#রুপকথার_খোঁজে
#৪র্থ_পর্ব
“তবে শুনো, আমি আমার বোনের বিয়ে এমন কোনো ছেলের সাথে দিবো না যে আগে অন্য মেয়ের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করার দাবি করে। আর সেই অন্য মেয়েটি যদি আমার স্ত্রী হয় তাহলে একজন স্বামী হিসেবে সেই ছেলেটিকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। বিয়ে তো অনেক দূরের কথা। এবার তুমি বলো, এই উত্তরটা মাকে কিভাবে দিবো?”
আকরাম চায়ের কাপটি পাশের টেবিলে রাখলো, তার মুখভাব বদলালো না। সে অপেক্ষা করছে রুহামার প্রতিক্রিয়ার। অপরদিকে আকরামের শীতল কন্ঠে বলা কথাগুলো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় লাগলো রুহামার। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। যখন কথাটা বুঝলো, তখন সে নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো, মাথাটা ফাকা লাগছে। মস্তিষ্কে কিছু সাজাতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। চেষ্টা করেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। গলার কাছে এসে সব কথাগুলো যেনো দলা পাকাচ্ছে। রুহামা অতিকষ্টে বললো,
“মিথ্যে কথা, আমাকে এতোবড় একটা অপবাদ দিচ্ছেন কি করে আপনি? সাঈদের সাথে আমার একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আমি কোনো পাপ করি নি”
রুহামা বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো, নিজেকে শান্ত রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। তার ভেতরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতোবড় অপবাদ সহ্য করা কোনো নারীর পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়। এমন অপবাদ কোনো স্বামী মেনে নিবে না। কিন্তু রুহামা করবেও বা কি? পুরুষশাসিত সমাজে নারীর আর্তনাদ কেউ কি শুনে? রুহামা কাঁদছে, ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার। বারংবার একই কথা বলছে, ‘এটা মিথ্যে, এটা মিথ্যে’ হঠাৎ অনুভূত হলো একজোড়া পুরুষালী হাত তাকে বেষ্টনীবদ্ধ করলো। আলতো করে আগলে তাকে বক্ষস্থলে নিবিড় ভাবে লেপ্টে রাখলো আকরাম। গম্ভীর আকরামের এমন কাজ রুহামাকে চমকে দিলো। পাথরের বুকে ফুল ফুটে? ফুটে হয়তো, দূর্লভ হলেও ঘটনাটি অসম্ভব নয়। সেই ফুলগুলো স্নিগ্ধ হয় আকরামের সংস্পর্শের ন্যায়। শুভ্র, স্নিগ্ধ, পবিত্র, উষ্ণ অনুভূতি। আকরাম কন্ঠ নরম করলো, তারপর বললো,
“আমি জানি এই অপবাদটি মিথ্যে”
আকরামের কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো, রুহামা মাথা তুলে বললো,
“আপনি জানেন? তাহলে আপনি সেই কথাগুলো বললেন কেনো?”
আকরাম ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলো। তারপর রুহামাকে আজ দুপুরের সকল কথাগুলো খুলে বললো।
দুপুর বেলা,
লান্সের পর পর ই অফিস থেকে বেড়িয়েছে আকরাম। আজ কাজের চাপটা অনেক বেশি ছিলো। একের পর এক জমির রেজিস্ট্রির কাজ করেছে সে। কদিন ধরে ভেতরে ভেতরে খুব প্রেসারে রয়েছে সে। রুহামার কথাগুলো ফেলে দেবার মতো নয়। যতই হোক নিজের বোনের ভবিষ্যৎ, একটা ভূল সিদ্ধান্ত তার পুরো জীবনকে তছনছ করে দিবে। কিন্তু সে সাঈদের সাথে কথা বলার সাহস করে উঠতে পারছে না। তিক্ত ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি নাড়াচড়াও করতে পারছে না সে। সাঈদকে সরাসরি জিজ্ঞেস করাটা তার মতো মানুষকে মানায় না, আর বলবেও বা কি? ‘আমার বউ এর সাথে পূর্বের সম্পর্কের ভাঙ্গনের কারণ কি?’— লোকে হাসবে, এই সব অযাচিত দ্বিধা আকরামের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। সাঈদ এখানে সাবরেজিস্টার হিসেবে বছরখানেক হয়েছে জয়েন করেছে। কিন্তু ছেলেটা কাজে খুব পটু। তাই আকরামের সাথে তার সম্পর্কটা বেশ দৃঢ়। এক বছরের সম্পর্ক আজ কেমন যেনো এলোমেলো ঠেকছে আকরামের কাছে। নিজের স্ত্রীর প্রাক্তনের সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হচ্ছে— কথাটা যতটা সহজ উপায়ে বলা যায়, অনুভূতিটা এতোটা সরল নয়। এক অজানা ক্ষোভ, জ্বলণ, ঈর্ষা নিবৃত্ত মনকে দগ্ধ করতে থাকে। তাই অবশেষে নিজের বন্ধু রবিনের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছে আকরাম। রবিন একজন কাউন্সিলর, সে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মানুষকে কাউন্সিলিং করে। রবিন ই আকরামকে বুদ্ধি দিয়েছে যেনো, সাঈদকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রিলেশন, হাবিজাবি নিয়ে প্রশ্ন করতে। আদিবাকে তার কেমন লাগে, সেই ব্যাপারগুলো খুতিয়ে দেখতে। আকরামও তার বুদ্ধিতে সম্মতি প্রকাশ করে, কিন্তু সাঈদ আজ অফিসেই আসে নি। তাই আজ তাড়াতাড়ি ই বেড়িয়ে পড়েছে আকরাম। বাসায় গিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতে হবে কিভাবে সাঈদের সাথে কথা বলা যায়। এর মাঝেই একটা ফোন আসে আকরামের নিকট। আকরামের যে বন্ধুটি তার নিকট সাহায্য চেয়েছিলো জমির ব্যাপারে, সে তার সাথে দেখা করতে চায়। অনেক জোরাজুরির পর অবশেষে আকরাম তার সাথে দেখা করার জন্য রাজী হয়।
রেস্টুরেন্টে বসে আছে আকরাম, তার বন্ধুটি আসতে একটু দেরি হবে। একেই বিরক্ত লাগছে, উপরন্তু একা একা বসে থাকতে থাকতে মেজাজ খানিকটা বিগড়ে গেল আকরামের। সে একটু পর পর ঘড়ি দেখছে এবং এদিক ওদিক নজর ঘোরাতে লাগলো আকরাম। হঠাৎ তার নজর আটকে গেলো একটা টেবিলের দিকে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। ছাইচাপা বিগড়ানো মেজাজ যেনো আরোও বিগড়ে গেলো তার। সাঈদ একটা মেয়ের সাথে সেই টেবিলে বসে রয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিলো আকরামের মনে। আকরামের ইচ্ছে হচ্ছিলো, এখনই সাঈদকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। কিন্তু পাবলিক প্লেসে সিন ক্রিয়েট করতে নারাজ সে। তাই মনে মনে একটা ফন্দি আটে সে। সাঈদদের পিছু নিবে সে। মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কের রহস্য উদ্ভাবন করবে সে। তাই সাঈদরা উঠলেই আকরামও রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
আকরামের পরিকল্পনা অনুযায়ী সে সাঈদদের পিছু নেয়। খুব ধৈর্য ধরে আকরাম তার পিছু পিছু যায়। একটা সময় তাদের একটা হোটেলে প্রবেশ করতে দেখে সে। তারা রিসেপশন থেকে একটা রুমের চাবি নিয়ে উপরে চলে যায়। সাঈদরা চলে যাবার পর আকরাম রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে। প্রথমে না বলতে চাইলেও পড়ে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে আকরাম রুম নাম্বারটি নেয়। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে নি আকরাম। যেয়ে নক করে বসে সেই রুমে। বেশ কিছুসময় কড়া নাড়ার পর অবশেষে সাঈদ দরজা খুলে। আকরামকে দেখে ভুত দেখার মতো ভয় পেয়ে যায় সে। আমতা আমতা করে বলে,
“ভাই, আআপনি?”
আকরাম নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। সাঈদের কলার চেপে ধরে সে, রাগ সামলাতে না পেরে তিন-চারেক কিল ঘুষি ও দিয়ে বসে।
“আমি তোকে প্রশ্ন করছি, তুই এখানে কি করছিস? এই তোর অসুখ? তুই না জ্বরে মাথা তুলতে পারছিস না? তাহলে এগুলো কি?”
“ভাই, আমার কথা শুনেন”
“চুপ, হারামজাদা। কি শুনবো? কি করছিস এই মেয়েটার সাথে এই রুমে? ছিঃ আপনার ভাবতেই লজ্জা করছে এমন একটা ছেলেকে আমি ভদ্র ভাবতাম। শুনে রাখ, তোর সাথে আমার বোনের বিয়ে তো দিবোই না সাথে তোর চাকরি কিভাবে থাকে সেটাও আমি দেখে নিবো”
আকরাম তাকে ছুড়ে ফেলে। তারপর সাঈদ আকুতি করে বলে,
“ভাই, এমন করবেন না। ভুল হয়ে গেছে আমার, আমার চাকরি খাবেন না। নতুন চাকরি। প্লিজ ভাই”
“তোদের মত পুরুষদের জন্য আমাদের নাম খারাপ হয়। তোকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না”
আকরামের রাগ আসমান ছুয়েছে। তার আর এক মূহুর্তও দাঁড়াবে না। রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার জন্য উদ্যত হতেই সাঈদ বলে উঠলো,
“আপনি আমার ক্ষতি করলে আমিও আপনাকে ছেড়ে দিবো না ভাই, কেমন লাগবে আপনার? যখন সবাই জানবে রেজিস্টর আকরাম আহমেদের বউ এর শরীরের সকল অংশ আমার চেনা। ভেবে দেখুন। সম্মান থাকবে তো আপনার? আমার চাকরি চলে গেলে আমার হয়তো খাবারের অভাব পড়বে। কিন্তু এই সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন তো। আমার সাথে তার কেমন সম্পর্ক ছিলো তা নিশ্চয়ই জানেন। সুতরাং আমাদের ঘনিষ্ঠতা কেমন তার প্রমাণ দেওয়া খুব কঠিন নয়”
সাঈদ কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই তাকে পাগলের মতো মারতে লাগতো আকরাম। ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো সাঈদের। আকরাম দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“আমার রুহামার নামে একটা বাজে কথা বললে তোর লাশ যাবে বাসায়, লজ্জা করে না তোর? নিজের চাকরি বাঁচাতে ওর নামে বাজে কথা বলে আমাকে ব্লাকমেইল করছিস? তোর যদি মনে হয় আমাকে দমাতে পারবি। চেষ্টা করে দেখ। এই পৃথিবীর আলো তোকে দেখা লাগবে না। বলে দিলাম”
আকরামের মারের চোটে একটা সময় অচেতন হয়ে পড়লো সাঈদ। সাঈদের সাথের মেয়েটি ভয়ে কুকড়ে উঠলো। সে অনুরোধ করতে লাগলো,
“আর মারবেন না ওকে, ছেড়ে দিন প্লিজ”
মেয়েটির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি প্রয়োগ করে ছেড়ে সাঈদকে ছেড়ে দিলো আকরাম। হাত জ্বলছে। কখনো কোনো মানুষকে পেটায় নি সে। কিন্তু কিছুতেই রাগ সংযত রাখতে পারে নি আজ। তারপর সাঈদকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে সে। সেখান থেকেই বাসায় আসে।
আকরামের কথাগুলো শুনে রুহামা চাপা স্বরে বলে,
“ও মিথ্যে বলেছিলো, বিশ্বাস করেন আমি কখনোই ওর সাথে শারিরীক ঘনিষ্ঠতায় যাই নি”
“আমি জানি, দুমাস একটা নারীর সাথে থেকে সত্য কোনটা মিথ্যে কোনটা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে রুহামা। তোমাকে বলেছিলাম না, মানুষ চড়িয়ে আমি খাই। শুধু এই সাঈদটাকেই বুঝতে পারি নি। আমি ওকে ছাড়বো না। এমন জঘন্য শাস্তি দিবো, দেখে নিও। কিন্তু মাকে আমি এই কথাগুলো বলতে পারছি না। যতই হোক, তার চোখে তোমার সম্মানহানি আমি মানতে পারবো না”
রুহামা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আকরামের দিকে। এ যেনো এক অন্য আকরামকে দেখছে সে। বিষাদে ভরা মনে এক কুসুম প্রভাত উঁকি দিলো। মনের মাঝের সকল জড়্তা এক নিমিষেই গলে গেলো যেন। রুহামা কৃতজ্ঞ কন্ঠে বললো,
“আমাকে বিশ্বাস করেন আপনি?”
“করি”
আকরামের ঠোঁটে মৃদু হাসি। গম্ভীর আকরামকে আজ খুজে পেলো না রুহামা। বরং এক অমায়িক মানুষকে নজরে পড়লো। এমন স্বামীর কল্পনাই তো করেছিলো সে। হঠাৎ ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। রুহামা নিজেকে সামলে নিলো। আকরাম গাম্ভীর্যকে আবার বরণ করলো, জিজ্ঞেস করলো
“কে?”
“ভাই, পুলিশ এসেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়………
চলবে