঠোঁট জোড়া নেড়ে মুননাকে বলল
‘ আমাকে আম্মা ডাকো বাচ্চা।
মুননা মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ তুমি জুননু নউ। আমাল জুননু কুথায়? আমাল তুননু কুথায়? আমাল গুড্ডু কুথায়? আমাল মুন্টু কুথায়?
ধবধবে ফর্সা কপালটাতে ভাঁজ পড়ল মহিলাটির।
‘ তুমি কি এখন আর খাবেনা? দুপুরে খাওনি যে। ঘুমাওনি।
মুননা মহিলাটির হাতের বাটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল
‘ তুমাল ভাতু মুজা নাই। জুননুল গুলো মুজা। ঝানঝান ভাতু, মুজা নাই। পুঁচা।
মহিলাটি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কষে চড় বসায় মুননার গালে। চেয়ারে বসা মুননা ধপ করে পড়ে যায়। ফোলা গালের পাশ লাল হয়। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে । ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে কেঁদে দেয় মুননা। ডাকে
‘ আম্মা?
এরিজমা চেঁচিয়ে ডাকে ইয়ামিনকে। ইয়ামিন দৌঁড়ে আসে। মুননাকে পড়ে থাকতে দেখে তুলে বসায়। কড়া কন্ঠে বলে
‘ কি করছিস তুই? ওকে মারা যাবেনা কিছুতেই।
এরিজমা রাগ নিয়ে বলে
‘ আমার তো এক্ষুণি মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে ভাইয়া । এটুকুনি একটা বাচ্চা আমার মুখে মুখে কথা বলে।
ইয়ামিন শান্ত করায় তাননাকে। বলে
” চকলেট দেব।
মুননা মাথা নাড়িয়ে কেঁদে বলে
‘ জুননুল কাছি যাবো। গুড্ডুল কাছি যাবো।
ইয়ামিন ধমক দেয়। একদম চুপ। খেয়েছ এবার চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো ওই খাটের উপর। যাও। মুননা কেঁদে কেঁদে খাটে উঠে শুয়ে পড়ে। কেউ ঘুম পাড়ায়না তাই ঘুম আসেনা। পাশে বোন নেই তাই কেউ জড়িয়ে ধরেনা। মুননার চোখে ঘুম নামেনা। ওদের ভয়ে শুধু চোখ বন্ধ করে রাখে। কত মানুষ আসে যায় হিসাব নেই। মুননার চোখ খোলা বারণ। সবাই ভেবে নেয় মুননা ঘুম।

পায়ে পড়া নুপুর আর হাতে পড়া একঝাঁক চুড়ির আওয়াজ করে ফোনে কথা বলতে বলতে অপর রুমে পা রাখে এরিজমা। কারো উপর ভীষণ রকম চড়া হয়। দরজা হালকা লাগানো। মুননা চোখ খুলে ধীরেধীরে। মেঝেতে পড়া থাকা একটি চাবি। দেখে সে খুশি হয়। এটা সে তুননুকে দেবে। বলবে
‘ তুননু দিখো মুননু তুমাল জুন্য খিলনা আনিছে।
তুননু তখন খিলখিল করে হাসবে না? মুননা সতর্কতা সহিত খাট থেকে নেমে পড়ে। ধলা আন্টি ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। এদিকে আসবে না তো? মুননা চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে নিজের পকেটে রাখে। তারপর গালে আঙুল দিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। বলে
‘ আমি জুননুল কাছি যাবো। দজজা খুলি তাপোর চলি যাবো।
খালি পায়ে হেঁটে দরজার কাছে যায় মুননা। দরজা ঠেলে বের হয়। কত বড় বিল্ডিং! মুননা আর পেছনে ফিরেনা। দৌড়ে দৌড়ে চলে যায়। গেইটের কাছে আসতেই দেখে দাঁড়োয়ান। জিজ্ঞেস করল
‘ কই যাও?
মুননা বলল
‘ তুমাকে ডাকে।
দাঁড়োয়ান মুননার সামনে বসে বলে
‘ কে ডাকে?
মুননা বালির উপর বসে। হাতড়ে বালি নিয়ে ছুঁড়ে মারে দাঁড়োয়ানের মুখ বরাবর। তারপর হাতে কামড় বসিয়ে দৌড় দেয়। দাঁড়োয়ান চিল্লায় কিন্তু চোখে কিছু দেখতে পায়না। যন্ত্রণা হয়। মুননা ততক্ষণে রাস্তায় গিয়ে উঠেছে। দৌড়াতে থাকে আশপাশ না তাকিয়ে। রাস্তার মানুষ তাকে দেখে। ভাবে হয়ত পিছু পিছু অভিভাবক আসবে। নরম পায়ের তলায় হঠাৎ ইটের কোণা ফুটে। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মুননা। কেঁদে উঠে, বসতেই টের পায় পায়ের তলায় রক্ত। রক্ত হাত দিয়ে ছুঁয়ে মুননা ঠোঁট টেনে কেঁদে দেয়। বলে
‘ ওবাপ লততো। বিথা পাছি। জুননু কুথায়? গুড্ডু কুথায়? আমি বিথা পাছি।
একজন মহিলা দৌড়ে আসে।
‘ বাবু তোমার আম্মা আব্বা কোথায়?
মুননা পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে বলে
‘ তুমাকে মেলে ফেলবো। আমাল নাম মুননু। বাবু নয়।
মহিলা হেসে ফেলে। তাননা রক্ত পায়ে নিয়ে দৌড় লাগায়। মহিলা ডাকে
‘ বাবু দাঁড়াও।
অনেকে ধরতে চায় মুননাকে। কিন্তু হাত দেখিয়ে বলে
‘ পুলিচ ওফিচাককে বুলে দিবো। গুলি কলে দিবে এদদম।
সবাই হতভম্ব তার কথায়। একটা ছেলে তো মুননার পেছন পেছন দৌঁড়ায়৷ কোথায় যায় তা দেখার জন্য। কিছুদূর গিয়ে মুননা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পা ভীষণ ব্যাথা করছে। মুননা বসে পড়ে। পা ধরে বলে
‘ জুননু পা বিথা কচচে। উফ। আমি দুক্কু পাচচি।
অল্পবয়স্ক ছেলেটা এগিয়ে আসে। বলে
‘ বাবু তুমি কোথায় যাবে?
মুননা এবার ঠোঁট টেনে কেঁদে দেয়। ছেলেটার আদুরে কন্ঠস্বর শুনে হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে নেওয়ার জন্য। ছেলেটা কোলে তুলে নেয় তাকে। মুননা ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে
‘ আম্মাল কাছি যাবো। আব্বাল কাছি যাবো।
ছেলেটা বলল
‘ তোমার আম্মা কোথায় থাকে?
মুননা বলল
‘ আমাদেল বালিতে থাকে৷
ছেলেটা বলল
‘ কোথায় তোমার বাড়ি?
‘ আমাল বালি ওখানে। আম্মাল ইখানে।
ছেলেটা মুননার সাথে কথা বলতে বলতে পা বাড়ায় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ছেলেটাকে আগে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া দরকার। পায়ে আঘাত লেগেছে। ঠোঁট ফুলে গিয়েছে। মুননা ঘেমে একাকার। কপালের একপাশে সালেহার লাগানো কালো টিপটা ছড়িয়ে গেছে। এলোমেলো লাগছে মুননাকে৷ ছেলেটার কাঁধে ঘুমিয়ে পড়ল মুননা৷ হসপিটাল বেশিদূর নয়৷ কিছুদূর এগোতেই হসপিটালে পৌঁছে যায় ছেলেটি৷ মুননাকে ডক্টর দেখায়৷ ডক্টর মূখার্জি সাথেসাথে বলে
‘ এই বাচ্চা তো ডক্টর তালুকদারের নাতি। এই ছেলে তোমার কাছে কি করে?
ছেলেটি সব খুলে বলল। ডক্টর মুখার্জি কোথাও যেতে চাইলেন। দরজার কাছে আসতেই চলে আসে জায়িদ। বলে
‘ ডক্টর আমার ওয়াইফের রিপোর্টটা। ও বাসায় ফেরার তাগিদ দিচ্ছে। এখানে নাকি বসে থাকতে খারাপ লাগছে। আমাকে ও থানায় ফিরতে হবে।
ডক্টর মুখার্জি থেমে যায়। জায়িদ বলল
‘ কি হয়েছে মিঃ মুখার্জি?
মিঃ মুখার্জি বলল
‘ চলুন৷ যায়। একটা গুড নিউজ আছে অফিসার।
জায়িদ পা বাড়ায়। কিন্তু আবার থেমে যায়। কানে আসে
‘ তোমার আম্মা কি করে?
‘ আমাল আম্মা জুননু। আম্মা লান্না কলে। আমাকে আল তুননুকে আদোল কলে। খাবাই দে। গুসোল কলায় দে৷ বিশিবিশি আদোল কলে। ইখানে ইখানে আদোল কলে। তাপোর কোলে নিয়ে বুসে থাকে। মাথায় আদোল কলে৷ হাতে আদোল কলে। পায়ে আদোল কলে।
ছেলেটা হেসে উঠল।
‘ বাহবা আম্মা অনেক ভালোবাসে তোমাকে। তাহলে ছেড়ে দিল কেন?
জায়িদ কম্পিত পায়ে হেঁটে সেই কেবিনে ডুকে। ছেলেটার কোল থেকে কেড়ে নেয় মুননাকে। সারা গালে আদর দিয়ে চেপে ধরে বুকের সাথে। চোখ ভিজে উঠে তার। মুননা চুপটি মেরে লেগে থাকে৷ জায়িদ বলল
‘ মামা কোথায় ছিলে তুমি? হ্যা? কত খুঁজেছি তোমাকে। জুননু কিভাবে কাঁদছে জানো? চলো জুননুর কাছে যায়।
জায়িদ মুননাকে নিয়ে ছুটল। মিঃ মুখার্জি রিপোর্ট বাড়িয়ে দিয়ে কিছু বলতে গেলে জায়িদ আবার দৌড় লাগায়। আনহার কেবিনে গিয়ে ডাকল
‘ আনহা?
আনহা উঠে বসে শোয়া থেকে। জায়িদ তার কাছে ছুটে আসে। মুননাকে দেখে বাকহারা হয়ে পড়ে আনহা । মুননাকে বুকের সাথে চেপে ধরে আনহার দিকে ঝুঁকে পড়ে জায়িদ। কপালে চুমু খেয়ে রিপোর্টটা আনহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
‘ রিপোর্ট নাও এখন৷ পরে দেখব৷ এখন বাসায় ফিরতে হবে। আসো।
আনহা রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ জায়িদ চলে যায়। আনহা রিপোর্টটি ব্যাগে ডুকিয়ে হাঁটা ধরল জায়িদের পিছুপিছু। গাড়িতে উঠে বসল তারা। জায়িদের বুকে মুননা লেগে আছে। সে একেবারে চুপ হয়ে গেছে। জায়িদ তাকে একহাতে চেপে ধরে আরেকহাতে ড্রাইভিং করছে।
তারা এসে পৌঁছায় বাড়িতে। জায়িদ আহম্মেদ বাড়িতে ডুকে পড়ে। পেছনে আনহা। জিনিয়া শেষ সিঁড়িতে মাথা ঠুকে বসেছিল। সোরা আর সালেহা বেগম তার পাশে বসে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছে। চোখের জল গড়ানো থামেনা জিনিয়ার। জায়িদ চেঁচিয়ে ডাকে
‘ জুননু? এই জুননু? তোর। দেখ তোর কে এসেছে? জুননু।
নাহিল আর দৌড়ে যেতে পারেনা। চোখজোড়া তার জ্বলজ্বল করে উঠে। সোরা, সাগর সাহেব, সালেহা বেগম ডেকে উঠে
‘ মুননা?
তাননা নাহিলের কোল থেকে ডাক দেয়
‘ মুননু। আমাল ভাই।
মুননা জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। জিনিয়া উঠে দাঁড়ায়। যেন সে স্বপ্ন দেখছে। মা ছেলে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে শুধু কেঁদে যায়। জিনিয়া কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যায় নরম পায়ে। মুননা কোনো কথা বলতে পারেনা। শুধু ঠোঁট টেনে টেনে কাঁদে। জিনিয়া মুননার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠে ডাকে
‘ আমার আব্বা!
মুননা সাথেসাথে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে। জিনিয়া গা কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে ছেলের কান্না দেখে। মুননা ঝাঁপ দেয় তার বুকে। জিনিয়া টাল সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে বসে পড়ে মেঝেতে। ছেলেকে বুকের সাথে চেপে ধরে গালে, মুখে অসংখ্য আদরে ভরিয়ে দেয়। পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে কান্নার আওয়াজ বাড়ে জিনিয়ার। পা তুলে পায়ের আঙুলগুলোতে আদর দেয় সে। ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটোতে আদর দিতে দিতে কাঁদে। মায়ের চোখের জলে ভিজে যায় মুননা। সবাই অবাক চোখে দেখে এক মায়ের পাগলামি। একেই কি তাহলে বলে মায়ের ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ?

চলবে,
মন্তব্য আশা করছি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here