#রুপকথার_খোঁজে
#৩য়_পর্ব
রুহামা বিলম্ব করলো না, পানি নিয়ে আসলো তখনি। আকরাম এবার মুখ খুললো, কিন্তু যা বললো তার জন্য সুমাইয়া বেগম প্রস্তুত ছিলেন না,
“সাঈদের মাকে ফোন করে জানিয়ে দাও মা, এই বিয়ে হবে না”
আকরামের কথা শুনে সুমাইয়া বেগম যেনো আকাশ থেকে পড়লেন, যেখানে আংটি পড়ানো হয়ে গিয়েছে, বিয়ের তারিখ অবধি ঠিক করার আলোচনা চলছে সেখানে এই কথাগুলো কি মানায়! এখন বিয়ে ভাঙ্গলে সমাজের শত কথার মুখোমুখি হতে হবে, শুধু তাই নয় এই সিদ্ধান্ত আদিবার মনের উপর ও বাজে প্রভাব ফেলবে। উপরন্তু এই সম্বন্ধের উৎস আকরাম নিজেই, সেখানে কি এমন ঘটলো যে আজ আকরাম ই বিয়ে ভাঙ্গার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সুমাইয়া বেগম অধৈর্য হয়ে উঠলেন। ব্যাতিব্যস্ত হয়ে শুধালেন,
“বিয়ে ভেঙ্গে নিবো মানে? কি বলছিস বুঝে বলছিস?”
“আমি ঠান্ডা মস্তিষ্কেই বলছি মা, সাঈদ আমার বোনের উপযুক্ত নয়। তাই এই বিয়ে ভাঙ্গার কথা বলছি”
স্বাভাবিকা চিত্তে ঠান্ডা গলায় কথাটা বললো আকরাম। রুহামা পানির গ্লাস হাতে বিমূঢ় দৃষ্টিতে আকরামের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঝাকে ঝাকে নিজেদের রাজত্ব করছে। আকরামের সিদ্ধান্তের কারণটা জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শ্বাশুড়ির সম্মুখে সেই কৌতুহলটা দেখাতে পারছে না সে। সুমাইয়া বেগম এবার কিঞ্চিত রেগে গেলেন। ছেলেকে বাজখাঁই কন্ঠে বললেন,
“তুমি কি বিয়ে কে ছেলেমানুষী ভাবো? এতো সহজ নাকি সবকিছু? ছেলেটাকে তোমার পছন্দ বলে এতোদূর কথা এগোলো। আর যেই আমরা বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি অমনি তুমি বলছো বিয়ে হবে না? কেনো বিয়ে ভেঙ্গে দিবো? সাঈদ কি এমন করেছে যে ও আদিবার যোগ্য নয়?”
আকরাম চুপ করে রইলো, তার মুখশ্রীতে বিরক্তির গাঢ়ত্ব প্রকাশ পেলো। সে কারণটা সবাইকে বলতে নারাজ। সুমাইয়া বেগম তাকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় একই প্রশ্ন করে উঠলেন, কিন্তু এবার যুতসই উত্তর পেলেন না। বরং আকরাম একই কথাই আওড়ালো। সুমাইয়া বেগম আকরামের এমন উত্তরে বিরক্তির সাথে বললেন।
“শোনো আকরাম, সে আদিবার যোগ্য নয় এই কথাটা আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর নয়। বরং তোমার উত্তরে আমি বিরক্তবোধ করছি। এই বিয়েটা তুমি এনেছো, তোমার পছন্দের উপর আমি প্রশ্ন তুলি নি। কিন্তু এখন আমার তোমার উপর প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে। মনে করো আমি সাঈদের আম্মুকে বললাম এই বিয়ে হবে না। সে আমাকে প্রথমেই যা প্রশ্ন করবেন তা হল, কেনো? এই কেনোর উত্তর কি দিবো? সবাই তোমার মতো নয়, দু কথায় আচ্ছা বলে রেখে দিবে। নানা প্রশ্ন করবে। আর এখানে মেয়েপক্ষ আমরা। সমাজ বাদ দাও আমাদের আত্নীয়রাই শত প্রশ্ন ছুড়ে দিবে”
“আত্নীয়রা কি ওই ছেলের সাথে ঘর করবে? ঘর তো করবে আমার বোন”
“সেই বোনকে কি বলবে? কেনো তার সাথে বিয়ে বিয়ে দিচ্ছো না?”
আকরামের চোখে ক্রোধের হাতছানি দেখলো রুহামা। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সংবরণ করছে। রুহামা আর পারলো না, ধীর স্বরে বললো,
“সাঈদের সমস্যাটা কি বলে দিলেই কিন্তু সব ঝামেলা মিটে যায়”
রুহামার কথা কর্ণপাত হতেই ক্রুদ্ধ নজর তাক করলো আকরাম। তার রক্তিম চোখ রুহামার অন্তরের পানি শুষে নিলো। রুহামা কথা বাড়ালো না। নজর সরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো বসার ঘরের দরজা ঘেষে আদিবা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ থেকে অনবরত নোনাজল ঝরছে। রুহামা দেরি করলো না। সে পানির গ্লাসটি আকরামের সামনে রেখেই আদিবার কাছে চলে গেলো। আদিবা তার ভাবিকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো। জড়ানো স্বরে বললো,
“ভাবী, ভাইয়া এগুলো কি বলে? কেনো হবে না আমাদের বিয়ে? উনি তো বেশ ভালো”
রুহামা উত্তর খুঁজে পায় না, কি উত্তর দিবে? সে তো নিজেই জানে না এই উত্তরটা। এদিকে বসার ঘরের উত্তাপ, বাকবিতণ্ডা আদিবার ঘর অবধি শোনা যাচ্ছে। সুমাইয়া বেগম একই প্রশ্ন করছেন। কিন্তু আকরাম উত্তর দিচ্ছে না। তার কথা বিয়ে হবে। আদিবা রুহামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আজ রুহামা আদিবার মাঝে নিজেকে দেখতে পারছে। সাঈদের সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদের পর সেও এভাবেই কেঁদেছিলো। রুহামার কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে আদিবার জন্য। সে চাইলেও কিচ্ছু করতে পারছে না। একটা সময় আদিবা বলে উঠে,
“জানো ভাবি, আমি উনার মাঝে আমার মনের রাজকুমারকে খুঁজে পেয়েছি। যেমনটা আমার ভালো লাগতো। যেমন দেখতে, তেমন আচার ব্যাবহার। হুট করে কি হলো ভাবি? রুপকথাগুলো কেনো এলোমেলো হয়ে গেলো?”
রুহামা ম্লান হাসলো। তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“মানুষের একটা বিশ্রি স্বভাব আছে, স্বীকার করতে চায় না তবুও স্বভাবটি তাদের রক্তের কণায় মিশে আছে প্লাজমার ন্যায়। তারা রুপকথায় বাস্তবতা খুঁজে আর বাস্তব জীবনে খুঁজে রুপকথা। বাস্তব যে অনেক ভিন্ন আদিবা। বাস্তবের রাজকুমারেরা রুপকথার থেকে ভিন্ন হয়। সবকিছুতে যদি রুপকথা খোঁজো তবে রিক্তহস্তে ফিরতে হবে তোমায়”
“তাহলে কি স্বপ্ন দেখবো না? তাহলে কেনো বলে আমাদের জন্য রাজকুমার আসবে ঘোঁড়ায় চড়ে?”
“সেটা যে একেবারে ভুল না কিন্তু নয়, রুপকথা গুলো বাস্তবের আদলেই গড়ে উঠে। শুধু লেখকেরা বাস্তবের কাঠিন্য রুপকথায় রাখে না। পাঠকদের স্বপ্ন দেখাতে চায় তারা। একটা কথা বলি আদিবা। জীবনে এমন অনেককিছু হয় যা কল্পনা করি না। সাঈদকে আপেক্ষিকভাবে তোমার ভালো লাগলেও এমনটা হতেই পারে সে তোমার রুপকথার রাজকুমার নয়। বিয়ের পর হয়তো তোমার জীবন বিষিয়ে উঠতো। তাই তো আজ আকরাম বিয়েটা ভাঙ্গতে চাইছে। রুপকথা সবাই খোঁজে, কিন্তু সেই রুপকথার খোঁজটা যে খুব কঠিন। এই বাজে কঠিন পথটা যে সবাইকে পার করতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয়, ধৈর্য্য ধরতে হয়, অনেক বিষাদ, দুঃখকে বরন করতে হয়। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে যে সেই রুপকথার খোঁজ পাবে না তুমি, কান্না থামাও। আকরাম তোমার ভাই, সে চাইবে না তার আদরের বোন কষ্ট পাক”
“তোমার রুপকথার খোঁজ সফল হয়েছে?”
চোখ মুছে কাঁপা স্বরে আদিবা প্রশ্নটি করে। রুহামা মৃদু হাসে। তারপর বলে,
“হু, হয়েছে”
আদিবা কান্না থামায়। কিন্তু রুহামাকে ছাড়ে না। তার কোলেই মাথা রেখে শুয়ে থাকে সে। আর রুহামা তার মাথায় বিলি কেটে দেয়। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলো রুহামা। ছেলেমানুষ সত্তাকে ছেড়ে আজ নিজেকে বেশ ম্যাচিউর মনে হলো তার। যেনো অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে সে, অথচ আদিবা থেকে মাত্র দু বছর বড় সে। আচ্ছা, সেদিন যদি আদিবার মতো সে কাউকে পাশে পেতো তাহলে হয়তো তার এতোটা ভেঙ্গে পড়তে হতো না। রুহামা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে প্রভাত উঁকি দিচ্ছে তার।
_________
মাগরিবের নামাজ শেষে চা খাবার অভ্যেস আকরামের। নামাজ পড়ে উঠেই হাক দেয় সে রুহামাকে। কিন্তু আজ সেটা হলো না, নামাজ শেষে কিছুসময় জায়নামাজেই বসে রইলো সে। তার অস্বস্তি লাগছে। মা বারবার এক প্রশ্ন করছে, কিন্তু উত্তরটা সে দিতে পারছে না। সবকিছু বিরক্ত লাগছে। ওমন একটা অমানুষের সাথে বোনের বিয়ে কিছুতেই দিবে না আকরাম। কিন্তু বিয়েটা ভাঙ্গবে কি করে! এই সময় ঘরে রুহামার প্রবেশ ঘটে। রুহামা তার নিয়ম অনুযায়ী আকরামের জন্য চা নিয়ে এসেছে। আকরামকে জায়নামাজে গম্ভীর চিত্তে বসে থাকতে দেখে সে ধীর গলায় বললো,
“চা খাবে না?”
রুহামা কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ধ্যান ভাঙ্গে আকরামের। জায়নামাজ গুছিয়ে চাটা হাতে নেয়। রুহামা মনে মনে সাজালো আকরামকে কিভাবে প্রশ্ন করবে। তার উপরে শ্বাশুড়ি গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি তো জানেন না, যে মানুষ তার মাকেই উত্তর দেয় নি রুহামা ছাই কিছু বলবে! তবুও চেষ্টা করবে রুহামা। আদিবার ও জানা উচিত ব্যাপারটা। নয়ত খামোখা ভাই এর উপর অভিমান করবে সে। রুহামা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সাহস জুগিয়ে শুধালো,
“সাঈদের সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাইছেন কেনো? একটা যুতসই কারণছাড়া মা তো এগোতে পারছেন না”
“তুমি সত্যি শুনতে চাও?”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গম্ভীর গলায় উলটো প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আকরাম। রুহামা কিছুটা ভড়কালেও পিছ পা হলো না, সাহস করে বললো,
“হ্যা, শুনতে চাইছি আমি”
“তবে শুনো, আমি আমার বোনের বিয়ে এমন কোনো ছেলের সাথে দিবো না যে আগে অন্য মেয়ের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করার দাবি করে। আর সেই অন্য মেয়েটি যদি আমার স্ত্রী হয় তাহলে একজন স্বামী হিসেবে সেই ছেলেটিকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। বিয়ে তো অনেক দূরের কথা। এবার তুমি বলো, এই উত্তরটা মাকে কিভাবে দিবো?….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি