#রোমান্টিক_ডাক্তার

পার্ট: ৩+৪

লেখিকা: সুলতানা তমা

নিজের বাবা মা’কে তো খেয়েছে অনেক আগেই এখন এসে আমার গাড়ে চেপে বসেছে। আর উনি মরার সময় আমার হাত ধরে বলে গেছেন “আমার ভাগ্নিটাকে দেখো” যত্তোসব জ্বালা আমার। নেহাত ওর নামে বাপ মায়ের দেওয়া কিছু সম্পত্তি আছে তাই এতো জ্বালা সহ্য করছি নাহলে তো কবেই….
আমি: নাহলে কবেই কি মামি, মেরে ফেলতে আমাকে…?
মামি: আপনি এসেছেন সময় হলো আপনার আসার
আমি: মতলবটা কি মামি বলবা
মামি: মানে
আমি: আমাকে সহ্যই তো করতে পারো না তাহলে আমি চোখের সামনে নেই বলে এতো তাড়া দিয়ে নিয়ে আসলে কেন
মামি: ও তুই বুঝবি না।
রুমে চলে আসলাম, কি যে চলছে এই মহিলার মাথায় আল্লাহ্‌ জানেন।

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বিকেলের আকাশ দেখছি। মন যেন কাউকে খুব মিস করছে, কাকে মিস করছে…? কাব্য…? কিন্তু ও কে আমার ওর জন্য এতো মন খারাপ হচ্ছে কেন। আচ্ছা আমি যে কাব্য’কে এতো মিস করছি ও কি আমায় মিস করছে নাকি চোখের আড়াল হতেই ভুলে গিয়েছে আমাকে…?
হঠাৎ তিশা আর মামির চেঁচামেচি শুনে তাড়াতাড়ি বের হলাম।
তিশা: আপনার মতো খারাপ মহিলা আর একটাও দেখিনি
আমি: কি হইছেরে তিশা
মামি: কি আর হবে প্রতিদিনই তো তোর বান্ধবী আমাকে যাতা বলে
আমি: তোমার স্বভাবে শুনো
তিশা: আসছিলাম তোকে ডাকতে সেই সকাল বেলায় অল্প কিছু খেয়ে বের হইছিলাম বিকেল হয়ে গেছে এই বাসায় তো খাবার খাওয়ার কোনো টাইম নেই তাই তোকে নিতে আসছিলাম আর এই মহিলা তুই যাবি না বলে আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিছে
আমি: ওহ বাদদে এসব আমার খিদে নেই একেবারে রাতে খাবো
তিশা: কি হইছে তোর চোখমুখ এমন লাগছে কেন
আমি: কিছুনা
তিশা: হুম বুঝেছি।
রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। কাব্য’র কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

তিশা: তমা উঠ রাত হয়ে গেছে (তিশার ডাকে তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। আশ্চর্য রাত হয়ে গেলো অথচ মামি আমাকে রান্না করার জন্য বকাবকি করলো না)
তিশা: কি ভাবছিস
আমি: মামি হঠাৎ পাল্টে গেলো কেন, আগে তো কাজের জন্য বকাবকি করতো। অন্যকিছু করবো দূরে থাক কাজের জন্য ঠিকমতো নামাজও পড়তে পারতাম না। আর আজ সেই বিকেল বেলা থেকে রাত অব্ধি ঘুমালাম বকাবকি করলো না।
তিশা: আমি সিউর এই মহিলা তোকে নিয়ে খারাপ কোনো মতলবে আছে
আমি: আর খারাপ কিবা করবে যা খারাপ আচরণ করে
তিশা: চল আম্মু আব্বু অপেক্ষা করছেন তোর জন্য
আমি: ঘুমের কারণে তো নামাজ পড়া হয়নি তুই যা নামাজ পড়ে আসছি
তিশা: ঠিক আছে।

নামাজ পড়ে তিশাদের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হতেই মামি ডাক দিলেন।
আমি: কিছু বলবে
মামি: হ্যাঁ তোর সাথে কথা আছে
আমি: বলো
মামি: তোর জন্য ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ভাবছি তোকে বিয়ে দিয়ে আমার দায়িত্ব শেষ করবো
আমি: বাহ্ যে মামির চোখে আমি বিষ সে নাকি আমাকে ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে
মামি: শুন আমি এতোটাও খারাপ না
আমি: হ্যাঁ তুমি কতোটা ভালো আমি জানি তো
মামি: চলে যাচ্ছিস যে কিছু তো বলে যা।
মামির কথার উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। বিয়ে দিবে যত্তোসব।

সবাই একসাথে খেতে বসেছি তখন আঙ্কেল মানে তিশার আব্বু আবার বিয়ের কথা বললেন।
তিশা: আব্বু আমি ভাবছিলাম তোমাকে বলবো কিন্তু এখন মত পাল্টে নিয়েছি
আঙ্কেল: কেন তমাকে বিয়ে দিতে হবে না নাকি। তুই কি চাস ওর মামি হুট করে যার তার সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে দিক।
তিশা: না আব্বু আমি তোমাকে পরে সব বলবো আপাতত বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবো না
আন্টি: আমি আরো ভাবছিলাম আমার দুই মেয়ের বিয়ে একদিনে দিয়ে দিবো
আমি: সবাই বিয়ে বিয়ে করছ আমি তোমাদের ছেড়ে গেলে তো
তিশা: রাজকুমার এসে তুলে নিয়ে যাবে
আঙ্কেল: হাহাহা আছে নাকি কোনো রাজকুমার
তিশা: হ্যাঁ আব্বু আছে এজন্যই তো বললাম আপাতত বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবো না
আমি: তিশা চুপ করবি
তিশা: হুম করলাম। শুন ওই মহিলার আচরণ আমার ভালো লাগছে না এখন থেকে রাতে তুই আমার সাথেই থাকবি।
আমি: হুম ঠিক আছে।

তিশার সাথে বসে গল্প করছি হঠাৎ মামি এসে ডাকতে শুরু করলো।
আমি: কি হইছে
মামি: বাসায় চল
তিশা: তমা এখন থেকে রাতে আমার কাছেই ঘুমাবে
মামি: কেন আমার বাসায় বুঝি জায়গার অভাব আছে
তিশা: না তবে ভালোবাসার যথেষ্ট অভাব আছে
মামি: দেখ তমা আমার কথা শুনে চলে আয়
আমি: পারবো না
মামি: কাল তোকে দেখতে আসবে, ওরা যদি এসে শুনে তুই রাতে অন্য বাসায় ঘুমাস তাহলে তো আমার মান সম্মান কিছুই থাকবে না
আমি: তোমার আবার মান সম্মান। আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে আসতে বললে কেন।
মামি: তো কি হইছে
আমি: নিজেই দেখা করো আমি যাবো না ওদের সামনে
মামি: লক্ষী মা এমন করে না আমি আর তোর সাথে খারাপ আচরণ করবো না তুই শুধু ওদের সামনে যাস
আমি: ঠিক আছে তবে কাল না দুদিন পর আসতে বলো
মামি: ঠিক আছে
আমি: এখন যাও আমি তিশার কাছেই থাকবো। (মামি চলে যেতেই তিশা আমার হাত জোরে চেপে ধরলো, ওর চোখ দুটু রাগে লাল হয়ে আছে)
আমি: কি হইছে
তিশা: তুই ছেলে পক্ষকে আসতে বলে দিলি তারমানে তুই তোর মামির পছন্দে বিয়ে করবি
আমি: বিয়ে করবো বলেছি নাকি, মামির কথা না শুনলে আরো বেশি খারাপ আচরণ করবে তাই রাজি হয়েছি।
তিশা: কাব্য শুনলে খুব কষ্ট পাবেরে
আমি: মানে কি এখানে কাব্য আসলো কোথা থেকে আর ও জানবেই বা কিভাবে।
তিশা: জানবে জানবে
আমি: জানলেই বা কি, শুন এসব এক দেখায় ভালোবাসা হয়না শুধুমাত্র একটুখানি ভালোলাগা জন্মায় মনের মধ্যে, এইটা ক্ষণিকের জন্য মোহ ছাড়া আর কিছুই না। চোখের আড়াল হলে দুদিন যেতেই এই মোহ কেটে যায় বুঝেছিস।
তিশা: কাব্য তোর এই ধারণা পাল্টে দিবে দেখিস
আমি: তুই এতো জোর দিয়ে বলছিস কিভাবে…? এই কাব্য’র সাথে তোর যোগাযোগ নেই তো…?
তিশা: অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।
তিশা চুপচাপ শুয়ে পড়লো কিন্তু আমার কথার উত্তর তো দিলো না। তারমানে কি তিশা কাব্য’র সাথে কথা বলে, যোগাযোগ আছে ওদের মধ্যে…? কি জানি থাকলে থাকুক ওদের মধ্যে যোগাযোগ তাতে আমার কি। ভাববো না আর কাব্য’র কথা। চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।

সকালে তিশার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো তাড়াতাড়ি উঠে নামাজ পড়ে নিলাম। তিশা নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো কিন্তু আমার তো আর ঘুম আসবে না একা একা কি করবো, বাসায় থাকলে তো এখন রান্না করতাম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, চারপাশে ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। হঠাৎ বাগানের দিকে চোখ পড়লো, তিশা খুব যত্ন করে এই বাগান তৈরি করেছে। বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে দেখে যেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু এই ভোরবেলা একা একা বাগানে যাওয়া কি ঠিক হবে ভেবে পাচ্ছি না। দুর যাই কিছু হবে না, রুম থেকে মোবাইলটা এনে বাগানের দিকে পা বাড়ালাম।

খালি পায়ে বাগানের মধ্যে হাটছি। ভোরবেলা শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর খালি পায়ে হাটার মজাই আলাদা, এতে মন শরীর দুটুই ভালো থাকে। আর ফজরের নামাজ পড়ে এসে একটু হাটাহাটি করলে তো মনে শান্তি বিরাজ করে, সাথে ভোরের আলো ফোটার সুন্দর দৃশ্য, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আর সূর্য উঠার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ছোটবেলায় একদিন আব্বু বলেছিলেন “নামাজে যে শান্তি আছে সে শান্তি আর কোথাও খুঁজে পাবে না। তোমার মন খারাপ নামাজ পড়ো মন ভালো হয়ে যাবে, তোমার নিজেকে একা লাগছে তাহলে নামাজ পড়ো আর নিজেকে একা মনে হবে না কারণ নামাজে আল্লহকে কাছে পাওয়া যায়, তুমি কোনো বিপদে পড়েছ কি করবে ভেবে পাচ্ছ না তাহলে নামাজ পড়ো আল্লাহ্‌ তোমাকে সাহায্য করবেন, তুমি সবসময় আল্লাহর এবাদত করো আল্লাহ্‌ তোমাকে সবসময় সাহায্য করবেন” আব্বুর কথা গুলো সেদিন মুখস্থ করে ফেলেছিলাম সাথে সেদিন থেকে নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম আজো পড়ছি। মধ্যে আব্বু আম্মুর হঠাৎ মৃত্যুতে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম নামাজও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আমার জীবনে তিশাকে পাঠালেন। তিশা সবসময় বুঝিয়েছে কখনো হতাশ হতে নেই সবসময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হয়। আব্বু আম্মুর মৃত্যুতে এতোটাই কষ্ট পেয়েছিলাম যে ভুলেই গিয়েছিলাম এই পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী নয়, সবাইকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে তাই আপনজনদের মৃত্যুতে আল্লাহকে ভুলে যেতে নেই।

আব্বু আম্মুর কথা মনে পড়াতে কখন যে দুচোখ দিয়ে পানি পড়ে গাল দুটু ভিজে গেছে বুঝতেই পারিনি। কয়টা বাজে দেখার জন্য মোবাইলে চাপ দিলাম কিন্তু মোবাইল তো অফ করা। তারমানে সারারাত মোবাইল অফ ছিল। মোবাইল অন করার সাথে সাথে ফোন আসলো, একটা অচেনা নাম্বার। এতো সকালে কে ফোন দিতে পারে তাও মোবাইল অন করার সাথে সাথে ভেবে পাচ্ছি না। সাধারণত অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলে আমি রিসিভ করিনা কিন্তু এই ফোনটা রিসিভ করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মন এই ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিল কিন্তু… রিসিভ করতেই একটা চেনা কন্ঠ ভেসে আসলো।
কাব্য: তিলো ও তিলো ফোন অফ করে রেখেছিলে কেন
আমি: (নিশ্চুপ হয়ে ওর কান্না শুনছি পাগলের মতো কাঁদছে)
কাব্য: কাল সন্ধ্যা থেকে ফোন দিচ্ছি সারারাত ফোন দিয়েই গেছি কিন্তু তোমার ফোন অফ আর এই তিশা গাদিটা তো ফোন রিসিভই করছে ন…. (কাব্য আটকে গেলো অর্ধেক কথা বলে, তারমানে তিশা আর কাব্য’র যোগাযোগ আছে আমার ধারনাই ঠিক। কিন্তু ওরা আমার থেকে লুকাচ্ছে কেন)
কাব্য: জানো আমি কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার ফোন অফ দেখে, আমার তো ইচ্ছে হচ্ছিল রাতেই ঢাকা চলে যাই তোমার কাছে। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না তাই সারারাত ট্রাই করেছি তোমার ফোন সারারাত অফ ছিল। (নিশ্চুপ হয়ে শুধু ওর কথা শুনছি কারণ কিছু বলার নেই আমার)
কাব্য: সারারাত আমাকে টেনশন দিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করে এখন চুপ হয়ে আছ (একটা মানুষ কাউকে প্রথম দেখায় এতোটা ভালোবাসতে পারে জানতাম না। আগে তিশাকে অনেক কথা শুনিয়েছি কিন্তু এখন কাব্য’র কান্না শুনে মনে হচ্ছে সত্যি ও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এইটাও কি সম্ভব, কেন এতো ভালোবাসে ও আমাকে…? কেন এতো কাঁদে আমার জন্য…?)
কাব্য: আমিও দেখবো তুমি কতোক্ষণ চুপ হয়ে থাকতে পারো (ও কাঁদছে আমি শুনছি কিন্তু দেখতে পারছি না তাও মনে হচ্ছে ওর চোখ থেকে টুপটুপ করে পড়া পানিগুলো আমার হৃদয় ভিজিয়ে দিচ্ছে। নিজের অজান্তেই আমার চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গাল বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো)
কাব্য: এই পাগলী একদম কাঁদবে না বলে দিচ্ছি। আমি কাঁদছি বলেই তো কাঁদছ আমি আর কাঁদবো না এইযে চোখের পানি মুছে নিলাম, প্লিজ তুমি কেঁদো না আমার কষ্ট হয়।
আমি নিশ্চুপ হয়ে আছি দেখে কাব্যও নিশ্চুপ হয়ে গেলো। ফোনের দুপ্রান্তে দুজন নিশ্চুপ হয়ে আছি আর একজন আরেকজনের নিঃশ্বাস শুনছি….

চলবে😍
#রোমান্টিক_ডাক্তার

পার্ট: ৪

লেখিকা: সুলতানা তমা

তিশা: তমা কোথায় গেলি
আমি: আসছি।
জানিনা কতোক্ষণ ধরে দুজন ফোনের দুপ্রান্তে নিশ্চুপ হয়ে একজন আরেক জনের নিঃশ্বাস শুনছিলাম। তিশা ডাক দেওয়াতে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিয়ে রুমের দিকে এগুলাম।

তিশা বিছানার উপর বসে ফোন টিপছে।
আমি: ডাকছিলি কেন
তিশা: তোর ফোন কোথায়
আমি: আমার হাতেই তো
তিশা: কাব্য’র সাথে কথা হয়েছে
আমি: হুম
তিশা: বাব্বাহ্ আমার অজান্তে এতো কিছু
আমি: তিশা তেলে আর জলে মিশ খায় না কখনো
তিশা: মানে
আমি: মানেটা খুব সহজ কাব্য’র সাথে আমাকে মানায় না।
তিশা: কেন তোর কোনদিকে কমতি আছে। আর তুই না সবসময় বলিস তোর আব্বু আম্মুর পর আমিই তোকে বোনের মতো সঠিক শিক্ষা দিয়েছি, নিজেকে অযোগ্য মনে করাটা তো আমার শিক্ষায় পরে না।
আমি: তিশা আমি নিজেকে অযোগ্য মনে করছি না বুঝার চেষ্টা কর…
তিশা: অযোগ্য মনে করছিস নাতো কি, কাব্য’র সাথে তোকে মানাবে না কেন।
আমি: তিশা বুঝার চেষ্টা কর
তিশা: তুই ভালো করে বুঝ আর হ্যাঁ কখনো নিজেকে অযোগ্য মনে করবি না। মনে রাখিস প্রত্যেকটা মানুষের ভিতরেই কিছুনা কিছু গুণ থাকে।
আমি: দ্যাত
তিশা: চলে যাচ্ছিস কেন।
তিশার কথার উত্তর না দিয়ে বাসায় চলে আসলাম। খুব রাগ হচ্ছে, কাব্য নাহয় না বুঝে পাগলামি করছে কিন্তু তিশা কেন বুঝতে চাইছে না কাব্য আর আমাকে যে মানায় না। কাব্য দেখতে যেমন স্মার্ট তেমনি আবার ডাক্তার আর আমি, কি আছে আমার…? এসএসসি দেওয়ার পর আব্বু আম্মু মারা গেলেন পড়ালেখা বাদ হয়ে গেলো, কতো স্বপ্ন দেখতাম এই দুবছরে সব স্বপ্ন একে একে কবর দিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া আমি দেখতে কালো কাব্য’র সাথে কোনো ভাবেই মানাবে না।

নিশ্চুপ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছে কাব্য ভুল করছে। পরক্ষণেই মনে হলো কাব্য নাহয় ভুল করছে কিন্তু আমি কি করছি, আমিও তো ভুল করছি। কাব্য’র কথা ভাবছি, ওর হাসিগুলো মনে করে নিজের অজান্তেই হাসছি কেন করছি এমন…? কাব্য মোহে আটকে আছে দুদিন গেলে মোহ কেটে যাবে তারপর আমি…? তখন তো আমায় কাঁদতে হবে। ফোন বেজে উঠলো, আবারো অচেনা নাম্বার। কিসের টানে যেন একটু তাড়াতাড়িই রিসিভ করলাম। কিন্তু এখন আর চেনা কন্ঠ ভেসে আসেনি একটা অপরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো।
–তিলোত্তমা বলছেন
আমি: হ্যাঁ আপনি কে
–তানভীর
আমি: কে তানভ…
তানভীর: আসলে আমার সাথে আপনার বিয়ের কথা চলছে (বাহ্ মামি তো দেখছি এক পা দু পা নয় একেবারে দশ পা এগিয়ে আছে, ছেলেকে আমার নাম্বারও দিয়ে দিলো)
তানভীর: কিছু বলছেন না যে
আমি: এমনি
তানভীর: আপনি দেখতে যেমন মিষ্টি তেমনি আপনার কন্ঠ…
আমি: আমাকে দেখলেন কোথায়
তানভীর: আপনার পিক দেখেছি আর নিজের অজান্তেই প্রথম দেখায় আপনার প্রেমে পড়ে গেছি (উফফ আবার সেই প্রথম দেখা। প্রথম দেখায় ভালোবাসার চৌদ্দ গোষ্ঠী কিলাই)
তানভীর: আপনার মনে হয় আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না
আমি: আসলে তা নয় (উফফ কিভাবে বুঝাই সত্যি ভালো লাগছে না)
তানভীর: আগে তো পিক দেখেছি তিনদিন পর দেখা হবে সামনাসামনি, হয়তো আবারো আপনার প্রেমে পরবো। রাখছি এখন।
আমি: হুম ঠিক আছে।
মামি আবারো ওদের আসার জন্য তারিখ দিয়ে দিলো, অবশ্য এখন মামির দোষ নেই আমি নিজেই তো বলছিলাম দুদিন পর যেন আসতে বলে।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার আকাশ দেখছি। নিজেকে বড্ড একা লাগছে। আচ্ছা আব্বু আম্মুর কাছে থাকলে কি আমার নিজেকে এমন একা মনে হতো…?
দূর থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসছে শুনে নামাজ পড়তে রুমে চলে আসলাম।
নামাজ পড়ে জায়নামাজেই বসে আছি মন যেন খুব করে আল্লাহ্‌ কে একটা কথাই বলতে চাইছে “আমার জন্য যা ভালো তাই করো, আমাকে সঠিক পথ দেখাও আল্লাহ্‌)
মামি: তমা নামাজ শেষ হয়েছে কথা ছিল
আমি: হ্যাঁ এসো (মামি এসে আমার পাশে বসলেন, আজ মামিকে অন্যরকম লাগছে)
মামি: ওদেরকে আসতে বলেছি তুই আবার রাগ করবি নাতো
আমি: (নিশ্চুপ)
মামি: মানছি তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি কিন্তু তুই তো আমার মেয়ের মতো তাই আমি চাই তোর ভালো জায়গায় বিয়ে হউক।
আমি: তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো (কি আর বলার আছে আমার, বিয়ে করবো না বললেই তো মামি আবার শুরু করবে)

মামির দেওয়া লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা পরনে, কানে ছোট ছোট লাল রঙের দুইটা দোল, চোখে গাড়ো করে কাজল টানা, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চুলগুলো খোঁপা করা। আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখছি, আজ মামির পছন্দে সেজেছি কারণ আজ আমাকে দেখতে আসবে। মধ্যে যে কিভাবে তিনটা দিন কেটে গেলো বুঝতেই পারিনি। সেদিন সকালে ফোন কেটে দেওয়ার পর কাব্য আর আমাকে ফোন করেনি। অবশ্য না করারই তো কথা, মোহ কেটে গেছে হয়তো।
মামি: তমা তোর হলো
আমি: হ্যাঁ মামি এইতো শেষ।

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মামির জন্য অপেক্ষা করছি, হয়তো এখনি এসে ডাক দিবে মেহমানদের সামনে যাওয়ার জন্য। তিশা রেগে আছে কারণ আমি মামির কথাতে রাজি হয়েছি। তিশা, আন্টি বা আঙ্কেল কেউ আসেনি আজ আমার কাছে। সবাই আমার উপর রেগে আছে কিন্তু কেউ এইটা বুঝছে না যে আমি মামির কথা না শুনলে আবার অশান্তি হবে, মামি আমার সাথে খারাপ আচরণ করবে। তাছাড়া মামি আর তিশাদের ঘাড়ে চেপে আর কতোদিন থাকবো বিয়ে হয়ে গেলেই ভালো।
মামি: তমা
আমি: হ্যাঁ মামি
মামি: বাহ্ লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে তো তোকে খুব সুন্দর লাগছে
আমি: শ্যামলা মেয়েদের কারো চোখে সুন্দর লাগে না গো মামি যেটুকু লাগে সেটা হলো ক্ষণিকের জন্য মোহ
মামি: উহু দেখিস ওরা তোকে দেখে খুব পছন্দ করবে
আমি: (খুব কষ্টে মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করলাম)
মামি: কিছুক্ষণ পরই ওরা তোকে দেখতে চাইবে আমি এসে নিয়ে যাবো লক্ষী মেয়ের মতো থাকবি বুঝেছিস
আমি: হু।

মামি চলে গেলেন আবারো জানালার বাইরে চোখ রাখলাম। আকাশ দেখছি আর দুবছর আগের কথা ভাবছি। আম্মু আব্বু মারা যাওয়ার পর মামা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন আর সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল মামির অত্যাচার। প্রথম প্রথম এসব শুনে শুধু কাঁদতাম একটা সময় নিজেকে খুব একা মনে হয়। সিদ্ধান্ত নেই এসব যন্ত্রণার চেয়ে আত্মহত্যা করা অনেক ভালো। হ্যাঁ সেদিন মাথার উপরে থাকা পাখাটায় ওড়নাও বেধে ফেলেছিলাম কিন্তু আত্মহত্যা করা হয়নি। বার বার একটা কথাই মাথায় আসছিল “আত্মহত্যা মহা পাপ” কষ্ট তো আর চিরস্থায়ী থাকবে না কষ্টের পরই তো সুখ আসে। ফোন বেজে উঠলো, হাতে নিয়ে দেখি তিশা।
আমি: হুম বল
তিশা: তুই কি সত্যি বিয়েটা করছিস
আমি: বিয়ে করছি মানে আজ তো শুধু দেখতে আসছে
তিশা: যদি বিয়ে ঠিক হয়ে যায়
আমি: তুই কি রাজি না
তিশা: না
আমি: ওকে দেখে যাক আমি মামিকে বলে দিবো ছেলে পছন্দ হয়নি
তিশা: ছেলে দেখতে কাব্য’র মতোই, পছন্দ হয়নি বললেই তোর মামি শুনবে নাকি।
আমি: সেটা আমার উপর ছেড়ে দে, তুই যেখানে রাজি না সেখানে আমি বিয়ে করবো না।
তিশা: কাব্য এসব শুনলে খুব কষ্ট পাবেরে
আমি: কাব্য কাব্য করিস না তো
তিশা: কাব্য’র ফোন অফ সকাল থেকে তাই যা খুশি করতে পারতেছিস
আমি: নাহলে কাব্য কি করতো
তিশা: তোকে এসে তোলে নিয়ে যেত
আমি: শুন তিশা ওর মোহ কেটে গেছে, আগে যে কান্নাকাটি করেছে এসব আবেগ ছিল আর এখন সবকিছু ও বুঝতে পেরেছে তা…
তিশা: তোকে আমার বুঝানোর ক্ষমতা নেই।
ফোন কেটে দিলো, শুধু কাব্য কাব্য করে উফফ ভাল্লাগেনা আর।

মামি: তমা চল মা
আমি: হুম।
মামির সাথে মেহমানদের সামনে আসলাম সত্যি এখন খুব কষ্ট হচ্ছে, কষ্টটা বোধহয় কাব্য’র জন্যই হচ্ছে। দুদিনের জন্য আবেগ দেখাতে এসেছিল আর আমি বোকার মতো ওকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম। এখন বোকামির ফল পাচ্ছি, প্রতিটা মুহূর্তে ওর কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছি।
ছেলের মা: আমরা তো আগেই দেখেছি তানভীর আলাদা কথা বলুক পছন্দ হলে আমরা রিং পড়িয়ে যাবো (রিং পড়িয়ে যাবে, কি বলছে এসব। তিশা শুনলে আমাকে আস্ত রাখবে না আর আমিও তো এভাবে হুট করে…)
মামি: তমা ওকে তোর রুমে নিয়ে যা
আমি: হুম।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, পাশে তানভীর।
তানভীর: বলেছিলাম না সামনাসামনি দেখলে হয়তো আবারো আপনার প্রেমে পড়ে যাবো, সত্যি আবারো আপনার প্রেমে পড়ে গেছি আর আপনার নামটাও খুব সুন্দর ‘তিলোত্তমা’ (আসছে আরেকজন আবেগ+মোহ দেখাতে অসহ্য)
তানভীর: আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে…
আমি: এভাবে হুট করে আমি বি…
তানভীর: আমি সোজা কথা বলতেই পছন্দ করি, আপনার কি কোনো রিলেশন আছে, আই মিন কাউকে ভালোবাসেন।
আমি: (নিশ্চুপ হয়ে আছি শুধু একটা নামই বার বার মনে পড়ছে ‘কাব্য’ তাহলে কি আমি কাব্য’কে সত্যি ভালোবাসি। কিন্তু কাব্য তো আমাকে ভালোবাসে না দুদিনের মোহে আটকে ছিল ও আর এখন চলেও গেছে)
তানভীর: আর কিছু বলতে হবে না আপনার নিশ্চুপ হয়ে থাকাতেই আমি উত্তর পেয়ে গেছি। (অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে কি উত্তর পেলো তানভীর। আর তিশার কথাই তো সত্যি তানভীর দেখতে কাব্য’র মতোই, কোন অজুহাতে এখন আমি বিয়েটা ভাঙবো। পছন্দ হয়নি বললে মামি শুনবে না, তিশা আমাকে আস্ত রাখবে না আর এই বিয়েটা আমিও করতে চাই না এখন কি করবো)
তানিভীর: কিছু বলবেন নাকি আমি আমার সিদ্ধান্ত সবাইকে গিয়ে জানিয়ে দিবো।
আমি: এই বিয়েটা আমি করতে… (ফোন বেজে উঠলো তিশা ফোন দিয়েছে দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম)
তিশা: যদি এই বিয়েটা করিস তাহলে আমাকে হারাবি
আমি: তিশা আমার কথা শুন…
তিশা ফোন কেটে দিলো, পিছনে তাকিয়ে দেখি তানভীর নেই। তানভীর আবার গিয়ে ওর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিবে নাতো…? কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও…? আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। দৌড়ে ড্রয়িংরুমে আসলাম।

আসতে মনে হয় অনেক দেরি হয়ে গেছে, সবাই হাসছে আর মিষ্টি খাচ্ছে। তানভীর এর দিকে তাকালাম ও আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
মামি: তমা উনারা আজকেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চান
আমি: মানে
মামি: হ্যাঁ তোকে উনাদের খুব পছন্দ হয়েছে তাই আজকেই…
আমি: কিন্তু আমি আজকে বিয়েটা করতে পারবো না
তানভীর: কেন আপনার সাথে কথা বলে তো মনে হলো আপনি রাজি আছেন
আমি: একবারো কি আপনাকে বলেছি আমি রাজি
তানভীর: তা বলেননি কিন্তু রাজি না এইটাও তো বলেননি
আমি: রাজি না বলতে চাচ্চিলাম তখনি তো ফোন বেজে উঠলো আর আপনি চলে এসে বলে দিলেন আজকেই বিয়ে করতে চান।
তানভীর: আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে শুধু তাই নয় আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি তাই আজকেই বিয়েটা করতে চেয়েছি।
আমি: কিন্তু আমি…
মামি: তমা হচ্ছেটা কি।
মামি আমাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে আসলো।

মামি: তমা এমন করার তো কথা ছিল না
আমি: আজকেই যে বিয়ে হবে এইটাও তো কথা ছিল না। আমি শুধু তোমার ভয়ে রাজি হয়েছিলাম তাই বলে বিয়ে করতে হবে নাকি।
মামি: কেন করতে পারবি না ছেলেটার কোন দিকে কমতি আছে।
আমি: তা বলছি না মামি আমি বিয়েটা করতে পারবো না বুঝার চেষ্টা করো।
মামি: তুই বিয়েটা করবি আর আজকেই করবি তোর মামার দিব্বি। (মামির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মামাকে দিয়ে দিব্বি দিতে পারলো, এখন আমি কি করবো। মামি আমাকে সবার সামনে নিয়ে আসলো)
মামি: তমা রাজি হয়েছে আসলে ছোট মেয়ে তো তাই…
ছেলের মা: কোন সমস্যা নেই আপনারা বিয়ের আয়োজন করুন সন্ধ্যা নেমে এসেছে তো রাতেই বিয়ে হবে
মামি: ঠিক আছে।
বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছি, দুচোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে। মামি আমার সাথে এমন করতে পারলো। বিয়ে আটকানোর কোনো রাস্তা নেই মামি দিব্বি দিয়ে দিয়েছে তাও মামার, আজ বুঝি আমার বিয়েটা হয়েই যাবে। কাব্য’র হাসিটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, আর বোধহয় ওর মিষ্টি হাসিটা কখনো দেখতে পারবো না।

চলবে😍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here