#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৩৪]
সাহিল মহাবিরক্ত জিনিয়ার উপর। আজ তাদের চতুর্থ এনিভার্সারি। বিয়ের চারবছর পূর্ণ হলো। কিন্তু জিনির তাতে হেলদোল নেই। সাহিল ভেতরে ভেতরে রাগ পুষে রাখল। জিনিয়া কাপড় ভাঁজ করছিল তাননা মুননার। বলল
‘ আজ আমাকে একটু কোর্টে যেতে হবে। স্যার যেতে বলেছেন। তাছাড়া পুরো শহরে সব দোকানপাট নাকি বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছেন প্রশাসন। সব রিসোর্ট গুলোতে ও তল্লাশি চলবে। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। আসল অপরাধী ধরা না পড়া পর্যন্ত শান্তি নেই। আমাকে ও যেতে বলা হয়েছে। যেহেতু কেসটা আমি লড়ছি।
সাহিলের আর ও মন খারাপ হলো। জিনি আছে এসব কোর্টকাচারি নিয়ে। আজকের দিনে অন্তত সাহিলের কাছাকাছি থাকলে কি হয়। সাহিল জিনিয়াকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলল। বলল
‘ আমার আজ কাজ নেই। সারাদিন বাসায় থাকব।
জিনিয়া বলল
‘ তাহলে তো আরও ভালোই হলো। তাননা মুননার সাথে খেলবেন। তাদের আব্বা কেন তাদের সাথে খেলেনা, কেন অফিসে যায় তা নিয়ে সারাক্ষণ আমাকে প্রশ্ন করতে থাকে।
সাহিলের আর ও মন খারাপে ভরে গেল। জিনি এখনও বুঝলনা। মেয়েটা বোকা। থাক আর কিছু বলবেনা সাহিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশে জায়িদকে দেখলনা আনহা। বালিশের উপর দেখল একটি সাদা কাগজ। আনহা হাতে নিল। খুলে নিল। তাতে লেখা।
‘ জিজ্ঞেস করেছিলে না কেন বিয়ে করেছি? কিজন্য বিয়ে করেছি। তাহলে উত্তরটা ও জেনে রেখো।
আমি আমার জন্যই তোমাকে বিয়ে করেছি।
আর কোনো প্রশ্ন জানা থাকলে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করে নিও। যাইহোক, আম্মার সাথে মুখ ভার করে কথা বলবেনা। আম্মাকে রান্নাঘরে গিয়ে সাহায্য করিও। আমার ফিরতে রাত হবে।
আনহা লেখাটুকু পড়ে বসে রইল ঝিম ধরে। যেদিন সে এই বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিল সেদিন তার উদ্দেশ্য ছিল জায়িদকে খুন করা। কিন্তু এই বাড়ির মানুষগুলোর যত্ন, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় তার কুৎসিত রূপটায় খুন হয়ে গেল। তার জঘন্য উদ্দেশ্য গুলোয় খুন হয়ে গেল। আর যাকে খুন করতে এল ক্ষণিকের জন্য হলেও তার অবাধ্য মন আগলে ধরতে চেয়েছিল। এই বাড়িটাকেই নিজের স্বপ্নপুরী বানাতে চেয়েছিল।
কিন্তু হলো কই? তারআগেই তো নিজের পাপের কাছে নিজেই বলিদান হলো সে। কিন্তু এবার আর ছাড়বেনা সে। আর হারাতে দেবেনা।
জিনিয়া ক্লান্ত হলো গোয়েন্দাদের সাথে সাথে তদন্তে করতে গিয়ে। বেলা বারোটার দিকে তাদের আজকের কাজ শেষ হলো। কালকে আবার হসপিটালের পেছন দিক থেকে কাজ শুরু।
জিনিয়া বাড়ি ফেরার আগে কেকের দোকানে ডুকে কেক কিনল। সাহিলের জন্য একটি ঘড়ি। একটি শার্ট কিনল। মানুষটা বেশি পাগল! আজ সে বেরোনোর সময় ভালো করে কথা ও বলেনি। মুখটা কালো করে রেখেছিল। কি ভেবেছিল জিনি আজকের দিনটা ভুলে গিয়েছে? এই দিনটাকে কি কখনো ভুলা যায়?
জিনিয়া বাড়ি ফিরল। সাহিল তার সাথে কথা বলল না। তাননা মুননার সাথে খেলছে। বাবাকে পেয়ে কি খুশি বাচ্চাগুলো! হাসি সরছেনা মুখ থেকে। সাহিল তার মাথা দিয়ে দুজনের পেটে সুড়সুড়ি দিল। দুজন হেসে লুটোপুটি। সাগর সাহেব, সালেহা বেগম আর সাজেদ সাহেব হাসলেন তাদের কান্ড দেখে। নাহিল ও যোগ দিল তাদের সাথে। সোরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। তাননা জিনিয়াকে দেখে বলল
‘ জুননু চকলেত আনুনাই?
জিনিয়া বলল
‘ আনছি। ভাত খাওয়ার পর।
তাননা বলল
‘ আম্মা আমলা খেলা কচচি আব্বাল সাথি।
জিনিয়া বলল
‘ খুব ভালো।
সাহিল তাকালো না জিনিয়ার দিকে।
আনহা বসে ছিল টেবিলে মাথা রেখে। জাহেদা এসে অনেক্ক্ষণ চেঁচিয়ে গেল।
‘ আমার ছেলের জন্য আমি বসে থাকতে পারি, আর কাউকে বসে থাকতে হবেনা। এই সেই।
আনহা শোনেনি। সে যাবেনা। জাহেদা আর না পেরে চলে গেল। আনহা ঘুমিয়ে পড়ল টেবিলে মাথা রেখে। জায়িদের গলা শোনার সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠল। ফোনে জোরে জোরে কথা বলছে সে। স্বাভাবিক কথা বললেও মনে হয় যেন কাকে গালি দিচ্ছে। আনহা দরজা খুলে দিল চট করে। জায়িদ দরজা খোলা আনহাকে দেখে আবার ফোনে মজে গেল। কথা বলা শেষ করে আসতে না আসতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আনহা। শক্ত করে ধরে মাথা ঠেকালো জায়িদের বুকে।
জায়িদ চমকালো না। বিস্মিত ও হলোনা। নরম গলায় বলল
‘ কেউ আসবে।
আনহা বলল
‘ আসুক।
জায়িদ বলল
‘ আম্মা!
সাথেসাথে ছেড়ে দিল আনহা। এদিকওদিক তাকিয়ে নাক ফুলিয়ে জায়িদের দিকে চাইল। তারপর গটগট পায়ের আওয়াজ তুলে চলে গেল। হাসল জায়িদ।
ফ্রেশ হয়ে এসে খেল। আনহা কোনো কথা বলল না তার সাথে। চুপচাপ শুয়ে পড়ল কানের উপর বালিশ রেখে। জায়িদ বালিশটা টেনে নিয়ে নিচের মাথার নিচে দিল। বলল
‘ বালিশ আর ও একটা লাগলে তোমার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসো। আমার বালিশ নিয়ে টানাটানি কেন?
আনহা ফিরল না। কানে হাতচাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। লাইট নিভিয়ে দিয়ে বলল
‘ আর প্যানপ্যান করবেন না। আমার ঘুম পাচ্ছে।
বলতে না বলতেই মুখের উপর তপ্ত শ্বাস অনুভব হলো আনহার। কানের কাছে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। কিছু গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে জায়িদ বুঝতে পেরেছে আনহা। কিছুক্ষণ সময় পার হলো শ্বাস প্রশ্বাস বিনিময়ে।
মেদহীন উদরের উপর তখন ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। জায়িদের আর ও কাছ থেকে কাছে চলে আসল আনহা। কানের কাছে গুঁজা শুকনো গোলাপফুলের গন্ধ এসে ঠেকল নাকে কিন্তু দেখার সুযোগ হলোনা। কানের নিচ বেয়ে গলার কাছে এসে ঠেকল উষ্ম স্পর্শ। শীতল হয়ে আসল আনহার হাত পা। আজ অন্তিম আত্মসমর্পণ ঘটল পুলিশ অফিসারের কাছে।
ছাদের একপাশে কোনোরকম ছোট টেবিল বসিয়ে কেক আর মোমবাতি রেখেছে জিনিয়া। সাহিল তাকে না দেখে চলে আসবে ছাদে। হঠাৎ ঘুম ছুটে যাওয়ায় সাহিল জিনিয়াকে দেখতে পেলনা। বিরক্ত হয়ে রাগ নিয়ে, অভিমান নিয়ে ডাকল, জিনি?
জিনিয়ার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠতেই ওয়ারড্রবের উপর রাখা শার্ট দেখতে পেল সে। কাগজে লিখা, এটা পড়ে ছাদে আসুন।
সাহিল তাই করল। বোতাম লাগাতে লাগাতে হাঁটল ছাদের উদ্দেশ্যে।
আকাশে রূপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে। তার আশেপাশে ও মেঘের আনাগোনা। জিনিয়া মুগ্ধ হয়ে চাইল তারাভরা ঝলমলে আকাশটাকে। ছাদের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। জিনিয়া ফিরল। সাহিলের চোখ স্থির লাল টকটকে বেনারসি পড়া মেয়েটার কাছে গিয়ে। বিয়ের শাড়ি গায়ে জিনিয়া। চাঁদের আলোয় রূপসার মতো লাগছে। তার ঠোঁটের কোণার হাসিটার সাথে হাসছে চোখদুটো। লজ্জা মেশানো সেই হাসিতে। একদম নববধূর মতো লাগল তাকে। যেন আবার বউ সেজেছে সাহিলের জন্য। এক পা এক পা করে এগোলো সাহিল। যেন পথ ফুরোতেই চায়না। জিনিয়া দাঁড়িয়ে থাকল। সাহিল তার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল
‘ হ্যাপী এনিভার্সারি প্রিয়তমা।
খুশিতে চোখে জল এল জিনিয়ার।
‘ হ্যাপী এনিভার্সারি। আপনার সাথে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকতে চাই। হাতে হাত ধরে, কাঁধে মাথা রেখে। সাহিল চেয়ে রইল। জিনিয়া গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। অনেক বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল
‘ আপনি কি ভেবেছেন? আমি সব ভুলে গিয়েছি?
সাহিল বলল
‘ দাঁড়াও এক্ষুণি আসছি। দৌড়ে রুমে যায় সাহিল। আবার এসে একটি পেনডান্ট বের করে বক্স থেকে। কয়েকডজন চুড়ি।
সাহিল বলল, পড়িয়ে দিই?
জিনিয়া পিছু ফিরে দাঁড়ালো। সাহিল তার গলায় পেনডান্ট পড়িয়ে দিল। হাতে চুড়ি। জিনিয়া লকেটটি চেয়ে চেয়ে হাসল। লাভ শেপ খুলে দেখল তাননা মুননা তার আর সাহিলের ছবি সেখানে। খুশিতে দিশেহারা হলো জিনিয়া। সাহিলের হাতে পড়িয়ে দিল ঘড়ি। বলল
‘ রাগ কমেছে?
সাহিল চেয়ে থাকল তার দিকে। লাল শাড়িটার আঁচল টেনে ঘোমটা পড়িয়ে দিল সে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে গালের দুপাশে হাত রেখে বলল
‘ তোমাকে আমি যতবার দেখি, ততবার মনে হয় প্রথম দেখছি। আমার জীবনের প্রথম মুগ্ধতা তুমি জিনি। তোমাকে আমি প্রথম দেখেছি ছোট বেলায়। তারপর বড় হওয়ার পর দেখেছি এক রোদদুপুরে বিয়ের ক্লাবে। চারপাশে কি রোদ!
জিনিয়া হাসল। সাহিল বলল
‘ শুধু রোদ ছিল না মেঘ ও ছিল। রোদের দেশে মেঘের বেশে রোদ আসে। জানো?
মেঘগুলো রোদের রূপ ধারণ করে থাকে রোদের দেশে, যাতে রোদ আর মেঘের মধ্যে পার্থক্য ধরা না পড়ে।
জিনিয়া আবারও হাসল। বলল
‘ আপনি আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া।
সাহিল কপাল ঠেকালো তার কপালে। নাকে নাকে ঘর্ষণ, মনে মনে বর্ষণ হলো। কপালের উপর ভালোবাসার ঘন প্রলেপ লাগিয়ে সাহিল বলল
‘ ভালোবাসি।
এই সামান্য কথাটায় কেঁপে উঠল জিনিয়া। শিহরণ বয়ে গেল সারাদেহে। চোখে বৃষ্টি নামল মুহূর্তে। হৃদয়ের আঙিনায় উঠল তীব্র ঝড়। মনে হলো খরস্রোতা নদীর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল নদীর খাদে। এক অদ্ভুত শব্দ করে কেঁদে উঠল জিনিয়া। থুবড়ে পড়ল সাহিলের বুকে। এই মুহূর্ত এখানেই থেমে যাক। থেমে যাক সবকিছু। এই শব্দ, এই আওয়াজটুকু এত এত দামী, মূল্যবান কেন? শুনতে এত ভালোলাগে কেন?
জিনিয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সাহিলকে। প্রায় অনেক্ক্ষণ সময় পার হওয়ার পর ছাড়ল। কেক কাটল। খাইয়ে দিয়ে বলল
‘ বলেছিলাম প্রশ্নটি হুট করে একদিন জিজ্ঞেস করে বসবো। আজ করলাম। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাননি কেন?.
সাথে সাথে চোয়াল শক্ত হলো সাহিলের। পুরোনো কথা তুলে লাভ কি? সাহিল রাগলো। বলল
‘ আমি তোমাকে ভালো টালো বাসিনা মেয়ে। একটুও না। কখনোই না। নো নেভার।
জিনিয়া হাসির সাথে সাথে আবার কাঁদল। সাহিল অবাক, মেয়েটা কি পাগল হলো?
চলবে